কারো শুরু কারো শেষ


রাত পোহালেই সূর্যের ডানায় ভর করে আসবে ১৪ এপ্রিল। রাশিয়ায় আর যে কোন দিনের মতই একটা দিন। তবে এরই মধ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রায় ছয়লাব হবে সুদূর বাংলাদেশের রাস্তাঘাট। আমি বাড়িতে ফোন করব। দিদি ফোন তুললে যখন বলব
-    শুভ নববর্ষ দিদি।
-    আজ তো চৈত্র সংক্রান্তি ভাই। পয়লা বৈশাখ তো আগামী কাল।
এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। মনে হবে ছোটবেলার কথা। তখন আমরা এটাকে বলতাম হালখাতা। চৈত্রের শেষের কয়েকদিন থেকেই পাশের জেলে পাড়ায় চলত চৈত্র পূজা। সারাদিন বিভিন্ন দল এসে ভুতপেত্নী সেজে নেচে যেত শিবের সাথে আর রাতে নাচ চলত মণ্ডপে। কী ভৌতিক ছিল সে রাতগুলো? চারিদিকে ভূতপেত্নীর আনাগোনা। ভয় আর উত্তেজনার মধ্য দিয়ে কাটতো নববর্ষের আগের এ দিনগুলো।
এরপর চৈত্র সংক্রান্তি। ছাতু, মুড়িমুড়কি এসব ছিল এদিনের মূল উপাদান। সাথে বিভিন্ন শাঁক। যতদূর মনে পড়ে এ সময় বাড়িঘর ধুয়েমুছে প্রস্তুত করা হত নতুন বছরকে বরণ করার জন্য।   
পয়লা বৈশাখ সকাল থেকে আসতে শুরু করত গ্রামের লোকজন। আমরাও যেতাম পাড়ায় পাড়ায়। কোলাকুলি, মিষ্টিমুখ এসব ছিল পয়লা বৈশাখের সকালের দৃশ্য। অনেকটা ঈদ আর বিজয়া দশমীর পরে কলাকুলির মত। তবে ওসব অনুষ্ঠান ছিল একেবারেই ধর্মীয়, পয়লা বৈশাখের কোলাকুলি – ধর্মনিরপেক্ষ, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙ্গালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ।  
এরপর আসত খদ্দেররা। এরা ছিল তাতী আর জোলা। আমাদের বাড়ি থেকে সুতা কিনে কাপড়, চাঁদর, লুঙ্গি, গামছা এসব তৈরি করত। খোলা হতো নতুন খাতা। সবাই চেষ্টা করত পুরনো বছরের ঋণ শোধ করতে। সারাদিন আসত খদ্দেররা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। দই, মুড়িমুড়কি আর বিভন্ন মিষ্টি দিয়ে বাড়ির লোকেরা বরণ করত শতশত অতিথিকে, বরণ করত নতুন বছরকে।
সেটা ছিল সংবাদপত্রের যুগ। পরের দিন কাগজে রমনার বটমূলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের খবর পড়তাম। তবে সেটা ছিল অনেক দূরে, ঢাকায়। গ্রামের জীবনে এর বাহ্যিক প্রতিফলন তখন তেমন দেখিনি। তবে এটা ঠিক বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতায় সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভূমিকা ছিল অপরিহার্য। পাকিস্তানি শাসকেরা সেটা বুঝতে পেরেছিল বলেই বারবার চেষ্টা করেছে রবীন্দ্র সঙ্গীত, পয়লা বৈশাখ এসব নিষিদ্ধ করতে। আর বাঙ্গালি বারবার এদেরকেই আঁকড়ে ধরেছে, সংস্কৃতির মশাল হাতে নিয়ে সে বারবার খুঁজেছে সামনে চলার পথ। সংস্কৃতি আর মৌলবাদের চলার পথ সবসময়ই বিপরীতমুখী। তাই তো আজও মৌলবাদ প্রাণপণে চায় এসব বন্ধ করতে। দুঃখজনক হলেও সত্য প্রায় সব সরকারই ভোটের কথা ভেবে এদের দাবিদাওয়ার কাছে নতি স্বীকার করে। মানুষ বরাবরই ছিল শক্তের ভক্ত নরমের যম। সরকারের মানবিক রূপটা হয়তো এখানেই প্রকাশ পায়।
বাংলা পঞ্জিকা নিয়ে আমি বরাবরই দ্বিধাগ্রস্থ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর কোন ব্যবহার নেই। যেটুকু ব্যবহার সেটা ধর্মীয় জীবনে। এমনকি ভাষা দিবস আমরা পালন করি একুশে ফেব্রুয়ারী, ৮ ই ফাল্গুন নয়। আমাদের দেশের শিক্ষা থেকে শুরু করে অফিস আদালত সবই চলে ইংরেজি (গ্রেগরিয়ান) পঞ্জিকায়। ঈদ, রোজাসহ ইসলাম ধর্মীয় সমস্ত উৎসব পালিত হয় হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী আর হিন্দুদের পূজা-পার্বণ, বিয়ে সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয় বাংলা পঞ্জিকার অনুসরণে। বাংলার হিন্দু এসব করতে এখনো কলকাতা থেকে প্রকাশিত পঞ্জিকাই অনুসরণ করে। সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্রের অবস্থানের ভিত্তিতে তৈরি এ পঞ্জিকা ইংরেজি বর্ষ পঞ্জির তুলনায় বেশ ফ্লেক্সিবল। তাই সরকারিভাবে ১৪ এপ্রিলকে ১লা বৈশাখ ঘোষণা করায় এক ধরণের দ্বৈত ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বাংলা পঞ্জিকার ব্যবহারে।
বিগত কয়েক বছর হল দেশে অনেক উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে নববর্ষ পালন করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে বাঙ্গালি। এটা যে শুধু সংস্কৃতির কারণেই হয়েছে তা নয়। বাজার অর্থনীতিও এখানে তার ভূমিকা রেখেছে। আগে সাধারণত ঈদ ও পূজা ছিল নতুন পোশাকে সাজার সময়। এখন ঈদ পূজার বাইরেও একুশে ফেব্রুয়ারী আর নববর্ষে নতুন পোশাক কেনার হিড়িক পড়ে দোকানে দোকানে। নতুন বছরকে নতুন আঙ্গিকে বরণ করে বাঙ্গালি।
বাংলা পঞ্জিকাকে মৌলবাদীরা হিন্দু ধর্মের সাথে গুলিয়ে ফেলার চেষ্টা করে। অথচ এই পঞ্জিকার প্রবর্তক হিসেবে আমরা দেখতে পাই আলাউদ্দীন হোসেন শাহ্‌ আর সম্রাট আকবরের নাম। সে যেই হন – উভয়েই মুসলমান শাসক। সম্রাট আকবরের সম্পর্কে বলা হয় সেটা হল উনি এই পঞ্জিকা এমনভাবে তৈরি করেন যে এর শুরু হয় হিজরি বছরের সাথে। ১৫৫৬ সালে মানে আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সময় পর্যন্ত তারা চলে হাতে হাত রেখে। আর এর পর থেকে হিজরি বরাবরের মত চান্দ্র নিয়মে চললেও আকবরের পঞ্জিকা চলে সৌর পথে। কারণ এটা স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে কর আদায়ের জন্য অধিক সুবিধাজনক ছিল। আকবরের মৃত্যুর পর এই পঞ্জিকা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেলেও পরবর্তীতে সেটা নতুন জীবন পায় বাংলায়। তাই যারা বাংলা পিঞ্জিকাকে হিন্দু পঞ্জিকা বলে বাঁধার সৃষ্টি করে তারা মূলত বাংলা বিরোধী, শত শত বছর ধরে চলে আসা বাংলার সংস্কৃতি বিরোধী। তাঁদের সাথে তাল দিয়ে যাঁরা বাঙালির এই প্রাণের উৎসব পালনে বাঁধা দেয় বা উৎসবকে সময়ের খাঁচায় ঢুকিয়ে দেয়, বাংলাদেশ, বাংলা সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের কমিটমেন্ট সম্পর্কে সন্দেহ জাগাটাই স্বাভাবিক।
অবশ্য তাঁদের কথা বলেই লাভ কি? অদ্ভুত জাতি আমরা। খুব কম জাতিই ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। বাঙ্গালি তাঁদের অন্যতম। যে ভাষার জন্য সে প্রাণ দিল, সেই ভাষায় ছেলেমেয়ের নাম রাখা তাঁরা লজ্জার মনে করে। আমাদের ছোটবেলায় রহিম, করিম এসব নাম বাংলা না হলেও বাংলা থেকে খুব দূরে ছিল না। সেগুলো বাইরের বলে মনে হতো না। আজকাল মানুষের নাম আরবি ঘেঁষা। যার নামে যত বেশি আরবির প্রভাব – সে তত খাঁটি বাংলাদেশি, তত সাচ্চা মুসলমান। অথচ প্রচুর মুসলিম দেশ আছে, যেমন ইন্দোনেশিয়া, যেখানে স্থানীয় নামেই তাঁরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
জাতিগত বৈশিষ্ট্য মানুষের অস্থিমজ্জায়। এমনকি যাঁরা যুগ যুগ ধরে বাইরে থাকেন, তাঁরাও তাঁদের এই বৈশিষ্ট্য কাটিয়ে উঠতে পারেন না। আর আমরা চাই দেশে বসেই সেটা কাটিয়ে উঠতে। বাংলাদেশে বসে আরবের শেখ হতে। তারা ভুলে যায় বাঙ্গালি ভালো মুসলমান হতে পারে, কিন্তু ভালো আরব কোন দিনই হতে পারবে না। আরব হওয়ার জন্য আরব হয়ে জন্মাতে হয়, বাঙ্গালিত্ব ত্যাগ করলেই আরব হওয়া যায় না।
আশা করি একদিন আমরা অনুধাবন করবো সবার উপরে আমরা মানুষ, তার পর বাঙ্গালি আর তারও পর হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃস্টান ইত্যাদি, ইত্যাদি। আর তখনই আমরা ফিরে যাবো মাটির কাছে, আবহমান বাংলার সংস্কৃতির কাছে। সবাইকে চৈত্র সংক্রান্তি আর নববর্ষের অনেক অনেক শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা।
ভালো থাকুন, সুখে থাকুন।

দুবনা, ১৩ – ১৪ এপ্রিল ২০১৮       

     

Comments

  1. ঠিকইতো, তাই মনে করি আমরা কোথায় যেনো হারিয়ে যাচ্ছি।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি