কোটা নিয়ে কথা

বেশ ক’দিন হল ফেসবুক খুব গরম কোটা ইস্যু নিয়ে। যেহেতু এ সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না, তাই কোন রকম মন্তব্য করা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করেছি। তবে বেশ কিছু বন্ধুর পোস্ট থেকে বুঝেছি ব্যাপারটা যথেষ্ট জটিল – এর পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলা সমান ভাবে বিপদজনক। কারণ দুপক্ষেরই নিজেদের পক্ষে শক্তিশালী যুক্তি আছে, আছে অনেক আবেগ। তবে গতকাল মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পুরস্কার প্রাপ্ত সাংবাদিক  মো. কামাল হোসেনের “কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেপথ্যের কাহিনী পড়ে ব্যাপারটা সম্পর্কে কমবেশি অবগত হওয়া গেল। এছাড়া ফেসবুকে অধ্যাপিকা কাবেরী গায়েনের লেখা থেকেও কিছু কিছু ব্যাপার পরিষ্কার হল। সেটার সুত্র ধরেই কিছু কথা।      

কোটা সিস্টেম বিভিন্ন দেশেই আছে। বিভিন্নভাবে সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোকে সামনে আনার এ এক প্রয়াস। একটা সময় পর্যন্ত কোটা অনেক সমস্যার সমাধান দিলেও পরে অনেক ক্ষেত্রেই সেটা নতুন সমস্যার তৈরি করে। এটা ঘটে যদি সময়সীমা বেঁধে না দেয়া হয়, অন্তত কিছু কিছু ক্ষেত্রে। কেননা যদি এ প্রথা অনন্তকাল ধরে চলতে থাকে অনেকেই নিজেকে আরও বেশী পারদর্শী করে তোলার উপর গুরুত্ব না দিয়ে কোটার ফোঁকর গলে উপরে উঠতে চায়। যার ফলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে উপরে তোলার যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সিস্টেম চালু হয়েছিল সেটার ব্যাঘাত ঘটে। শিল্প বা ব্যবসাকে উৎসাহিত করতে কোন এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যবসায়ীদের যেমন কর মউকুফ করা হয় এক্ষেত্রেও সেটা হতে পারে। অর্থাৎ কোটার উদ্দেশ্য হবে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমাজের পিছিয়ে পড়া একটা অংশকে উপরে তোলা, তাকে বুঝতে দেয়া যে সমাজ তোমাকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিছু বাড়তি সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে – এখন তোমার দায়িত্ব সেটাকে লাইফ বোট হিসেবে ব্যবহার করে নিজে উপরে ওঠা আর সেই সাথে নিজের আশেপাশের (সংসারের) মানুষদেরকেও উপরে নিয়ে আসা। এরকম কমিটমেন্ট না থাকলে কোটা কোন সমস্যার সামাধান তো করবেই না, বরং দুর্নীতির এক হাতিয়ারে পরিণত হবে যা ব্যবহার করে এক ধরণেসুবিধাবাদী শ্রেনী গড়ে ঠবে আর এর ফলে দেখা দেবে অসন্তোষ।
শুধু আমাদের দেশ কেন পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই সব চেয়ে বড় সমস্যা সুষম বণ্টনের  –  তা সে সম্পদ, সুযোগ সুবিধা, আইন, বিচার যাই হোক না কেন। গরীব বা পিছিয়ে পড়া মানুষ সম্পদের ভাগ কম পেলেও শাস্তির ভাগটা ষোল আনাই পায়। এক অদ্ভুত নিত্যতার সূত্র কাজ করে সমাজে। আর এর জের ধরে ধনী আরও ধনী হয়, গরীব হয় আরও গরীব। অনেক কথা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা নিয়ে। এই ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষের কোন মানুষের আপত্তি থাকার