অপেক্ষা

প্রথম যেবার মার সাথে ইন্ডিয়া যাই ১৯৬৯ সালে আমার বয়স পাঁচের মত। অনেকটা সময় কেটেছে বেহালায় দাদাদের ওখানে। তখন ভাগুদা, জোসৎনা বউদি আর দীপুদা ওখানে থাকতেন। স্বপনদা থাকতো আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের হোস্টেলে। প্রায়ই আসতো অমুল্য মামা আর পদ্মা মামী। ওঁদের বাসা ছিল কিছুটা দূরে অশোকা সিনেমা হলের পাশে। এর পর অনেক সময় কাটে কোঁতরং দাদুর ওখানে। সেখান থেকে বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে যেতাম সন্ধ্যাদির ওখানে। আরও কিছু দিন ছিলাম বোকারো স্টিল প্ল্যান্টে। সুবোধদা আর অশোক মামার কর্মস্থল। পাশাপাশি না হলেও দু জনের বাসা ছিল হাঁটা পায়ের দুরত্বে, অন্তত আমরা বিকেলে হাঁটতে হাঁটতেই চলে যেতাম মামার ওখানে। তবে সবচেয়ে বেশি সময় তখন কাটাই বহরমপুর। গঙ্গা বা দামোদরের একদিকটায় বহরমপুর শহর, মাসি আর মামার বাড়ি নদীর ওপারে গোয়ালজান গ্রামে। কোলকাতা থেকে গেলে যেতাম শেয়ালদহ স্টেশন হয়ে, নামতাম বহরমপুর। হিন্দমোটর থেকে গেলে হাওড়া বাউন্ড ট্রেনে, নামতাম খাগড়া স্টেশনে। এ পথে পড়ত গুপ্তিপাড়া যেখানে আরেক দাদুর বাস, আমাদের ছোট্ট স্টপেজ।  সময় কাটাতাম মূলত মাসির বাড়িতে। মামা মামী দুজনেই চাকরি করতেন, তাই সারাদিন বাইরে বাইরে। আমাদের এলাকায় তখন মেয়েরা খুব একটা চাকরি বাকরি করত না। তাই যখন জোসৎনা বউদি, পদ্মা মামী বা বড় মামী বিকেলে চাকরি থেকে ফিরতেন ওঁদের কি স্মার্টই না লাগত। মাসি সারাদিন কাটতো বাড়িতে  মা কালির পূজা অর্চনা করে আর গান লিখে। তাছাড়া মার মত মাসিরও ঘর ভরা ছেলেমেয়ে – চার ভাই আর চার বোন। ছোটরা আমার সমবয়সী। মামারা তখন শুধুই দুজন। তবে মামার ওখানে যে করার কিছু ছিল না তা নয়। মামা কৃষি অফিসার। বাড়ির বিল্ডিংএর দোতলা তখনও শেষ হয়নি, তবে সামনের বাগান গাছে গাছে ভর্তি। কত যে ফুল তাতে! যেহেতু ইন্ডিয়া গেলে আমি মার সাথে বিভিন্ন যাওয়া ঘুরে বেড়াতাম তাই মামা বলতেন বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁর বাগানের জন্য ফুলের বীজ সংগ্রহ করে আনতে। তাই ছুটির দিন যখন মামা বাসায় থাকতেন ঘুম থেকে উঠেই দৌড়ে চলে যেতাম সেখানে। রং বেরঙের ফুলে বাগান ভর্তি, ঘুরে ঘুরে দেখতাম। খাওয়া দাওয়া তো আছেই। তবে মামা আর মামীর সাথে ঘনিষ্ঠতা হয় ১৯৭২ সালে ইন্ডিয়া বেড়াতে গিয়ে। যুদ্ধের পর আমরা সেবার গেছিলাম। মামা তখন বহরমপুর থাকেন না। চাকরির কারণে চলে গেছেন নবগ্রাম বলে এক জায়গায়। মায়ের সাথে আমিও সেখানে গেলাম। বেশ কিছুদিন কাটল একসাথে। এখনও মনে পরে সেখানেই প্রথম খোলা মাঠে সিনেমা দেখার কথা। হঠাৎ জানা গেল রাতে সিনেমা দেখাবে। যাত্রায় যেমন প্যান্ডেল হয় তেমনি খোলা মাঠে তাবু টাঙ্গানো হল, চেয়ার পাতা হল। অন্ধকার নেমে আসতেই শুরু হল সিনেমা। ওখান থেকে আমরা গেলাম তারকেশ্বর বামা ক্ষ্যাপার আশ্রমে। স্বপনদা তখন নক্সাল করে, অনেক দিন খোঁজ খবর নেই। মা তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ান আর ঠাকুর দেবতার কাছে জানতে চান স্বপনদার খবর। তারকেশ্বর শুধু মন্দিরই নয়, পাশেই বন, ঠিক যেন তপোবন। গেরুয়া বা লাল কাপড় পরা সাধুরা ধ্যানে মগ্ন। লোকে লোকারণ্য। কত মানুষ যে আসছে সেখানে! ওখানে নিয়ম শব দাহ না হওয়া পর্যন্ত পূজা হবে না। একদিন দুপুর গড়িয়ে বিকাল কিন্তু শবের দেখা নেই। সবাই অপেক্ষায়। পূজা না হলে প্রসাদ হবে কোত্থেকে? খাবার তো তার পরে! সন্ধ্যার দিকে যখন শব এলো, চিতায় আগুন জ্বললো, সবাই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলো। সেবার মামা মামী দুজনেই ছুটি নিয়ে আমাদের সাথে গেলেন গয়া, বুদ্ধ গয়া, কাশী। কাশীর রাজবাড়ির সূর্যঘড়ি দেখিয়ে মামা অনেক কথা বললেন। পরে ভাসমান সেতুর উপর দিয়ে হেঁটে গেলাম গঙ্গার অন্য পাড়ে যেখানে তুলসী দাসের মন্দিরে জীবন্ত পুতুলের নাচ আমাকে মুগ্ধ করলো।  
এরপর মা অনেক বার গেলেও আমার আর মায়ের সাথে ওদিকে যাওয়া হয়নি। স্কুল, বন্ধু বান্ধব এসব নিয়েই সময় কেটেছে। ১৯৮০ সালে এসএসসি পরীক্ষার পরে ওদিকটায় গেলেও মামার ওখানে গেছিলাম মাত্র এক দিনের জন্য। বাগান দেখে, গল্প করে সময় কেটে গেছে। মামীমা অনেক কিছু রান্না করলেও আমার যেটা পছন্দ সেটা যতটা না খাবার তার চেয়ে বেশি রিচুয়াল। মামা খুব ভালবাসতেন সকালে ঘি দিয়ে এক গ্লাস ভাতের মার খেতে। ব্যাপারটা আমারও পছন্দ হয়ে গেল। মামা বাড়ি গেলে আর যাই হোক না হোক ওটা আমার চাই চাই।

বহরমপুর শেষ যাই ১৯৮৯ সালে বাবার সাথে। ওটা ছিল আমার মাস্টার্স শেষ করার পরে। সেবার দেশে ছিলাম ১৪ সপ্তাহ, এর মধ্যে দিন পনেরোর জন্য ইন্ডিয়া যাওয়া। বহরমপুর গেছিলাম মাত্র এক দিনের জন্য। এখন আর কিছুতেই সময় বের করা যায়না কোথাও গিয়ে কিছু সময় কাটানোর। এর পরে ১৯৯৭ আর ২০১৪ সালে কোলকাতা গেলেও বহরমপুর পর্যন্ত যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তবে ইদানিং কালে ইন্টারনেটের কল্যাণে মাঝে মধ্যে যোগাযোগ হয়। দু’ চার মিনিট কথাও হয়। আসলে কথাটাও একটা আজব জিনিস। যাদের সাথে অনবরত কথা হচ্ছে তাদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলা যায়, যাদের সাথে যোগাযোগ তেমন নেই তাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে কথা খুঁজে পাওয়াও বিরাট ঝক্কি। এটাও সেই তেলে মাথায় তেল মাখার মত। মামার কাছে আমার নিজেরই বিভিন্ন প্রশ্ন থাকে তাঁদের, মার শৈশবের দিনকাল নিয়ে। মামীমার সাথে তেমনটা হয় না। হাতে ফোন ধরিয়ে দিলে বলতেন
- কিরে কেমন আছিস? মনে আছে তোর সেই ছোট বেলার কথা?
- থাকবে না কেন? সব মনে আছে। তুমি ভালো?
- এইতো। বুঝতেই তো পারিস, বয়স হয়েছে আমাদের দু জনেরই। বুড়বুড়ির সংসার। নে অন্যদের সাথে কথা বল। আর হ্যাঁ, এবার ইন্ডিয়া এলে এদিকে আসবি কিন্তু।

সে আর যাওয়া হল কোথায়? আমি নিশ্চয়ই আসব একদিন। তুমি তো সে অপেক্ষায় আর রইলে না। ভালো থেকো।

দুবনা, ০৭ জুলাই ২০১৯
                         



Comments

Popular posts from this blog

রাজনীতি

২৪ জুনের দিনলিপি

স্মৃতি