কেন?

কেন? এটা আমার আজন্ম প্রশ্ন। হয়ত পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র হবার কারণে। তাই কারণে-অকারণে এই প্রশ্ন করে যাই সারা জীবন। ছেলে এক গ্লাস চা চাইল, আমি বলি, "কেন"? বউ বললো এক প্যাকেট দুধ কিনতে, আমি বলি "কেন"? জানি প্রশ্নগুলো অবান্তর তবুও করে যাই। অভ্যেস বলে কথা। আমার এমন অনেক অভ্যেস আছে, যেমন কোনো কথার উত্তরে ভালো, ঠিক আছে এইসব বলা। অনেকটা রোবটের মত - কিছু একটা শব্দ করা আর কি, যদিও আমার ক্ষেত্রে সেটা সময় আর পরিস্থতি বিবেচনায় ভিন্ন অর্থ বহন করে। যেমন ভালো আমার জন্য শুধু ভালই নয়, বুঝলাম, জানা রইলো এই সবের প্রতিশব্দ। একবার তো বউ আমাকে ওর  কোনো এক ঘনিষ্ট আত্মিয়ের মৃত্যু সংবাদ দিলে আমি ভালো বলায় আমার সাথে কয়েক দিন কথা বলাই বন্ধ করে দিল। তারপরও আমি এসব বলে যাই - কারণে-অকারণে প্রশ্ন করে যাই। মনে আছে

মাথায় কত প্রশ্ন আসে দিচ্ছে না কেউ জবাব তার
সবাই বলে মিথ্যে বাজে বকিসনা আর খবরদার

তারপরেও না বকে পারি না, না বলে পারি না ...

গত কয়েক দিনে আমাদের দেশে একজন শিক্ষক, একজন সাধু, একজন এলজিবিটি পত্রিকা চালক আর তার বন্ধু নাই হয়ে গেলেন। চাপাতিকে যদি annihilation অপারেটর হিসেবে দেখি, তবে মানুষের গলার দিকে এর প্রয়োগের ফলে মানুষ ভার্চুয়াল স্টেটে চলে যায় - তখন তাকে দেখা যায় না, তার সাথে কথা বলা যায় না, তাকে  নিয়ে শুধু লেখা যায়। এই ভার্চুয়াল স্টেট কে বলে নাই হয়ে যাওয়া।

চার চারটে  মানুষ বেমালুম নাই হয়ে গেলেন - রাতের নীল আকাশের  মত শান্ত বাংলাদেশের বুকে মৃদু বাতাসে আরো মৃদু একটু ঢেউ উঠলো - তার পরেই যাহা বায়ান্ন তাহাই তিপ্পান্ন। মনে পড়ল ইওসেফ ব্রদস্কির লেখাটা - "হঠাত খবর এলো নাজী দখলকৃত কিয়েভে দুজন লোক মারা হয়েছে - একজন ইহুদি আর একজন সাইকেল চালক। সবারই এক প্রশ্ন, সাইকেল চালক আবার কি দোষ  করলো।" নাজী  দখলকৃত এলাকায় ইহুদিদের মতই দেশে একজন বুদ্ধিজীবী, একজন হিন্দু, একজন বৌদ্ধ, একজন খ্রীস্টান, একজন ব্লগার বা অন্য কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি মারা যাওয়াটা আজকাল আর কোনো খবর নয় - এটা চাঁদ-সূর্য্য ওঠার মতই নিয়ম।

কিন্তু বললাম না, নিজের অজান্তেই আমি প্রশ্ন করে বসি কেন এমন হয়। মনে পড়ল মাত্র কয়েক দিন আগে  দেয়া প্রধানমন্ত্রীর বাণী - ধর্মীয়  অনুভুতিতে আঘাত সহ্য  করা হবে না। এর জের ধরে দু দিন আগে দুই শিক্ষককে ছ মাসের জেল দেয়া হলো। ভাবতে থাকি, আচ্ছা এইযে সাধু মারা গেল, একের পর এক মন্দির আর প্রতিমা ভাঙ্গা হলো বা হচ্ছে, তাতে কি দেড়  কোটি মানুষের ধর্মানুভুতিতে আঘাত লাগছে না। লাগছে তো ঠিক ই - তাহলে সরকার কেন নিশ্চুপ? অনেক ভেবে উত্তর পেয়ে গেলাম। সরকার তো শুধু ধর্মানুভুতিই রক্ষা করেন না, গণতন্ত্রও  রক্ষা করেন। দেড়  কোটি মানুষের ঢাক-ঢোলে, মন্ত্র-জপে বাকি চৌদ্দ কোটির তো  ধর্মানুভুতিতে আঘাত লাগতেই পারে। তাই ৫৭ ধারা আর গণতন্ত্রের অপূর্ব সংমিশ্রণে এই সব ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন হতেই পারে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতেই পারে।সুতরাং আমরা যারা সব ধরনের সংখ্যালঘুদের অধিকার খর্ব হলো বলে ভাবছি, একটু যুক্তি দিয়ে দেখলেই বুঝবেন ওসব কত যুক্তিহীন। এসবের প্রেক্ষিতে সরকার বলে দিলেই পারে "ইসলাম" ধর্মানুভুতিতে আঘাত সহ্য  করা হবে না। তাহলেই অন্যেরা নিজ নিজ দায়িত্বে সিদ্ধান্ত নেবে তারা পূজা করবে কি করবে না। তাহলে আর প্রতিমা ভাঙ্গলে সরকারকে আর কেউ দোষ  দিতে পারবে না।

আরো একটা ব্যাপার যা আমাকে ভাবাচ্ছে। দল ভাঙ্গা আমাদের দেশে হর-হামেশা ব্যাপার। ১৯৭৫ পর যখন আওয়ামীলীগ ভেঙ্গে মালেক আর মিজান গ্রুপ হলো, কতইনা কষ্ট লেগেছে। এরপর কত দল ভেঙ্গেছে। জাসদ, সিপিবি আরো কত নাম। তাই রাজনৈতিক দলের ভাঙ্গা গড়া চলবে এটাই নিয়ম। কিন্তু ইদানিং দেখছি দলের ভিতরে একাধিক গ্রুপ তৈরী হচ্ছে, একে অন্যের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাড়াচ্ছে, কখনো-সখনো এক পশলা যুদ্ধেও নামছে - কিন্তু দল থেকে কেউ বেরুচ্ছে না। এটাকি ক্ষমতাসীন দলের বিশেষ গুন নাকি দলের নেতৃত্বের অলৌকিক শক্তি? তবে কারণ যাই হোক, ফল কিন্তু অভূতপূর্ব। এইত সবে শেষ হওয়া ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে দেখা গেল - আওয়ামীলীগের এক গ্রুপ ভোট নিল, অন্য গ্রুপ হিন্দু পেটালো। মনোপলী  তো  মনোপলীই - no বিএনপি-জামাত। ভোটও নেবো  আমরা, প্যাদাবোও আমরা। আগে ছিলো  "ভোট দে না হয় সম্পত্তি দে"। এখনকার নতুন শ্লোগান মনে হচ্ছে "ভোটও দিবি, সম্পত্তিও দিবি"। Bravo.

দুবনা, ২৭ এপ্রিল ২০১৬      

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি