বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী


গত ১৭ মার্চ জাতি পালন করল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০০ তম জন্ম দিবস মস্কোস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে এ উপলক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”র উপর এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয় সেখানে আমার আলোচনা নিয়ে কিছু ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে যারা সেখানে ছিলেন না তারা অনেকেই জানতে চেয়েছেন আমার আলোচনার বিষয় সেটা ছিল মূলত লিখিত প্রবন্ধ, যেটা আমি পুরোটা পড়তে পারিনি দুটো কথা এখানে বলা দরকার। অনেকের ধারণা আমার প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুকে নেগেটিভ আলোয় দেখানো হয়েছে। আমার বিশ্বাস সবাই যদি ধৈর্য ধরে শেষ পর্যন্ত শুনতেন তাদের সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হত। আমি শুধুমাত্র “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”তে লেখা বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমার নিজের অনুভূতির কথা বলেছি।  দেখিয়েছি চল্লিশের দশকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আদর্শে আস্থা রেখে  রাজনৈতিক জীবন শুরু করলেও তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা মাত্র দু’ দশকের মধ্যে তাঁকে বঙ্গবন্ধুতে পরিণত করে। জাতি পায় বাহাত্তরের সংবিধান যেটা আমার মনে হয় জাতির প্রতি, বিশেষ করে যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করে, তাদের প্রতি জাতির পিতার রাজনৈতিক উইল, আদেশ। ইচ্ছুক পাঠকদের জন্য পুরো লেখাটাই নীচে দিলাম       


বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী

আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে আমরা তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী নিয়ে কথা বলছি আমি পুস্তক সমালচক নই, তাই আমার আলোচনা হবে বইটি পড়ে আমার যে অনুভূতি তার উপর এখানে অনুভূতির উপর দুটো কথা বলা দরকার ঈশান কোণে যখন কালো মেঘ দেখা দেয় তখন আমরা দুয়ারে মেলা জামাকাপড় বা ধান পাট তুলি মনে আশঙ্কা নিয়ে আবার ঝড় শুরু হলে ঝাল মুড়ি খেতে খেতে অপেক্ষায় থাকি কখন সেটা শেষ হবে ঝড়ের ঠিক পরে ভয়ে ভয়ে দৌড়ে আম কুড়োতে যাই পাছে ডাল ভেঙ্গে মাথায় পড়ে আর সব কিছু শান্ত হলে হিসেব করি  কি কি ক্ষতি হল ঝড়ে এটা অনুভূতির নেগেটিভ দিক পজিটিভ উদাহরণ হল আমরা যখন কোন নামকরা শিল্পীর গান শুনতে যাই, বিখ্যাত অভিনেতার অভিনয় বা দামী খেলোয়াড়ের খেলা দেখতে যাই তখন আমাদের অনুভূতির কতগুলো পর্যায় থাকে প্রথমত সেটা প্রত্যাশা, তারপর ঘটনাটি যখন ঘটে সে সময়ের আবেগ, ঘটনার ঠিক পরপর আবেগের রেশ আর অনেক পরে যখন সবকিছু শান্ত হয় – ঘটনার সূক্ষ্ম ও নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনী প্রকাশের পর থেকেই সেটা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, বইটি প্রকাশের আগে থেকেই সেটা বিভিন্ন মহলে কৌতূহলের উদ্রেক করেছে এর আগে শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্ম নিয়ে   অনেকে লিখলেও এটাই ছিল যাকে বলে ফার্স্ট হ্যান্ড ডেলিভারি তাই ছিল প্রত্যাশা আর সেটা ছিল বইটি হাতে পাওয়ার আগেই এক ধরণের আবেগ মিশ্রিত অনুভূতি ছিল বইটি পড়ার সময় বই পড়া শেষে ছিল সেই আবেগের রেশ মিশ্রিত অনুভূতি আর অনেক দিন পরে, যখন সমস্ত আবেগ স্তিমিত হয়ে এসেছিল, অনুভূতি ছিল বইটির সত্যিকার মেসেজের এখন এসবের কথাই বলব
এর আগে বইটি পড়ার প্রেক্ষাপটের কথা বলি বইটি বেরনোর সাথে সাথেই বাংলাদেশ প্রবাসী পরিষদ রাশিয়া এর উপর একটি সেমিনার করার চিন্তা করে যেহেতু বঙ্গবন্ধু পরিষদ এ ধরণের সেমিনার করার প্রধান দাবীদার তাই আমরা তাদের সাথে এ নিয়ে কথা বলি দেশ থেকে কয়েক কপি বই আনান হয় আমি নিজে নেটে বইটি পাই, পড়ি কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই সেমিনার আর করা হয়নি এটা ছিল ২০১২ সালের কথা
ঐ সময় আমি নিজেও ইতিহাস, বিশেষ করে ভারত বর্ষের ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনা
করছিলাম পড়ি জ্যাক্সনের বেশ কয়েক খণ্ড ভারত ইতিহাস পড়ি নেহেরুর “Glimpses of world history, History of India, An autobiography”, গান্ধীর আত্মজীবনী “The story of my experiments with truth”, নেতাজী সুভাষের “An Indian pilgrim, The Indian struggle”, মৌলানা আবুল কালাম আজাদের “India wins freedom, যশোবন্ত সিংহের “Jinnah, India, Partition, Independenceরুদ্রাংশু মুখার্জীর  Nehru and Bose – Parallel lives” ইত্যাদি এসব বলার একটাই কারণ – ওই মুহূর্তে আমি ভারতের তৎকালীন  রাজনীতি সম্পর্কে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে খুব ভালোভাবে অবগত ছিলাম
ঠিক সেই মুহূর্তে এই বইটি বেরোয়, আমার হাতে আসে আমি পড়তে শুরু করি প্রথম অনুভূতি ছিল শক আমি যেসব বইয়ের নাম করলাম তাদের প্রায় সবগুলোই ছিল লেখার দিক থেকে খুব উঁচু মানের কিছু কিছু বিশ্ব সাহিত্যের ভাণ্ডার তাই সহজ সরল, অনেক ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বাংলার ব্যবহার কিছুটা হলেও শকের সৃষ্টি করে পরে অবশ্য সেটা কেটেছে যখন ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার সুযোগ এসেছে শকের কারণ ছিল, বই মানেই আমরা ধরে নেই সাহিত্যের অংশ, তাই ইচ্ছা অনিচ্ছায় ভাষার দিকটা চোখে পড়ে কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখলাম বইটা লিখেছেন গণ মানুষের নেতা তাঁর দেশের সাধারণ মানুষের জন্য তাই উপরোল্লিখিত বইগুলো যেখানে জনগণের এক ছোট্ট অংশের মনের খোরাক যোগায় এই বই কোটি কোটি মানুষের মনের কথা বলে এটা আবার নতুন করে প্রমাণ করে শেখ মুজিব আসলেই ছিলেন গণ মানুষের নেতা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গ্যালিলিওর কথা যিনি ল্যাতিনের পরিবর্তে ইতালিয়ান ভাষায় তাঁর রচনাবলী প্রকাশ করেন। ফলে শুধু ল্যাতিন জানা বিজ্ঞানী বা ধর্ম যাজকেরাই নয়, সাধারণ মানুষও তাঁর গবেষণা সম্পর্কে জানতে পারে।   
দ্বিতীয় ধাক্কাটা ছিল আরও বড় যেটা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছে আমার জন্ম ১৯৬৪ সালে ১৯৬৮ সালের কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা আমার মনে আছে, তবে ১৯৬৯ সালে যখন প্রথম বার ইন্ডিয়া যাই তখন থেকে সব কিছুই বেশ ভালো করেই মনে আছে তখন আমার বয়স পাঁচ বহরমপুরে ছিলাম মাস দুয়েক, তাই মাসীর বাড়ীর পাশের স্কুলে যেতে শুরু করি এখনো মনে পড়ে বাংলা বইয়ে নেতাজী সুভাষ বোসের ছবি তিনি আমার অন্যতম প্রিয় নেতাদের একজন যখন দেশে ফিরি তার কিছুদিন পরে শুরু হয় উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান গ্রামের বাজার লাগতে শুরু করে একটু দূরের খালে চারিদিকে শেখ মুজিবের নাম বাড়িতে কেউ তখন সক্রিয় রাজনীতি না করলেও সবাই ছিলেন শেখ মুজিবের সমর্থক মানিকগঞ্জ বা ঘিওর থেকে আসা আওয়ামী লীগের নেতাদের এলাকায় কাজ শুরু ও শেষ হত আমাদের বাড়ি থেকেই চা দিয়ে শুরু হলে ভাত দিয়ে শেষ হত অথবা তার উল্টোটা এখনো চোখ বুজলেই বাড়ির সবচেয়ে বড় আমগাছের মাথায় সবচেয়ে লম্বা বাঁশে লাগানো পতাকা ভেসে ওঠে মনের পর্দায় যাহোক, আমার সেই ৫ বছর বয়স থেকে ২০১২ সাল মানে ৪৮ বছর বয়স পর্যন্ত শেখ মুজিব ছিলেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার কণ্ঠ, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের অন্যতম নায়ক তাই যখন পড়লাম চল্লিশের দশকে ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তানের জন্মের পেছনে, বিশেষ করে বাংলায় পাকিস্তান আন্দোলনকে গণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার পেছনে শেখ মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন – সেটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল আমার বিশ্বাস, বইটা যদি অন্য কারো লেখা হত, এটাকে আমি ডাহা মিথ্যা বা শত্রুর অপপ্রচার বলে ধরে নিতাম এরপর অনেক সময় কেটে গেছে এই সত্যটুকু হজম করতে আসলে আমি বরাবরই মনে করতাম ভারত বিভাগ একটা ভুল সিদ্ধান্ত উপরে উল্লেখিত বইগুলো পড়ে আমার এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়েছে আমরা যে কোন কাজের সাফল্য বিচার করি তার ফল দেখে জিন্নাহ বারবার বলেছিলেন ভারত ও পাকিস্তান হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বন্ধুসুলভ দুটো দেশ তাই হয়েছে কি? আগে দুটো সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধিতা ছিল, এখন সেই বিরোধ তো কমেইনি বরং আরও বেড়ে দুটো দেশের মধ্য ছড়িয়ে পড়েছে উপমহাদেশের যে পটেনশিয়াল ছিল উন্নতির জন্য, সেটা ব্যয় হচ্ছে নিজেদের মধ্যে হানাহানি করতে তাই শেখ মুজিব এমন একটা ভুল প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে সক্রিয় ছিলেন সেটা মেনে নেওয়া সত্যি কঠিন ছিল
তবে সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই আমরা অন্যভাবে দেখি, অন্য ভাবে বুঝি এসব বুঝতে আমাকে যেসব বই সাহায্য করেছে সেগুলো হল রামচন্দ্র গুহর “India after Gandhi, রমিলা থাপ্পারের “The Past as Present”, কুলদীপ নায়ারের “Beyond the lines” জভাল নয়াহ হারারির “Sapiens: A brief history of humankind, Homo Deus: A brief history of tomorrow আরও ছিল লেভ গুমিলেভ, অমর্ত্য সেন, অতুল সুর, ক্ষীতিমোহন সেন, নীরোদ সি চৌধুরী সহ আরও অনেকের লেখা। মনে পড়ে নেতাজী সুভাষের কথা উনিও আমার প্রিয় নেতা ছিলেন দেশে থাকতেই জানতাম জার্মান ও জাপানের সাথে তাঁর যোগাযোগের কথা তবে সোভিয়েত ইউনিয়নে আসার আগে পর্যন্ত নাৎসি ও জাপানীদের পাশবিকতার ব্যাপকতা জানতাম না তাই অনেক দিন পর্যন্ত নেতাজীর সেই ভূমিকা মেনে নিতে পারিনি তবে ২০১২ সালে ওনার বই পড়ার পরে নেতাজী সম্বন্ধে যে একটা নেগেটিভ ধারণা গড়ে উঠেছিল সেটা অনেকটাই  কমেছে সময়ের সাথে সাথে আবেগ যতই উপশমিত হয়েছে, ভিন্ন ভাবে অসমাপ্ত আত্মজীবনীর মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছি শুধু বই নয়, শেখ মুজিবকেও বইয়ের লেখা আর পরবর্তী জীবনে তাঁর কাজকর্ম দেখে চেষ্টা করেছি তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বিবর্তন বুঝতে
বইয়ের এক জায়গায় জমিদারদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন হিন্দু জমিদারদের মুসলিম প্রজাদের উপর অত্যাচারের কথা, কিন্তু মুসলিম জমিদাররা সেটা করত অর্থনৈতিক কারণে অর্থাৎ ওই সময়টা তিনি রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতেন কিন্তু পরবর্তী জীবনে তিনি ধর্ম নয়, ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের অগ্রদূত হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন অথবা মাঝির সাথে তাঁর কথোপকথনে যখন তিনি স্পষ্টই বলেন এই পাকিস্তান তিনি চাননি, সেখানে তিনি তাঁর ভুল স্বীকার করেন অথবা সেই বৃদ্ধা মহিলার খাবার খাওয়ানোর ঘটনা যখন দরিদ্র বৃদ্ধা তাঁকে শুধু খাইয়েই শান্ত হননি, নিজের শেষ সম্বল কিছু টাকা তুলে দিয়েছেন তাঁর নেতার হাতে কারণ – মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করত, তিনিও সাধারণ মানুষের কাছেই সমর্থন খুঁজতেন পরবর্তীতে এই বিশ্বাসই তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়, তার পরেও বঙ্গবন্ধু এ দেশের মানুষের উপরে কখনই বিশ্বাস হারাননি এখানেই তিনি অনন্য আবার ফিরে যাই সেই ভাষা আন্দোলনের দিনগুলোতে একবার তিনি আক্ষেপ করেছেন জিন্নাহকে ভুল বোঝানো হয়েছে তিনি শেষ পর্যন্ত জিন্নাহর সুবুদ্ধির উপর আস্থা রাখতে চেয়েছেন কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে জিন্নাহর বক্তব্যের পর তিনি মত পালটান, ছাত্রদের সভায় বলেন “কোন নেতা যদি অন্যায় কাজ করতে বলেন, তার প্রতিবাদ করা এবং তাঁকে বুঝিয়ে বলার অধিকার জনগণের আছে ...রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব“ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্ঠা ১০০) এখানেই তিনি অন্যদের থেকে আলাদা তাঁর এ কথা তখনকার জন্য যেমন, কী বর্তমান, কী ভবিষ্যৎ সব কালের জন্যই তেমনি সময়োপযোগী তিনি বিশ্বাস করতেন কাজ করলে ভুল হবেই ভুল শুধু তাদেরই হয় না, যারা কাজ করে না      

অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ৫১ পৃষ্ঠায় শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন মুসলিম লীগের সভাগুলোতে উর্দু, ইংরেজি ও বাংলায় বক্তব্যের কথা
তিনি আরও লিখেছেন “জিন্নাহ সাহেব যেখানে বসেছেন, তাঁর কাছেই আমাদের স্থান যখন উর্দু স্লোগান উঠত, আমরা তখন বাংলা স্লোগান শুরু করতাম” (পৃষ্ঠা ৫২) এ সবই দেশ বিভাগের পূর্বের মানে ১৯৪৬ সালের ৭ – ৯ এপ্রিলের ঘটনা তার মানে দেশ বিভাগের পূর্ব থেকেই ধর্মের সাথে সাথে ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ আমরা দেখি শেখ মুজিবের মধ্যে দেশ বিভাগের কথায় ফিরে গেলে আমরা কিছু জিনিস খেয়াল করব ব্যক্তিগতভাবে ভারত বিভাগ আমার মনে হয় বাংলা আর পাঞ্জাব বিভাগ এ দুটো প্রদেশই ব্রিটিশ শাসনের বিপক্ষে ছিল সবচেয়ে সোচ্চার আর ছিল বঙ্গভঙ্গের তিক্ত অভিজ্ঞতা ১৯৪৬ সালে কোলকাতায় ডাইরেক্ট অ্যাকশনের সময় তাঁর ভার্সন অন্যান্য  লেখকের থেকে ভিন্ন সেখানে যে দুটো জিনিস উনি উল্লেখ করেছেন তা হল এই দাঙ্গার জন্য তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন না আর তিনি বিভিন্ন হিন্দু পরিবারের সাহায্যে এগিয়ে আসেন কিন্তু এই কোলকাতা দাঙ্গাই অবিভাজ্য ভারতের কফিনে শেষ পেরেক যেটা আমার বিশ্বাস অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে লাগানো হয়েছিল দেশ ভাগের অনেক আগে থেকে মুসলিম লীগের এক অংশের সাথে শহীদ সাহেব আর শেখ সাহেবের সম্পর্কের টানাপোড়ন ছিল যা তিনি বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করেছেন তবে যেটা চোখে পড়ে সেটা হল বিরোধীদের প্রতি ভাষা প্রয়োগে শালীনতা যেটা আজকাল খুব একটা দেখা যায় না  ভারত বিভাগের ইতিহাস আমাদের জানা দরকার এজন্যে নয় যে আমাদের আবার এক দেশে পরিণত হতে হবে কিন্তু আমরা যদি সঠিক ইতিহাস জানি ও বুঝতে পারি, আমরা যদি বুঝতে পারি দ্বিজাতি তত্ত্ব আসলে রাজনৈতিক চাল, এটা কোন সমস্যার সমাধান তো করেইনি বরং প্রচুর নতুন সমস্যার জন্ম দিয়েছে, যদি বুঝতে পারি মানুষের ধর্ম মানুষের একমাত্র ও শেষ পরিচয় নয়, মানুষের পরিচয় তার মনুষ্যত্বে, তার মানবিক গুণাবলীতে তাহলে উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে তিক্ততা কমবে, আমরা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে পারব এক দেশ না হোক, একটা উপমাহাদেশে বাস করতে পারব যেখানে ধর্ম বা রাষ্ট্রীয় সীমানা পারস্পারিক বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না  
  
এই বইয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বারবার উল্লেখ করেছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু
তারপরেও তিনি তাঁর সাথে দ্বিমত পোষণ করতে কুণ্ঠিত হননি একবার শহীদ সাহেব তাঁকে “তুমি কেউ না” বললে তিনি উত্তর দেন “আমি কেউ, নইলে আপনি আমাকে এখানে ডাকতেন না“ কিন্তু তারপরেও তাঁদের সম্পর্কের অবনতি ঘটেনি, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁরা পরস্পরের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল 
আমরা আজ বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী নিয়ে শুধুমাত্র আলোচনার খাতিরেই আলোচনা করছি না, সেটা করছি এই অমূল্য বই থেকে শিক্ষা নিতে
এখানে আলোচিত সব কথাই তাঁর নিজের কথা আজ কি ভাবা যায় কোন কর্মী তাঁর নেতার মুখের উপর দ্বিমত প্রকাশ করছে, আর করলেও নেতা সেটাকে গ্রহণ করছেন শহীদ সাহেবের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করে শেখ মুজিব যেমন তাঁর দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন, সেটাকে গ্রহণ করে শহীদ সাহেবও নেতৃত্বের গুণাবলী কেমন হওয়া উচিৎ তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বর্তমান বাংলাদেশে কী নেতা, কী কর্মী – সবার মধ্যেই এসব গুণাবলীর প্রচণ্ড অভাব           
 
অসমাপ্ত আত্মজীবনী আমাদের শুধু এই মহান নেতার ব্যক্তিজীবনের চিত্রই তুলে ধরে না, সেই সময়ে বাংলার বিশেষ করে বাংলার মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরে আমরা জানতে পারি পূর্ববাংলার আর্থসামাজিক অবস্থার কথা সেদিক থেকে এ বই আমাদের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল
তবে আজ আমরা শুধু এ বই নিয়েই আলোচনা করছি না, আমরা পালন করছি এই মহান নেতার শততম জন্মদিন মাত্র ক’দিন আগে ছিল ৭ই মার্চ ফেসবুকে
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বধীনতার সংগ্রাম”
কথাগুলো নতুন করে দেখে মনে হল এটাই যেন জাতির প্রতি তাঁর মেসেজ
স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি কিন্তু মুক্তি পেয়েছে কি? কী বোঝাতে চেয়েছেন তিনি মুক্তি বলতে? জানি, সেটা হবে একান্তই আমার ইন্টারপ্রিটেশন, তবুও বলছি  
স্বাধীনতা পরবর্তী যে সাড়ে তিন বছর তিনি জীবিত ছিলেন, তাঁর সমস্ত কাজকর্ম এটাই প্রমাণ করে যে তিনি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি চেয়েছিলেন তিনি চেয়েছিলেন শ্রমিক তার কাজের ন্যায্য মজুরি পাক, কৃষক পাক তার ফসলের ন্যায্য দাম তাই তো তিনি সমাজতন্ত্রকে সংবিধানের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন সেই সাথে গণতন্ত্রের কথাও ভলেননি অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি বারবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এ জন্যে যে মুসলিম লীগ সরকার তাদের বিরোধী দলকে কাজ করতে দিচ্ছে না, বারবার জেলে ঢুকিয়ে তাঁর বাক স্বাধীনতা রোধ করা হচ্ছে তিনি জানতেন দেশ গঠনে বিরোধী দলের ভূমিকার মূল্য, তিনি জানতেন বাক স্বাধীনতার মূল্য গণতন্ত্র তাই ছিল দেশের মূল নীতির আরেক স্তম্ভ ধর্ম যে জাতির সমার্থক নয় আর বাংলাদেশ যে জাতীয় রাষ্ট্র, ধর্মীয় নয় সেটাও তিনি দেশ বিভাগের পরেই উপলব্ধি করেছিলেন আর তাই  জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বকে ত্যাগ করেছিলেন আর সেই মুক্তি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতায় ধর্মনিরপেক্ষতা – এটা ধর্মহীনতা নয়, এটা সব ধর্মের সমান অধিকার তিনি সাম্প্রদায়িকতার কালো থাবা থেকে মুক্তির পথ দেখেছেন ধর্মনিরপেক্ষতায় আর তাই ধর্মনিরপেক্ষতা হয়েছে সংবিধানের তৃতীয় স্তম্ভ আর ছিল সার্বভৌমত্ব তিনি জানতেন কোন জোটে যোগ দেওয়া মানেই নিজেদের সার্বভৌমত্ব কিছুটা হলেও বিসর্জন দেওয়া একমাত্র জোটনিরপেক্ষতা সমাজতান্ত্রিক বা ধনতান্ত্রিক  কোন নির্দিষ্ট শিবিরে না গিয়ে দেশকে স্বাধীনভাবে বিকাশের সুযোগ দেবে সে থেকেই সার্বভৌমত্ব হয় সংবিধানের চতুর্থ স্তম্ভ তাই বঙ্গবন্ধু যখন মুক্তির কথা বলেন, তিনি গণতন্ত্রের কথা বলেন, তিনি সমাজতন্ত্রের কথা বলেন, তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন, তিনি সার্বভৌমত্বের কথা বলেন
বঙ্গবন্ধুর মত নেতা পৃথিবীতে বিরল তিনিই মনে হয় একমাত্র নেতা যিনি দু দুটো দেশের জন্মে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন যারা পাকিস্তানের ধারণাকে পূর্ব বাংলার মুসলমান সমাজের কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম আর যেহেতু বাংলায় ভোটে বিজয়ী হওয়ার কারণেই পাকিস্তান স্বপ্ন থেকে বাস্তবতা লাভ করে, তাঁকে নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের স্থপতিদের একজন বলা যায় আর বাংলাদেশের যে তিনি স্থপতি সেটা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না 
আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী মন দিয়ে পড়ি, দেখব তাঁর বিবর্তন দ্বিজাতি তত্ত্বে বিশ্বাস করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দিয়ে শুরু করলেও সময়ের সাথে সাথে তিনি নিজেকে পরিবর্তন করেন, সেই সাথে পরিবর্তন করেন নিজ দলের আদর্শ ৭ মার্চ তিনি আর শুধু শেখ মুজিবুর রহমান নন, তিনি বঙ্গবন্ধু তিনি এদেশের মানুষের প্রিয় নেতা এখন তিনি শুধু স্বাধীনতাই চান না, তিনি চান মুক্তি আর মুক্তি বলতে তিনি কি বোঝাচ্ছেন সেটা আমি আগেই উল্লেখ করেছি অন্য কেউ অন্যভাবে এর ব্যাখ্যা দিতে পারে, কিন্তু এটা আমার ব্যাখ্যা, আমার বিশ্বাস আমরা যারা সোভিয়েত ইউনিয়নে লেখাপড়া করেছি, তারা জানি তিনি চেয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন যেন তাঁর দেশের জন্য মানুষ গড়ে দেয় কিরকম মানুষ? অবশ্যই যারা সমাজতন্ত্র গড়বে, যারা শোষণহীন সমাজ গড়বে তাঁর বাকশালও কী সেই ইঙ্গিতই দেয় না? এখানে আরও একটা কথা সমাজতন্ত্রের আদর্শের প্রতি তিনি বিশ্বাস করলেও নিজে কিন্তু সেই সময়ে বিদ্যমান কোন সমাজতান্ত্রিক দলে যোগদান করেননি তিনি নিজেকে বদলিয়েছেন, নিজের দলকে বদলিয়েছেন আজকাল রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা নিজেকে বদলায় না, দল বদলায় সেটাও ভাবার বিষয়

বঙ্গবন্ধু আমাদের দেশের, এই ভূমির প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তিনি সারা জীবন সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন, সেই অভিজ্ঞতার আলোকে নিজের রাজনৈতিক ভাবাদর্শ বদলিয়েছেন আর সেটা করেছেন নিজের জন্য নয়, দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য আর তাই রাজনৈতিক খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করে তিনি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সার্বভৌমত্বকে বেছে নিয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে এটাই আমাদের প্রতি তাঁর রাজনৈতিক উইল বা আদেশ  বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনী শেষ করতে পারেননি, তবে তাঁর পরবর্তী জীবনের কাজকর্ম স্পষ্টভাবে আমাদের সেই দিক নির্দেশনা দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এটা তাঁকে অন্ধভাবে ভালোবাসা নয়, এটা তাঁর নির্দেশিত পথে দেশ গড়া, সমাজ বদলানো শুধু মাত্র সেটা করেই আমরা এই অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শেষ পাতাগুলো লিখতে পারব ধন্যবাদ!    

দুবনা - মস্কো, ১৭ মার্চ ২০১৯    

পুনশ্চঃ
অজ্ঞাত কারণে সেদিন পুরো প্রবন্ধ পড়া সম্ভব হয়নি। কিছু অপ্রীতিকর ঘটনারও সূত্রপাত হয়। এ নিয়ে এক বন্ধুর সাথে কথা বলার সময় ও বলে “এখন দেশে অনুসরণের সংজ্ঞা বদলে গেছে। অনুসরণ মানে আমি যা করি সেটা করার দরকার নেই, আমি যেটা বলি সেটা কর।“ সমস্যা হল বঙ্গবন্ধু যেটা করেছেন আমরা সেটা তো করছিই না, এমনকি তিনি যেটা বলে গেছেন সেটাও করছি না।  

দুবনা, ০৪ এপ্রিল ২০১৯  



                         

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি