একুশের ষোল
কয়েক দিন ধরেই বাতাসে বিজয়ের গন্ধে। হ্যাঁ, যেদিন জাগীর ব্রিজের ওখানে প্যারাসুট দিয়ে
ভারতীয় সৈন্য নামল, আমাদের দিন গণা শুরু হল – বিজয় কতদূর? এটা অনেকটা খেলার শেষ কয়েক
মিনিটের মত, যখন প্রিয় দল জিততে থাকে, আমার অপেক্ষা করি, কখন শেষের বাঁশি বাজবে আর
প্রতিটি সেকেন্ডই যেন অসম্ভব দীর্ঘ মনে হয়। সেই যুদ্ধে অবশ্য শেষের বাঁশি বলে কিছু
ছিল না, তবে শেষ হবে – সেই আশা ছিল। আজ যেমন করোনার কবলে মানুষের দিন তারিখ সব এক হয়ে
গেছে তখনও তেমনি কোন দিন তারিখ ছিল না, ছিল এক দীর্ঘ ধুসর দিন বা কালো রাত – আশাহীন,
অন্তহীন। তাই যখন বিজয়ের খবর এল অনেকেই জানতো না কোন তারিখ, কোন বার। মনে পড়ে সেই খবরে
বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেছিল। কিসের আনন্দ? কিসের উচ্ছ্বাস? বিজয় কি সেটা তখন জানতাম
না, তাহলে? হ্যাঁ, এই অন্তহীন ভয় থেকে মুক্তি পাবার আনন্দ। যুদ্ধের মাসগুলো ছিল ভয়ের
মাস, প্রতিটি মুহূর্তে সবাই ভয়ে থাকত এই বুঝি কোন দুঃসংবাদ আসবে, ঠিক এখন যেমন করোনার
কবলে পড়ে আমরা ভয়ে ভয়ে থাকি। সে সময় আমরা বন্দী ছিলাম না, তবে মুক্তির স্বাদও ছিল না।
সন্দেহ, ভয়, অনিশ্চয়তা – এসব আমাদের দিন রাত্রি সব আচ্ছন্ন করে রাখত। তাই বিজয়ের কথা
শুনে প্রথম যেটা মনে হল – বাড়ি ফিরব। বাড়ি – এটা কি শুধুই ঠিকানা? না, এটা স্বস্তির
জায়গা, এটা সেই জায়গা যেখানে মানুষ প্রাণ খুলে হাসতে পারে, কথা বলতে পারে, এটা সেই
জায়গা যাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখা যায়। তাই খুব শীঘ্রই যে বাড়ি ফিরব, দেখা হবে বন্ধুদের
সাথে, দেখা হবে পরিচিত গাছপালা, পরিচিত পরিবেশের সাথে এই স্বপ্নই আমাকে ঘিরে রেখেছিল। এপ্রিলে বাড়ি ছাড়ার পড়ে অনেক সময় কেটে
গেছে, কিন্তু পাড়ার বন্ধুরা সব সময়ই মনের কোনেই ছিল। কত কথা, কত অভিজ্ঞতা জমা হয়ে ছিল
ওদের সাথে ভাগ করে নেয়ার জন্য, ওদের কথা শোনার জন্য। মনে হয় প্রত্যেকেরই এরকম একেকটা
বিজয়ের ছবি ছিল মনের কোণে। সেই বিজয়ের পর পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে। সবাই কি বাড়ি ফিরতে
পেরেছে? বাড়ি ফিরলেও সবাই কি সেই স্বপ্নের বাড়ি খুঁজে পেয়েছে? কত লোক হারিয়ে গেছে নিজেদের
স্বপ্নের মধ্যে হাবুডুবু খেয়ে, কত লোক বাধ্য হয়েছে স্বাধীন দেশে বাড়ি ছাড়া হতে। কত
স্বপ্ন বেঘোরে মারা গেছে, কত রক্ত অনাদরে অবহেলায় বয়ে গেছে বাংলার নদীনালা খাল বিলে।
তার পরেও দেশ আছে। যত স্বাদহীনই হোক না কেন আমরা পেয়েছি স্বাধীন দেশ, পেয়েছি জাতি হিসেবে
বিশ্বের বুকে পরিচিতি। সব কিছুর পরেও বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, সোনার বাংলা
আমার ঠিকানা। হ্যাঁ, দেশটা আজ সেই স্বপ্নে দেখা দেশ থেকে অনেক দূর, তবে তার দায় ত্রিশ
লক্ষ শহীদের নয়, তার দায় দুই লক্ষ মা বোনের নয়, তার দায় কয়েক কোটি মানুষ যারা কী নিজ
ভুমে, কী শরণার্থী শিবিরে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে দিন কাটিয়েছে, নিজ নিজ জায়গা থেকে
বিজয়ের দিনটাকে একটু একটু করে এগিয়ে আনার চেষ্টা করেছে তাদেরও নয়। এই স্বপ্ন ভঙ্গের
ব্যর্থতা একান্তই আমাদের যারা সময় মত হাল ধরতে পারিনি, যারা সময় মত রুখে দাঁড়াতে পারিনি,
যারা স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দে সেটাকে রক্ষা করার, লালন করার, তাকে নিজেদের মত করে
গড়ে তলার দায়িত্ব পালন করতে পারিনি। আমরা যে জাতি হিসেবে জিততে পারি এই বিজয় সেই বিশ্বাস
আমাদের জাগিয়েছে, এই বিশ্বাস নিয়ে আমরা সামনে এগুব, স্বপ্নকে সফল করব – সেই হোক আজকের
এই দিনে আমাদের নতুন শপথ। সবাইকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা।
দুবনা, ১৬ ডিসেম্বর ২০২১
Comments
Post a Comment