অক্টোবর বিপ্লব

আজ ৭ নভেম্বর ২০১৭ ঠিক একশ’ বছর আগে এই দিনে রাশিয়ার পিটার্সবার্গে ঘটেছিল গত শতাব্দীর তো বটেই, মানব ইতিহাসের অন্যতম ঘটনা দুনিয়া কাঁপানো দশ দিনে এই প্রথম সমাজের লাঞ্ছিত, নিপীড়িত মানুষ নিজের হাতে নিজের ভাগ্য তুলে নিয়েছিলো মানব সভ্যতার ইতিহাসে শুরু হয়েছিল এক নতুন অধ্যায় প্যারি ক্যমিউন যেমন উদ্বুদ্ধ করেছিল বলশেভিকদের, ঠিক তেমনি পরবর্তী প্রায় সত্তর বছর রুশ বিপ্লব আশা জাগিয়েছে মানুষের মনে, স্বপ্ন দেখিয়েছে শেকল ছেঁড়ার, নিজের ভাগ্য নিজের হাতে তুলে নেবার
          ১৯৮৩ সালে যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে আসি তখন আন্দ্রোপভ ক্ষমতায় ব্রেঝনেভের স্ট্যাগনেশনের পরে নতুন গতি পেয়েছে সমাজ এ যেন অনেকটা ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থার মত সবার মধ্যে এক ধরণের ভয়, বিশেষ করে যারা কাজে ফাঁকি দিয়ে দোকানে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে তাদের মধ্যে যেহেতু দেশে থাকতেই বাম রাজনীতির সাথে জড়িয়েছিলাম, আর ছোট বেলা থেকেই রাশিয়া তথা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা, চেষ্টা করতাম যতটুকু সম্ভব দেশটাকে বুঝতে, দেশের মানুষকে বুঝতে মনে পড়ে, এখানে আসার আগে যখন জ্যাঠামশাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে যাই, উনি বলেছিলেন
-   ভালো মন্দ মানুষ সব জায়গায় আছে, ভালোদের সাথে মেলামেশা করো, মন্দদের এড়িয়ে চলো
-   ও দেশে মন্দ মানুষ নেই
          জ্যাঠামশাই এর উত্তরে কিছুই বলেন নি, তবে মনে মনে হয়তো হেসেছিলেন বিদেশে না গেলেও বয়সের সাথে সাথে মানুষ কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করে যেটা বই পড়ে হয় না জীবনের অভিজ্ঞতা নির্মম কিন্তু সত্য আর সেটা বুঝতে খুব বেশী সময় লাগেনি আমার দেখেছি দেশের মতই রুশ দেশও ভালো মন্দ সব ধরণের মানুষে ভরা বিপ্লব করে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা বদলানো যায়, সার্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা করে মানুষকে ডিগ্রীধারী করা যায়, কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা তার অভ্যেস বদলানো যায় না মানব সভ্যতার ইতিহাস এটাতো তার ভালো থাকতে, ভালো খেতে, ভালো পড়তে চাওয়ার ইতিহাস আর এই চাহিদা, এই লোভই তাকে যুগের পর যুগ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে নতুন কিছু করার এমনকি আজও উন্নত দেশগুলোতে, যেখানে মানুষের নুন্যতম চাহিদাগুলো একপ্রকার মিটে গেছে, সেখানেও মানুষ একটা নতুন আই-ফোনের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করে, একটা নতুন মডেলের গাড়ির জন্য রাতের ঘুম হারাম করে এটা অভাব নয়, এটা স্বভাব যুগ যুগ ধরে অর্জিত স্বভাব এটা কি বিপ্লব করে বদলানো যায়?
          সোভিয়েত আমলে ৭ই নভেম্বর ছিল দেশের প্রধান উৎসব ছুটির দিন কলকারখানা, বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গা থেকে দলে দলে মানুষকে নিয়ে যাওয়া হতো ডেমনস্ট্রেশনে আমিও যেতাম রেডস্কয়ারে তবে আমাদের বিদেশীদের যতটা আগ্রহ ছিল, সোভিয়েত বন্ধুদের মধ্যে তেমনটা দেখতাম না কমসোমল থেকে পাঠানো হতো, যেতো – অনেকটা অনিচ্ছা নিয়েই সবাই যে তেমন তা নয়, তবে অনেকেই তখন নভেম্বরে বরফ পড়তো শীতকে উপেক্ষা করে যেতাম সেই ডেমনস্ট্রেশনে মনে হতো আমরাও ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম বাসে করে নিয়ে যাওয়া হতো জুবভস্কী বুলভারে, ঠিক  প্রগতি প্রকাশনের সামনে ওখান থেকে পায়ে হেঁটে এঙ্গেলসের স্ট্যাচুর সামনে দিয়ে লেনিন লাইব্রেরী হাতের ডান দিকে রেখে ঢুকতাম রেড স্কয়ারে হাতে থাকতো রঙ বেরঙের বেলুন, কখনও “মহান অক্টোবর বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক” শ্লোগান লেখা ব্যানার লেনিনের সমাধির উপর দাঁড়িয়ে থাকা সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের প্রতি হাত নাড়াতে নাড়াতে বাজিলিক চার্চের পাশ দিয়ে নেমে যেতাম মস্কো নদীর ধারে ঐ সময় প্রায় একই রকম আড়ম্বরের সাথে পালিত হতো মে ডে বসন্তের উষ্ম আবহাওয়ায় এই ডেমনস্ট্রেশনে লোক হতো আরও বেশী আর ৯ ই মে বিজয় দিবসের মুল অনুষ্ঠান ছিল বিভিন্ন পার্কে, যেখানে আমরা দল বেঁধে যেতাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকদের অভিনন্দন জানাতে আর তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে এখন, নতুন রাশিয়ায় বিজয় দিবস পালন করা হয় অনেক বড় করে – এটা আজ সত্যিকারের মানুষের উৎসব, জাতীয় উৎসব – যেখানে ছোট বড় নির্বিশেষে সবাই রাস্তায় আসে যুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনগুলো স্মরণ করতে, যারা রক্ত দিয়ে পৃথিবীকে ফ্যাসিবাদের কবল থেকে রক্ষা করেছে – তাদের প্রতি সম্মান জানাতে
          আজ খুব মনে পড়ছে সেই ১৯৮৩ সালের ৭ নভেম্বরের কথা মাত্র দু মাস আগে এসেছি এ দেশে যদিও এর মধ্যেই অনেক কিছু দেখেছি, অক্টোবর বিপ্লব দিবস ছিল আমাদের জন্য নতুন সারা শহরের রাস্তাঘাট লাল পতাকায় সাজানো কোথাও কোথাও আলোও জ্বালানো হয়েছে বড় ভাইয়েরা আগেই বলেছিলেন সাল্যুতের কথা সবাই অপেক্ষা করছি রাত দশটা কখন বাজবে তার আগে থেকেই সবাই জড়ো হয়েছি ক্রেস্তের ওখানটায়, দুই আর তিন নম্বর ব্লকের মাঝামাঝি ঠিক দশটায় শুরু হোল সাল্যুত বা আতশবাজী কামানের গোলার মত আলোর পিণ্ড উঠে গেল উপরে, আর তারপর রঙ্গিন বৃষ্টি হয়ে নেমে এলো আমরা সবাই আনন্দে “হুররে হুররে” বলে চিৎকার করতে লাগলাম মনে আছে সেই দিন হামিদ ভাই বলেছিলেন, “অক্টোবর বিপ্লবের ১০০ বছর পূর্তিতে কত যে বাজী পুড়বে, সেটা আমরা কল্পনাও করতে পারব না“ আজ যে এ উপলক্ষ্যে বাজী পুড়ছে না, সেটা কী তখন কল্পনা করতে পেরেছিলাম আরও মনে পড়ছে আমাদের ইয়ারমেট জয়নালের কথা হোস্টেলে ফিরে দেখি ও বেডের নীচে শুয়ে আছে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায় বলল, গোলার শব্দে ও ভেবেছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে ঘটনাটা হাস্যকর মনে হলেও সে সময়ে সোভিয়েত – অ্যামেরিকান সম্পর্কের উত্তাপ ভালো করেই মনে করিয়ে দেয়          
          অনেক দিন থেকেই ৭ই নভেম্বর এ দেশে কাজের দিন তবে নভেম্বরকে স্মরণ করতেই হোক আর যে কারণেই হোক, এখন এখানে পালন করা হয় ৪ নভেম্বর – জাতীয় ঐক্য ও সংহতি দিবস নামে, মিনিন আর পঝারস্কীর ১৬১২ সালে পলিশদের বিরুদ্ধে অভ্যুথানের স্মৃতি স্মরণ করে তবে এবারের কথা অন্য শত হলেও শত বর্ষ প্রায় সারা বছরই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিপ্লবের উপর হয়েছে টক শো, বিভিন্ন বিশ্লেষণমূলক অনুষ্ঠান কেউ হয়েছে বিপ্লবের প্রশংসায় পঞ্চমুখী, কেউবা পৃথিবীর বর্তমান বিপর্যয়ের জন্য অক্টোবর বিপ্লবকে করেছে দায়ী কেউবা লেনিনকে দেখছে জিনিয়াস  স্ত্র্যাটেজিস্ত হিসেবে, কেউবা জার্মান চর রূপে কারো কাছে স্ত্যালিন মহানায়ক, কারো কাছে হিটলারের মতই খল তবে আমার মনে হয় এর পেছনে কাজ করছে পশ্চিমা দুনিয়া আর তাদের অনুসারীদের হীনমন্যতা কারণ গত শতকের প্রতিটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছে লেনিন, স্ত্যালিন আর সোভিয়েত ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে একদিকে যেমন লেনিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বিশ্বের বুকে এক নতুন ব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে, যা কিনা সমগ্র মানব জাতিকে এক নতুন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, অন্য দিকে স্ত্যালিনের নেতৃত্বেই বিশ্ব ফ্যাসিবাদ মুক্ত হয়েছে শুধু ইউরোপ কেন সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ পেয়েছে তাদের চিরকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আবার সোভিয়েত ইউনিয়নই পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে প্রথমে রকেট আর এর পরে মানুষ পাঠিয়েছে মহাকাশে এ সবই ছিল পশ্চিমা বিশ্বের গালে বড় রকমের চপেটাঘাত আর তাই এত দিন পরেও তারা ইতিহাস নতুন করে লিখতে উঠেপড়ে লেগেছে
          আজ শুধু বামেরা কেন, অনেক দক্ষিনপন্থী অর্থনীতিবিদরাও স্বীকার করে মার্ক্সের অবদানের কথা মার্ক্সবাদ এখনো পুজিবাদী অর্থনীতির সেরা বিশ্লেষণগুলোর একটা এর অ্যাকাডেমিক মুল্য অপরিসীম তবে এটাকে বাস্তবায়নের জন্যে লেনিন যে পথে চলেছেন সেটাই জন্ম দিয়েছে স্ত্যালিনের ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধে বা সোভিয়েত ইউনিয়নের শিল্পায়নে অপিরিসীম ভুমিকা থাকা সত্বেও মিলিয়ন মিলিয়ন নির্দোষ প্রানের দায় কি স্ত্যালিন এড়াতে পারবে? তবে এর জন্য যতটা না সমাজতন্ত্র দায়ী তার চেয়ে বেশী দায়ী মানুষের ক্ষমতার প্রতি চিরায়ত লোভ সমাজতন্ত্রের আগেও এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার বাইরেও প্রচুর একনায়ক ছিল যাদের হাতে লেগে আছে কোটি মানুষের রক্ত  আইনস্টাইনের E = mc2   সূত্র ধরে যেমন অ্যাটম বোমা তৈরি করা যায়, তেমনি আনবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রও গড়ে তোলা যায় আর এটা নির্ভর করে লক্ষ্যের উপর অথবা সুত্রকে বাস্তবে রূপ দেয়ার নীতিমালার উপর এ জন্যে তো আর সুত্রকে দোষ দেয়া যায় না তবে এটা বলা যায় সমাজতন্ত্র বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কী লেনিন, কী স্ত্যালিন, কী মাও সবাই কমবেশি ভুল করেছেন আর সে জন্যেই বিপ্লবের শত বর্ষে  এসে আমরা সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে অতীত কালে কথা বলছি লেনিন যেমন তার ভাই আলেকজান্ডারের সন্ত্রাসবাদী পথকে ভুল বলে বলেছিলেন “আমরা অন্য পথে যাবো”, মনে হয় বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতার সাথে তাল মিলিয়ে আমাদেরও লেনিনের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে হবে “আমরাও  অন্য পথে যাবো”       
          যখনই সমাজতন্ত্রের কথা বলা হয়, বলা হয় ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে সমষ্টির কথা কিন্তু আমার মনে সব সময়ই প্রশ্ন জাগে, এই যে সমাজতন্ত্রের হাত ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় শত ভাগ জনগন শিক্ষিত হল, তারা কী ব্যক্তি নন? শুধু তাই বা কেন, এই যে আজ পশ্চিমা দুনিয়ায় বিভিন্ন ওয়েলফেয়ার স্টেটের আবির্ভাব – সেটাও কিন্তু সোভিয়েত ব্যবস্থাকে মোকাবেলা করার জন্যই সোভিয়েত শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও সভ্যতার ইতিহাসে এক অনন্য ব্যবস্থা বলে মনে করা হয়, এখনও ফিনল্যান্ডসহ অনেক পশ্চিমা দেশ সোভিয়েত শিক্ষা ব্যবস্থার অনুকরণে নিজেদের শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে  তাই অক্টোবর বিপ্লবের সাফল্য যেমন ছিল, তেমনি ছিল ব্যর্থতাও তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশ হিসেবে আজ কালের গহ্বরে হারিয়ে গেলেও বিভিন্ন রূপে, বিভিন্ন আঙ্গিকে তা বেঁচে আছে পৃথিবীর আনাচে কানাচে, কোটি মানুষের চিন্তায় আর এখানেই অক্টোবর বিপ্লবের সার্থকতা 
          সরকারি ভাবে কিছু করা না হলেও রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবের শত বর্ষ পালন করছে বেশ ঘটা করেই আর সেই সুত্র ধরে বিভিন্ন দেশের বাম দলগুলোর সাথে বাংলাদেশ থেকেও প্রতিনিধিরা যোগ দেন সেই উৎসবে ফলে আমাদেরও সুযোগ হয় অনেক দিন পরে দেশের উচ্চ পর্যায়ের বাম দলের নেতৃত্বের  সাথে দেখা করার আমরা যারা দেশে বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম তাদের অনেকেই মিলিত হই সিপিবি আর ওয়ার্কার্স পার্টির ডেলিগেটদের সাথে এক মত বিনিময় সভায় এটা ছিল সত্যিকার অর্থেই মত বিনিময় সভা যেখানে সাবাই নিজের মতটা প্রকাশ করেছে, অন্যের মত গ্রহণ করার কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না দেশ থেকে আসা ডেলিগেটরা ছিলেন সিপিবির সাধারণ সম্পাদক কমরেড শাহ আলম ভাই, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দিবালোক সিংহ টুটুল দা আর ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা ভাই ওনারা প্রথমে আমাদের কথা শুনলেন, আমরা যারা অনেক দিন এ দেশে আছি, যাদের চোখের সামনে ঘটে গেছে এ দেশের যুগান্তকারী পরিবর্তন, যারা রাশিয়ার সমাজতন্ত্র থেকে পুজিবাদে ফিরে যাওয়ার সাক্ষী তাদের মতামত, তাদের অনুভুতির কথা জানতে চেয়েছেন একই সাথে মনোযোগ সহকারে শুনেছেন দেশের রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের মূল্যায়ন, রাজনীতির সাম্প্রদায়িকরণে আমাদের উৎকণ্ঠার কথা তারা বলেছেন দেশের বর্তমান রাজনীতির কথা, রুশ দেশে সমাজতন্ত্রের পতনের পর দেশে বাম রাজনীতির সার্বিক পরিস্থিতির কথা সিপিবির কমরেডরা দৃঢ় গলায় ব্যক্ত করেছেন মার্কসবাদ – লেনিনবাদের প্রতি তাদের অঙ্গীকারের কথা, সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের কথা টুটুল দার কণ্ঠে সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের কথা শুনে এক দিকে যেমন খুশি হয়েছি লক্ষ্যের প্রতি তাদের অবিচলতা দেখে তেমনি ভয়ও পেয়েছি মনে পড়ে গেছে সেই বুড়ো ইহুদীর গল্প এক বুড়ো ইহুদীকে প্রশ্ন করা হয়
-   সুখ কী?
-   আমি যে রাশিয়ায় জন্ম নিয়েছি, এটাই আমার বড় সুখ
-   আর দুঃখ কী?
-   আমার এই সুখই আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ
          আমি রাশিয়ায় আসি ১৯৮৩ সালে আর ১৯৮৬ সালে থেওরেটিক্যাল ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে যোগ দেই এর পর থেকে এখনও পর্যন্ত আমার মেলামেশা মূলত ফিজিসিস্ট আর ম্যাথেম্যাটেশিয়ানদের সাথে এই লোকগুলো একেবারে ভিন গ্রহের বাসিন্দা, যারা টাকাপয়সা থেকে অঙ্কের সমীকরণ নিয়েই নিজেদের ব্যস্ত রাখতে ভালবাসে, আর এই ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির মধ্যেই কাটিয়ে দেয় জীবন আর্থিক মাপকাঠিতে এদের অধিকাংশই সর্বহারার খুব কাছাকাছি, কিন্তু তারা সর্বহারা নয়, হতে পারবেও না এরা বেঁচেই থাকে সব ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করার জন্য ধর্মের মূল কথা যেখানে অন্ধ বিশ্বাস, বিজ্ঞানের চালিকা শক্তি সেখানে অবিশ্বাস, সন্দেহ এখনও পর্যন্ত যে সব দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়েছিলো বা হয়েছে – সেখানেই মার্ক্সবাদ  লেনিনবাদকে প্রশ্নাতীত করার চেষ্টা চলেছে, এটাকে ধর্মের মতই ডগমায় পরিণত করা হয়েছে যে বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে মার্ক্সবাদ গড়ে উঠেছিলো সেই মার্ক্সবাদকে প্রশ্নাতীত করে তার ভেতর থেকে বিজ্ঞানকেই বিতাড়িত করা হয়েছে এটাও মনে হয় সোভিয়েত সিস্টেম পতনের অনেকগুলো কারণের একটা  
          আমার কেন যেন মনে হয় সাম্যবাদের ব্যাপারটা আমরা খুব আক্ষরিক অর্থে গ্রহন করেছি। এই ধরুন আমার গ্রাম। সেখানে শিক্ষক ছিল, উকিল ছিল, ব্যবসায়ী ছিল, বামুন, পুরুত, মোল্লা, নাপিত, ধোপা, তাঁতি, কৃষক সব ছিল। সব মিলিয়েই ছিল সুখী সমৃদ্ধ গ্রাম। যদি ওখানে শুধু শিক্ষক বা ব্যবসায়ী থাকতো, অথবা নাপিত বা কৃষক – গ্রাম কী স্বয়ং সম্পূর্ণ হতো? মোটেই না। জীবনের প্রয়োজনে হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করেই কাজের এই বিভাগ হয়েছে আর এই বিভাগই পরে শ্রেনীর জন্ম দিয়েছে। কখনও বা কোন কোন উদ্দেশ্যে এই শ্রেনী গুলো একত্রিত হয়, আবার কখনোবা বিভাজিত হয়। বাইরের শত্রুর আক্রমন থেকে বাঁচতে সবাই এককাট্টা হই, আবার সেটা কেটে গেলে নিজেদের স্বার্থে একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতায় নামি। আর এই প্রতিযোগিতাই আমাদের সামনের দিকে নিয়ে যায়। আচ্ছা ভাবুন, অলিম্পিকে শুধু ট্রায়াল হচ্ছে, যেখানে সবার উদ্দেশ্য থাকে প্রথম চারজনের মধ্যে থাকা যাতে পরবর্তী রাউন্ডে খেলা যায়। তখন কি সবাই সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামে, বিশেষ করে যারা সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন? নামে না। কিন্তু যখন ফাইনাল হয় সেখানে সবাই আপ্রান চেষ্টা করে সোনা জিততে। এটা আমাদের মজ্জাগত। আর তাই যদি হয় তবে সবাইকে কি সমান করা যাবে? যেটা করা দরকার সেটা হল সবার জন্য সমান সুযোগের ব্যবস্থা করা। সোভিয়েত ইউনিয়ন সেটা করতে পেরেছিল। একই এলাকার প্রায় সমস্ত বাচ্চারাই (যদি জনগনের শত্রু বলে পরিচিত মানুষদের ছেলেমেয়েদের বাদ দেয়া যায়, যদিও অধিকাংশ ক্ষেতের ঐ ছেলেমেয়েকে আলাদা করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় তাদের লালনপালন করা হতো বলে শুনেছি) একই ধরণের সুযোগ সুবিধা পেতো। যার ফলে অতি অল্প সময়ে অনেক নামকরা বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বেরিয়ে আসে সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে। আমার মনে হয় এখানেই সাম্যের একটা লাগাম টানার দরকার ছিল। কেন না পরবর্তীতে যখন একজন ডাক্তার আর একজন সাধারণ শ্রমিকের বেতন এক হয়ে গেল, তখনই দেখা গেল এক ধরণের অসন্তোষ। একজন শ্রমিক যেখানে ৯ টা ৫ টা কাজ করে বাকী সময় নিজেকে দিতে পারে, একজন শিক্ষক তখন বাড়িতে বসে ছাত্রদের খাতা দেখে, লেকচার রেডি করে। একজন বিজ্ঞানী যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণই সমস্যা নিয়ে ভাবে। তাই মেকানিক্যালি সবাইকে সমান করতে গেলে সেটা ন্যায্য হয় না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তাই আমার মনে হয় শ্রেনীবিহীন সমাজের শ্লোগান একটা ইউটোপীয় ব্যাপার। কেননা সুস্থ সমাজে বিভিন্ন পেশা থাকবে, বিভিন্ন পেশার দ্বন্দ্ব থাকবে। এই বৈপরিত্বের একতা আর সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সমাজ এগুবে সামনের দিকে। শ্রেনীই যদি না থাকে, সমাজের বিভিন্ন মানুষের মধ্যে যদি স্বার্থের দ্বন্দ্ব না থাকে তবে সমাজ এগুবে কিসের ভিত্তিতে? তাই শ্রেনীহীন সমাজ নয়, সমাজের বিভিন্ন শ্রেনীর দ্বন্দ্বগুলোকে কিভাবে ননঅ্যানটাগনিষ্টিক করা যায় সেই ফর্মুলাই খুঁজতে হবে। আর এজন্যে দরকার রাষ্ট্রীয় ভাবে সবাই যাতে সমান সুযোগ পায় সেটা প্রদান করা, বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনা আর কোন অবস্থাতেই যেন কোন শ্রেনীর সম্পদ বা ক্ষমতা একটা ক্রিটিক্যাল মাত্রা না পেরিয়ে যায় সেটা বজায় রাখা। কেননা এক বার ভারসম্য নষ্ট হলেই ক্ষমতাশীলরা চায় তাদের ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে, আর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য দুর্বলরা শুরু করে প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্র। গরবাচেভের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি এক সময় খুব জনপ্রিয় ছিল। তবে শান্তির জন্যে শক্তি দরকার। দুর্বল শান্তিতে থাকতে পারে না, তাকে শান্তিতে থাকতে দেয়া হয় না। শান্তিও লড়াই করেই অর্জন করতে হয়, লড়াই করেই রক্ষা করতে হয়।  
          বিভিন্ন দেশে ক্ষমতায় আসার পর কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর বিভিন্ন রকম অধঃপতন দেখা গেলেও যে কোন দেশের জন্যই এসব দলের গুরুত্ব অপরিসীম। এই অধঃপতন যতটা না আদর্শের কারণে তার চেয়ে বেশী ক্ষমতার নিজস্ব চরিত্রের কারণে। ক্ষমতা, বিশেষ করে অসীম ক্ষমতা মানুষের র‍্যাশনাল চিন্তাভাবনার পথে বাঁধা সৃষ্টি করে। তবে বিরোধী দল হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির জুরি নেই। বাংলাদেশ এখন সমাজিক অস্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দিন দিন আমরা আক্ষরিক অর্থেই দূরে সরে যাচ্ছি একাত্তর থেকে। ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সাপোর্টিভ ফোর্স হয়ে যে ভুমিকা পালন করতে পেরেছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে আজ সেটা পারছে না। আর বাম দলগুলোর  এই দুর্বলতাকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক শক্তি রক্ত দিয়ে ছিনিয়ে আনা ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব – সব একটু একটু করে গ্রাস করে ফেলছে। বিপ্লবের শত বর্ষে তাই নতুন করে শপথ নিতে হবে। ডগমা নয়,  নতুন বাস্তবতায় নতুন করে দলের রণনীতি, রণকৌশল ঠিক করতে হবে। লড়াইটা আদর্শের জন্য হলেও বেলা শেষে লড়াইটা যেন মানুষের জন্য হয়, মানবতার জন্য হয়, দূষণমুক্ত পরিবেশের জন্য হয়।
এবারের সংগ্রাম হোক শান্তির জন্য, মানবতার জন্য, প্রকৃতি ও মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, পরিবর্তনই হোক সমাজ পরিবর্তনের মহামন্ত্র।

দুবনা, ০৭ – ০৮ নভেম্বর ২০১৭            


                                                 
                 

          

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি