৮ই মার্চের শুভেচ্ছা

আর মাত্র কয়েক দিন পর ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এখন আর মনে পরে না দেশে এ দিনটা আমরা কিভাবে পালন করতাম বা আদৌ পালন করতাম কিনা? যদিও উদয়ন, সোভিয়েত ইউনিয়ন, সোভিয়েত নারী এসবের কল্যানে এ দিনটার নাম জানতাম। তাছাড়া ছাত্র ইউনিয়ন, খেলাঘর, উদিচী এসবের সাথে জড়িত থাকার কারনেও এ দিনটা একেবারে অপরিচিত ছিল না। তবুও মনে হয় মস্কোতেই জীবনের প্রথম এ দিনটি পালন করেছিলাম।    

আমি সোভিয়েত ইউনিয়নে আসি ১৯৮৩ সালের ৬ ই সেপ্টেম্বর। তার কয়েক দিন পরে হোল গনমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশ ছাত্র সংগঠনের নির্বাচন, আমরা ধীরে ধীরে পরিচিত হলাম সংগঠনের কাজকর্মের সাথে। ওই সময় বিজয় দিবস পালিত হতো গনমৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের দনস্কায়ার ক্লাবে, একুশ মিকলুখো মাকলায়ায়, ৮ই মার্চ প্লেখানভের এক হলে আর স্বাধীনতা দিবস মেই এর ক্লাবে। এ ছাড়া মস্কো মেলা হতো মিকলুখো মাকলায়ায় আর বার্ষিক সম্মেলন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শহরে।      

এখনও মনে পরে ১৯৮৪ র মার্চের সেই দিনটার কথা। আগে থেকেই জানা ছিল অনুষ্ঠান হবে প্লেখানভে। তখন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ওখানে পড়তেন। আমরা দল বেধে গেলাম। জেসমিন আপা, লায়লা আপা, জলি আপা, পলি আপা, শিখা আপা, শেফালী আপা আর আমরা একদল ছেলে – নতুন পুরানো সব মিলে। কেউ বক্তৃতা দিল, কেউ শুধুই অভিনন্দন জানালো। এরপর ছিল হাল্কা খাবার, শ্যাম্পেন। নতুন দেশে নতুন পরিবেশে যেকোনো অনুষ্ঠানই ছিল এক নতুন অভিজ্ঞতা – অনেকের সাথে এক সাথে আবার  সময় কাটানোর সুযোগ। তাই আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম এসব অনুষ্ঠানের জন্য।   

এখন এ দেশে আগের মতই জাকজমক করে ৮ই মার্চ পালিত হয়। ৭ তারিখে অফিসে অফিসে এ উপলক্ষে পার্টি হয়, ভালমন্দ খাবার, টোস্ট। ইদানিং কালে প্রাইভেট কোম্পানিগুলো এ উপলক্ষে কর্পোরেটিভ আয়োজন করে। সাধারন মানুষও পিছিয়ে থাকে না। ফুল কিনে আনে বাসায়, খুলে শ্যাম্পেন বা ওয়াইনের বোতল। এক কথায় মেয়েদের উৎসব হলেও দিনটা ছেলেমেয়ে সবাই মিলেই পালন করে। তার অর্থ কিন্তু এই নয় এখানে কোন সমস্যা নেই।

এরকম সময়ে আমার মার কথা মনে পরে। না, আমরা মাকে ৮ ই মার্চে অভিনন্দন জানাতাম না, মা, বউদি, বোন, ভাইঝি কাউকেই না। তখন এই ট্র্যাডিশন ছিল না দেশে, অন্তত গ্রাম এলাকায়। তার পরেও মার কোনই অসুবিধা হয়নি আমাদের বাড়ি নতুন কিছু ট্র্যাডিশন নিয়ে আসতে। ওই সময় গ্রামের মেয়েরা খুব কমই লেখাপড়া করত, স্কুলে যেতো। কিন্তু মার লেখাপড়া জানা ছিল। ফলে গ্রামের মহিলারা চিঠি পেলে মায়ের কাছেই আসতো চিঠি পড়াতে বা লিখতে। যেখানে আমার কাকাতো বোনেদের খুব বেশি লেখাপড়া না করিয়ে বিয়ে দেয়া হয়েছিল, কিন্তু মা দিদিকে পরিয়েছে বাড়ির অনেকের বাধা উপেক্ষা করে, শুধু বাবার সমর্থনে। দিদি যখন বিয়ে বসতে চায়নি, তা নিয়েও কাউকে কোনদিন কোন কথা বলতে দেয়নি। দিদি শুধু যে মাস্টার্স ডিগ্রী নিয়েছে তাই নয়, সেলাই, টাইপ, শর্টহ্যান্ড, রান্না, গ্রামীন চিকিৎসক আর কত কোর্স শেষ করার যে ডিগ্রী নিয়েছে তার শেষ নেই। সুধীরদা বিয়ে করে মাস্টার্স শেষ করে, বউদি তখন সবেমাত্র স্কুল শেষ করল। দাদা বউদিকে অংক শেখাতো, তা থেকেই প্রেম। বাড়িতে প্রথম প্রেম করে বিয়ে। সেখানেও মা কাউকে কোন কথা বলতে না দিয়ে ছেলে বিয়ে করিয়ে আনল। বউদি এলে বলল, পড়াশুনা করতে হবে। কাকারা আপত্তি করতে চাইলে বলল, “আমার বউ, আমিই ঠিক করব, সে পড়বে না ঘরের কাজ করবে।“ বউদি মাস্টার্স পেল। দিদি, বউদি স্কুলে চাকরি করল। এ সবই মার ইচ্ছা শক্তির বলে আর বাবার অকুণ্ঠ সমর্থনে। বাড়িতে যে গান শেখার ট্র্যাডিশন সেটাও মার চেষ্টায়। আসলে কোন কাজের জন্য দরকার ইচ্ছা আর কাছের মানুষদের  সমর্থন। তার জন্য ৮ই মার্চ দরকার পরে না, ফুল দরকার পরে না – যেটা দরকার সেটা পরস্পরকে বোঝার ক্ষমতা, বোঝার ইচ্ছা। আমাদের বাড়িতে কি মস্কোয়, কি দেশে ভাইরা রান্না করবে না বউরা – সেটা কখনো মুখ্য নয়। যখন যে থাকে বা পারে সেই করে। সংসার তো একটা।

কিন্তু আজকাল অনেক এফ বি বন্ধুদের দেখি তারা হয় নারী বিদ্বেষী অথবা পুরুষ বিদ্বেষী – অথচ এরা মানুষের এপিঠ-ওপিঠ, একজনকে  বাদ দিয়ে অন্যজন অসম্পূর্ণ। তাই আসুন না আমরা নারী-পুরুষের শত্রুতা ভুলে যাই – এক হয়ে লড়াই করি সবার জন্য সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য।

সবাইকে ভালবাসা।

মস্কো, ৫ মার্চ ২০১৭ 

             

   

Comments

  1. পরিচ্ছন্ন লেখা, সরল আহ্বান

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা