ভাষা আন্দোলন এখানে সেখানে


ভাষা আন্দোলনের কথা উঠলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাহান্নর ফেব্রুয়ারির ঢাকার রাজপথের দৃশ্য, পুলিশের গুলিতে শহীদ রফিক, শফিক, বরকতের মুখ স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে ভাষা বা মাতৃভাষার জন্য এটাই প্রথম বা একমাত্র আন্দোলন কি না?
     ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে ভাষা আন্দোলন হয়েছে আফ্রিকানা ভাষাকে ডাচ থেকে আলাদা ভাষা করার দাবীতে প্রথম আন্দোলন শুরু হয় ১৮৭৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় এই আন্দোলন আবার শুরু হয় ১৯০২ সালে ইংরেজ ও বোরদের যুদ্ধ শেষে যার ফলশ্রুতিতে ১৯২৫ সালে আফ্রিকানা দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারী ভাষার মর্যাদা পায় সর্বশেষ এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ১৯৯৪ সালে যখন বর্ণবাদের পতনের পর আফ্রিকানা ইংরেজির সাথে ১১ টি রাষ্ট্রভাষার একটিতে পরিণত হয়   
    বালুচ জাতীয়তাবাদের মূলে রয়েছে বালুচ ভাষা আন্দোলন
আধুনিক বালুচ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শুরু ১৯২০ সালে এদের ভাষ্য অনুযায়ী ধর্ম নয়, ভাষা ও জাতি (এথনিসিটি) জাতির মূল ভিত্তি, তাই এরা বরাবরই পাকিস্তানের ভিত্তি দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে ছিল এবং এখনো পর্যন্ত তাদের সংগ্রাম অব্যাহত আছে
 স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে তীব্র অসন্তোষ দেখা দেয়, ফলে সে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটা সাময়িক ভাবে স্থগিত রাখে। তবে ভারতে বাংলা ভাষার আন্দোলনের শুরু গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে যা কিনা এখনো পর্যন্ত আসাম, ঝাড়খণ্ড, বিহার, ছত্তিসগড় ও কর্ণাটকে বিরাজমান
    যেহেতু অ্যামেরিকা ইমিগ্রান্টদের দেশ, তাই ভাষা নিয়ে বিতর্ক এখানে শুরু হয় সুদুর ১৭০৩ সালেই পরবর্তীতে অ্যামেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে ফান্স ও স্প্যানিশ ভাষাভাষী বিভিন্ন এলাকা দখল করায় এই বিতর্ক তীব্রতা লাভ করে ১৯০৭ সালে প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্ট বলেন “অ্যামেরিকায় শুধু একটা ভাষারই জায়গা আছে, আর সেটা হল ইংরেজি“ ১৯৮১ সালে ইংরেজি ভার্জিনিয়ার সরকারি ভাষা বলে ঘোষিত হয় ২০০৯ সালে টেনেসি ইংরেজিকে একমাত্র সরকারি ভাষা করার বিপক্ষে ভোট দেয় ভাষার প্রশ্নে অ্যামেরিকার বিভিন্ন রাজ্য বিভিন্ন রকম নিয়ম রয়েছে, কোন কোন রাজ্যে ইংরেজিই একমাত্র সরকারি ভাষা, কোন কোন রাজ্যে অন্য ভাষা বিশেষ সুবিধা ভোগ করছে সেদিক থেকে রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্ন অ্যামেরিকায় এখনো পর্যন্ত অমীমাংসিত 
    সুদুর ১৮৩০ সালে থেকে গায়েলিককে (আয়ারল্যান্ডের ভাষা, যার কথ্য রূপ ছিল বিভিন্ন প্রান্তিক এলাকায়) পুনরুদ্ধারের জন্য আন্দোলন শুরু হয় আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের মতে আইরিশ জনগণ ধীরে ধীরে ইংরেজদের সাথে মিশে যাচ্ছে, তাদের পুনরজাগরণ হতে পারে ভাষা ও সংস্কৃতির জাগরণের মধ্য দিয়ে
    ১৮৩৫ -১৮৩৯ সালে দক্ষিণ স্লাভিয়ান ভাষার আন্দোলন শুরু হয় ক্রোয়েশিয়ায় যাদের উদ্দেশ্য ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্যের ভিতর ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে ক্রোয়েশিয়ান জাতি তৈরি করা     
