সিপিবি আমার প্রথম ও শেষ দল

গত শনিবার সকালে টেলিফোন বেজে উঠলো, অন্যদিক থেকে পরিচিত গলা বলল, "বিজনদা, প্রথম আলোর মতিউর রহমান এখন মস্কো আছেন। বিকেলে আমাদের সময় দিয়েছেন দেখা করার জন্য। আপনি থাকবেন কিন্তু।" যদিও আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না, দেখা করাটা দরকার কি না, তবুও বললাম ঠিক আছে। আজকাল আমি কিছু কিছু জিনিসের খুব অভাব বোধ করি - যেমন জ্ঞানবুদ্ধি, সময়, টাকা-পয়সা। জ্ঞানবুদ্ধির অভাব আবার বরাবরই  ছিল, এর সাথে অর্থ যোগ হয়েছে বাবার হোটেল ত্যাগ করার পর, এখন আবার সময়টা যোগ হয়েছে। তাই খুব জরুরী  কিছু না থাকলে চেষ্টা করি মস্কো গেলে বাসায়ই সময় কাটাতে। তাছাড়া বুঝতে পারছিলাম না, দেখা করেই বা কি হবে? হ্যা দেশের কথা জিজ্ঞেস করা যায়, জিজ্ঞেস করা যায় প্রথম আলোর কিছু কিছু লেখা সম্পর্কে, তার পরেও কেন যেন মন চাইছিল না যেতে - আবার ভাবলাম এই উপলক্ষ্যে কিছু বন্ধুর সাথে দেখা হবে, সেটাই বা খারাপ কি?  বাসায় বললাম বিকেল ৮ টার পর বাইরে যাবো, যাতে কোনো জরুরী  কাজ থাকলে আগেই বলে।
যেমন বলেছিল, ঠিক ৯ টায় চলে এলাম মেট্রোপলিটন হরেলের সামনে। তখন কেউ আসেনি। দাড়িয়ে দাড়িয়ে বোর হচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম আদৌ আসার দরকার ছিল কি না। ধীরে ধীরে অনেয়রা চলে এলো। হোটেলের লবিতে ঢুকে দেখি মতি ভাই বসে কথা বলছেন। আমাদের পাশের টেবিলে বসতে বললেন। মতি ভাইকে দেখেছি অনেক বার - মস্কোতে আর দেশে। শেষ দেখা ১৯৮৯ তে একতা অফিসে। তখন অনেক দিন দেশে ছিলাম, সময় পেলেই চলে যেতাম পার্টি অফিসে বা একতা অফিসে। সেই সময় পেরেস্ত্রোইকা নিয়ে সবাই ব্যস্ত। ওই সময় আমার কয়েকটা লেখা বেরিয়েছিল একতায়। এছাড়া উনি মস্কো এলেও দেখা হত। এবার হোটেলে যাবার সময় আমার কেন যেন মনে হয়েছিল ওনাকে দেখব লম্বা পাঞ্জাবীতে আর টুপি  মাথায়, সাথে মেহেদী রঙের দাড়ি। তাই হোটেলে ঢুকে বহু আগে দেখা পরিচিত মুখ দেখে মনে মনে একটু আশ্বস্ত হলাম।
কিছুক্ষণ পরে উনি আমাদের টেবিলে চলে এলেন। পরিচয় জানতে চাইলেন। শুধু নামই নয়, কবে এসেছি, কোন সংগঠন থেকে এসবও। আমরা ছিলাম সবাই সিপিবি আর মহিলা পরিষদের থেকে। নাম বললাম, বললাম পার্টি স্কলারশিপে, মানিকগঞ্জ থেকে, আজহার ভাই আর লেনিন ভাই এর রিকমেনডেসনে। জিজ্ঞেস করলো আজহার ভাই এর সাথে যোগাযোগ আছে কিনা, দেশে যাই কিনা? এদেশে কেমন কাটছে আমাদের? আমি চাইছিলাম অনার কাছ থেকে দেশের কথা শুনতে। "আমি বাইরে এসে দেশের কথা বলতে ভালবাসি না, তাছাড়া সব তো পত্রিকাতেই লিখি" বলে উনি প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলেন। এর মাঝে আমাদের বন্ধুরা এদেশ সম্পর্কে বলতে লাগলেন। আর আমি সময় বুঝে ভাঙ্গা রেকর্ডের মত আবার শুরু করলাম,
"এক সময়ে সিপিবির সাথে জড়িত ছিলাম। এখন কোনো কিছু করি না, তবে সাম্যবাদে এখনো বিশ্বাস করি। নিজের জীবনে চেষ্টা করি সেই সময়ের অনেক কিছুই একটু হলে মেনে চলতে। আপনি কি ওই আদর্শ থেকে একেবারেই দুরে চলে গেছেন, নাকি এখনও কিছু কিছু বিশ্বাস করেন?"
"কঠিন প্রশ্ন। এ দেশ থেকেই তো সমাজতন্ত্র চলে গেল। কি হবে আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ফলে? তবে আমার জীবনের প্রথম ও শেষ দল সিপিবি। আমি সেই ১৯৮৭ তে শেষ বারের মত এখানে এসেই বুঝতে পেরেছি ঘটনাটা অন্য দিকে যাচ্ছে। তাই ৯০ এর শুরুতেই সরে গেছি। পার্টি যখন ভাগ হলো, আমি ছিলাম না। অন্য কোনো দলে যাই নি। সেই সময়ে সোভিএট্ সমাজ নিয়ে অনেক পড়াশুনা করতাম, এখনো গর্বাচেভের পেরেস্ত্রোইকা নিয়ে ভাবি।" 
অনার কথা শুনতে শুনতে মনে পরছিল আন্দ্রে লিন্ডের কথা। খুব নামকরা কস্মলোজিস্ট। ১৯৯৯ তে ইতালিতে দেখা। কয়েকটা লেকচার দিয়েছিলেন। মাঝে মধ্যেই সত্তর আর আশির দশকের সোভিয়েত সমাজের কথা বলতেন, যখন তিনি সেখানে পড়াশুনা করতেন, আর একটু একটু করে বিজ্ঞানের জগতে নিজের নামকে প্রতিষ্ঠিত করছিলেন। সে কথায় মাঝে মধ্যে শ্লেষ থাকলেও সোভিয়েত সমাজের প্রতি তার একধরনের নস্টালজিয়াও প্রকাশ পেত। আমি ভাবছিলাম মতি ভাইকে লিন্ডের গল্পটা বলি, তবে সে সময় আর হয়ে উঠেনি।
কথা হলো রূপপুর নিয়ে। উনি স্কেপটিক। বিশেষ করে দেশে স্পেসালিস্টদের অভাবে আর বিদ্যুত কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিয়ে। বললাম, "আপনি কি বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রয়োজনীতা স্বীকার করেন? যদি তাই হয়, তবে আমাদের পরিবেশ আন্দোলনের মূল কাজ হবে, বিদ্যুত কেদ্রের নিরাপত্তা খাতে যাতে কোনো রকম ইকনমি করা না হয় তা নিয়ে আন্দোলন করা।" তবে উনি আবারও বিতর্ক এড়িয়ে গেলেন।
প্রশ্ন উঠলো ওনার সাথে সরকারের সম্পর্ক নিয়ে। 
"আমি আমার কাজ করি। সরকার ভালো করলে যেমন বলি, ব্যর্থ হলে সমালোচনা করি। সরকার চায় আমরা সব সময় স কাজে তাকে সমর্থন করে লিখি। এভাবে তো সাংবাদিকতা হয় না।"
দেশে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমন সম্পর্কে বললেন, "শুধু ইন্টারনেটের কারণে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে খবর আসছে বলেই নয়, বিগত দিনগুলোতে  সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমন সত্যই বেড়েছে। দেশে উগ্রপন্থীতের দাপট বাড়ছে। তবে তার জন্যও কিছুটা হলেও সরকার দায়ী।"
খুব ইচ্ছে করছিল জানতে গত নির্বাচনের পরে  প্রথম আলোতে ছাপানো সিঁদুর পরা মহিলাদের ছবি সম্পর্কে। ভাবলাম, কি লাভ, উনি ঠিকই উত্তরটা এড়িয়ে যাবেন। তারপর বললেন যে ওনাদের প্রকাশনী সব থেকে বেশি মুক্তি যুদ্ধের উপর বই প্রকাশ করে। বললেন ওনার ব্যস্ততার কথা।
মতি ভাই বরাবরই স্মার্ট ছিলেন, এখন আরো ডিপ্লোম্যাটিক হয়েছেন।
অনেক প্রশ্নই করা হয়নি। সময়? না মনে হয়। আসলে গেলামই যখন প্রথম থেকেই পজিটিভ মাইন্ড সেট নিয়ে যাওয়া দরকার ছিল। আর তা হলে হয়ত বা নেট ঘেটে ওনার  বা প্রথম আলো সম্পর্কে একটু তথ্য জেনে যেতাম - তাতে প্রশ্ন করতে সুবিধা হত, আরো বেশি কিছু জানা যেত।
তবে এটা  ঠিক ওনার বর্তমান আদর্শ পছন্দ করি বা নাই করি, উনি আগেই মতই খুবই প্রফেসনালী নিজের কাজটা করে যাচ্ছেন।     

জুন ০১, ২০১৬


পুনশ্চ: ভুলেই গেছিলাম। নিজের পুরানো কমরেডদের কথাও বললেন। বললেন লেনিন ভাই, নাহিদ ভাই - এদের সাথে দেখা হয়, কথা হয়। সেলিম ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে বললেন, ওনাকে জিজ্ঞেস কোরো, উনি যোগাযোগ করেন কিনা। প্রথম আলোতে বাম ঘরানার খবর ছাপানো সম্পর্কে বললেন, কিছু ছাপার থাকলে তো ছাপবো । আরো বললেন, "আমার এখনো সফট কর্নার  আছে ওদের জন্য। তাই নিজেই আগ বাড়িয়ে খবর সংগ্রহ করি, চেষ্টা করি তা প্রকাশ করতে।" হ্যা, বিচ্ছেদ যত মধুরই হোক, কিছু না কিছু তেতো স্বাদ ঠিক রেখে যায়। পুরানো কমরেডদের কথা বলতে গিয়ে একটু হলেও সেটা প্রকাশ পাচ্ছিলো।



Comments

  1. সকালবেলা ভাল লাগলো বিজন তোমার খোলামনের লিখাটি পড়ে। "বরাবরই স্মার্ট ছিলেন, এখন আরো ডিপ্লোম্যাটিক হয়েছেন।.....উনি আগের মতই খুবই প্রফেসনালী নিজের কাজটা করে যাচ্ছেন।"
    উনি নিজের কাজটি ভাল পারেন। তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা দেশের কতখানি কাজে লাগছে তা তিনি নিজেই বলতে পারবেন। মোকসেদুল হামিদ

    ReplyDelete
  2. বিজনদার লেখাটি ভালো। ২৮ বছর পর মস্কো গেছেন মতি ভাই। বিজনদা এবং তাঁর অনেক বন্ধুই এখনো হাল ছাড়েননি। স্বপ্নও দেখেন। সেই আলোয় আলাপটা কতটুকু জমেছিল, তা অবশ্য বুঝতে পারিনি। আচ্ছা, মস্কোর জীবন নিয়ে কেউ তো লিখতে পারেন পত্রিকার পাতায়!

    ReplyDelete
  3. বিজনদার লেখাটি ভালো। ২৮ বছর পর মস্কো গেছেন মতি ভাই। বিজনদা এবং তাঁর অনেক বন্ধুই এখনো হাল ছাড়েননি। স্বপ্নও দেখেন। সেই আলোয় আলাপটা কতটুকু জমেছিল, তা অবশ্য বুঝতে পারিনি। আচ্ছা, মস্কোর জীবন নিয়ে কেউ তো লিখতে পারেন পত্রিকার পাতায়!

    ReplyDelete
  4. হামিদ ভাই, হ্যা শুধু নিজেই বলতে পারবেন কি করার সামর্থ্য ওনার ছিল, আর কি করতে পারলেন আর কতটা তিনি সন্তুষ্ট সেটা করে। তবে আমাদের আকাঙ্খা যে তর চাওয়ার সাথে মিলবে তা কিন্তু নয়। ফেইস বুকে আলোময়্দার মন্তব্য ছিল

    "তা ঠিক পজেটিভ ধারনা নিয়ে এগুলে, তাঁর কাছ থেকে জানার অনেক কিছু আছে। উনি একজন সফল মানুষ। সময়ের সাথে বদলে যাওয়া ব্যক্তিত্ব। বদলে দেওয়ারও শক্তি রাখেন। তাঁকে নিয়ে সরকার, বিরোধীদল, মৌলবাদী দল, বিশ্বেব বেহায়া দল, সুশীল দল সবাইকে ভাবতে হয়। আমাদের ভাবনা কি সূর্যকে স্পর্শ করে? আমি হিমালয়ের কে?"

    আমি তাকে এভাবে লিখেছিলাম। যেহেতু প্রশ্ন বা মন্তব্য অনেকটা একই রকম, তাই সেটাই এখানে তুলে দিচ্ছি



    আলোময় দা, আমার মাথা ব্যথা ওনার সফলতা নিয়ে নয়, নিজের ব্যর্থতায়। মানে, যদি কোথায় যেতেই হয় বা যাই - খোলা মনে যাওয়া ভালো, তাতে সময়টার ব্যবহার ভালো করে করা যায়। হ্যা উনি সফল মানুষ। আমরাও কিন্তু ওনার পত্রিকাটা পড়ি, ভালো বলি - এটাও তার কাজেরই মূল্যায়ন। আমি মাঝে মধ্যেই ভাবি, আচ্ছা এই যে আমরা অনেকেই ডাক্তার হলাম, ইঞ্জিনিয়ার হলাম আর শেষমেষ ব্যবসা শুরু করলাম, এতে কিন্তু কেউ আমাদের দলত্যাগী বলে না, বা বলে না দেশ বা সমাজ তোমাকে বিশেষজ্ঞ করতে এত টাকা খরচ করলো, আর তুমি শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবসায়ী হলে? বরং সফল ব্যবসায়ী হলে আমরা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আসলে একজন ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হতে পারে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দলত্যাগ করা যায় - রাজনীতি তাদের একটা। হ্যা যদি ওনাকে সিপিবির একজন হিসেবে দেখি সেটা এক ব্যাপার, আর যদি সাংবাদিক বা পত্রিকা ব্যবসায়ী হিসেবে দেখি - আমরা ঠিক উল্টো ফল দেখব। মানে এসব ক্ষেত্রে অনেক কিছুই নির্ভর করে শুধু কারো কাজের উপরই নয়, আমরা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছি তার উপর। সোভিয়েত দেশে অনেক কিছুই ভালো ছিলো (এখানে বলছি খাবার দাবারের কথা), তবে প্যাকেট আকর্ষনীয় ছিল না। বর্তমানে ফর্ম কন্টেন্ট এর থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা প্রায়ই কন্টেন্ট খুজতে গিয়ে ফর্মের কথা ভুলে যাই - তাইতো আমাদের আবেদন প্রায়ই অন্যের কানে ঢোকে না। বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির দেউলিয়াত্ব মনে হয় এখানেই।

    ReplyDelete
  5. জাহীদ, আমাদের মস্কোর জীবনতো একেক জনের একেক রকম - (তলস্তয়ের মতে দুখের জীবন - তাই তো এত বিচিত্রময়) তাই লেখাগুলো হবে খুবই ব্যক্তিগত। তা ছাড়া লেখার জন্য যে হাত দরকার আমার সেটা আছে বলে মনে হয় না (খুব ছোট আর সরু হাড্ডি চামড়ার আমার হাত - এ থেকে রস বেরোয় না)। তার পরেও মাঝে মধ্যে নিজের অনুভুতি (জানি না আমার, আমাদের অনুভুতি থাকাটা যৌক্তিক কিনা) নিয়ে লিখি এখানে বা ফেইস বুকে। ভালো লাগলে পড়তে পার, কমেন্ট করতে পার - তবে এটা পত্রিকায় ছাপানোর মত কিছু নয়, নিজের সাথেই ফিসফিসিয়ে কথা বলা আর কি।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি