থেমিসের মৃত্যু

ঝড় আর ঝড়, আজ চারিদিকে শুধুই ঝড়ের আনাগোনা। উপকূলে ঝড়, রাজনৈতিক মঞ্চে ঝড়, আর সেই সাথে মুষল্ধারে বৃষ্টি যা বন্যা হয়ে একদিন সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে – এই দেশকে, দেশের রাজনীতিকে – সব সব।
আমি কখনই দেশের টকশো দেখি না। তবে সুলতানা কামালকে নিয়ে এতো ঘটনার পর ফেসবুকের লিঙ্ক ধরে দেখলাম ঐ টকশো। আর ভাবলাম বানের জলে ভাসতে ভাসতে কত দুরেই না চলে গেছি আমরা। মনে পড়লো স্কুল জীবনের কথা। আমাদের ইংরেজী পড়াতেন আতাব আলী স্যার। তিনি তবলিগ করতেন। এখনো করেন। আমার সাথে প্রায়ই ক্লাসে কথা হতো – উনি বলতেন সৃষ্টিকর্তার কথা, আমি প্রকৃতির। কত ধরনের কথাই না হতো, কত ধরনের বিতর্ক। এখন মনে হয় – ডিজিটাল বাংলাদেশে এসব আর করা যায় না।
হঠাৎই মনে পড়ে গেল মহাভারতের গল্প, যুধিষ্ঠিরের স্বর্গারোহণ। তিনি একাই গেছিলেন। তার ভাইয়েরাও তার সাথে যেতে পারে নি। হ্যা, হিন্দু ধর্মে আছে আমাদের কাঁধে বসে থাকে যমরাজের দুই দুত – চিত্রগুপ্ত না কি যেন নাম। ওরা সারাক্ষন লিখে যায় আমাদের ভালমন্দের উপাখ্যান। অবশ্য সেটা হতো অনেক আগে। আজকের ডিজিটাল যুগে ওরা নিশ্চয়ই ওয়েবক্যাম লাগিয়ে দেয় সদ্যোজাত শিশুর শরীরের কোথাও আর স্বর্গে বসেই কোন বড় মনিটরে দেখে কে কী করছে না করছে। আর মরার সাথে সাথে ভিডিও প্রমান নিয়ে আসে। টো করার জো নেই। কর্ম অনুসারে সাথে সাথে স্বর্গে বা নরকে ঢুকিয়ে দেয়। যাকে বলে হাতেনাতে ধরা, ইমারজেন্সী ট্রিবুন্যাল অ্যান্ড পানিসমেন্ট উইথ ইমিডিয়েট অ্যাকশান। অন্য ধর্মে অবশ্য বিচারের জন্য যুগযুগ অপেক্ষা করতে হয় – একেবারে শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত। জানি না কোনটা ভালো – সাথে সাথে বিচার পাওয়া না কি বিচারের জন্য অনির্দিষ্ট কাল অপেক্ষা করা? তবে কথাটা সেখানে নয়। আসল কথা যেটা – তা হচ্ছে প্রতিটি লোককেই ব্যক্তিগত ভাবে তার কাজকর্মের হিসেব নিকেশ দিতে হয়, আর তার ভিত্তিতে শুধু সেই লোকটাই তার প্রাপ্য বিচার পায়। তার বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, পাড়া-প্রতিবেশী, স্বজাতি বা স্বধর্মী কেউই তার পাপ পুন্যের ভাগী হয় না।
কথাগুলো বলছিলাম এ জন্যে যে, এক দিকে আমরা ধর্ম ধর্ম বলে আস্ফালন করবো, আর ধর্মের এই সব সাধারণ ব্যপারগুলো মানব না, তাতো হয় না। লঙ্গদুতে যুবলীগের নেতা খুন হল, কিন্তু যতদূর জানি কে দায়ী সেটা কেউ জানে না। আর যদি জেনেই থাকে – সেতো এক দুজন মাত্র, তাহলে সারা গ্রাম জ্বললো  কেন? কারন – ব্যপারটা ধর্মে নয়, ধর্মকে ব্যবহার করে অপকর্ম করায়। মনে আছে মধ্যযুগের ইউরোপের কথা? তখন সেখানে চার্চ ছিল সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী আর তাই বিনা বিচারে শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে দ্বিমতপোষণকারীদের আগুনে পুড়িয়ে মারত। রাজনীতির সাথে ধর্মের যোগসাজসে ধর্ম আর রাজনীতি দুটোই নষ্ট হয়, তাদের তাদের স্বকীয়তা হারায় – ধর্ম হয় রাজনৈতিক হাতিয়ার আর রাজনীতি হয় ধর্মান্ধ। এ জন্যেই তো উন্নত দেশগুলো ধর্মকে রাজনীতির থেকে দূরে রেখেছে, রাষ্ট্র থেকে দূরে রেখেছে। আর এটাই সেসব দেশের উন্নয়নে সাহায্য করেছে। ইউরোপ, আমেরিকার উন্নতির একটা প্রধান কারন এটা। তাই আমাদের দেশে যখন ধর্মকে রাজনীতিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা দেয়া হয় সেটা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে বলেই মনে হয়।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী ঢালাও ভাবে দেশের জনগনের এক বিরাট অংশকে শুকরভোজী, মদ্যপ আর গাঁজাখোর বলে চিহ্নিত করলেন। এর আগেই উনি বললেন, উনি সবার অভিভাবক। একজন অভিভাবক হিসেবে এই অভিযোগ কতটুকু যুক্তিযুক্ত ভাবার বিষয়। প্রশ্নটা কিন্তু মদ গাঁজা খাওয়ার নয়, প্রশ্নটা - যারা সরকারের বিভিন্ন কাজ সম্পর্কে সমালোচনা করছে তারা যৌক্তিক কথা বলছে কি না সেখানে। এরা যে সরকারের শুধু সমালোচনা করে তাই নয়, প্রশংসাও করে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে এরাই সরকারের পেছনে দাঁড়িয়েছিল। এরা তো আপনাকে এদের পক্ষ নিতে বলছেন না, পক্ষপাতিত্ব করতে বলছেন না। এরা চাইছে যে আদর্শকে সামনে রেখে বাংলার মানুষ দেশ স্বাধীন করেছিল, যে আদর্শকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু, চারনেতা আর আওয়ামীলীগ একাত্তরে মানুষকে যুদ্ধের ডাক দিয়েছিল – সেই আওয়ামীলীগের সভানেত্রী হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে আপনি সেই আদর্শের পথে থাকুন, দেশকে সে পথে চালান। তাদের তো বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তিনি নিজের থেমিসের ভাস্কর্য সরানোর প্রতিবাদ করতেন। যেভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা  বিসর্জন দিয়ে এক বিশেষ ধর্মের প্রতি দেশ ঝুকে পড়ছে, বঙ্গবন্ধু যার যা আছে তাই নিয়ে এ চক্রান্ত রুখে দাঁড়ানোর জন্য বাংলার মানুষকে সংগ্রামে নামতে বলতেন। তাহলে?
মৃত্যুর পর স্বর্গে বা নরকে যায় মানুষ। দেশ মরে না, দেশ স্বর্গে বা নরকে যায় না। তাই তার ধর্মের দরকার নেই। ধর্মের দরকার মানুষের – পরকালের জন্য। যারা ধর্মকে ব্যবহার করে ইহকালে ফায়দা লুটে, তারা ধার্মিক নয়, ধর্মব্যবসায়ী। এই সব ধর্মব্যবসায়ী থেকে সাবধান।

দুবনা, ০৫ জুন ২০১৭




Comments

Popular posts from this blog

রাজনীতি

২৪ জুনের দিনলিপি

স্মৃতি