আলোর আঁধার


আমার বাংলাদেশ জীবন কাটে হ্যারিকেনের আলোয়। গ্রামে তখনও বিদ্যুৎ ছিল না। তরা যদিও তাঁত শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল, গ্রাম্য রাজনীতির শিকার হয়ে তরার উপর দিয়েই বিদ্যুৎ সরবরাহ হত আশেপাশের গ্রামে। সন্ধ্যায় মা, বৌদি বা দিদি বাড়িতে সন্ধ্যা দেওয়ার পর আমাদের বাড়িতে হ্যারিকেন জ্বলত। সন্ধ্যা দেওয়া মানে ধুপ আর প্রদীপ হাতে প্রথমে তুলসী গাছ তলা, এরপর একে একে আমাদের ঘর, বড় ঘর, রান্না ঘর, গুদাম ঘর, কাছারি ঘর, রাখালদের ঘর আর সব শেষে গোয়াল ঘরের সামনে ঘুরে আসা। এখনও সেই নিয়মটা চালু আছে, তবে বিদ্যুৎ বাবাজি যেহেতু বিদ্যুৎ গতিতে প্রায়ই এদিক সেদিক ঘুরতে বেরোয়, তাই আলো জ্বালানোর ক্ষমতা আর আগের মত আমাদের হাতে নেই। তবে ১৯৮৩ সালে রাশিয়া আসার পর বিদ্যুৎ বিভ্রাটে পড়তে হয়নি বললেই চলে। ব্যতিক্রম ঘটলো গতকাল।

আগামী সপ্তাহে সাঙ্কত পিতারসবুরগ যাব একটা কনফারেন্সে। প্রেজেন্টেশন রেডি করছিলাম, হঠাৎ কম্পিউটার অফ হয়ে গেল। মাত্র ঘণ্টা খানেক আগে একবার অফিস থেকে সবাইকে বের করেছে ফায়ার সার্ভিস। ওরা মাঝে মধ্যে এমনটা করে। আমরা কতটুকু প্রস্তুত সেটা পরীক্ষা করতে সিগন্যাল দেয়, সবাই অফিস থেকে বেরিয়ে নীচে জড়ো হয়। আরও কিছুক্ষণ পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে সব চেক করার পর আমরা ভেতরে ঢোকার অনুমতি পাই। তাই এভাবে কারেন্ট চলে যাওয়া সবাইকে চিন্তায় ফেলল। সবাই করিডোরে ভিড় করে বিভিন্ন মন্তব্য শুরু করল। মাত্র দুদিন আগেই নিউ ইয়র্ক টাইমস রাশিয়ায় সিআইএ কর্তৃক সাইবার অ্যাটাকের তৎপরতার খবর দিয়েছে, এ নিয়ে এখানকার টিভিতেও খবর এসেছে। অনেক ঠাট্টা করতে শুরু করেছে সে নিয়ে। আমাদের ইন্সটিটিউটের এই চত্বরে শতাধিক বিল্ডিং, রিয়াক্টর ইত্যাদি। পাশের বিল্ডিং থেকে খবর এলো সেখানেও কারেন্ট নেই। বাসা থেকে ফোন করে জানাল কারেন্ট নেই, ঠাণ্ডা জল নেই, শুধু গরম জল আছে। ফেরার পথে দোকান থেকে যেন জল কিনি। কিন্তু দোকানপাট সব বন্ধ। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে যখন বুঝলাম ঘটনা সিরিয়াস, বাসার দিকে রওনা দিলাম।
বাসায় অন্ধকার। জল নেই, টিভি কাজ করছে না, ইন্টারনেট নেই। এমন কি স্মার্টফোনেও নেট ঠিক মত কাজ করছে না। অফিসে যখন করিডোরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, দুই মহিলা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল ফ্রিজের খাবারের কী হবে। আমার তখন মনে হয়েছিলো হাসপাতালে রুগীদের কথা। বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করলাম কোন খবর পেতে, মস্কোয় সেভাকে ফোন করে বললাম নেটে কিছু পায় কি না দেখতে, কিছুই বলতে পারল না। কি আর করা ক্যামেরা নিয়ে ভল্গার ধারে হাঁটতে গেলাম। এখন এখানে সূর্য ডুবে রাত সাড়ে নয়টায়, যদিও আলোর রেশ থাকে প্রায় এগারটা পর্যন্ত। রাত মানে কয়েক ঘণ্টার গোধূলি। শহর অন্ধকার, কোথাও কোন আলো নেই দু একটা বাড়ি ছাড়া যেখানে নিজস্ব জেনারেটর আছে।

হঠাৎ যেন শহরটাই ঘুমিয়ে পড়েছে। এই প্রথম বুঝলাম কী হতে পারে মানুষের সাথে সাইবার অ্যাটাকে। বর্তমানে সভ্যতা এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে আমরা টেকনোলজির সাথে এমনভাবে মিশে গেছি যে এগুলো আমাদের জীবনে আলো বাতাসের মত হয়ে গেছে। রাতে  যখন বাসায় ফিরলাম, ঘুটঘুটে অন্ধকার। আগে বাসায় মোমবাতি থাকত, আমি কখনই এসব নিয়ে ভাবি না, সমস্যা নাকের ডগায় এসে পড়লে তার মোকাবিলা করি। খুঁজে পেতে বৌ মোমবাতি বের করল। গ্যাসের চুল্লীতে চা করে খেলাম। না পড়লে ঘুমটা ঠিকমত হয় না। তবুও ই-বুকটা অন করতে মন চাইল না। চারিদিক শান্ত। মাঝে মধ্যে গরমে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো যৌবনের প্রাণ খোলা হাসি। বাইরে নীলাকাশে অস্তে যাওয়া সূর্যের আভাস। ঘুম ভাঙ্গল রাত তিনটেয়। অন্ধকারে বাথরুম করে কিচেনে ঢুকে শুনি ফ্রিজের আওয়াজ। হ্যাঁ, আলো ফিরেছে। এখন শুধু সকালের অপেক্ষা।

দুবনা, ১৯ জুন ২০১৯                   




Comments

Popular posts from this blog

রিসেটের ক্ষুদ্র ঋণ

পরিমল

প্রশ্ন