দিমিত্রি ইভানভিচ মেন্দেলিয়েভ – বিজ্ঞানী ও মানুষ


তবোলস্ক রাশিয়ার ছোট্ট একটা শহরের নাম তেল ও গ্যাসের জন্য বিখ্যাত তুমেন্সক প্রদেশে অবস্থিত সুদূর ১৫৮৭ সালে এই শহর প্রতিষ্ঠা করা হয় সাইবেরিয়া জয়ের জন্য, যদিও শহরের স্ট্যাটাস সে পায় আরও তিন বছর পরে ১৫৯০ সালে এটাই সাইবেরিয়ার প্রথম শহর ষোড়শ শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত তবোলস্কই ছিল সাইবেরিয়ার প্রধান রাজনৈতিক, ধর্মীয়, শাসনতান্ত্রিক ও সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর ১৭০৮ সাল থেকে এটা ছিল উরাল পর্বতশ্রেণী থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল সাইবেরিয়ার কেন্দ্রস্থল তবে উনিশ শতকে তবোলস্ককে পাশ কাটিয়ে নতুন রাস্তাঘাট ও বানিজ্যপথ গড়ে ওঠার কারণে সে তার পূর্বের গৌরব ও গুরুত্ব হারাতে শুরু করে       
তবোলস্ক যখন তার অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে একটা সাধারণ শহরে পরিণত হতে চলেছে তখনই ইভান পাভলোভিচ মেন্দেলিয়েভ ও মারিয়া দমিত্রিয়েভনা মেন্দেলিয়েভার কোল আলো করে জন্ম নেয় দমিত্রি বা দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিয়েভ তার জন্ম ১৮৩৪ সালের ২৭ জানুয়ারি বা নতুন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৮ ফেব্রুয়ারি পিতা ইভান পাভলোভিচ মেন্দেলিয়েভ ছিলেন তখন তবোলস্ক জিমনেশিয়াম এবং তবোলস্ক এলাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডাইরেক্টর দিমিত্রি ছিল পরিবারের সপ্তদশ (মতান্তরে চতুর্দশ) ও কনিষ্ঠ সন্তান ইতিহাস থেকে জানা যায় সতেরো সন্তানের আট জনেরই মৃত্যু ঘটে শিশুকালে          
১৮৩৪ সালে দিমিত্রির জন্মের কিছুদিন পরে তার বাবা ইভান পাভলোভিচ অন্ধ হয়ে গেলে চাকুরিচ্যুত হন আর ১৮৪৭ সালে দিমিত্রির বয়েস যখন মাত্র তেরো তখন তিনি মারা যান ফলে বিশাল সংসারের দায়িত্ব পড়ে মা মারিয়া দিমিত্রিয়েভনার হাতে এই মহীয়সী মহিলা শুধুমাত্র যে একটি ছোট্ট কাঁচের কারখানাই চালাতেন তা নয়, নিজের সব সন্তানদের সেই সময়কার সবচেয়ে ভালো শিক্ষা দিতেও সমর্থ হন তিনি ছোট ছেলের মধ্যে অনন্য প্রতিভা দেখতে পান আর সেই প্রতিভার বিকাশে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন কিন্তু তবোলস্ক জিমনেশিয়ামে দিমিত্রি তেমন কৃতিত্বের পরিচয় দেয় নি অনেক সাবজেক্টই তার তেমন ভালো লাগত না, যদিও পদার্থবিদ্যা আর গণিতের প্রতি তার ছিল অদম্য আগ্রহ প্রথাগত শিক্ষার প্রতি তার বিরাগ ছিল সারা জীবন  
মারিয়া দিমিত্রিয়েভনা ১৯৫০ সালে যখন মারা যান দিমিত্রির বয়স তখন মাত্র ষোল  দিমিত্রি ইভানোভিচ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর মাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতেন বহু বছর পরে নিজের এক গবেষণা পত্র “একক ওজনের মাধ্যমে জলীয় দ্রবণের গবেষণা” মায়ের স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ করে তিনি লিখেছেন “মা আমাদের প্রতিপালন করেছেন ভালোবাসা দিয়ে, শেষ শক্তি আর অর্থ ব্যয় করে আমাদের সাইবেরিয়া থেকে বের করে এনেছেন শুধুমাত্র বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য মৃত্যুকালে বলেছেন, আমরা যেন আত্মতুষ্টিতে না ভুগি, যেন পরিশ্রমী হই, কথায় নয় যেন কাজে বৈজ্ঞানিক সত্য সন্ধান করি, কেননা তিনি জানতেন আমাদের আরও অনেক অনেক জানতে হবে, বিজ্ঞানের পথে, ভালবাসা দিয়ে কিন্তু দৃঢ় ভাবে সমস্ত কুসংস্কার ও ভুলগুলো নির্মূল করেই শুধু সত্যিকারের জ্ঞান লাভ সম্ভব সত্যের সুরক্ষা, স্বাধীন বিকাশ, সার্বজনীন মঙ্গল আর মানসিক প্রশান্তি – এটাই হবে গবেষণার প্রধান অর্জন” মায়ের এই শেষ ইচ্ছাকে দিমিত্রি ইভানোভিচ পবিত্র বলে বিবেচনা করতেন  

নিজের প্রতিভা বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ মেন্দেলিয়েভ পান পিতারবুরগে প্রধান পেডাগগিক্যাল ইন্সটিটিউটে সেখানকার শিক্ষকেরা তাঁদের ছাত্রদের মনে বিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসার বীজ বপন করতেন এখানে কাজ করতেন পিতারবুরগ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকেরা ইন্সটিটিউটের পরিবেশ, স্বল্প সংখ্যক ছাত্র, শিক্ষকদের পিতৃসম ভালোবাসা এ সবই ছাত্রদের ব্যক্তিগত প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অবদান রাখত
ছাত্রজীবনে মেন্দেলিয়েভের গবেষণার বিষয় ছিল আনালিটিক্যাল কেমিস্ট্রি, অরথাইট ও পাইরেক্সিনের গঠন অধ্যয়ন করা পরবর্তীতে তিনি কখনোই কেমিক্যাল আনালাইসিস নিয়ে কাজ করেননি, যদি এটাকে মনে করতেন বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল পরিমার্জনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ্ধতি তিনি মনে করতেন “প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতই মিনেরলজির সূত্রও সেই  তিনটি বিভাগের অন্তর্গত, যা কিনা বস্তুর আকার বা ফর্ম, গঠন বা বিষয়বস্তু ও গুনাবলী নির্ধারণ করে বস্তুর আকার ক্রিস্টালগ্রাফির সূত্র মেনে চলে, আর তার গুনাবলী ও গঠন পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের সূত্র মেনে চলে
ইন্সটিটিউট শেষ করে মেন্দেলিয়েভ প্রথমে সিম্ফেরাপোলে, তারপর ওদেসায় শিক্ষকতা করেন ১৮৫৬ সালে সাঙ্কত পিতারবুরগ ফিরে এসে কেমিস্ট্রিতে মাস্টার্স থেসিস ডিফেন্ড করেন ২৩ বছর বয়সে তিনি পিতারবুরগ ইউনিভার্সিটিতে এসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন যেখানে প্রথমে তাত্ত্বিক ও পরে অরগ্যানিক কেমিস্ট্রি পড়াতেন    
১৮৫৯ সালে মেন্দেলিয়েভ দুই বছরের জন্য হেইডেলবারগ যান সেখানে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন স্বনামধন্য  বিজ্ঞানীর সান্নিধ্য লাভ করেন এবং নিজের তৈরি ল্যাবরেটরিতে ক্যাপিলিয়ারিটি (কৈশিকতা) এবং তরলের সারফেস টেনশনের উপর গবেষণা করেন হেইডেলবারগে গবেষণার শেষের দিকে মেন্দেলিয়েভ লেখেন “আমার গবেষণার মূল বিষয় হল ভৌতিক রসায়ন এমন কি নিউটন বিশ্বাস করতেন যে রাসায়নিক প্রক্রিয়ার কারণ হল বলবিদ্যার অনুরূপ আন্তঃআণবিক আকর্ষণ শক্তি রাসায়নিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন আবিষ্কার রসায়নকে পদার্থবিদ্যা ও বলবিদ্যা থেকে আলাদা করে নতুন এক বিজ্ঞানে পরিণত করেছে কিন্তু একদিন সেই সময় আসবে যখন রাসায়নিক সম্পর্ক বলবিদ্যা বা যান্ত্রিক ঘটনা বলে বিবেচিত হবে আমার গবেষণা সেই দিনকে এগিয়ে নিয়ে আসবে        
১৮৬১ সালে মেন্দেলিয়েভ সাঙ্কত পিতেরবুরগ প্রত্যাবর্তন করেন এবং ইউনিভার্সিটিতে অরগানিক কেমিস্ট্রির উপর শিক্ষকতা শুরু করেন এ সময় এই বিষয়ের উপর তাঁর কতগুলো বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ বের হয় তিনি ছিলেন অরগানিক কেমিস্ট্রিতে রাশিয়ার প্রথম তাত্ত্বিকদের একজন এর পরেও অরগানিক কেমিস্ট্রি মেন্দেলিয়েভের কর্মজীবনের কোন উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রে পরিণত হয়নি ১৮৬৩ সালে পিতেরবুরগ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা ও গণিত ফ্যাকাল্টি তাঁকে টেকনোলোজি ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়, কিন্তু টেকনোলজির উপর মাস্টার্স ডিগ্রী না থাকায় তাঁর নিয়োগ হয় ১৮৬৫ সালে তিনি অবশ্য ১৮৬৪ সালে পিতেরবুরগ টেকনোলজিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক হিসেবে নির্বাচিত হন     
১৮৬৫ সালে তিনি “জলের সাথে অ্যালকোহলের যোগ সম্পর্কে” (About alcohol compounds with water ) নামে ডিএসসি থেসিস ডিফেন্ড করেন আর ১৮৬৭ সালে ইউনিভার্সিটির অজৈব রসায়ন বিভাগের দায়িত্ব পান এই পদে তিনি দীর্ঘ ২৩ বছর অধিষ্ঠিত ছিলেন   
ছাত্রদের পড়াতে গিয়ে তাঁকে নিজেকেই বই লিখতে হল তিনি যখন কেমিক্যাল এলিমেন্টগুলোর আলোচনা পর্যানুক্রমে করতে চাইলেন দেখলেন কাজটা সহজ নয় তিনি প্রথমে যোজনী অনুসারে সেটা করার সিদ্ধান্ত নিলেন, কিন্তু পরে বিভিন্ন এলিমেন্টের সাদৃশ্য ও পারমানবিক ভরের উপর ভিত্তি করে সেটা করার পক্ষে মত দেন এটাই পরবর্তীতে তাঁকে জীবনের প্রধান আবিষ্কারের দিকে নিয়ে গেল যা মেন্দেলিয়েভের পেরিওডিক টেবিল বা পর্যায়ক্রমিক সারণী নামে খ্যাতি লাভ করে
কিছু কিছু এলিমেন্টের মধ্যে যে সাদৃশ্য বিদ্যমান সেটা অনেকেরই জানা ছিল ১৮৫৭ সালে সুইডিশ রসায়নবিদ লেন্সেন এ বিষয়ে লিখেন মেন্দেলিয়েভের লাইব্রেরিতে ১৮৪৩ সালে প্রকাশিত জার্মান রসায়নবিদ গ্মেলেনের একটা টেবিলও ছিল ১৮৫৭ সালে ইংরেজ রসায়নবিদ অডলিং তাঁর ভার্সন প্রকাশ করেন কিন্তু কোন টেবিলই সেসময় জ্ঞাত সব এলিমেন্টকে একটি মাত্র টেবিল বা সারণীতে প্রকাশে সফল হয় না যদিও বিভিন্ন গ্রুপ ও বিভিন্ন ফ্যামিলির উপস্থিতি ছিল প্রতিষ্ঠিত সত্য, কিন্তু এই সব গ্রুপ ও ফ্যামিলির আন্তঃসম্পর্ক ছিল অজানা  
মেন্দেলিয়েভ পারমানবিক ভর বৃদ্ধির পর্যায়ক্রমে প্রতিটি কেমিক্যাল এলিমেন্টগুলো সাজিয়ে সেই সম্পর্ক আবিষ্কার করতে সমর্থ হন এজন্যে তাঁকে প্রচুর মানসিক পরিশ্রম করতে হয় তিনি প্রতিটি এলিমেন্টের পারমানবিক ভর ও মূল গুলাবলী আলাদা আলাদা কার্ডে লিখতে শুরু করেন এবং সেই কার্ডগুলো বিভিন্ন কম্বিনেশনে সাজান কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল তখন পর্যন্ত অনেক এলিমেন্ট আবিষ্কৃত হয়নি আর তাদের পারমানবিক ভর তখনও পর্যন্ত খুব নিখুঁত ভাবে নির্ণীত হয়নি প্রায় ১৫ বছর যাব অক্লান্ত পরিশ্রমের পর দিমিত্রি ইভানোভিচ যখন আশা ছেড়ে দেন, তখনই সমস্যার সমাধান আসে তাঁর নিজের ভাষায় “সারা রাত না ঘুমিয়ে, সমাধানের আশা ছেড়ে এক সুন্দর সকালে আমি যখন জামাকাপড় না খুলেই আমার কেবিনেটের সোফায় শুয়ে পড়ি এবং অচিরেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়ি স্বপ্নে আমি সেই সারণী দেখতে পাই আমি সাথে সাথে ঘুম থেকে উঠে পড়ি এবং হাতের কাছে পাওয়া প্রথম কাগজের টুকরোয় স্বপ্নে দেখা সেই সারণী টুকে রাখি” এ থেকে দেখা যায় যে “মেন্দেলিয়েভের টেবিল স্বপ্নে পাওয়া” মেন্দেলিয়েভ নিজেই এই কিংবদন্তী তৈরি  করেন বিজ্ঞানের সেই অন্ধ ভক্তদের জন্য যারা অন্তর্দৃষ্টি ব্যাপারটা যে কী সেটা ঠিক বুঝতে পারে না
নিজে যেহেতু রসায়নবিদ তাই মেন্দেলিয়েভ এলিমেন্টের রাসায়নিক গুণাবলী তাঁর সিস্টেমের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেন এবং রাসায়নিকভাবে সাদৃশ্য মূলক এলিমেন্টগুলো একের পর এক সাজাতে থাকেন কিন্তু এতে কোন ফল আসে না তখন তিনি ইচ্ছে মত কিছু কিছু এলিমেন্টের পারমাণবিক ভর বদলান (যেমন ৬০ এর পরিবর্তে তিনি ইউরেনিয়ামের ভর লেখেন ২৪০), কোবাল্ট ও নিকেল, টেলুরিয়াম ও আয়োডিন পুনর্বিন্যাস করেন এবং তখনও পর্যন্ত অজ্ঞাত এলিমেন্টদের জন্য তিনটে ঘর ফাঁকা রাখেন এভাবে তিনি তাঁসারণীর প্রথম ভার্সন প্রকাশ করেন ১৮৬৯ সালে তাঁর আবিষ্কৃত সূত্র বলে “রাসায়নিক এলিমেন্টের বৈশিষ্ট্য তাদের পারমাণবিক ওজনের উপর নির্ভরশীল (properties of elements are periodically dependent on their atomic weight)    
মেন্দিলিয়েভের আবিষ্কারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল তা একেবারে আলাদা বলে মনে হওয়া উপাদানগুলির সমস্ত গোষ্ঠীগুলিকে একত্রিত করতে পেরেছিল এই পর্যায়ক্রমিক টেবিলের অপ্রত্যাশিত ব্যর্থতা তিনি বেশ সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করেন এই বলে যে অনেক রাসায়নিক এলিমেন্ট বিজ্ঞানে তখনো অজানা তাই টেবিলে তিনি বেশ কিছু ঘর ফাঁকা রেখেছিলেন,  কিন্তু প্রস্তাবিত এলিমেন্টের পারমাণবিক ভর ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন তিনি একই সাথে কিছু সংখ্যক এলিমেন্টের পারমাণবিক ভর সংশোধন করেন পরবর্তী বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল তাঁর তত্ত্বের নির্ভুলতা প্রমাণ করে

প্রথম কয়েক বছর মেন্দেলিয়েভ তাঁর সারণীতে বিভিন্ন পরিবর্তন আনেন ১৮৬৯ সালে তিনি হ্যালোজেন ও ক্ষারীয় ধাতুকে টেবিলের কেন্দ্র থেকে প্রান্তে নিয়ে আসেন পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি ১১ টি এলিমেন্টের পারমাণবিক ভর সংশোধন করেন এবং ২০ টি এলিমেন্টের স্থান পরিবর্তন করেন এর ফলে ১৮৭১ সালে তিনি “রাসায়নিক এলিমেন্টের পর্যায়ক্রমিক সূত্র” নামে প্রবন্ধ প্রকাশ করেন যাতে মেন্দেলিয়েভের টেবিল বলতে গেলে আধুনিক রূপ পায় তাঁর এই নিবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে তখনকার সমস্ত বিখ্যাত রসায়নবিদদের কাছে পাঠানো হয়, কিন্তু কেউই এই আবিষ্কারের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি ১৮৭৫ সালে লেককডে বুয়াবদ্রান (F. Lekokde Buabodran) গ্যালিয়াম আবিষ্কার করেন যার বৈশিষ্ট্য মেন্দেলিয়েভের করা পূর্বাভাষের সাথে মিলে যায় তখন থেকেই এই সারণীর প্রতি রসায়নবিদদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন শুরু হয় ১৮৭৯ সালে স্ক্যান্ডিয়াম আর ১৮৮৬ সালে জার্মানি আবিষ্কৃত হয় এদের বৈশিষ্ট্য মেন্দেলিয়েভের বর্ণনার সাথে পুরোপুরি মিলে যায় এটা ছিল মেন্দেলিয়েভের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিজয়   
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে আরেক রাশিয়ান বিজ্ঞানী আলেক্সান্দর ফ্রিদমান সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বের এক গাণিতিক মডেল তৈরি করেন ১৯২২ সালে যেহেতু তখন বিশ্বাস করা হত যে মহাবিশ্ব পরিবর্তনশীল নয়, আইনস্টাইন সেটাকে ভুল বলে পরিত্যাগ করেন কিন্তু ১৯২৯ সালে হাবলের আবিষ্কারের পর মহাবিশ্ব যে সম্প্রসারিত হচ্ছে সেটা প্রমানিত হয় বর্তমানে ফ্রিদমানের মহাবিশ্ব কসমোলজির সবচেয়ে পরিচিত, ব্যবহৃত ও গ্রহণযোগ্য মডেল   
জীবনের শেষ পর্যন্ত মেন্দেলিয়েভ তাঁর পেরিওডিক তত্ত্বের বিকাশ উন্নতি অব্যাহত রেখেছিলেন ১৮৯০-এর দশকে  তেজস্ক্রিয়তা এবং নিষ্ক্রিয় গ্যাসের আবিষ্কারে পর্যায়ক্রমিক সারণী গুরুতর সমস্যার সম্মুখীন হয় ১৯০০ সালে হিলিয়াম, আর্গন ইত্যাদি নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলো শূন্য গ্রুপ নামে এক নতুন গ্রুপে স্থাপন করার মধ্য দিয়ে  সমস্যাটি সফলভাবে সমাধান করা হয়েছিল পরবর্তী আবিষ্কারগুলো রেডিও আক্টিভ বা তেজস্ক্রিয় উপাদানের প্রাচুর্যকে পর্যায়ক্রমিক সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত করতে সাহায্য করেছে
মেন্দেলিয়েভ নিজে মনে করতেন ফিজিক্যাল ব্যাখ্যার অনুপস্থিতি পেরিওডিক সূত্র এবং পেরিওডিক সিস্টেমের  প্রধানতম ত্রুটি কিন্তু যতদিন না পরমানুর মডেল তৈরি হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত এটি অসম্ভব ছিল  তিনি  দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে "পেরিওডিক  সুত্রের  ভবিষ্যত মোটেই হুমকির সম্মুখীন নয়, বরং ভবিষ্যতে   এই সূত্র কাঠামোগত ভাবে শুধু উন্নতই হবে"

১৮৯০ সালে দিমিত্রি ইভানোভিচ  বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন লঙ্ঘনের প্রতিবাদে সেন্ট পিটার্সবার্গে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান এবং সমস্ত শক্তি ব্যবহারিক গবেষণায় নিয়োজিত করেন সেই ১৮৬০ দশকেই  দিমিত্রি ইভানোভিচ শিল্পের সাথে জড়িত বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করতে শুরু করেন তাই এই প্রতিভাকে কাজে লাগনোর জন্য সরকার তাঁকে প্রাথমিক অর্থনৈতিক বিষয়গুলির, বিশেষ করে কাস্টমস শুল্কের উন্নয়নের কাজে নিযুক্ত করে মেন্দেলিয়েভ উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে রাশিয়ার কাস্টমস এবং শুল্ক নীতি প্রণয়ন বাস্তবায়নে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন

১৮৯১ সালে নৌ মন্ত্রণালয় ধূমহীন (ধোঁয়াহীন) বিস্ফোরক পাউডার উদ্ভাবনের জন্য মেন্দেলিয়েভকে দায়িত্ব প্রদান করে এবং ১৮৯২ সালে তিনি অত্যন্ত সফলতার সাথে এই কাজটি সম্পাদন করেন
১৮৯৩ সালে সদ্য রূপান্তরিত মাপ ও ওজন চেম্বারের (chambers of weights and measures) প্রধান (ম্যানেজার) হিসেবে মেন্দেলিয়েভকে নিযুক্ত করা হয় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন সেখানে তিনি মেট্রলজি (metrology)   বা মাত্রাবিজ্ঞানের উপর কাজের সমন্বয় করেন ১৮৯৯ সালে উরালের বিভিন্ন কারখানা ভ্রমণের ফলাফল ছিল সেখানকার শিল্পের উপর একটি বিস্তৃত এবং অত্যন্ত তথ্যপূর্ণ বই মাতৃভূমির সেবায় যে তিনটি প্রধান বিষয়ে মেন্দেলিয়েভের কাজকর্ম বিস্তৃত ছিল সেগুলো হল প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, শিক্ষা ও অর্থনীতি বিজ্ঞানীর নিজের ভাষায় “আমি কখনই একজন শিল্পপতি, নির্মাতা বা ব্যবসায়ী ছিলাম না, হবও না,  কিন্তু আমি জানি যে তাদের প্রতি উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব না দিয়ে আপনি রাশিয়ার জন্য কল্যাণমূলক বিকাশের কথা ভাবতে পারবেন না“ দীর্ঘ দিন তিনি ছিলেন রাশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যারা সংগ্রাম করেন তাদের প্রথম সারির একজন কিন্তু শিল্প বিকাশের জন্য কাজ করে তিনি পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারেননি ১৮৮৮ সালে মেন্দেলিয়েভ  ডন এবং উত্তর দনেতস নদ দুটো   পরিষ্কার করার জন্য একটি প্রকল্প তৈরি করেন ১৮৯০ দশকে বিজ্ঞানী ব্রোকহাউস এবং এফ্রন এনসাইক্লোপিডিক অভিধানের প্রকাশনায় অংশ নেন,  যেখানে তিনি প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক উস সংরক্ষণের উপর বেশ কয়েকটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন তাঁর কথায় “যতদিন সম্ভব আমি আমার দেশে একটি ফলপ্রসূ শিল্প ও ব্যবসায়িক ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করব  ... বিজ্ঞান এবং শিল্প – এটাই আমার স্বপ্ন
কে এই দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিয়েভ? লেভ আলেসান্দ্রভিচ চুগায়েভের ভাষায় “মেন্দেলিয়েভ একজন জিনিয়াস রসায়নবিদ, প্রথম শ্রেনীর পদার্থবিদ; হাইড্রোডাইনামিকস,  আবহাওয়া,  ভূতত্ত্ব,  রাসায়নিক প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখার ফলপ্রসূ গবেষক; রসায়ন পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি রাসায়নিক শিল্পের অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ;  

      
রাশিয়ান অর্থনীতির একজন বিশেষ চিন্তাবিদ“ এ ছাড়াও তিনি একজন মহান শিক্ষক এই মহা বিজ্ঞানী মারা যান সাঙ্কত পিতেরবুরগে ১৯০৭ সালের ২০ জানুয়ারি (নতুন পঞ্জিকা অনুযায়ী ২ ফেব্রুয়ারি)
সোভিয়েত ইউনিয়নে যেমন, আধুনিক রাশিয়াতেও তেমনি এ দেশের খ্যাতিমান বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষদের স্মৃতি অত্যন্ত যত্নের সাথে সংরক্ষণ করা হয়। দিমিত্রি ইভানোভিচের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ১৮৬০ সালে পিতারবুরগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩১ বছর বয়েসী অধ্যাপক মস্কো রিজিওনের ক্লিন অঞ্চলে প্রিন্স দাদিয়ানির উত্তরসূরিদের কাছ থেকে “ববলভা” এস্টেট কিনে নেন। এই এস্টেট ছিল লুতস্নিয়া নদীর অদূরে “ববলভ” পাহাড়ে অবস্থিত। বাড়ির বারান্দা থেকে দেখা যেত বিস্ময়কর প্রাকৃতিক দৃশ্য যার গুণগান গাওয়া হয়েছে আলেক্সান্দর ব্লক, আন্না আখমাতভা, আন্দ্রেই বেলির মত বিখ্যাত কবিদের কবিতায়। দিমিত্রি ইভানোভিচের এস্টেটে অতিথিদের মধ্যে ছিলেন পপোভ, সেচেনভ, দকুচায়েভ, তিমির‍্যাজেভ, রেপিন, ইয়ারোশেঙ্কো, কুইঞ্জি, ভ্রুবেলের মত বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ও শিল্পীগণ। এখানে তিনি চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় বাস করেন। এখানেই তিনি তাঁর বিখ্যাত পর্যায়ক্রমিক সারণী তৈরি করেন। “দিমিত্রি মেন্দেলিয়েভ রাষ্ট্রীয় যাদুঘর” নামে সেই বাড়িতে বর্তমানে দিমিত্রি ইভানোভিচের জীবন ও কর্মের উপর বিভিন্ন প্রদর্শনী কাজ করে। সেখানে রয়েছে এই মহান বিজ্ঞানীর বিভিন্ন ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, দুর্লভ বইয়ের সংগ্রহ, ডকুমেন্ট, চিত্রকলা আর সেই টেবিল যেখানে বসে দিমিত্রি ইভানোভিচ তাঁর যুগান্তকারী সারণী তৈরি করেছেন। এ ছাড়াও রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে তাঁর নামে আছে বিভিন্ন রাস্তা, মস্কোয় একটি মেট্রো স্টেশনের নাম তাঁর নামানুসারে করা হয়েছে।
মস্কোয় আছে মেন্দেলিয়েভ কেমিকো-টেকনলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি। দুবনায় ভল্গা নদীর তীর মেন্দেলিয়েভের নামে।       
দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিয়েভ ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম রসায়নবিদদের একজন তাই তাঁর রসায়নে নোবেল প্রাইজ না পাওয়াটা অনেকের কাছেই রহস্য কিন্তু একজন বিজ্ঞানী কখনোই কোন পুরস্কারের (এমন কি নোবেল প্রাইজ) জন্য গবেষণা করেন না বিজ্ঞানী সত্যের সন্ধানী গবেষণার আনন্দই তাঁকে পথ চলতে সাহায্য করে সত্যকে জানাই তাঁর জন্য আসল পুরস্কার
তিনি হাতে গোনা বিজ্ঞানীদের একজন যার আবিষ্কার বা শিক্ষা বলতে গেলে অপরিবর্তনীয় রয়েছে নিউটনের কথা ভাবুন তাঁর অনেক আবিষ্কার আজ প্রশ্নের সম্মুখীন, অন্তত বস্তুর বেগ যখন আলোর বেগের সমতুল্য, তখন সেই তত্ত্ব কাজ করে না তখন আমরা আইনস্টাইনের শরণাপন্ন হই কসমোলজির সর্বশেষ আবিষ্কারগুলো আইনস্টাইনের সূত্রের সঠিকতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে সেদিক থেকে দেখলে মেন্দেলিয়েভের পর্যায়ক্রমিক সারণী এখনও সাফল্যের সাথে বিজ্ঞানের সেবা করে যাচ্ছে এখনও দুবনাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন ল্যাবরেটরিতে নতুন নতুন কেমিক্যাল এলিমেন্ট সিন্থেসিস করা হচ্ছে ১০১ নম্বর রাসায়নিক এলিমেন্ট তাঁর নামে উৎসর্গ করা হয়েছে যার নাম রাখা হয়েছে মেন্দেলিয়েভি অনেকের মতে দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিয়েভ হলেন রসায়নের আইনস্টাইন      
দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিয়েভের মত এমন বহুমুখী প্রতিভার এক বিশাল ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে এত স্বল্প পরিসরে লেখা সত্যিই কঠিন তারপরেও যে দুটো কথা না বললেই নয় তা হল তাঁর জীবনের লক্ষ্যই ছিল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সত্যকে জানা এবং জন্মভূমি রাশিয়ার সার্বিক উন্নতির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তিনি কখনোই ক্ষমতাসীনদের সাথে আপো করেননি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে তিনি অধ্যাপকের পদ থেকে পদত্যাগ পর্যন্ত করতে পিছু পা হননি তিনি শুধু একজন বিশ্বমানের বিজ্ঞানীই নন, তিনি একজন সত্যিকারের মানুষও বটে তাঁর জীবন থেকে তাই রসায়ন বা বিজ্ঞানের বাইরেও আমাদের অনেক কিছুই শেখার আছে       

সূত্র

লেভ আলেক্সাদ্রোভিচ চুগায়েভ – দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিয়েভ
জীবন এবং কর্ম লেনিনগ্রাদ, কেমিকো- টেকনিক্যাল প্রকাশনী (১৯২৪) (রাশিয়ান)
সমসাময়িকদের স্মৃতিকথায় দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিয়েভ মস্কো, আতমিজদাত (১৯৭৩) (রাশিয়ান)
দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিয়েভ – জ্ঞানের সীমানা আগে থেকে দেখা অসম্ভব মস্কো, সোভিয়েত রাশিয়া (১৯৯১) (রাশিয়ান)
দুবনা, ২০ মার্চ - ২৪ এপ্রিল ২০১৯


ফেব্রুয়ারির ২৩ তারিখে জাহীদ বিজ্ঞানচিন্তার জন্য একটা লেখা চাইছিল দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিয়েভের উপর। প্রথমে একটু আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত রাজী হয়েছিলাম। বিভিন্ন কারণে লেখাটি সময় মত দিতে পারিনি, তাই বিজ্ঞানচিন্তা মেন্দেলিয়েভকে ছাড়াই বেরিয়ে গেছে। লেখাটি তৈরি করতে গিয়ে অনেক কিছুই পড়তে হয়েছে, জানা হয়েছে অনেক নতুন তথ্য। জেনেছি দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিয়েভ শুধু একজন বিশ্বখ্যাত রসায়নবিদই নন, বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন মানুষ। সত্যিকার মানুষ। কিন্তু লেখাটি যখন তৈরি করাই হয়েছে, তাই এখানে শেয়ার করছি, যদি কেউ এ থেকে নতুন কিছু জানতে পারে এই আশায়।

দুবনা, ২৪ এপ্রিল ২০১৯        




Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

রাজনীতি

স্মৃতি