কথা ছিল না। কিন্তু সেটা করার আগে যে কাজটা করার দরকার ছিল, সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করা, সেটা কি হয়েছে? হয়নি বলেই আজ একদিকে যেমন অনেক জেনুইন মুক্তিযোদ্ধা বাদ পড়েছেন তালিকা থেকে, অন্যদিকে অনেক স্বাধীনতা বিরোধী মানুষও মুক্তিযোদ্ধা সেজে এই কোটার ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে গেছে সমাজের উঁচু তলায়। এই ফেক মুক্তিযোদ্ধারাই এখন অসন্তোষের জন্ম দিচ্ছে
দেশ স্বাধীন হল একাত্তরে, বয়েস পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো সত্যিকার অর্থে সরকার গড়ে উঠলো না। হাসছেন? হ্যাঁ, প্রধান প্রধান দলগুলো সরকার গঠন করে, সরকার গঠনের পরে বিরোধীদল যাতে কখনই মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, সে জন্য সব কিছুই করে আমাদের দেশের সব সরকার, কিন্তু নিজেরা ব্যবহার করে বিরোধী দলের মত। কিভাবে? স্বাভাবিক ভাবেই ধরে নেওয়া যায় সরকার, মানে মন্ত্রীসভা দলের উর্ধে, দেশের সমস্ত জনগনের ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব সরকারের। তাই দেশের মানুষের একটা অংশ যদি কোন কারণে সরকারের কোন নীতি মেনে নিতে না পারে, তাঁরা এর প্রতিবাদ করবে, সরকারকে তাদের দাবী জানাবে। আর জনগনের প্রতিনিধি হিসেবে সরকার তাদের সঙ্গে আলচনায় বসবে, সমস্যার একটা যৌক্তিক সমাধান বের করার চেষ্টা করবে। কিন্তু দেশে আমরা কি দেখি? যে কোন ইস্যু নিয়ে কথা বললেই সরকারী দলের লোকজন পাল্টা ইস্যু নিয়ে রাস্তায় নামে। ভাবখানা এই বিরোধী দলের ক্ষমতা আছে সরকারী দলের দাবী দাওয়া পূরণ করার। এক্ষেত্রে রাশিয়ায় বর্তমানে চালু এক চুটকি মনে পড়ে গেল।
ইংল্যান্ডের সলসবেরিতে স্ক্রিপালের উপর রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের অভিযোগ তুলে ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ ইউরোপের অনেক দেশ ১৫০ জনের মত রাশিয়ান কূটনীতিক বহিষ্কার করেছে। রাশিয়াও এ ব্যাপারে ইংল্যান্ডের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছে এবং তার প্রমান স্বরূপ ১৫০ জন কূটনীতিক বহিষ্কার করেছে। কিন্তু যেহেতু রাশিয়া নিজেরা নিজেদের কূটনীতিক বহিষ্কার করতে পারে না, নিরুপায় হয়ে তাঁরা ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক বহিষ্কার করেছে।
আমাদেরও সেই অবস্থা

বিরোধীরা মিছিল করে চায় অধিকার
সহমত জানিয়ে রাস্তায় নামে সরকার
রাস্তাদুটি পাশাপাশি -  সমান্তরাল
যুদ্ধংদেহী দুদলকে তারা করেছে  আড়াল।

অবশ্য আমাদেরই বা দোষ কী? সারা বিশ্বই আজ এ পথের পথিক। কেউ আর আলোচনার টেবিলে বসে না। ফেসবুক, টুইটার, টেলিভিশনের পর্দা থেকে হুঙ্কার ছাড়ে। দিনকে রাত আর রাতকে দিন করার এই প্রতিযোগিতায় কী সাংবাদিক কী রাজনীতিবিদ  ভুলে যান তাঁদের প্রধান কর্তব্য।  
আলোচনার টেবিল যখন সুশীল সমাজের দখলে তখন সরকারের সাথে জনগণের আলচনার সম্ভাবনা খুবই কম, আরও কম শান্তিপূর্ণ উপায়ে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সমাধানের সম্ভাবনা।  

দুবনা, ১০ এপ্রিল ২০১৮ 




Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি