আমি কি যে বলি

কি আপনি শুনছেন তো আমার কথা?
হুম!
হুম মানে? আমি এক ঘণ্টা যাবত আপনার সাথে কথা বলছি, আর আপনি দু তিন বার হুম। নাকি টেলিফোন পাশে রেখে দিয়েছেন?
না না, টেলিফোন রাখব কেন? আমি তো তোমার কথা শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে বসে আছি।
সে আবার কী কথা? আমি এতো কথা বলছি আর আপনি কথা শোনার অপেক্ষা করছেন?
তোমার আহসানকে মনে আছে? আমার বন্ধু?
ও, আহসান ভাই! নিশ্চয়ই মনে আছে।
আমরা প্রায়ই একসাথে ঘুরতাম হোস্টেলের পেছনের বনে। একদিন ও একটা ধাঁধাঁ বলেছিল। শুনবে?
বলেন।
আমার দেশের বাড়ি মানিকগঞ্জ। গুলিস্তান থেকে যেতাম। একদিন ও গল্প শুরু করল – “দোস্ত, ধর তুমি কালু ড্রাইভারের গাড়িতে উঠলে গুলিস্তান থেকে। গাড়িতে ২০ জন যাত্রী। শাহবাগে পাঁচজন নামলো, তিন জন উঠলো। সাভারে উঠলো ১০  জন আর নামলো ৫ জন। নবীনগরে ৪ জন উঠলো। গাড়ি চলছে, চলছে।“ – “তারপর?” “বলতো দোস্ত ড্রাইভারের নাম কি?” আমার তো হাসতে হাসতে পেটে খিল।
এতে হাসির কি হল? 
না না, হাসির কি আছে। শুধু ড্রাইভারের নামের সাথে যাত্রীদের কি সম্পর্ক সেটা ভেবে হাসছিলাম।
কিন্তু আপনি আমাকে এ গল্প বলছেন কেন?
এমনিতেই। তুমি গত এক ঘণ্টায় আমাকে হাজার দেশ ঘুরিয়ে আনলে, হাজার মানুষের হাড্ডি কচলালে অথচ আমি বসেই আছি, বসেই আছি  কখন তুমি আসল কথাটা বলবে। আমার মাঝে মধ্যে মনে হয় আমাদের লোকেরা সবাই “হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল।“ আর আমিও অপেক্ষায় থাকি যদি কোন দরকারি ইনফরমেশন পাওয়া যায়। বুঝলে তো, এটা ইনফরমেশনের যুগ। বলা হয় যার কাছে যত বেশি ইনফরমেশন সে তত বেশি ধনী। নিজে বললে তো নতুন কিছু জানা হয় না, শুনলে কোন না কোন নতুন ইনফরমেশন পেতেও পারি, তাই অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমাকেও কবিগুরুর সাথে গলা মিলিয়ে গাইতে হবে “অনেক কথা যাও যে বলি কোন কথা না বলি, তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি।“    
না না, এটা কিন্তু ঠিক বললেন না। আমি তো অপেক্ষা করছিলাম আপনার মতামত শুনতে, কিন্তু আপনি চুপ করে ছিলেন বলেই তো আমি এত কথা বলছিলাম।
শোন, এটা তোমার দোষ নয়, আমাদের সবারই এখন এই অবস্থা। কিছুদিন আগে এক বন্ধুর সাথে দেখা। কয়েক যুগ পরে। ছাত্র জীবনেও সে প্রচুর কথা বলত, নিজের মতটাকেই একমাত্র ঠিক বলে মনে করত। এখন বিশাল মানুষ। তাই এখন নিজেকে সন্দেহ করার তো কোন প্রশ্নই আসে না, সে অবকাশও তার নেই। হঠাৎ একটা বিষয় নিয়ে কথা উঠলো। আমার কথা পুরোটা না শুনেই সে দুহাতে মতামত বিলিয়ে দিতে শুরু করল। আমি ভাবি, মানুষ যদি এভাবে মতামত বণ্টন না করে অভাবীদের মাঝে নিজেদের ধন দৌলতের ছিটেফোঁটা বিলিয়ে দিত, তাতে তাদের ধর্ম কর্মও হত, সমাজে বৈষম্যও কিছুটা কমত। অবাক লাগে দেখে এই মানুষগুলো যথেষ্ট বুদ্ধিমান, সমাজে প্রতিষ্ঠিত – পড়াশুনাও ভালই শিখেছে, কিন্তু অন্যের কথা, ভিন্ন মত শুনতে শেখেনি। আচ্ছা বলতে পার যারা কথা শুনতে জানে না তারা শেখে কেমন করে? বই পড়ে অবশ্য শেখা যায়, কিন্তু বই পড়ে তুমি শুধু লেখকের মত জানবে, সেটাও আবার তোমার নিজের মত করে ব্যাখ্যা করবে।  কিন্তু কথা বললে আর কথা শুনলে মতামত বিনিময় হয়।  তুমি শুধু তোমার ইন্টারপ্রিটেশন পাচ্ছ না, তোমার ভাবনার প্রেক্ষিতে অন্যেরা কি ভাবছে সেটাও পাচ্ছ। ফলে জানাটা পোক্ত হয়। কিন্তু যুগ বদলে গেছে, মানুষ নিজেকে জানাতেই ব্যস্ত, জানতে নয়। দেখ না টকশোগুলোয়, মানুষ মানুষের মুখের কথা কিভাবে কেড়ে নেয়। একজনের কথা শেষ না করতে দিয়েই কিভাবে নিজের বক্তব্য হাজির করতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে! আর সব চেয়ে বড় কথা কেউ তার কথা শুনছে কি না এ নিয়ে তার মাথা ব্যথা নেই। বলা, নিজেকে প্রকাশ করাই যেন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। সেটা অবশ্য মানুষের দোষ নয়, যুগটাই এমন। আমাদের পোশাকপরিচ্ছদ, চলনবলন, আমাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ – সব কিছুরই একটাই মাত্র লক্ষ্য, নিজেকে জাহির করা, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা। আর অবাক ব্যাপার এই আমরা অন্যদের তোয়াক্কা না করলেও, অন্যদের নিজের সমগোত্রীয় মনে না করলেও তাদের মতামতের কিন্তু ঠিকই তোয়াক্কা করি। একটা লাইক পাওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকি। নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য সবচেয়ে নোংরা পথ বেছে নিতেও ভ্রূক্ষেপ করি না। আমরা দিন দিন যেন একাধিক স্বত্বার মানুষে পরিণত হচ্ছি। সমাজের দিকে তাকাও। ধর্মগুরু, যাদের হওয়ার কথা ছিল আদর্শ মানুষ তারাই আজ ধর্ষক। রাজনীতিবিদ, যাদের হওয়ার কথা ছিল সমাজসেবী তারাই আজ সবচেয়ে বড় ঠগ। অর্থাৎ বাইরে আমরা কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক, ঘরে আদিম যুগের হিংস্র জানোয়ার। ভেতরের সাথে বাইরের এই যে অবিরাম সংঘাত সেটাই আজ মানুষকে মানুষ থাকতে দিচ্ছে না। যাকগে অনেক বকলাম। এই তো কথা শুনতে চাইছিলে। বললাম তো। অনেক কথা। কিন্তু তুমি কি সত্যিই এসব শুনতে চাইছিলে নাকি অন্য কথা?
যেমন?
এই ধর তোমার প্রতিটি কথায় সায় দেওয়া, বলা, ঠিক বলেছ। সাবাশ। এইসব আর কি!
না না, কি যে বলেন?
সত্যিই তাই। কি যে বলি!

দুবনা, ০৭ জুন ২০১৯
     



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি