হোলি

আমার ছোট বেলায় হোলি ছিল দোল। অনেক সময় আমরা বলতাম দোল যাত্রা। বড়দার ওখানে বেশ বড় দোলের ভিটি বা ভিটা করত, আমাদের একটু ছোট। তিন ধাপের এই ভিটি দেখতে ছিল অনেকটা পেরুর পিরামিডের মত। এসব ভিটি সাধারণত সারা বছর ধরেই থাকতো বাড়ির দুয়ারে। বছরের অন্য সময় ওখানে শসা, লাউ এসব বোনা হত। সেই ভিটি থেকে ওঠা গাছে উপর দেওয়া হত বাঁশের জাংলা, তার উপর থাকতো কঞ্চি। অনেক পরে যখন সেই জাংলা থেকে লাউ বা শসা ঝুলে থাকতো আর বৃষ্টির দিনে তেল কাঁচামরিচ মুড়ি খেতাম শসা দিতে দোলের কথা কারই মনে থাকতো না। গ্রামে সবচেয়ে বড় দোল হত রমন গোঁসাইয়ের আখড়ায়। সেখানে এমন কি রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ পাল্কিতে করে ঘোরানো হত। যদি ভুল না করি আখড়া সংলগ্ন খালে মেলা বসত। ঠিক বলতে পারব না, তবে যতদূর মনে পড়ে বেতিয়াল রাসমেলা বসত খুব সম্ভবত এই দোলকে ঘিরেই। চলত অনেক দিন। রাসমেলার নামেই বেতিলা পরিচিত ছিল। একবার গিয়েছিলামও, তবে যাত্রা দেখতে, রাতের বেলায়, তাই মেলাটা আর দেখা হয়নি। সেই দোল যাত্রার পরের দিন ছিল হোলি খেলার রেওয়াজ। সবাই বিভিন্ন রকম রঙ আর পিচকিরি নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম রঙ খেলায়। যদিও তখন হাল্কা রঙ মানে যা খুব সহজেই ধুয়ে ফেলা যায় তেমন রঙ পাওয়া যেত বাজারে, আমরা ব্যবহার করতাম পাকা রঙ। আমাদের বাড়িতে ছিল রঙের কারখানা। সুতার ব্যবসা ছিল। নারায়ণগঞ্জ থেকে সাদা সুতা আর রঙ কিনে এনে রঙ করা করা হত পরে বিক্রির জন্য। তাই রঙ ছিল যাকে বলে পাকা। কয়েক দিন আগে থেকেই আমরা সেই রঙ সংগ্রহ করে রাখতাম আর হোলির বা রঙ খেলার দিন মনের সুখে বালতি বালতি সেই রঙ পিচকিরি দিয়ে অন্যের গায়ে মাথায় ছুঁড়তাম। সব চেয়ে আনন্দের ব্যাপার ছিল বৌদিদের রাঙ্গিয়ে দেওয়া। এরপর ছিল সেই রঙ ওঠানোর প্রানান্তকর চেষ্টা। চৈত্রের প্রচণ্ড তাপ উপেক্ষা করে উত্তপ্ত বালির বিশাল চর পার হয়ে যেতাম কালীগঙ্গার ঘাটে। এতো যত্ন সহকারে সাবান মেখে স্নান মনে হয় বছরের আর কোন দিন করিনি। আমাদের গ্রাম ছিল হিন্দু ও মুসলমানে আধাআধি। সে সময় র‍্যাগ ডের চলন শুরু হয়নি, হলেও সেটা গ্রামে এসে পৌঁছেনি। তাই আমরা সাবধানে রঙ খেলতাম যাতে সেটা কোন মুসলমানের গায়ে না লাগেলাগলে কী হবে সেটা জানতাম না, জানতাম ইসলাম ধর্মে এসব নিষিদ্ধ। এভাবেই ছোটকাল থেকেই আমাদের পরধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখান হত। জানি না এখন বাড়িতে দোল যাত্রা হয় কি না? তবে দোল যে ধীরে ধীরে হোলিতে পরিণত হয়েছে সেটা ফেসবুক খুললেই দেখা যায়। এখন এমন কি মস্কোয়ও লোকে রঙ খেলে, বিশেষ করে কিশোর কিশোরীরা। তবে সেটা দোল উপলক্ষে নয়, মূলত গ্রীষ্মে। মাঝে মধ্যে ওদের দেখি দল বেঁধে মেট্রোতে করে যাচ্ছে, মুখে বিভিন্ন রঙের খেলা। আসলে আজকাল ওরা যেভাবে বিভিন্ন রঙে চুল রঙ করে তাতে কোনটা যে হোলি আর কোনটা যে নয় সেটাই অনেক সময় বুঝে উঠতে পারি না। তবে রঙ সব সময়ই মনে আনন্দের সঞ্চার করে বিশেষ করে সে রঙ যখন অন্যের শরীরে। রঙ দিয়েই শুরু হয় আমাদের বসন্তের আগমন।
দুবনা, ২১ মার্চ ২০১৯   



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা