সোভিয়েত নারীর দেশ ও এক লিপির গল্প

 


কয়েকদিন আগে সুপ্রীতি ধর লিপির “সোভিয়েত নারীর দেশে” বইটা পড়া শেষ করলাম। বইয়ের নাম সম্পর্কে ও নিজেই লিখেছে। আমিও দু’ কলম লিখছি সেটার সমর্থনে। আমি যখন এ দেশে আসি, অবাক হয়ে দেখি চারিদিকে শুধু নারী আর নারী – হাসপাতালে, দোকানে, ক্যান্টিনে, ক্লাসে – কোথায় নেই তারা? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুরুষদের এক বিরাট অংশ হারিয়ে গেছে যুদ্ধ ক্ষেত্রে। শুধু কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেই? সেই বিপ্লবের পর থেকে একের পর এক নেমে এসেছে কঠিন সব পরীক্ষা আর এসব পরীক্ষার প্রথম শিকার হয়েছে এদেশের পুরুষ। ফলে বরাবরই দেশ গড়ার কঠিন দায়িত্ব পড়েছে মেয়েদের কাঁধে। যুদ্ধ – এটা তো শুধু ফ্রন্ট লাইনে যুদ্ধ নয়, যোদ্ধাদের সময় মত রসদ সরবরাহ করা, মানে সাপ্লাই মেশিন চালু রাখা, এটা কে করেছে? হ্যাঁ সোভিয়েত নারীরা। তাই বলা চলে বিপ্লবের পর থেকে এদেশের নারীরাই দেশ গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে আর তাইতো সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অবাধ বিচরণ। সেদিক থেকে সোভিয়েত নারীর দেশে নামটি নিঃসন্দেহে ফিটিং।

এর আগেও অনেকেই তাদের সোভিয়েত জীবন নিয়ে লিখেছে
– দ্বিজেন কাকু,  খুররম ভাই, শাহাব, ববি আরও অনেকে। লিখেছে শাহীন তার মূলত সোভিয়েত পরবর্তী অভিজ্ঞতার কথা। আর সবারই নিজ নিজ অভিজ্ঞতা। তলস্তয় আন্না কারেনিনায় বলেছেন «Все счастливые семьи похожи друг на друга, каждая несчастливая семья несчастна по-своему», মানে সব সুখী পরিবার দেখতে একই রকম, তবে অসুখী পরিবার নিজের নিজের মত অসুখী। হ্যাঁ, এসব লেখায় আমরা দেখি কমবেশি সবাই আমরা একইভাবে সময় কাটিয়েছি – পড়াশুনা করে, আড্ডা দিয়ে, সিনেমা থিয়েটার দেখে, হই হুল্লোড় করে। আর সেটা আমরা প্রায় সব শহরের একইভাবে করেছি। কী বড়, কী ছোট – সব শহরেই আমাদের এই সুখের চিত্রও ছিল কমবেশি একই রকম। এটা ছিল আমাদের সমষ্টি জীবন। কিন্তু যখনই ব্যক্তি জীবনে এসেছি – দেখা যায় এই কালেকটিভ সুখের মধ্যেও আমাদের প্রায় সবারই ব্যক্তিগত দুঃখ ছিল আর সেই দুঃখটা ছিল একে জনের একেক রকম।         

আমরা যারা মস্কোয় ছিলাম, বড় ভাইবোনদের আদর যত্নে দেশের জন্য মন খারাপ হওয়া ঠিক ততটা প্রলম্বিত হত না, যদিও তা পরে ফিরে আসত। কিন্তু যারা বাইরের শহরে যেত, তারা দেশ ত্যাগের শক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ত। কোন শহরে তাকে পাঠানো হবে এটা ছিল তার জন্য মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন। ইতিমধ্যে মস্কোর বড় ভাইবোনদের পেয়ে তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, খুব অল্প সময়ের মধ্যে তারা একে অন্যেকে আপন করে নিয়েছে। এখানে বলা দরকার, নতুন আসা ছেলেমেয়েরা যেমন অভাবিত ভাবেই বাংলাদেশিদের পেয়ে হাতে চাঁদ পায়, একই ঘটনা ঘটে বড়দের সাথেও। তারাও তো অপেক্ষা করে থাকে নতুন মুখের জন্য, দেশের নতুন খবরের জন্য। তাই খুব তাড়াতাড়িই তারা একে অন্যের বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। অনেকেই পরেও সেটা ধরে রাখে চিঠিপত্র আদানপ্রদানের মাধ্যমে। কত ছেলেমেয়ে যে মস্কোয় থেকে যাওয়ার জন্য অনুনয় বিনয় করেছে তার শেষ নেই। অল সোভিয়েতের সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য হিসেবে সেটা দেখেছি। তাই মস্কো আসার পর মস্কোর বড়রা তাদের আপন করে নেবার পরেও যখন আবার শুরু হত নতুন যাত্রা সেটা অনেকটা সেই দেশ থেকে বিদায় নিয়ে আসার মতই। এটাও লিপি সহ অনেকের লেখাতেই উঠে এসেছে। তবে এটাও ঠিক মস্কোয় অনেক বাংলাদেশি থাকার ফলে আমরা বিদেশীদের জানার, তাদের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগটা আড্ডা দিয়ে নষ্ট করেছি। ছোট শহরে যারা থাকত তারা সেই সুযোগ প্রায়ই ভালভাবে কাজে লাগিয়েছে। অন্তত এসব লেখা দেখে সেটাই মনে হয়। এটা নিঃসন্দেহে মানুষের নিজের উপরে নির্ভর করে, তবে পরিবেশ অনেক কিছুই ঠিক করে দেয়। এমনকি গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধুমাত্র পদার্থবিদ্যায় পড়াশুনা করার ফলে আমার বিদেশি বন্ধুদের সাথে যতটা মেলামেশা হয়েছে, মেডিসিন বা ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টিতে যারা পড়াশুনা করত তাদের অধিকাংশই মূলত নিজেদের মধ্যে মিলেমিশেই দিন কাটিয়েছে। তাই বাইরের শহর খুব যে খারাপ কিছু ছিল তা নয়। তবে এটাও ঠিক মস্কো বসে এভাবে বললেও ওখানে থেকে কী অনুভব করতাম বলা কষ্ট। সেই সময়ে যখন আমাদের বয়স ছিল বিশ ছুঁই ছুঁই, তখন এটা নিঃসন্দেহে কঠিন ছিল, তবে এখন পেছন ফিরে তাকালে প্রায় সবাই বলবেন তাদের সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম শহর ততটা খারাপ ছিল না।

দ্বিজেন কাকুর দুটো বইয়ে (সমাজতন্ত্রে বসবাস ও জীবন স্মৃতি) আমার নামটা কেমন কেমন করে যেন ঢুকে গেছে, ববিও ওর বইয়ে আমার উল্লেখ করেছে। শাহীন তার অপ্রকাশিত বইয়েও আমাকে কায়দা করে ঢুকিয়ে দিয়েছে। লিপিও দেখলাম বেশ কয়েকবার ঘুরে ফিরে আমার কথা বলেছে। পাগলামির কারণেই এসব হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। কিছু কিছু লোকজন ভালো পাগল হতে পারে – ওদের বইয়ে আমার উপস্থিতি সেটাই প্রমাণ করে। আলোময় দার ভাগ্নি বিধায় ও আসার পরপরই আমার সাথে আলাপ। যদি ভুল না করি আমিই ওকে ট্রেনে তুলে দিয়েছিলাম, অথবা এটাও হতে পারে আমাকে সেটা করতে বলা হয়েছিল আর আমি বরাবরের মতই কোন কাজের অজুহাতে সেটা করিনি। এরপর বেশ কয়েকবার দেখা। বন্ধুত্ব যতটুকু হয়েছে তারচেয়ে বেশি হয়েছে শত্রুতা। আসলে আমার সব বন্ধুরাই কমবেশি আমার শত্রু, তাই এ নিয়ে ওদের মাথা ব্যথার কারণ নেই। আমি অনেককেই প্রায়ই চিরকুট লিখতাম, লিপির জন্যে চিরকুটের সাথে থাকত কাঁচা হাতে আঁকা কিছু ছবি। অনেক কিছুই লিখতাম – হেয়ালি করে। “তুমি তোমার কষ্টের কষ্টিপাথর নিয়েই থাক” সেটা ছিল নেহায়েত শব্দ নিয়ে খেলা। তখন যদি জানতাম, ভালো কিছু লিখতাম।

 ১৯৮৯ সালে  আমি মাস্টার্স থিসিস ডিফেণ্ড করে যখন লেনিনগ্রাদ যাই লিপি তখন মস্কোয়। সেটা আমি ভালো করেই জানতাম। একসাথে আড্ডা দিয়েছি। এসব জেনেও ওর হোস্টেলে গেছিলাম। ও নিয়ে লিপির প্রশ্ন ছিল “এটাই কি প্রেম?” না লিপি, এটা প্রেম নয়। তোমাদের সাথে ভালো ভাবে পরিচয় হওয়ার আগেই আমি একটা ছবির প্রেমে পড়েছিলাম। ছবি যে এতো ছোট হতে পারে আর এমন ভাবে আজীবন হৃদয় জুড়ে থাকতে পারে – সেটা জানা ছিল না। এখন পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় সেটাও প্রেম নয়, এক ধরণের ভ্রম। আর এ কারণেই হয়তো ছবির মানুষটা ছবিই থেকে গেছে আজীবন। ছবিকে ভালবাসা যায়, তবে তার সাথে কথা বলা যায় না, মনের ভাব আদানপ্রদান করা যায় না। এটা একদিক দিয়ে ভালো। আমরা আমাদের
উদাসীনতা দিয়ে একে অন্যের থেকে দূরে সরে থাকি। তবে এটাও ঠিক, বলার তো কিছুই নেই। কথা বলতে হলে তাই কথা খুঁজতে হত যেটা আমার ধাঁতে সয় না, তাই কথা হত নাকি কথা বন্ধ হত সেটা ছিল ভাবনার বিষয়। আর তাই হাই- হ্যালোটাও আজকাল আর বলা হয় না। 

সব সময় দেখা না হলেও লিপির খবরাখবর প্রায়ই পেতাম। আমাদের অনেক কমন বন্ধু বান্ধবী ছিল, অথবা বলা যায় একই
সার্কেলে আমাদের ঘোরাফেরা ছিল। ঠাট্টা করে অনেকে বলত ঠাকুর বাড়ি। ওরা ঠাকুর ছিল, আমি? আউটসাইডার – বহিরাগত। নেহেরু সহ অন্যান্য উচ্চবর্ণের মানুষের মাঝে আম্বেদকারের মত, যদিও আমার জন্য নিজেকে আম্বেদকারের সাথে তুলনা করা ধৃষ্টতা। তবে খুব костлявый মানে কাঁটাওয়ালা, তাই না পারত গিলতে না পারত ফেলতে। এত বছর পরেও সেই অবস্থার কোনই পরিবর্তন হয়নি।

সোভিয়েত ইউনিয়নে বাংলাদেশি মেয়েদের দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হত আর এত বেশি ছেলে সেই কাজে ব্যস্ত থাকত যে খুঁজে পেলেও লাভের চেয়ে লোকসানই হত বেশি। এটাও একটা কারণ লিপি সহ অন্যান্য বাংলাদেশি মেয়েদের সম্পর্কে খবর রাখার। এমনকি না চাইলেও সব খবরই কানে আসত, কেননা কোন আড্ডাই মেয়েদের প্রসঙ্গ বাইপাস করে এগুতে পারত না। সংখ্যায় অল্প বলেই হয়তো বাংলাদেশি মেয়েরা আমাদের আড্ডায় বিশাল যানজট তৈরি করত যা থেকে বেরুনো চাট্টিখানি কথা নয়। তবে যখন থেকে পেরেস্ত্রইকার সুযোগ নিয়ে ছাত্ররা ব্যবসায়ীর বেশ পরতে শুরু করল, আড্ডাগুলো আর আগের মত রইলো না। মন খুলে গল্পের জায়গা দখল করল রাস্পুতিন, আবসলিউট, স্মিরনভ, নেপোলিয়ন এসব পানীয়। এর মধ্যে আমার ছবিটাও পাচার হয়ে গেল ভিন দেশে, ফলে লিপির সাথে যোগাযোগ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে শুরু করল। এরপর শুনলাম ওর দেশে যাবার আর বিয়ে করার কথালিপি নিজে যেটাকে বলেছে দুঃখের জীবনের শুরু। আমি কি অবাক হয়েছিলাম?  আমি নিজে আজীবন এত সব ওলটপালট কাজ করি যে অন্যেরা করলে মোটেই অবাক হই না। সালটা ঠিক মনে নেই, একদিন লিপি এল কোলে ছোট্ট এক বাচ্চা নিয়ে। নাম তার সীমন্তিনী। সাথে ছিল ওর বর। তবে সেই বর কতটুকু বর আর কতটুকু শাপসেটা শুধু লিপিই বলতে পারবে। আমি বরাবরই চালচুলো বিহীন মানুষ। যাহোক কিছু একটা রান্না হয়েছিল, মনে হয় লিপিই করেছিল। সত্যি বলতে ওর বরকে একেবারেই মনে নেই। সেটা মনে হয় জন্যেই যে আমাদের কোন কমন ইন্টারেস্ট ছিল না। আমি বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে পারি, তাই খুব কমই কারও সাথে কথা চালিয়ে যেতে অসুবিধা হয়। যেহেতু লিপির বরকে মনে করতে পারছি না, মনে হয় কারণ একটাই – বলার মত কমন কিছু ছিল না কোন কারণে আমাদের মধ্যে হাই হ্যালোর বাইরে কোন কথা হয়নি। এরপর আর কখনই ওর সাথে দেখা হয়নি। পরে এক বাবা দিবসে ফেসবুকে সীমন্তিনীর লেখা দেখে বুঝেছি – সব কিছুর পরেও সন্তানের কাছে বাবা বাবাই, মা মাই। আমরা বড়রা অনেক সময় সেটা বুঝতে চাইনা। নিজেদের ভাবনাটাই ছেলেমেয়েদের জন্য সঠিক বলে ভাবি। আমার ছেলেমেয়েরা সেই ভার মুক্ত। জানি না সেটা ওদের জন্য জীবনে কী বয়ে আনবে। তবে স্বাধীনতার জন্য অনেক কিছুই ত্যাগ করত হয়।  

মস্কো বা সোভিয়েত ইউনিয়নে যারা পড়াশুনা করেছেন তাদের লেখার উপর লিখতে গেলে সেটা বইয়ের সমালোচনা থাকে না, সেটা হয় বইয়ের সঙ্গে বসবাস করতে গিয়ে নিজের জীবনটাও ফিরে দেখা। তাই অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা এখানে উঠে আসে। মনে পড়ে ১৯৮৯ সামারেই লিপির সাথে আমার অথবা আমার সাথে লিপির মস্কো ঘুরে বেড়ানোর কথা। আমাদের আড্ডার জায়গা ছিল বিভিন্ন। আমার ঘর, প্লেখানভ বা অন্য কোন হোস্টেল। আমার ঘরেই কফি খেয়ে কত সময় যে পার করে দিয়েছি!  আবার কখনও হুট করেই চলে গেছি প্লেখানভেলিপি ওর বান্ধবীর কাছে, আমি ছবির খোঁজে। অপু, রুমা, তপু, ইভান অনেকেই যোগ দিয়েছে আমাদের সাথে বা আমরা নিজেরাই যোগ দিয়েছি ওদের সাথে। কখনও কখনও লেনিনগ্রাদ থেকে পল্লব আর কেশব এসে আমাদের দল ভারী করেছে।

সময়টা ছিল ভাঙ্গা গড়ার। দেশটা ভাঙছিল, ভাঙছিল মানুষের কপাল। প্রেম। ভালবাসা। বন্ধুত্ব। আর এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই গড়ে উঠছিল অট্টালিকা। কিছু কিছু মানুষ রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে বটগাছ হয়ে যাচ্ছিল। সব মানুষই ছিল দিকভ্রান্ত। কেউ দীর্ঘ দিনের বিশ্বাস হারিয়ে হতাশায় ভুগছিল, কেউবা পুরানো বিশ্বাস বিসর্জন নিয়ে নতুন  বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ করছিল। চারিদিকে ছিল বিশ্বাসের অভাব। অধিকাংশ মানুষ কে কাকে ঠকাবে সেই প্রতিযোগিতায় নেমেছিল। একাত্তরে তবুও শত্রু মিত্র চেনা যেত, এখানে সে সুযোগ ছিল না। দু পয়সা বেশি লাভের জন্য একজন আরেকজনকে নির্দ্বিধায় পরিত্যাগ করত। সারা দেশটাই ছিল এমন। গতিহারা, দিশেহারা, নেতৃত্বহারা। যে দেশের মানুষ দীর্ঘ সময় নিজের কথা ভাবেনি, যে দেশে পার্টি ঠিক করেছে কে কি পরবে, কি খাবেএক সকালে হঠাৎ তারা দেখল সেই চোখ, সেই হাত উধাও হয়ে গেছে। জিনিস পত্রের মূল্য  যা ছিল ধ্রুব তারার মত সত্য তা সবাইকে অবাক করে, হতাশ করে পাহাড় চুড়ায় ওঠে গেছে। চারিদিকে নাকি তখন টাকা উড়ত। কিন্তু এত বেশি মানুষ সেই উড়ন্ত টাকার পেছনে ছুটত যে খুব কম লোকের ভাগ্যেই সেটা জুটত। আদর্শ হারানো মানুষ আর্থিক ভাবেও নিঃস্ব হতে শুরু করে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে অমূল্য জীবন হয় মূল্যহীন। 

 

অন্যদেশের ছেলেমেয়েদের কথা বলতে পারব না তবে সোভিয়েত জীবন ছিল অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের দেশে ফেলে আসা জীবনের মত। দেশেও আমরা একসাথে হৈ হুল্লোড় করতে পছন্দ করতাম। চায়ের দোকানে গিয়ে কেউ একজন অন্যদের খাওয়াতাম। মানে এক ধরণের কালেক্টিভ লাইফ কমবেশি সবার ছিল। সোভিয়েত জীবনেও কোন ঘরে এক সাথে খাওয়া দাওয়া করা, আড্ডা দেওয়া এসব আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি হওয়ায় আমাদের কালেক্টিভ লাইফ ছিল আনন্দের। তবে আগেই যেমন বলেছি ব্যক্তিগত জীবন ছিল একেজনের একেক রকম। প্রেমে বিরহে আনন্দে বেদনায় ভরা। বিশেষ করে বাঙালিদের মধ্যে প্রেম ঘটতো সবার অংশগ্রহণে, হৈ হুল্লোড় করে। একসাথে রান্না, ঘোরাফেরা কত কী!  কিন্তু প্রেম যখন ভাঙত হাতাশায় ভুগত শুধু নায়ক নায়িকারা। এখানে ইচ্ছা অনিচ্ছায় বন্ধুদের বসন্তের কোকিল সাজতে হত। কিন্তু যখন আমরা ব্যবসায়ী হলাম, প্রাইভেট প্রোপার্টির ধারণা দৃঢ় হল তখন আমাদের কালেক্টিভ লাইফ আর আগের মত রইলো না। সেই সাথে অনেকের সামনে এল অস্তিত্বের সংগ্রাম। আগে কেউ স্টাইপেন্ডের টাকায় চললে তাকে হিরো ভাবা হত। নতুন বাস্তবতায় সে সবার চোখে বোকা বলে সাব্যস্ত হতে শুরু করল। এক কথায় দেশের সাথে সাথে মানুষের মনমানসিকতা এতটাই বদলে গেল যে সেটাও এক ধরণের হতাশার জন্ম দিল। মানুষ যখন চাকরি করে বা দীর্ঘ দিন কাজ করে টাকা পয়সা উপার্জন করে তার ব্যবহার হয় এক রকম আর সে যখন হুট করে অনেক টাকার মালিক হয় তার ব্যবহারও দ্রুত বদলে যায়। সব মিলিয়ে ১৯৯১ সালে প্রতিবিপ্লব শুধু রাশিয়াতেই নয়, মানুষের আদর্শে, মানসিকতায় সব ক্ষেত্রেই ঘটেছিল।   

লিপির বইয়ে সোভিয়েত পরবর্তী জীবনের কথা আছে, তবে তত বিস্তারিত নয়। অনেক দিন কারও সাথে কোন যোগাযোগ না থাকলেও মোটামুটি ২০১০ থেকে অনেকের সাথেই যোগাযোগ গড়ে ওঠে। কারও সাথে সেটা এখনও এগিয়ে যাচ্ছে, ভাঙছে অনেকের সাথেই। জীবনে বিভিন্ন চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে গিয়ে একটা উপলব্ধি এসেছে সেটা হল কারও সাথে যদি আমার না পড়ে সে জন্য তাকে খারাপ মানুষ হতে হবে না। তেলে জলে যায় না, যদিও কী তেল কী জল কেউই খারাপ নয়। সবার সাথে আমার পথ এক হবে না সেটা মেনে নিয়েই সামনে যেতে হবে আর কারও সাথে আমার সম্পর্কের উপর যদি অন্য কোন মানুষের ভালমন্দ জড়িয়ে থাকে চেষ্টা করতে হবে সেই সম্পর্কটার একটা চলনসই রূপ দিতে। আমার ভালো লাগা মন্দ লাগা যেন তাদের কষ্ট না দেয় যাদের ভাগ্য আমার কারণে এই সম্পর্কের কাছে জিম্মি হয়ে আছে।   

এরপর লিপির সাথে দেখা ২০১১ সালে দেশে বেড়াতে গেলে। অল্প সময়ের জন্য, তবে আন্তরিকতার অভাব ছিল না। এখন ছাত্রজীবনের সেই মুক্ত বিহঙ্গ আমরা আর কেউই নই। সমাজ, সংসার, ছেলেমেয়ে কত দায়িত্ব! দেখা হল আবার পিকনিকে আর আমার ছবি প্রদর্শনীতে। ফেসবুকে মাঝে মধ্যে হাই হ্যালো হত। এরপর একদিন দেখি লিপির পোস্ট আমি শাহবাগ যাচ্ছি, তোমরা চলে এস। শুরু হল নতুন জীবন। লিপি এখন রাস্তা কাঁপানো এক্টিভিস্ট। শাহবাগ মুক্তমঞ্চের প্রথম সারির মুখ। এরপর একে একে আসবে হুমকি, সাফল্য। সোভিয়েত ফেরত অনেকেই অনেক বড় বড় চাকরি করছে, গাড়ি বাড়ি ধন দৌলত করেছে অনেকেই, তবে লিপির মত সব ছেড়ে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছে কজন? এটা ভালো বা মন্দের কিছু নয়। এটা বাস্তবতা। ওর জনপ্রিয়তা, ওর দেশপ্রেম, নারীদের জন্য ওর লড়াই এটাকে অনেকেই ঈর্ষা করতে পারত। আমি কি করি? না। কেন? আমার মনে হয় ঈর্ষা না করাটাই সবচেয়ে বেশি ঈর্ষনীয়। রুশীরা বলে বিপ্লব তার সন্তানদের হত্যা করে। শাহবাগের অনেকের সাথেই সেটা ঘটেছে। লিপিও ব্যতিক্রম নয়। তারপরেও থেমে থাকেনি। এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নারীদের সমান অধিকারের দাবি। এত সাফল্যের মধ্যেও মাঝে মাঝে ওর হাতাশা আমাদের বিচলিত করে। সাফল্য ব্যাপারটা আসলেই খুব গোলমেলে। রবি ঠাকুরের ভাষায় যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না।” এই যে নারীর জন্য, নারী অধিকারের জন্য এত সংগ্রাম, লিপির অনেক লেখায় মনে হয় সেই নারীত্বকেই যেন ও হারিয়ে ফেলেছে। রাতকে বাদ দিয়ে যেমন দিনকে বোঝা যায় না, পুরুষকে বাদ দিয়ে তেমনি নারী অস্তিত্ব বোঝা যায় না। এরা পরস্পরের শত্রু নয়, সম্পূরক। লিপির পরিচিত অনেক পুরুষ আছে যাদের নিয়ে তাদের বউরা, যাদের অনেকেই লিপির বান্ধবী, দিব্যি সুখে আছে, সুখে সংসার করছে, শুধু সুখেই নয়, সম্মানের সাথে সংসার করছে। আসলে আমরা অনেক সময়ই নিজেদের ভুল সিদ্ধান্তকে পুরো সমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে খুশি  হই। যদিও আন্দোলনের বাইরে নয়, তবুও বাইরে থাকার ফলে এখন ওর সময় আছে অতীতের পৃষ্ঠাগুলো নতুন করে উল্টিয়ে দেখার। বোঝার - কোথায়, কোন বাঁকে ভুল ছিল। আর যে বা যাদের কারণে সেটা হয়েছে তাদের ক্ষমা করার। কারণ যতদিন মনে ক্ষোভ থাকবে ততদিন সেই অতীত, সেই দিনগুলো বিভীষিকার মত ওকে তাড়িয়ে বেড়াবে। আর ক্ষমা করলে নতুন করে জীবন শুরু করা যাবে। হয়তো সে জীবন স্বপ্নে দেখা জীবনের মত হবে না, তবে সেটা হবে শান্তির, আনন্দের, স্বাধীন জীবন – হ্যাঁ নিজের এগোর থেকে মুক্তি পাওয়া জীবন। অনেকদিন পরে সোভিয়েত বাস্তবতায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। অনেক অনেক শুভকামনা লিপি।

দুবনা, ২৮ জুলাই ২০২১ 

 


 

 

 

 

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা