বইয়ের খোঁজে বন্ধুর খোঁজে

                                               


আমরা কত কত নেশার কথা বলি। মদের নেশা। গাঁজার নেশা। কিন্তু কেউ বলে না মদ বা গাঁজা কারও হবি বা শখ। আবার একই ভাবে আমরা হবির কথা উঠলে বলে বই পড়া, ছবি তোলা, মাছমারা আরও কত কি? কিন্তু বইয়ের নেশা কি মদ গাঁজার চেয়ে কোন অংশে কম?
বই পড়ার নেশা সেই ছোটবেলা থেকেই। একটু সময় পেলেই বাড়ির সবাই যে যার মত একটা বই নিয়ে বসে পড়ত। কে জানে, তখন যদি স্মার্টফোন থাকত, বইয়ের জায়গা হয়তো দখল করে নিত এরাই। আমার ছেলেমেয়রা ছোটবেলায় অনেক বই পড়ত। কোথাও বেড়াতে গেলে ব্যাগ ভরে বই নিয়ে যেতে হত। নিজেরাই নিত। এখন যে পড়ে না, তা নয়, তবে পড়ে অনলাইন এবং সেটা সব সময় ক্ল্যাসিক সাহিত্য নয়। তার মানে কি বই পড়াও স্থান কালের উপর নির্ভরশীল? 

সব কিছুর মতই পড়াটাও মনে হয় বইয়ের সহজলভ্যতার উপর নির্ভর করে। পড়া ঠিক নয়, পড়ার আবেগ, পড়ার জন্য ব্যাকুলতা। দেশে থাকতে যেহেতু বইয়ের অভাব বোধ করিনি সেটা ততটা জানা ছিল না। তবে পড়ার ব্যাপারে আমি বরাবরই ছিলাম সিলেক্টিভ, সব বই পড়তাম না। ডিটেকটিভ কখনই টানত না। পড়তে পছন্দ করতাম জীবনী, ইতিহাস, বিশ্ব সাহিত্যের নামকরা লেখকদের রচনা, তাই প্রায়ই বই আনাতে হত অর্ডার দিয়ে। তবে দুদিন আগে হোক, দুদিন পরে হোক, ঠিক হাতে পেয়ে যেতাম। কিন্তু মস্কো আসার পর বই, বিশেষ করে বাংলা বই হয়ে উঠলো অমাবস্যার চাঁদের মত। রুশ বই তখনও ঠিক পড়তে পারি না, ইংরেজি খুব যে ভালো জানি তা   তো নয় আর ইংরেজি বইও তেমনটা পাওয়া যেত না। তবে ছাত্র জীবনের শেষের দিকে এসে সাহিত্যের পুরনো বইয়ের দোকান খুঁজে পাই। আগে শুধুই কিনতাম নিজের সাবজেক্টের মানে পদার্থবিদ্যা আর গণিতের বই। এই দোকানের ফলে কাম্যু, কাফকা, সারত্রে, টমাস মান, হেরম্যান হেসে, হেমিংওয়ে, বাক, ফকনার, স্টেনবারগ, মারকেজ সহ অনেক লেখকের কয়েক শ বইয়ের (ইংরেজিতে) কালেকশন তৈরি হয়। আর দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়, চেখভ, পুশকিন, সলঝেনিতসিন, পাস্তেরনাক সহ বিভিন্ন রুশ লেখক তো আছেই। যখন নিজের ছেলেমেয়ে হল, সে সাথে যোগ হল শেলফের পর শেলফ ভর্তি ছোটদের বই। ছোটবেলায় ওদের এসব বই পড়ে শোনাতে শোনাতে নিজে উসপেনস্কি, বারতো, নোসভ, চুকভস্কি, মারশক ইত্যাদি লেখকের ভক্ত হয়ে গেছিলাম। তবে ছাত্রজীবনে সব সময়ই অপেক্ষা করতাম বাংলা বইয়ের, বাংলা পত্রিকার। মঙ্গলার যখন একতা আসত, ঘুম থেকে উঠেই ছুটতাম সেই পত্রিকার জন্য।

গ্রীষ্মের ছুটিতে কেউ না কেউ দেশে বেড়াতে যেত। দেশের খাবারের সাথে সাথে আসত বাংলা গানের ক্যাসেট আর বাংলা বই। দেশে সিগারেটখোররা যেমন এক টান, দু’টান পরেই সিগারেট বুকিং দেয়, আমরাও তেমনই নতুন বই এলেই বুকিং দিতাম। কখনও কখনও মাসের পর মাস কেটে যেত বইটা হাতে পেতে। মিন্টু দা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের «সেই সময়» আর «পূর্ব পশ্চিম» যখন মস্কো নিয়ে এলো – সময় যেন কিছুতেই কাটতে চায় না। কত হাত ঘুরে যে বইগুলো আমার কাছে এসেছিলো তার হিসেব রাখাই দুষ্কর। আমাদের বইয়ের গোডাউন ছিল দ্বিজেন কাকুর (শর্মা) বাসা। সেখানে কত যে বই ছিল কে জানে। আমি তখনও ও দিকে খুব একটা যেতাম না। তাই কাকুর প্রিয়ভাজন কেউ (তপু, সুস্মি) গেলে ওদের দিয়ে আনিয়ে পড়তাম। ন হন্যতে, হাজার চুরাশির মা, চিলেকঠার সেপাই, পদ্মা নদীর মাঝি, পুতুল নাচের ইতিকথা, পথের পাঁচালী – এরকম কত বই যে হাতে হাতে ঘুরত! তখন আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতাম। এসব বইয়ের তাই ব্যক্তি মালিকানা বলতে কিছু ছিল না। পড়া হলেই বইটা অন্যের কাছে পৌঁছে দেওয়া হত। একসাথে বই পড়া, এক সাথে গান শোনা – এসব শুধু আমাদের পড়াশোনাতেই উসাহী করত না, গড়ে উঠত বন্ধুত্ব। প্রেম ভালোবাসার ভাঙ্গা গড়াও চলত বইয়ের মাধ্যমে। চাইলে প্রিয় মানুষকে কোন বই পড়তে দিয়ে সেখনে যেন বা ভুল করেই একটা চিরকুট ঢুকিয়ে দেওয়া যেত।

সে সময় বই কেনার আরও দুটো জায়গা ছিল – একটা প্রগতি প্রকাশন – কোন বইয়ের বাংলা অনুবাদ বেরুলেই সবাই ছুটত
জুবভস্কি  বুলভারে প্রগতির শো রুমে। অনেক সময় হতাশ হয়ে ফিরে আসতাম। বইয়ের সংখ্যা ছিল সীমিত আর আমরা ছিলাম কয়েক শ। এছাড়া মাঝে মধ্যে বই মেলায় আসত বাংলা বই। সেখানেও যেতাম বাংলা বইয়ের খোঁজে। আশির দশকের মস্কোয় বাংলা বই ছিল  বইয়ের চেয়েও বেশি কিছু। বই ছিল প্রেম, ছিল নেশা, ছিল কবুতর যে প্রেম পত্র নিয়ে যেত প্রিয়ার কাছে। বই ছিল জীবন। এখন সেই দেশ, সেই সময় – কিছুই আর নেই। প্রিয়ারা, বন্ধুরা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তবে বই ঠিক আগের মতই আছে। এখনও দিনের কাজের শেষে রাতের গভীরে বই না পড়লে ঘুম কিছুতেই চোখে আসে না। পদার্থবিদ্যা, ফটোগ্রাফিসহ আরও দু একটা শখের মতই বইও হয়েছে উঠেছে জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ – জীবনের অক্সিজেন।    

অনেকেই জানতে চান কী হয় এত বই পড়ে? কঠিন প্রশ্ন। কিছু কিছু বই কখন কোথায় পড়েছি সেটাও মনে আছে। যেমন ১৯৯০ সালে ইস্তাম্বুল যাবার পথে ট্রেনে পড়েছিলাম পথের পাচালী। বলতে গেলে সেটাই আমাকে এই দীর্ঘ ভ্রমনের ক্লান্তি থেকে দূরে রেখেছিল। ১৯৯২ সালে কৃষ্ণ সাগরের ধারে ইয়াল্টার বীচে বসে ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী পড়ে নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলাম কিউবার সমুদ্র তীরে। দস্তয়েভস্কির সাদা রাত পড়ার পরে যখন ১৯৮৯ সালের গ্রীষ্মে গেলাম লেনিনগ্রাদ, শ্বেত রাত্রে নেভা নদীর তীরে বসে মনে হচ্ছিল এই বুঝি নাস্তেঙ্কা বেরিয়ে আসবে তার ভালবাসার মানুষের হাত ধরে। অথবা ১৯৯২ সালে যুদ্ধ শান্তি পড়তে পড়তে চলে গেছিলাম নতুন মেট্রো অত্রাদনায়া যদি হঠাৎ নাতাশা রস্তোভার দেখা মেলে। হ্যাঁ, বই আমাদের সময়ের গণ্ডী পেরিয়ে নিয়ে যেতে পারে কী অতীতে কী ভবিষ্যতে। অনবরত এত বই পড়ার পরের হাতে গণা কিছুমাত্র বইয়ের কিছু কথা আমার মনে গেঁথে গেছে। যেমন গীতার «ফলের চিন্তা না করে কাজ করে যাও» যা আমার ইন্টারপ্রেশনে «ফলের কথা না ভেবে কাজ, কাজের প্রক্রিয়াকে উপভোগ কর» অথবা গোরকির «সবার কথা শুনবে, কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবে নিজে», রবি ঠাকুরের «যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে» বা দস্তয়েভস্কির «কেউ তোমাকে ভালবাসল কিনা তাতে নয়, অন্যকে ভালবাসার মধ্যেই সুখ» তার মানে কি সারা জীবন এই যে এত্ত এত্ত বই পড়া সবই বৃথা? মোটেই না, এসব পড়েছিলাম বলেই আজ লিখতে পারছি। পড়ার আনন্দ অন্যদের সাথে ভাগ করে নিতে পারছি। বই পড়ার সাথে সাথে আমরা যদি নিজেদের কল্পনা শক্তি কাজে লাগাতে পারি তাহলে আমাদের মন পায় মুক্তির সন্ধান। অন্ধভাবে বইয়ের লেখায় বিশ্বাস আমাদের মনকে যেমন অন্ধকার কারাগারে নিক্ষেপ করে, মুক্ত মন নিয়ে পড়াশুনা করলে আমরা পাই সত্যিকারের স্বাধীনতার আস্বাদ। আর কারণেই আমরা সেই আশির দশকেও মস্কোর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে যেতাম বইয়ের সন্ধানে। এখন আমরা যাই দেশ বিদেশের গণ্ডী পেরিয়ে বইয়ের হাটে বইয়ের খোঁজে, জ্ঞানের খোঁজে, শান্তির খোঁজে।

 

দুবনা, ১৯ জুন ২০২১      

 

লেখাটি পড়ুয়া - র দ্বিতীয় সংখ্যায় ১৬ জুলাই ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়েছে। পৃষ্ঠা ৬১ - ৬৩  
পড়ুয়া, বর্ষ ০১,
সংখ্যা ০২, জুলাই ২০২১, পৃষ্ঠা ৬১ - ৬৩


 


Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা