আর প্রতিবাদ নয় এবার চাই প্রতিরোধ

 


পূজায় তাণ্ডব নিয়ে যেসব পোস্ট চোখে পড়ল তার প্রায় সবগুলোতেই সংখ্যালঘুদের কথা বলা হয়েছে, বলা হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর আক্রমণের কথা। তাতে ক্ষোভ আছে, আছে সমবেদনা, আছে সহমর্মিতা। তবে একটা জিনিসের অভাব চোখে পড়ার মত। কেউ বলছে না যে আক্রমণ হয়েছে মানুষের উপর, পরাজিত হয়েছে মানবতা। লঙ্ঘিত হয়েছে মানুষের নাগরিক অধিকার। কেন? তাহলে কি বুঝতে হবে হিন্দু মরলে মুসলমান হিসেবে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি, মানুষ মরলে মানুষ হিসেবে সেটা পারি না? আর তাই ঐক্য নয় বিভেদের মাধ্যমে আমরা ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছি? 
 
অনেকেই কালো প্রোফাইল ব্যবহার করছেন। আমি করিনি। অনেকেই প্রতিবাদস্বরূপ কেন পূজা বন্ধ করা হল না সেটা জানতে চাইছেন। আমি করিনি। কেন? মৌলবাদ আমার শত্রু। আমি আমার হাসিমুখ দেখিয়ে, ভাল থেকে শত্রুর আনন্দ একটু হলেও মাটি করতে চাই। ওরা তো এ দেশ থেকে পূজা নির্বাসন দিতে চায়। পূজা চালানই হবে তার সঠিক প্রতিবাদ।

আমাদের অনেকেই প্যারিসসহ বিভিন্ন পশ্চিমা দেশে সন্ত্রাসী আক্রমণে তাদের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করেছিল। আজ যা ঘটছে, বাংলাদেশে বিভিন্ন সংখ্যালঘুদের উপর যেসব আক্রমণ ঘটে সবই সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ। হ্যাঁ, সন্ত্রাসবাদী। কেননা লক্ষ্য একটাই - আতঙ্ক সৃষ্টি করে এদের দেশ ছাড়া করা। কোন প্যারিসবাসী বা অন্য কেউ বাংলাদেশের এই হতভাগ্য মানুষের সমর্থনে কিছু বলেছে কি? কেন? কারণ সরকার একে বলে বিচ্ছিন্ন ঘটনা, সংখ্যাগুরুরা এটাকে বিপথগামী পাকিস্তানপন্থীদের আক্রমণ বলে নিজেদের কাঁধ থেকে দায়িত্ব সরিয়ে ফেলে। আর আমরা যারা তা সে হিন্দুই হোক আর মুসলমানই হোক বিষয়টাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে আসতে চাই না, কেউ করলে তার অবস্থা হয় প্রিয় সাহার মত।


২০১৪ সালে নির্বাচনের পরে হিন্দুদের উপর আক্রমণ হলে অপেক্ষা করেছিলাম মস্কোর বন্ধুরা কিছু বলে কিনা সেটা দেখতে। এর আগে আমরা একসাথে শাহবাগের পক্ষে বলেছি। নাইন ইলেভেনের পরে স্থানীয় মুসলিমদের উপর আক্রমণের খবর পেয়ে ওখানে বন্ধুদের ফোন করে খোঁজ নিয়েছি। কিন্তু ২০১৪ সালে কেউ জানতেও চায়নি দেশে আত্মীয় স্বজন কেমন আছে? (ব্যতিক্রম আহসান আর মিজান)। এখানে আমরা কিছু করতে পারি কিনা। পরে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সবাইকে জড়ো করে প্রতিবাদ লিপি দিয়েছি দুতাবাসে। অনেকেই জানতে চেয়েছে কেন তাদের বলা হল না। বলেছি ঘরে যখন আগুন লাগে প্রথম বালতি জল নিজেকেই ঢালতে হয়। আর বলেছি - আমার প্রতিবাদ আমি হিন্দু বলে নয়, মানুষ বলে। ঠিক যেভাবে প্যালেস্টাইনে ইসরাইলের আক্রমণের প্রতিবাদ করি, একজন বামপন্থী হিসেবে আমার মনে হয়েছে হিন্দুদের উপর এখন যে আক্রমণ হচ্ছে সেটা মানবতার উপর আক্রমণ। যেখানেই মানুষকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় সেখানেই যেকোনো প্রগতিশীল, যেকোনো বিবেক সম্পন্ন মানুষের উচিৎ তার প্রতিবাদ করা।


বর্তমানে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি একটা জোকে পরিণত হয়েছে। অনেকটা ধর্ষণ করে মিলনের মত। শুধু সংখ্যালঘুদের জন্য নয় নিজেদের বিবেকের জন্য হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ (হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি এদের এক স্বল্প অংশ এই আক্রমণে জড়িত) মানুষের উচিৎ এর প্রতিবাদ করা, প্রতিরোধ গড়ে তোলা আর বিষয়টাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে আনা। ভুলে যাবেন না মাত্র কয়েক বছর আগেও আমেরিকা আর ইউরোপ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধা দিতে চেয়েছিল। তাদেরও জানা দরকার মৌলবাদের আসল রূপ। যারা ভাবেন দেশের সমস্যা বাইরে নেওয়া কেন, তারা অনেকেই ঘরে বৌয়ের উপর নির্যাতন করে বাইরে নারীর অধিকার রক্ষার সৈনিক সাজার মনোভাব পোষণ করেন। যখন সমস্যা আছে, সেটা সমাধানই আসল কথা। বাইরের মানুষ আপনার দুর্বলতার কথা জানলে যতটা সম্মান খোয়া যাবে তার চেয়ে বেশি অর্জন হবে সমস্যা সমাধান করলে। উদাহরণ? একসময় আমরা ছিলাম তলাবিহীন ঝুড়ি। সবার কাছে গেছি সাহায্যের হাত পেতে আর সেই সাহায্য নিয়েই আজ এই পর্যায়ে এসেছি। এখন আমরা অনেকের জন্যই উদাহরণ। তাই বিষয়টা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তোলা দোষের কিছু নেই। এটা তো গোপন কিছু নয় যে প্রশাসনের এক অংশের গাফিলতির বা অনিচ্ছার বা সক্রিয় অংশগ্রহনের কারণেই এসব ঘটে। আর অন্য এক অংশ এই সমস্যা সমাধানে আন্তরিক বলেই মনে হয়। এসব ঘটনা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচিত হলে যেকোনো প্রশাসনই বাধ্য হবে বিষয়টার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে।


প্রতিবাদ তো অনেক হল আসুন এবার প্রতিরোধের কথা ভাবি।

দুবনা, ১৬ অক্টোবর ২০২১




Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি