নো ম্যান্স ল্যান্ডের বাসিন্দারা

মৃত্যুলোকে হঠাৎই প্রচণ্ড শোরগোল। জন্মের পর থেকে কেউ এমনটা দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না। ওপারের ইমগ্রেশন অফিসাররা সব জড়ো হয়েছে, চলছে জল্পনা কল্পনা। ওখানে যে ভিড় একেবারে হয় না তা নয়, তবে সেটা হয় যুদ্ধের সময় বা কোন বড় ধরণের সন্ত্রাসী ঘটনার পরে, যখন প্রচুর মানুষ একসাথে মারা যায় আর সবাই এসে ভিড় করে মৃত্যুলোকের দ্বারে। অনেক আগে, যখন পাসপোর্ট ভিসার বালাই ছিল না, যখন সবাই শুধুই মৃত ছিল, ছিল না জাতপাতের ঝামেলা, তখন অবশ্য এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা ছিল না ওদের। মৃত্যুলোকের রক্ষীরা (আধুনিক ভাষায় ইমিগ্রেশন অফিসাররা) তাদের কাজকর্মের ফলস্বরূপ কাউকে স্বর্গে পাঠাতো, কাউকে নরকে। কিন্তু উন্নতির সাথে সাথে মানুষের বিভিন্ন রকম সার্টিফিকেট হয়েছে, তারা শুধু আগের মত মানুষই নেই, অ্যামেরিকান, ইউরোপিয়ান, রাশিয়ান, বাংলাদেশী, ভারতীয় ইত্যাদি হয়েছে। শুধু কি তাই, তারা এখন হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, ইহুদী – কত ভাগে যে বিভক্ত হয়েছে তার হিসেব আজ কে রাখে। তাই পরলোক হয়েছে অ্যাপারথাইড আমলের দক্ষিণ আফ্রিকার মত। কাউকে পাঠাতে হচ্ছে স্বর্গে, কাউকে বেহেশতে, কাউকে হেভেনে, কেউ যাচ্ছে নরকে, কে দোজখে, কেউ বা হেলে। একটু ভুল করলেই হল, ১৯৫৭ সালের মত সিপাহী বিদ্রোহ দেখা দেবে, তখন সামলাও ঠ্যালা।
তবে আজকে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা নজীরবিহীন। অ্যামেরিকান পাসপোর্টধারী দুই বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আগন্তুক এসেছে একই সাথে। দুজনেরই নাম “Mr. Kamal Mazumdar.” আর এখানেই লেগেছে যত গণ্ডগোল। ওয়ান ইলেভেনের আগে মিঃ এর পরিবর্তে শ্রী (Sri) বা মোঃ (Md) লেখা থাকতো, ফলে কার কোন ধর্ম সে নিয়ে রক্ষীদের মাথা ঘামাতে হত না। ওয়ান ইলেভেনের পর কেউ আর মাথা বাড়িয়ে নিজের ধর্মের পরিচয় দিতে চায় না, তাই সবাই লেখে মিঃ। আর মিঃ এর পরে Kamal এটা কামাল না কমল সেটা বের করা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়? এক সময় মজুমদার টাইটেল শুধু হিন্দুদেরই ছিল, এখন ওটা হিন্দু মুসলমান সবাই ব্যবহার করে। ফলে ইমিগ্রেশন অফিসারদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে, নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা চলছে কে এই আগন্তুকরা। ওরা এই দুজনকে নিয়ে এতো বিব্রত যে কেউ কেউ ওদের ঘাটের মরা বলে উল্লেখ করতেও দ্বিধা বোধ করছে না। শত হলেও মৃত্যুলোকের প্রহরী, দেবতার তুল্য। সামান্য মানুষের কাছে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে তো আর নিজেদের মান খোয়াতে পারে না। তাই ঠিক হল লটারি করে ওদের একজনকে পাঠানো হবে স্বর্গে, অন্য জনকে বেহেশতে।
কথায় বলে বিপদ আসলে সবদিক থেকেই আসে। লটারির দানে Mr. Kamal Mazumdar পাসপোর্টধারী শ্রী কমল মজুমদার চলে গেল বেহেশতে আর Mr. Kamal Mazumdar পাসপোর্টধারী মোঃ কামাল মজুমদার চলে গেল স্বর্গে। শুরু হল নতুন পরীক্ষা।
কমল মজুমদার ব্রহ্মচারী এবং চিরকুমার। অসংখ্য হুরপরীর মাঝে নিজের জায়গা সে খুঁজে পেল না। সে ভাবল এটা হয়তো নতুন কোন পরীক্ষা। সুন্দরী অপ্সরার প্রলোভন দেখিয়ে তাকে স্বর্গচ্যুত করার ষড়যন্ত্র। তাই সে একই সাথে মৌনব্রত ও অনশন ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত নিল। হুরপরীদের মাথায় হাত। বেহেশতের আগন্তুককে সেবা না করতে পারলে তাদের বেতন দেবে কে? তাদের চাকরিই বা থাকবে কি করে?

কামাল মজুমদারের অবস্থাও তথৈবচ। কোথাও কোন হুরপরীর দেখা নেই, শুধু খাবার আর খাবার। দই, মিষ্টি, ফলমূল  কী নেই সেখানে? কিন্তু আমাদের কামাল মজুমদার ননভেজ, নিরামিষ খাবার দেখেই তার বমির ভাব শুরু হল। নিরুপায় কামাল মজুমদার অনশন শুরু করল।

দু জনের অনশনের কথা স্বর্গ ও বেহেশতের অন্যান্য অধিবাসীদের কানে গেল। দু অঞ্চলেই ছিল নির্বাচিত পার্লামেন্ট, ছিল প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রী। অনশনকারীদের কাছে ডেলিগেশন পাঠানো হল তাদের দাবী দাওয়া জানার জন্য। শেষ পর্যন্ত পরিষ্কার হল যে বেহেশতের প্রজা স্বর্গে আর স্বর্গের প্রজা বেহেশতে চলে গেছে। কিন্তু চাইলেই তো আর বদলান যায় না। প্রোটোকল বলে একটা ব্যাপার আছে। তাই দু জনকেই যুদ্ধবন্দী হিসেবে ঘোষণা করা হল। শুরু হল বন্দী বিনিময় প্রক্রিয়া। দুই বন্দীর বিনময়ের জন্যে দু পক্ষের দশ জনের ডেলিগেশন কম করে হলেও বার দশেক মিলিত হল। এসব সম্মেলনে কত হুরপরী যে নাচ গান করল, আর কত খাবার যে নষ্ট হল তার হিসাব রাখতেই নতুন কমশন বসলো। এছাড়া তো ছিল ব্যায়ের হিসাব। অর্থ আত্মসাৎ, ইনকম্পিটেন্সিসহ হাজার অভিযোগ। এক কথায় মত্যুলোকে ছোটখাটো এক বিপ্লব ঘটে গেল। দেখা গেল মর্ত্যের মানুষ শুধু দেহটা ছাড়া আর সবই তাদের সাথে করে নিয়ে এসেছে। তারা আগের মতই লোভী, চোর, বাটপাড় ইত্যাদি। (জ্ঞানী ও সৎ যে নেই তা নয়, কিন্তু তারা ওখানেও কোন নির্বাচনে অংশ নেয় না, নিলেও পৃথিবীর মতই হেরে যায়)।
যাই হোক অনেক খড়কুটো পুড়িয়ে তাদের মুক্ত করা হল। কমল মজুমদার এলো স্বর্গে, আর কামাল মজুমদার বেহেশতে। কিন্তু এখানেই তাদের দুঃখের শেষ হল না।
কমল মজুমদার ডায়াবেটিকসের রোগী, হার্টেও সমস্যাও আছে। ডাক্তার তাকে মিষ্টি খাওয়া ক্যাটাগরিক্যালি নিষেধ করেছে, হাঁটতে বলেছে দৈনিক কয়েক কিলোমিটার। কিন্তু এখানে খাবার মানেই মিষ্টি। রসগোল্লা, চমচম, রাজভোগ, জিলাপি আর হরেক রকম ফল। হাঁটাচলার জায়গা নেই বললেই চলে। বলতে গেলে এটা বিশাল এক ডাইনিং রুম। চারিদিকে শুধু খাবার আর খাবার। স্বর্গে এসে কমল মজুমদার নরকের আগুনেই পুড়তে লাগলো। 

ওদিকে কামাল মজুমদার যে খুব ভালো আছে সেটাও বলা যায় না। পৃথিবীতে ভালোবাসা যে কাকে বলে সেটা সে জানত না। মেয়েদের সে সবসময়ই দেখেছে অবজ্ঞার চোখে। মেয়েরা ছিল দাসীর মত। কী নিজের বৌ, কী অন্য কেউ। সারা জীবন সে মেয়েদের বিরুদ্ধে বাজে মন্তব্য করেছে, বন্ধুদের সাথে মিলে মেয়েদের উতক্ত্য করেছে, এমন কী ধর্ষণ পর্যন্ত করেছে। তার চারিদিকে শুধু মেয়ে আর মেয়ে, যেন এক বিশাল হেরেম। যেখানে ভালবাসাই প্রথম ও প্রধান কথা সেই বেহেশতে সে নিজেকে কিছুতেই খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। যে বেহেশতের জন্য সে জিহাদের পর জিহাদ করেছে এখন দেখছে সে নিজেকে এই পরিবেশের জন্য গড়ে তোলেনি। সে এখানে অপাংক্তেয়, অযাচিত। বেহেশতে বসেও সে যেন দোজখের আগুনে জ্বলছে।  
অনেক ভেবে দু দুজনই তাদের কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানাল তাদেরকে নো ম্যান্স ল্যান্ডে মানে স্বর্গ ও বেহেশতের বাইরে পাঠিয়ে দিতে। ওরা দুজন এখন স্বর্গ, বেহেশত, হেভেন – এসবের মাঝে ঘুরে বেড়ায়, যখন যা পায় সেটাই খায়, গল্প করে ফেলে আসা পৃথিবীর দিনগুলোর আর ভাবে কেন ওরা পৃথিবীতে দুজন দুজনার বন্ধু হতে পারল না।                                            

দুবনা, ১৬ এপ্রিল ২০১৯ 




Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি