রিক্সা



সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় চীন দেশে ইঁদুর, মশা, মাছি ও চড়ুই নিধন যজ্ঞ চলে জনগণকে বোঝানো হয় প্রতি বছর চড়ুই যে পরিমান ফসল নষ্ট করে তা দিয়ে সাড়ে তিন কোটি মানুষ খাওয়ানো সম্ভব ফলে সাধারণ মানুষ পাখি নিধন যজ্ঞে মেতে ওঠে ১৯৫৮ সালের মার্চ আর এপ্রিল মাসের তিন দিনে প্রায় নয় লাখ পাখি ধ্বংস করা হয় সে বছর ফসলের ভাল উৎপাদন হলেও দেখা গেল ফরিং, ছ্যাঙ্গা এসব অসম্ভব রকম বেড়ে গেছে আর তারা ফসলের চারা নষ্ট করে ফেলছে পাখির ধ্বংসের ফলে পরিবেশ থেকে প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রক বিলোপ পেয়েছে  এ থেকে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে আসেন যে প্রকৃতির সমস্ত জীবমণ্ডল এক অদৃশ্য সূত্রে গাঁথা এই চক্রের কোন এক লিংক খোয়া গেলে পুরো চক্রটাই অকেজো হয়ে যায় সমাজও সেই রকমই একটা চক্র সমাজের ধনী, গরীব, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, কুলি, মজুর, ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ারসহ বিভিন্ন পেশার লোক একই চক্রে গাঁথা, একে অন্যের উপর বিভিন্ন ভাবে নির্ভরশীল ছোট বলে কাউকে বাদ দিলে পরিণতিতে সমাজটাই অচল হয়ে যেতে পারে, অন্তত যতদিন না বিকল্প ব্যবস্থা বের হচ্ছে সমাজ গড়ে উঠেছে যুগের পর যুগ ধরে, তাই রাতারাতি সব কিছু বদল করা যাবে সেটা ভাববার কারণ নেই   
দেশে এখন রিক্সা নিয়ে বিভিন্ন কথাবার্তা  চলছে কর্তা ব্যক্তিরা চাইছেন ঢাকা শহরকে সিঙ্গাপুর বা পৃথিবীর অন্যান্য শহরের মত করতে, যানজট কমাতে তার প্রথম পদক্ষেপ রিক্সা উচ্ছেদ কিন্তু মনে রাখা দরকার এসব শহর এক দিনে গড়ে ওঠেনি তাছাড়া ইউরোপ অ্যামেরিকার শহরগুলো শীতের কারণে রিক্সাবান্ধব নয় বাংলাদেশ বা এ এলাকার পরিবেশ খোলা গাড়ি তথা রিক্সা সহায়ক, তাই এখানে এসব গড়ে উঠেছে রিক্সা লাখ লাখ মানুষের কর্ম সংস্থান করেছে। তাই রিক্সা ওঠানোর আগে তাদের কর্ম সংস্থান করার কথা ভাবাটা প্রশাসনের লোকজনদের ভাবা দরকার। মেয়র বলছেন তাদের গ্রামে গিয়ে ধান কাটতে, কিন্তু সমস্যা হল এসব লোকজন গ্রামে কাজ নেই বলেই একদিন শহরে এসেছে। তাই গ্রামে গিয়ে ধান কাটার কথা বলা আসলে নিজেদের দায়িত্ব অস্বীকার করা, দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া। তাই এভাবে রিক্সা উচ্ছেদের আগে দরকার ছিল এসব মানুষের কর্ম সংস্থানের কথা ভাবা। কিন্তু গল্পটা এখানেই শেষ নয়। রিক্সা না চললে রিক্সার যাত্রীদের কি অবস্থা হবে? লাখ লাখ মানুষ যাদের প্রাইভেট কার নেই, রিক্সাই যাদের একমাত্র বাহন তারা চলবে কীভাবে? হাঁটবে? তা হাটার অবস্থা আছে আপনার শহরে? তাছাড়া আরও একটা কথা। বাংলাদেশের রাজনীতি তো অনেক আগে থেকেই ব্যবসায়ীদের দখলে। তাই এটা তাদের না বোঝার কারণ নেই যে বাজার অর্থনীতিতে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে চাহিদা। গ্রামে সাধারণ মানুষের শ্রমের চাহিদা নেই বলেই তারা শহরে আসে। শহরে রিক্সার চাহিদা আছে বলেই তারা শহরে টিকে আছে। শহরে কেন তাদের চাহিদা আছে? কারণ সেখানে পর্যাপ্ত পরিমানে পাবলিক ট্র্যান্সপোর্ট নেই। সেটা থাকলে মানুষ রিক্সা বা সিএনজি ব্যবহার করত না। তাই রিক্সা সরানোর আগে পাবলিক ট্র্যান্সপোর্ট বাড়ান তাহলে রিক্সার চাহিদা কমবে। তারপরেও যাতে গ্রামের মানুষ শহরমুখী না হয় সে জন্যে গ্রাম এলাকায় কাজের সুবিধা বাড়ান। নিজেরা সমস্যা সমাধানে কিছু করবেন না, শুধু মানুষের বেঁচে থাকার ন্যুনতম অধিকারটুকু কেঁড়ে নেবেন সেটা তো হয়না। আরও একটা কথা, যদি রিক্সা উঠিয়ে তার পরিবর্তে বাস সার্ভিস চালু করতেই চান, মনে রাখবেন পলিউশনে ডুবে থাকা ঢাকা শহরের পলিউশন এতে আরও বাড়বে বই কমবে না। আজ পৃথিবীর দেশে দেশে সবাই যেখানে পলিউশন থেকে রক্ষা পেতে ব্যস্ত আপনি কিন্তু সেটাকেই ডেকে আনছেন। শেকলের একটি লিংক ভাঙ্গা যত সোজা মনে হয় আসলে সেটা তত সোজা নয়।   সব শেষে আর একটা কথা। এই লোকগুলো আর যাই হোক, নিজের পরিশ্রমের পয়সায় বেঁচে থাকে, ভিক্ষে করে না, লুটপাট করে না, ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎ করে না, জনগনের টাকায় পোদ্দারি করে না। দেশে তো আজকাল সৎ লোকের এমনিতেই অভাব। মুখের গ্রাস কেঁড়ে নিলে এদের অনেকেই বাধ্য হবে অপরাধ করতে। অসৎ মানুষে ভরে গেছে দেশ। সেটা ষোল কলায় পূর্ণ না করলে কি একেবারেই চলবে না?   



দুবনা, ১২ জুলাই ২০১৯





Comments

Popular posts from this blog

রাজনীতি

২৪ জুনের দিনলিপি

স্মৃতি