   নেপালেও বিভিন্ন সময়ে নেপালী ভাষাকে সরকারী ভাষার মর্যাদা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন আন্দোলন হয়েছে, হচ্ছে বর্তমানে ইউক্রাইন, লিথুনিয়া, লাটভিয়া, এস্টোনিয়ায় রুশ ভাষাভাষীরা বিভিন্ন বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হচ্ছে এর অর্থ বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে বাংলাদেশের জন্ম, পরবর্তীতে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা এসবের পরেও মাতৃভাষা সব জায়াগায় সমান মর্যাদা পায়নি এমন কি আমাদের দেশে উপজাতীয় ভাষাগুলোর সংরক্ষণ ও বিকাশে আমরা আমরা তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারিনি শুধু তাই নয়, বিগত কয়েক বছরে স্কুলের সিলেবাস থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দিকপালদের রচনা বাদ দিয়ে নিজেদের ভাষার প্রতিও আমরা বাহান্নর দেওয়া অঙ্গীকার পালন করতে পারছি না মাতৃভাষাকে শুধু রাষ্ট্রভাষা করার মধ্য দিয়েই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, তার সংরক্ষণ, মুক্ত চর্চা ও বিকাশ – এসবও দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে  

   কিন্তু যে প্রশ্নটা আমাকে ভাবায় সেটা হল কেন ১৯৪৭ এ দেশ বিভাগের পরে আমরা ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু করলাম? এই অঞ্চল যুগ যুগ ধরেই বিভিন্ন ভিনদেশি শাসকের অধীনে ছিল
মানুষের ভাষা বাংলা থাকলেও, বিভিন্ন সময়ে রাজা বা সুলতানদের আনুকূল্যে বাংলা ভাষার চর্চা হলেও যতদূর জানি রাষ্ট্রীয় ভাষা কখনই বাংলা ছিল না অনেক আগে রাজন্যবর্গের ভাষা ছিল সংস্কৃতি, পরে প্রাকৃত, সুলতান আমলে ফার্সি আর ইংরেজ আমলে ইংরেজি এসব ভাষা শুধু বাংলা নয় সারা ভারতবর্ষেরই সরকারী ভাষা ছিল তখন রাজা আসত, রাজা যেত সাধারণ মানুষ নিজের কাজ করত আর কর দিত মনে হয় বিংশ শতাব্দীতেই সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার ভাবনা আসে যখন কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ স্বাধীন ভারতের কথা বলে, সেটা শুধু ইংরেজদের পরিবর্তে স্থানীয়দের শাসনই ছিল না, সেটা ছিল রাজা বাদশাদের পরিবর্তে সাধারণ মানুষের শাসন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা আর যাই হোক রাজবংশীয় বা রাজার প্রতিনিধি ছিলেন না, তারা ছিলেন জনগণের প্রতিনিধি জনগণই ছিল তাদের শক্তির উৎস, বিশেষ করে গান্ধী যখন কংগ্রেসকে গণমানুষের কাছে নিয়ে যান আর পরবর্তীতে শেরে বাঙ্গলার কৃষক প্রজা পার্টি আর চল্লিশের দশকে মুসলিম লীগ ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষকে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করে তোলে দেশের মানুষের মধ্যে, বিশেষ করে মধ্যবিত্তদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম নেয়, তারা নিজেদের দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রকদের একজন হিসেবে দেখতে পান আর মানুষ যখন স্বাধীনতার স্বাদ পায় সে সেটা পরিপূর্ণ ভাবেই চায় একটা দেশ বা জাতীর স্বাধীনতা কখনই পরিপূর্ণ হতে পারে না যদি না তার মাতৃভাষা যথাযথ মর্যাদা পায়, যদি না সে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভ এবং পরবর্তীতে নিজেকে বিকাশের সুযোগ পায় তাই বিশ্বের যেকোনো প্রান্তেই, যেখানেই জনগণের এক উল্লেখযোগ্য অংশ কোন একটা নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলে, সে দেশে সেই ভাষাকে উপযুক্ত মর্যাদা না দেওয়া হলে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়, অনেক ক্ষেত্রে সেটা দেশের ঐক্য রক্ষায় বাধা হিসেবে কাজ করে            
   মনে রাখতে হবে যদিও ভাষা আন্দোলন গণ আন্দোলনের রূপ পায় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, ঘটনাটা এক দিনে ঘটেনি
১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের লখনউ সেশনে উর্দুকে ভারতীয় মুসলমানদের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে প্রস্তাব করা হলে বাংলার প্রতিনিধিদল সেটা প্রত্যাখ্যান করে ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার ঠিক পরপরই করাচীতে জাতীয় শিক্ষা সামিট উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রস্তাব করে তখনই ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠন তামুদ্দিন মজলিসের সেক্রেটারি আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদে নামে

এখানে উল্লেখ্য যে দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগে থেকেই, মানে চল্লিশের দশকের শুরু থেকেই বাংলা ভাষা বা বাংলাকে নিয়ে বিভিন্ন চিন্তা ভাবনা চলছিলো রাজনৈতিক মহলে
প্রাদেশিক কংগ্রেস নেতা শরৎ বোস, মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশেমসহ অনেকেই ভারত বা পাকিস্তানের বাইরে স্বাধীন বাংলার কথা বলছিলেন তাই দেশ বিভাগের পরে পাকিস্তান এসেম্বলির প্রথম অধিবেশনেই ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বিধায় বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবী জানান সেদিক থেকে বলতে গেলে সেটাই ছিল ভাষার জন্য বাঙালীর প্রথম দাবী যা কিনা পরবর্তীতে আন্দলনে রূপ নেয় সেদিন অঙ্কুরিত বীজ ধীরে ধীরে মহীরুহে পরিণত হয়, যার ফলশ্রুতি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা তাই ভাষা যেকোনো জাতিসত্ত্বার সাথে, জাতীর স্বাধীনতার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত যতদিন না আমরা এই সহজ সত্যটুকু অনুধাবন করতে পারব, যতদিন না আমরা ধর্ম বা অন্য কোন অজুহাতে ভাষার উপর আক্রমণকে শক্ত হাতে রুখে দাঁড়াব, ততদিন পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা বারবার প্রশ্নের সম্মুখীন হবে আজ ধর্মের নামে যেসব গোষ্ঠী সিলেবাস থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন দিকপালদের লেখা বাদ দেওয়ার কথা তোলেন, তারা শুধু ভাষা নয়, আমাদের স্বাধীনতার ভিত্তিতেই আঘাত হানেন মনে রাখতে হবে ষাটের দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীও সেই চেষ্টাই করেছিল রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার অপচেষ্টার মাধ্যমে আর একাত্তরে “আমার সোনার বাংলা” কণ্ঠে ধারণ করেই মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তান ও তাদের দেশীয় দোসরদের হাত থেকে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল বাংলার আকাশকে মুক্ত করেছিল পরাধীনতার কালো মেঘ থেকে এখনো দেশে বিভিন্ন মহল, এমনকি প্রশাসন ও শিক্ষা বিভাগের একটা অংশ বাংলা অক্ষরকে হিন্দুয়ানী বলে প্রচারণা চালায় একই ভাবে তারা আঘাত করে পহেলা বৈশাখ থেকে শুরু করে বাঙালীর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে এটা আসলে ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে আমাদেরকে হাজার বছরের ঐতিহ্য, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি থেকে বঞ্চিত করে  একটা নিঃস্ব জাতিতে পরিণত করার পায়তারা, যাতে আমাদের নতুন করে পাকিস্তান, আরব বিশ্ব বা তাদের পশ্চিমা মোড়লদের অনুগত দাসে পরিণত করার পথটা সহজ হয়ে যায় আজ তাই একুশের গুরুত্ব অন্য সময়ের চেয়ে অনেক অনেক বেশি আর্থিক উন্নয়নের স্রোতে ভাষা যেন ভেসে না যায় সেটা খেয়াল রাখা খুব জরুরী কেননা ভাষাই আমাদের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি, ভাষাই আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম স্তম্ভ। একাত্তরের চেতনা যেমন বাহান্নর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, ঠিক তেমনি ভাবে জড়িত বাংলা ভাষার সাথে। তাই ধর্ম, ভোট, উন্নয়ন – যে লেবাসেই আসুক না কেন, যারাই বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির উপর আঘাত হানে তারা মূলত দেশের স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করে। এদের সাথে আঁতাত    আসলে জাতীর প্রতি বেঈমানি, বাহান্ন আর একাত্তরের শহীদদের রক্তের প্রতি বেঈমানি। সবাইকে মহান একুশের আন্তরিক শুভেচ্ছা।
দুবনা, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
             

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি