শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও আনুসঙ্গিক প্রসঙ্গ
গত ১৪
ডিসেম্বর দেশ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করল। ১৯৭১ সালের এই দিনে হানাদার পাকবাহিনী আর তার স্থানীয় দোসরদের হাতে প্রাণ
হারায় পূর্ববাংলার অসংখ্য বুদ্ধিজীবী। যদিও ডিসেম্বরের এই বুদ্ধিজীবী
হত্যাযজ্ঞের শুরু ১০ ডিসেম্বর যখন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের স্বাধীনতাকামী
মানুষদের ধরে নিয়ে যায় আলবদর আর রাজাকাররা। নেট ঘাঁটলে
যে তথ্য পাওয়া যায় সেটা এরকম – এ সময়
হানাদার বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে প্রাণ হারান ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯
জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী ও ১৬ জন অন্যান্য পেশার মানুষ। শুধু এদেরকেই নয়, নয় মাস ব্যাপী পাকসেনা ও তাদের দোসরদের তাণ্ডবলীলায় নিহত
সকল বুদ্ধিজীবীদের প্রতিই জাতি এদিন শ্রদ্ধা জানায়।
দেশে থাকাকালীন মানে ১৯৮৩ সালে দেশ ত্যাগের আগে এ দিনটিতে আমি বা আমরা এলাকায় কিছু করতাম বলে মনে পড়ছে না। শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরীসহ অনেকের হত্যাকাণ্ডের কথা জানতাম, তবে হয়তো শহর ছাড়িয়ে গ্রামে এ দিনটি নিয়ে তখন তেমন কিছুই করা হত না। তাছাড়া যে সাড়ে তিন বছর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ছিল দেশে তা যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ গড়ার কাজেই ব্যস্ত ছিল। তখন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস বা শহীদ দিবসও পালিত হত অনেক সাদাসিধে ভাবে। না ছিল এখনকার মত টাকার ছড়াছড়ি, না ছিল পরিবেশ। তারপর পঁচাত্তরে পট পরিবর্তন। নতুন শাসকেরা এড়িয়ে যেতে না পারলেও এসব দিবসগুলো মহিমান্বিত করতে আগ্রহী ছিল না মোটেই। তাই জাতীয় দিবসগুলো ছিল স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার দিন। রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলে তারা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতির কথা জানাতেন জনগণকে।
মস্কো আসার পর আমরা অন্যান্য জাতীয় দিবস পালন করলেও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের কথা ভাবিনি। ২০১০ সালে বাংলাদেশ প্রবাসী পরিষদ রাশিয়া গঠনের পর দেশে জামাত শিবিরের বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ হিসেবে মস্কোয় আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে এ দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পর থেকে প্রতিবারই আমরা যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করে আসছি।
বুদ্ধিজীবী বলতেই আমাদের মনে হয় তারা সবাই প্রগতিশীল চিন্তায় বিশ্বাসী। তা কিন্তু নয়। কায়িক শ্রম নয়, বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে যারা জীবিকা অর্জন করেন, যেমন শিক্ষক, লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক – এরাই হচ্ছেন বুদ্ধিজীবী। এরা প্রগতিশীল বা প্রতিক্রিয়াশীল দু ধরণের হতেই পারেন। তাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক প্রগতিশীল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হলেও প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীরা ঠিক বেঁচে যায় এবং যুদ্ধপরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে নেপথ্যে থেকে শেখ মুজিব সরকার তথা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই তারাই চালিয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, পাক সেনা আত্মসমর্পণ করেছে বলে ঘোষণা দেওয়ার পরেও ইয়াহিয়া খান বলে তারা সাময়িকভাবে যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছে। হ্যাঁ, পরবর্তী পর্যায়ে পাকসেনা সরাসরি যুদ্ধে না নামলেও আজও পর্যন্ত বাংলাদেশে তাদের দোসররা সে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
একাত্তরে নিহত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নাকি প্রায় ৯৯% ছিলেন বাম চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। এটা বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে অবিভক্ত ভারতবর্ষে। যেহেতু কোলকাতা থেকেই শুরু হয়েছিল ব্রিটিশদের ভারত জয়, তাই কোলকাতাই ১৯১১ সাল পর্যন্ত ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। কোলকাতার সাথে সাথে বোম্বাই ও মাদ্রাজ ব্রিটিশ ভারতের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠলেও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল কোলকাতা। তাই সে সময় ভারতে যে রেনেসাঁ শুরু হয়, সেটা কোলকাতা থেকেই শুরু হয়। ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণেরা নতুন আলোয় ভারতীয় সমাজকে, ভারতের ভবিষ্যৎ দেখতে শুরু করে। বলা হত “আজ বাংলা যা ভাবে, আগামী কাল অবশিষ্ট ভারত তা করে।“ তবে এটাও ঠিক এই জাগরণী শক্তির সিংহভাগই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। মুসলিম সমাজের যে অংশ এই কাফেলায় যোগ দেয়, পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন শুরু হলে তাদের অধিকাংশ সেদিকেই চলে যায়। দেশ বিভাগের পরে তাই বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজের এক বিরাট অংশ কোলকাতায় থেকে যায়, অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র অংশ ঢাকায় চলে আসে। কিন্তু ১৯৪৮ সালে উর্দু হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, এই ঘোষণায় বাংলার শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সমাজ যেন হঠাৎই চেতনা ফিরে পায়। শুরু হয় ভাষা আন্দোলন, যা পরবর্তীতে স্বাধীন দেশের জন্য আন্দোলনে রূপ নেয়। ওই সময়ে যেসব বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, দ্বিজাতি তত্ত্বকে সম্বল করে সামনে এগুতে চাইছিল, তারা বিভিন্নভাবে বাংলা ভাষাকে ইসলামীকরণের চেষ্টা করে, যার একটা ছিল আরবী হরফে বাংলা লেখা। আর যাদের এরই মধ্যে দ্বিজাতি তত্ত্ব সম্পর্কে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল তাঁরা দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির ধারায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেন। তখনই গড়ে ওঠে ছাত্র ইউনিয়ন। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় তাঁরা বিভিন্ন গণসংগঠনের মধ্য দিয়ে নিজেদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করে যান।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে ভারত বিভক্ত হয়েছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। তাই যদিও জিন্নাহ পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলিম সবার জন্য সমান অধিকারের ঘোষণা দেন বাস্তবে সেটা কখনই হয়নি। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের কাছে হিন্দুরা সব সময়ই শত্রু বা ভারতের দালাল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাই ১৯৭১ সালে প্রথম আক্রমণটা নেমে আসে হিন্দুদের উপরেই। এরপরে যারা প্রধান শত্রু ছিল – সেটা বাম প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী। এরা শুধু সেই আজাদীকেই মিথ্যা বলেনি, ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করলে সেটার প্রতিবাদ করেছে, সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেছে। তাই যুদ্ধের সময় স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দুদের পরেই আঘাত নেমে আসে বাম ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের উপর। আর আওয়ামী লীগতো ছিলই। তবে আওয়ামী লীগ এদের শ্রেনী শত্রু ছিল না, ছিল রাজনৈতিক শত্রু।
মাত্র এক সপ্তাহ পরে দেশে নির্বাচন। দেশ অর্থনৈতিক ভাবে অনেক এগিয়ে গেছে এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে আমরা কী এগিয়েছি? এখনও সেই পাকিস্তান আমলের মতই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মৌলবাদীদের আক্রমনের শিকার হচ্ছে। শুধু কি মৌলবাদী? আওয়ামী লীগ, বিএনপির মত রাজনৈতিক দলগুলোও এসব করছে। যারাই প্রগতির কথা বলছে, মুক্ত চিন্তা করছে – তারাও শিকার হচ্ছে মৌলবাদীদের আক্রমনের, সরকার তাদের শায়েস্তা করছে ৫৭ ধারার মারপ্যাঁচে। নির্বাচনের প্রার্থী তালিকায় দেখা যাবে কী নৌকা কী ধানের শীষ কোন মার্কাই আজ আর মৌলবাদী ইসলাম মুক্ত নয়। এ বিষয়ে আমার প্রায়ই মনে পড়ে গ্রামের বাজারের কথা। আমাদের বাজারে অনেকেই দুধ বিক্রি করতে আসতো নদী পার হয়ে। লোকজনের সন্দেহ ছিল পথে এরা দুধে নদীর জল মেশায়। প্রশ্ন হল অনুপাতটা কত? যদি দুধে জলের পরিমাণ একটা ক্রিটিক্যাল মাত্রা পেরিয়ে যায়, তখন সেটা দুধ না থেকে জলে পরিণত হয়। এখন প্রায়ই দেখা যায় বিএনপি বা জামাতের লোকজন আওয়ামী লীগে যোগদান করছে। অনেক এলাকায় সেটা মনে হয় সেই ক্রিটিক্যাল মাত্রা পেরিয়ে গেছে, ফলে নামে আওয়ামী লীগ থাকলেও কাজেকর্মে এসব জায়গায় আওয়ামী লীগ তার চরিত্র হারিয়ে বিএনপি বা জামাতের চরিত্র লাভ করেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের কর্মীদের সিপিবি ও বাম জোটের নেতা কর্মীদের উপর আক্রমণ সেদিকেই ইঙ্গিত করে। ভোটের রাজনীতির খপ্পরে পড়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ইসলামীকরণ আজ জোর কদমে এগিয়ে চলছে। আর এসব হচ্ছে যে দল নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক মনে করে তাদের কাঁধে ভর করেই।
১৯৫৪ সালে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের অনুপাত ছিল শূন্যের কাছাকাছি, আজ নাকি সেটা প্রায় আশি শতাংশ। বিএনপিতে সেটা কম হবে বলে মনে হয় না। তার মানে দেশে রাজনীতির বানিজ্যকরণ ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। এই যদি হয় আমাদের এম পি প্রার্থীদের চেহারা, তাদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষ কী আশা করতে পারে? আর এসবের কারণ দেশের রাজনীতিবিদ তৈরির কারখানায় অনেক আগেই তালা ঝুলানো হয়েছে। প্রায় তিরিশ বছর হতে চলল ডাকসু নির্বাচন স্থগিত। অথচ এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল সমস্ত আন্দোলনের সুতিকাগার। এখান থেকেই শুরু ভাষা আন্দোলন, এখান থেকেই কী পাকিস্তান আমলে, কী স্বাধীন দেশে – স্বৈরাচারবিরোধী সমস্ত আন্দোলনের শুরু। সব কিছুর মতই সুস্থ্ রাজনীতিকেও লালন করতে হয়, রাজনীতি চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়। সেটা না হলে রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে থাকে না - ব্যবসায়ী, ধর্মব্যবসায়ী, চোর, বাটপারদের হাতে চলে যায়।
বাংলাদেশে সব কিছুতেই এখন এক নতুন টেন্ডেন্সি দেখা দিয়েছে – সেটা অন্যের সাথে তুলনা। সন্তান পরীক্ষায় পাশ করল, আমরা তার রেজাল্ট তুলনা করি পাশের বাড়ির ছেলের ফলাফলের সাথে। গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করল, আমাদের মন্ত্রীরা উদাহরণ দেয় ভারতের সড়কে কি হচ্ছে। সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলো – ইউরোপ/অ্যামেরিকার উদাহরণ চলে আসে সামনে। আমরা নিজেদের দুর্বলতা নিয়ে কথা না বলে অন্যের দুর্বলতা খুঁজি। নিজের দোষ স্বীকার না করে অন্যের দোষ শিকার করি। বিষ দিয়ে বিষ তোলার মত ভুল দিয়ে ভুল সংশোধন করার চেষ্টা করি। বর্তমান সরকারের আমলে দেশের উন্নতি হয়েছে অনেক। বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে তার একটা বিশাল ফর্দ অনেকেই দিয়ে থাকেন। এ নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু মানুষের প্রশ্ন তাদের দুঃশাসন নিয়ে। ছোট বড় বিভিন্ন বিরোধী দলের স্বাভাবিক রাজনীতি করার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করা নিয়ে। যেখানে হেফাজত বা ওলামা লীগ নির্বিঘ্নে তাদের প্রতিক্রিয়াশীল দাবী দাওয়া জানাতে মিটিং মিছিল করে, সেখানে বাম প্রগতিশীল মানুষের ন্যায্য দাবীর মিটিং মিছিলে নেমে আসে সরকারী খড়গ। আওয়ামী লীগ যে অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও উন্নতি চায় সেটা দেখানোর জন্য বর্তমান নির্বাচনী প্রচারণা যাতে শান্তিপূর্ণ হয় সেটা নিশ্চিত করা দরকার ছিল, কিন্তু বিরোধী দলের উপর, বিশেষ করে বামপন্থী জোটের উপর তাদের আক্রমণ আবার বলে দেয় বর্তমান সরকার সুস্থ্ রাজনীতির চর্চা করতে আগ্রহী নয়। বিএনপি সেটা কখনই করেনি। “রাজনীতিকে কঠিন করে তুলব” এই শ্লোগান তো জেনারেল জিয়ারই। বর্তমান আওয়ামী লীগ সেই শ্লোগান বাস্তবায়িত করেছে। এটা রাজনৈতিক ভাবে আওয়ামী লীগের বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়ার একটি উদাহরণ।
আমরা শুরু করেছিলাম শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের কথা দিয়ে। মাঝে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছি। দেখেছি কীভাবে হিন্দু ও বাম প্রগতিশীল ধারার রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা ধর্মীয় উগ্রবাদীদের আক্রমনের শিকার হয়েছে। এখনও সেটা চলছে। চলছে প্রকাশ্যেই। সরকারের প্রচ্ছন্ন ছত্রছায়ায় আওয়ামীপন্থী ইসলামী জোটগুলোর পোস্টার, শ্লোগান সেটাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে বলে দেয়। প্রশ্ন জাগে ভোটের রাজনীতি করে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ কী তার উৎসে ফিরে যাচ্ছে, মানে আওয়ামী মুসলিম লীগে পরিণত হচ্ছে নাকি বিজেপি যেমন আরএসএস, সংঘ পরিবার ইত্যাদির মুখপাত্র, আওয়ামী লীগও ধীরে ধীরে হেফাজত, ওলামা লীগ ইত্যাদি ইসলামী জোটের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছে?
বাংলাদেশের সামনে কঠিন অগ্নি পরীক্ষা। শক্তিশালী রাজনৈতিক তৃতীয় শক্তির অভাব সমস্যা আরও প্রকট করে তুলেছে। আওয়ামী লীগের পরাজয় দেশকে ২০০২ সালের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারে। বর্তমানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাঁধে ভর করে সেই দুঃশাসন আরও দীর্ঘস্থায়ী, আরও ভয়াল হতে পারে। আবার আওয়ামী লীগের বিজয় দেশের স্বাভাবিক রাজনীতির বিকাশকে চিরতরে নষ্ট করে দিতে পারে। এখানে রাশিয়ার সাম্প্রতিক কালের রাজনীতির উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ভ্লাদিমির পুতিন এখানে খুব জনপ্রিয়। কিছুদিন আগে তিনি পেনশনের বয়স সীমা বাড়ানোর মত একটা অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেন, ফলে তার জনপ্রিয়তা অনেক কমে যায়। কিন্তু আমার বিশ্বাস দেশের ভবিষ্যতের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। আর এসব সিদ্ধান্ত নিতে পারে শুধু জনপ্রিয় নেতারা নিজেদের জনপ্রিয়তাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে। আমাদের দেশও এখন এরকম এক পরিস্থতির মুখোমুখি। যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতেই যায়, পারবেন কি শেখ হাসিনা তার জনপ্রিয়তাকে বাজি রেখে আওয়ামী লীগকে ঢেলে সাজাতে, এ দলের ইসলামীকরণ প্রবণতাকে রুখে দিতে?
আমার দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশের রাজনীতিকে সুস্থ্ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে ছাত্র রাজনীতির বিকাশ এবং একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী সমস্ত রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বাম ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বাংলাদেশের মাটিতে অবাধ রাজনীতি চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করার কোন বিকল্প নেই।
দুবনা, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮
দেশে থাকাকালীন মানে ১৯৮৩ সালে দেশ ত্যাগের আগে এ দিনটিতে আমি বা আমরা এলাকায় কিছু করতাম বলে মনে পড়ছে না। শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরীসহ অনেকের হত্যাকাণ্ডের কথা জানতাম, তবে হয়তো শহর ছাড়িয়ে গ্রামে এ দিনটি নিয়ে তখন তেমন কিছুই করা হত না। তাছাড়া যে সাড়ে তিন বছর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ছিল দেশে তা যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ গড়ার কাজেই ব্যস্ত ছিল। তখন স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস বা শহীদ দিবসও পালিত হত অনেক সাদাসিধে ভাবে। না ছিল এখনকার মত টাকার ছড়াছড়ি, না ছিল পরিবেশ। তারপর পঁচাত্তরে পট পরিবর্তন। নতুন শাসকেরা এড়িয়ে যেতে না পারলেও এসব দিবসগুলো মহিমান্বিত করতে আগ্রহী ছিল না মোটেই। তাই জাতীয় দিবসগুলো ছিল স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার দিন। রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলে তারা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতির কথা জানাতেন জনগণকে।
মস্কো আসার পর আমরা অন্যান্য জাতীয় দিবস পালন করলেও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের কথা ভাবিনি। ২০১০ সালে বাংলাদেশ প্রবাসী পরিষদ রাশিয়া গঠনের পর দেশে জামাত শিবিরের বাড়াবাড়ির প্রতিবাদ হিসেবে মস্কোয় আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে এ দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পর থেকে প্রতিবারই আমরা যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করে আসছি।
বুদ্ধিজীবী বলতেই আমাদের মনে হয় তারা সবাই প্রগতিশীল চিন্তায় বিশ্বাসী। তা কিন্তু নয়। কায়িক শ্রম নয়, বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে যারা জীবিকা অর্জন করেন, যেমন শিক্ষক, লেখক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক – এরাই হচ্ছেন বুদ্ধিজীবী। এরা প্রগতিশীল বা প্রতিক্রিয়াশীল দু ধরণের হতেই পারেন। তাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক প্রগতিশীল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হলেও প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবীরা ঠিক বেঁচে যায় এবং যুদ্ধপরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশে নেপথ্যে থেকে শেখ মুজিব সরকার তথা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই তারাই চালিয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বলা দরকার, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, পাক সেনা আত্মসমর্পণ করেছে বলে ঘোষণা দেওয়ার পরেও ইয়াহিয়া খান বলে তারা সাময়িকভাবে যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছে। হ্যাঁ, পরবর্তী পর্যায়ে পাকসেনা সরাসরি যুদ্ধে না নামলেও আজও পর্যন্ত বাংলাদেশে তাদের দোসররা সে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
একাত্তরে নিহত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে নাকি প্রায় ৯৯% ছিলেন বাম চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। এটা বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে অবিভক্ত ভারতবর্ষে। যেহেতু কোলকাতা থেকেই শুরু হয়েছিল ব্রিটিশদের ভারত জয়, তাই কোলকাতাই ১৯১১ সাল পর্যন্ত ছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। কোলকাতার সাথে সাথে বোম্বাই ও মাদ্রাজ ব্রিটিশ ভারতের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠলেও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল কোলকাতা। তাই সে সময় ভারতে যে রেনেসাঁ শুরু হয়, সেটা কোলকাতা থেকেই শুরু হয়। ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণেরা নতুন আলোয় ভারতীয় সমাজকে, ভারতের ভবিষ্যৎ দেখতে শুরু করে। বলা হত “আজ বাংলা যা ভাবে, আগামী কাল অবশিষ্ট ভারত তা করে।“ তবে এটাও ঠিক এই জাগরণী শক্তির সিংহভাগই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। মুসলিম সমাজের যে অংশ এই কাফেলায় যোগ দেয়, পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন শুরু হলে তাদের অধিকাংশ সেদিকেই চলে যায়। দেশ বিভাগের পরে তাই বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজের এক বিরাট অংশ কোলকাতায় থেকে যায়, অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র অংশ ঢাকায় চলে আসে। কিন্তু ১৯৪৮ সালে উর্দু হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, এই ঘোষণায় বাংলার শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সমাজ যেন হঠাৎই চেতনা ফিরে পায়। শুরু হয় ভাষা আন্দোলন, যা পরবর্তীতে স্বাধীন দেশের জন্য আন্দোলনে রূপ নেয়। ওই সময়ে যেসব বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, দ্বিজাতি তত্ত্বকে সম্বল করে সামনে এগুতে চাইছিল, তারা বিভিন্নভাবে বাংলা ভাষাকে ইসলামীকরণের চেষ্টা করে, যার একটা ছিল আরবী হরফে বাংলা লেখা। আর যাদের এরই মধ্যে দ্বিজাতি তত্ত্ব সম্পর্কে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল তাঁরা দেশের প্রগতিশীল রাজনীতির ধারায় নিজেদের সম্পৃক্ত করেন। তখনই গড়ে ওঠে ছাত্র ইউনিয়ন। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় তাঁরা বিভিন্ন গণসংগঠনের মধ্য দিয়ে নিজেদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করে যান।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে ভারত বিভক্ত হয়েছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। তাই যদিও জিন্নাহ পাকিস্তানে হিন্দু-মুসলিম সবার জন্য সমান অধিকারের ঘোষণা দেন বাস্তবে সেটা কখনই হয়নি। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের কাছে হিন্দুরা সব সময়ই শত্রু বা ভারতের দালাল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তাই ১৯৭১ সালে প্রথম আক্রমণটা নেমে আসে হিন্দুদের উপরেই। এরপরে যারা প্রধান শত্রু ছিল – সেটা বাম প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী। এরা শুধু সেই আজাদীকেই মিথ্যা বলেনি, ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করলে সেটার প্রতিবাদ করেছে, সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেছে। তাই যুদ্ধের সময় স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দুদের পরেই আঘাত নেমে আসে বাম ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের উপর। আর আওয়ামী লীগতো ছিলই। তবে আওয়ামী লীগ এদের শ্রেনী শত্রু ছিল না, ছিল রাজনৈতিক শত্রু।
মাত্র এক সপ্তাহ পরে দেশে নির্বাচন। দেশ অর্থনৈতিক ভাবে অনেক এগিয়ে গেছে এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাবে আমরা কী এগিয়েছি? এখনও সেই পাকিস্তান আমলের মতই ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মৌলবাদীদের আক্রমনের শিকার হচ্ছে। শুধু কি মৌলবাদী? আওয়ামী লীগ, বিএনপির মত রাজনৈতিক দলগুলোও এসব করছে। যারাই প্রগতির কথা বলছে, মুক্ত চিন্তা করছে – তারাও শিকার হচ্ছে মৌলবাদীদের আক্রমনের, সরকার তাদের শায়েস্তা করছে ৫৭ ধারার মারপ্যাঁচে। নির্বাচনের প্রার্থী তালিকায় দেখা যাবে কী নৌকা কী ধানের শীষ কোন মার্কাই আজ আর মৌলবাদী ইসলাম মুক্ত নয়। এ বিষয়ে আমার প্রায়ই মনে পড়ে গ্রামের বাজারের কথা। আমাদের বাজারে অনেকেই দুধ বিক্রি করতে আসতো নদী পার হয়ে। লোকজনের সন্দেহ ছিল পথে এরা দুধে নদীর জল মেশায়। প্রশ্ন হল অনুপাতটা কত? যদি দুধে জলের পরিমাণ একটা ক্রিটিক্যাল মাত্রা পেরিয়ে যায়, তখন সেটা দুধ না থেকে জলে পরিণত হয়। এখন প্রায়ই দেখা যায় বিএনপি বা জামাতের লোকজন আওয়ামী লীগে যোগদান করছে। অনেক এলাকায় সেটা মনে হয় সেই ক্রিটিক্যাল মাত্রা পেরিয়ে গেছে, ফলে নামে আওয়ামী লীগ থাকলেও কাজেকর্মে এসব জায়গায় আওয়ামী লীগ তার চরিত্র হারিয়ে বিএনপি বা জামাতের চরিত্র লাভ করেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের কর্মীদের সিপিবি ও বাম জোটের নেতা কর্মীদের উপর আক্রমণ সেদিকেই ইঙ্গিত করে। ভোটের রাজনীতির খপ্পরে পড়ে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ইসলামীকরণ আজ জোর কদমে এগিয়ে চলছে। আর এসব হচ্ছে যে দল নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক মনে করে তাদের কাঁধে ভর করেই।
১৯৫৪ সালে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মধ্যে ব্যবসায়ীদের অনুপাত ছিল শূন্যের কাছাকাছি, আজ নাকি সেটা প্রায় আশি শতাংশ। বিএনপিতে সেটা কম হবে বলে মনে হয় না। তার মানে দেশে রাজনীতির বানিজ্যকরণ ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে। এই যদি হয় আমাদের এম পি প্রার্থীদের চেহারা, তাদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষ কী আশা করতে পারে? আর এসবের কারণ দেশের রাজনীতিবিদ তৈরির কারখানায় অনেক আগেই তালা ঝুলানো হয়েছে। প্রায় তিরিশ বছর হতে চলল ডাকসু নির্বাচন স্থগিত। অথচ এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল সমস্ত আন্দোলনের সুতিকাগার। এখান থেকেই শুরু ভাষা আন্দোলন, এখান থেকেই কী পাকিস্তান আমলে, কী স্বাধীন দেশে – স্বৈরাচারবিরোধী সমস্ত আন্দোলনের শুরু। সব কিছুর মতই সুস্থ্ রাজনীতিকেও লালন করতে হয়, রাজনীতি চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়। সেটা না হলে রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে থাকে না - ব্যবসায়ী, ধর্মব্যবসায়ী, চোর, বাটপারদের হাতে চলে যায়।
বাংলাদেশে সব কিছুতেই এখন এক নতুন টেন্ডেন্সি দেখা দিয়েছে – সেটা অন্যের সাথে তুলনা। সন্তান পরীক্ষায় পাশ করল, আমরা তার রেজাল্ট তুলনা করি পাশের বাড়ির ছেলের ফলাফলের সাথে। গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করল, আমাদের মন্ত্রীরা উদাহরণ দেয় ভারতের সড়কে কি হচ্ছে। সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলো – ইউরোপ/অ্যামেরিকার উদাহরণ চলে আসে সামনে। আমরা নিজেদের দুর্বলতা নিয়ে কথা না বলে অন্যের দুর্বলতা খুঁজি। নিজের দোষ স্বীকার না করে অন্যের দোষ শিকার করি। বিষ দিয়ে বিষ তোলার মত ভুল দিয়ে ভুল সংশোধন করার চেষ্টা করি। বর্তমান সরকারের আমলে দেশের উন্নতি হয়েছে অনেক। বিদ্যুৎ থেকে শুরু করে তার একটা বিশাল ফর্দ অনেকেই দিয়ে থাকেন। এ নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। কিন্তু মানুষের প্রশ্ন তাদের দুঃশাসন নিয়ে। ছোট বড় বিভিন্ন বিরোধী দলের স্বাভাবিক রাজনীতি করার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করা নিয়ে। যেখানে হেফাজত বা ওলামা লীগ নির্বিঘ্নে তাদের প্রতিক্রিয়াশীল দাবী দাওয়া জানাতে মিটিং মিছিল করে, সেখানে বাম প্রগতিশীল মানুষের ন্যায্য দাবীর মিটিং মিছিলে নেমে আসে সরকারী খড়গ। আওয়ামী লীগ যে অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে রাজনৈতিক পরিস্থিতিরও উন্নতি চায় সেটা দেখানোর জন্য বর্তমান নির্বাচনী প্রচারণা যাতে শান্তিপূর্ণ হয় সেটা নিশ্চিত করা দরকার ছিল, কিন্তু বিরোধী দলের উপর, বিশেষ করে বামপন্থী জোটের উপর তাদের আক্রমণ আবার বলে দেয় বর্তমান সরকার সুস্থ্ রাজনীতির চর্চা করতে আগ্রহী নয়। বিএনপি সেটা কখনই করেনি। “রাজনীতিকে কঠিন করে তুলব” এই শ্লোগান তো জেনারেল জিয়ারই। বর্তমান আওয়ামী লীগ সেই শ্লোগান বাস্তবায়িত করেছে। এটা রাজনৈতিক ভাবে আওয়ামী লীগের বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়ার একটি উদাহরণ।
আমরা শুরু করেছিলাম শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের কথা দিয়ে। মাঝে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছি। দেখেছি কীভাবে হিন্দু ও বাম প্রগতিশীল ধারার রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা ধর্মীয় উগ্রবাদীদের আক্রমনের শিকার হয়েছে। এখনও সেটা চলছে। চলছে প্রকাশ্যেই। সরকারের প্রচ্ছন্ন ছত্রছায়ায় আওয়ামীপন্থী ইসলামী জোটগুলোর পোস্টার, শ্লোগান সেটাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে বলে দেয়। প্রশ্ন জাগে ভোটের রাজনীতি করে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ কী তার উৎসে ফিরে যাচ্ছে, মানে আওয়ামী মুসলিম লীগে পরিণত হচ্ছে নাকি বিজেপি যেমন আরএসএস, সংঘ পরিবার ইত্যাদির মুখপাত্র, আওয়ামী লীগও ধীরে ধীরে হেফাজত, ওলামা লীগ ইত্যাদি ইসলামী জোটের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছে?
বাংলাদেশের সামনে কঠিন অগ্নি পরীক্ষা। শক্তিশালী রাজনৈতিক তৃতীয় শক্তির অভাব সমস্যা আরও প্রকট করে তুলেছে। আওয়ামী লীগের পরাজয় দেশকে ২০০২ সালের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে পারে। বর্তমানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাঁধে ভর করে সেই দুঃশাসন আরও দীর্ঘস্থায়ী, আরও ভয়াল হতে পারে। আবার আওয়ামী লীগের বিজয় দেশের স্বাভাবিক রাজনীতির বিকাশকে চিরতরে নষ্ট করে দিতে পারে। এখানে রাশিয়ার সাম্প্রতিক কালের রাজনীতির উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ভ্লাদিমির পুতিন এখানে খুব জনপ্রিয়। কিছুদিন আগে তিনি পেনশনের বয়স সীমা বাড়ানোর মত একটা অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেন, ফলে তার জনপ্রিয়তা অনেক কমে যায়। কিন্তু আমার বিশ্বাস দেশের ভবিষ্যতের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। আর এসব সিদ্ধান্ত নিতে পারে শুধু জনপ্রিয় নেতারা নিজেদের জনপ্রিয়তাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে। আমাদের দেশও এখন এরকম এক পরিস্থতির মুখোমুখি। যদি আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতেই যায়, পারবেন কি শেখ হাসিনা তার জনপ্রিয়তাকে বাজি রেখে আওয়ামী লীগকে ঢেলে সাজাতে, এ দলের ইসলামীকরণ প্রবণতাকে রুখে দিতে?
আমার দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশের রাজনীতিকে সুস্থ্ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হলে ছাত্র রাজনীতির বিকাশ এবং একাত্তরের চেতনায় বিশ্বাসী সমস্ত রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বাম ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য বাংলাদেশের মাটিতে অবাধ রাজনীতি চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করার কোন বিকল্প নেই।
দুবনা, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮
Comments
Post a Comment