সোনার বাংলা
আজকাল দেশের
বিভিন্ন ঘটনা দেখে মনে হয় আমাদের দেশ যেন ইস্যু ভিত্তিক এক দেশ। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার ইস্যু থেকে যে আগুন
ছড়িয়ে পড়েছিল এদেশের মানুষের বুকে কালের বিবর্তনে একটার পর একটা ইস্যু যোগ হতে হতে
শেষ পর্যন্ত তা মুক্তিযুদ্ধের রূপ পায়। এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাঙ্গালী জাতি পায়
স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ। কিন্তু এত ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে
স্বাধীনতা পেলেও ইস্যুর শেষ হয়নি। সকালে আলিমদার তো বিকেলে প্রিয়া সাহা,
গতকাল ধর্ষণ তো আজ গণপিটুনি, এখন ডেঙ্গু তো তখন নোবেল। লাগাতার এই ইস্যু যেন বিগত দশকগুলোর লাগাতার হরতাল। এক ইস্যু থেকে বেরোতে না বেরোতেই আরেক ইস্যু সাধারণ মানুষের টুঁটি চেপে ধরছে, তার আর সময়ই থাকছে না অন্য কিছু নিয়ে
ভাবার।
গত দুদিন ফেসবুকে
নোবেলের এক সাক্ষাৎকার নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। এক বন্ধু আমাকে ভিডিওটা ইনবক্স করে। দেখে ভাল লাগেনি, তবে এ নিয়ে কিছু লিখব
বলে ভাবিনি। কারণ এদের যত কম পাত্তা দেওয়া যায় ততই ভাল। এখানে আমার জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে রাশিয়ার অভিজ্ঞতার কথা
মনে পড়ে গেল। বিপ্লব পরবর্তী ১৯২২ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত
সোভিয়েত ইউনিয়নের জাতীয় সঙ্গীত ছিল ইন্টারন্যাশনাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যেটাকে এরা মহান পিতৃভূমির যুদ্ধ নামে অভিহিত করে, দেশে
জাতীয়তাবাদী জাতীয় সঙ্গীতের প্রয়োজন মনে করে দেশীয় নেতৃত্ব। এ জন্যে বিশেষ কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশন আলেক্সান্দ্রভের সুর আর সেরগেই
মিখালকভের কথা নিয়ে রচনা করে এক মহান সঙ্গীত যেটা গেয়ে লাল ফৌজ ফ্যাসিবাদকে পরাজিত
করে। শুধু জাতীয় সঙ্গীতই নয় আরও অনেক যুগান্তকারী গান তখন
রচিত হয়েছে আর এই গান প্রেরণা যুগিয়েছে সোভিয়েত জনগণকে তাদের জীবন মরণ লড়াইয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়া আলেক্সান্দ্রভের
সুর করা সেই গান ত্যাগ করে। অনেক দিন পর্যন্ত জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে
গ্লিঙ্কার মিউজিক বাজানো হত। তখন দেখেছি রুশ খেলোয়াড়রা কীভাবে হতাশ
হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। সোভিয়েত জাতীয় সঙ্গীতের শক্তি আর ক্ষমতার
অভাব অনুভব করত এদেশের বেশিরভাগ মানুষ। পুতিন ক্ষমতায় এসে আলেসান্দ্রভের মিউজিক
ফিরিয়ে আনেন, শুরু হয় কথার সন্ধান। দেশ জুড়ে প্রতিযোগিতা। শেষ পর্যন্ত আবার সেরগেই মিখালকভ নিয়ে আসেন রাশিয়ার
বর্তমান জাতীয় সঙ্গীতের কথা। এ নিয়ে সমাজে বিশেষ করে পশ্চিম ঘেঁষা
লিবেরালদের মধ্যে কিছুটা অসন্তোষ দেখা দিলেও এখন বলা যায় রাশিয়ার জাতীয় সঙ্গীত কালোত্তীর্ণ।
নোবেল সেই
সাক্ষাৎকারে রবীন্দ্রনাথের “সোনার বাংলা”র সাথে জেমস/প্রিন্সের “বাংলাদেশ”এর তুলনায়
বলেছে তার মতে সোনার বাংলা বর্তমান বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করে না। বাংলাদেশ গানটিই নাকি
বর্তমান বাংলাদেশের জন্য বেশি প্রযোজ্য। ঘটনা কি জানার জন্য ইউটিউবে গানটা শুনলাম।
হ্যাঁ, বিগত কয়েক যুগের খ্যাতিমান মানুষদের অবদানের কথা স্মরণ করা হয়েছে এ গানে। কিন্তু
দেশ তো শুধু কিছু নেতা বা বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বনামধন্য কিছু মানুষ নয়। দেশ এসবের
ঊর্ধ্বে। এখানে আরও একটা কথা বলা দরকার। কিছু জিনিস আছে যা সময়ের সাথে না বাঁধাই
ভাল। এখানে আবার সোভিয়েত জাতীয় সঙ্গীতে ফিরে আসি। এক সময় সেখানে লেনিনের সাথে
স্ট্যালিনের নামও ছিল। পরে ক্রুশ্চেভ সেটা সরিয়ে ফেলে। বাংলাদেশ গানে এই যে এত
মানুষের গুণগান – এক সময় এদের কাউকে না কাউকে অন্যদের ভাল নাও লাগতে পারে। তাহলে
কী জাতীয় সঙ্গীত পিংপং খেলার বস্তুতে পরিণত হবে? তাছাড়া জাতীয় সঙ্গীত ব্যাপারটা এত
হালকা নয় যতটা নোবেল মনে করে। আমার হয়তো বলা উচিৎ হবে না, তবে আমার ধারণা নোবেল
তার জনপ্রিয়তা পেয়েছে জি বাংলায় গেয়ে। এটা জাতীয় প্রতিযোগিতা নয়, নোবেল বাংলাদেশকে
প্রতিনিধিত্ব করে না, তারপরেও বাংলাদেশের বলেই কিন্তু এদেশের মানুষ নিঃশর্ত ভাবে
তাকে সমর্থন করেছে। এই জনপ্রিয়তা যতটা না সে নিজে অর্জন করেছে তার চেয়ে বেশি
দিয়েছে এদেশের মানুষ, যারা সোনার বাংলাকে ভালবাসে, যারা জানে “আমার সোনার বাংলা”
বুকে ধারণ করেই এদেশের মানুষ পাকিস্তান আমলে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে লড়েছে, “আমার
সোনার বাংলা” কে জাতীয় সঙ্গীত জেনেই একাত্তরে লড়াই করেছে, এই গান গেয়েই হাসি মুখে
প্রাণও দিয়েছে মুক্তি সেনার দল। আমার মনে আছে যুদ্ধের সময় আমরাও এই গান গেয়েছি। যুদ্ধ
শেষে যখন বাড়ি ফিরি, আমাদের বাড়িতে যে মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্প ছিল সেখানে মুক্তিসেনারা
প্রতিদিন সকালে এই জাতীয় সঙ্গীত গাইত। ওদের
সাথে দাঁড়িয়ে আমরাও গলা মিলিয়ে গাইতাম “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।” আজও
দেশের কোন টীম যখন খেলতে নামে কোটি কোটি মানুষ মনে মনে এই কথাগুলো উচ্চারণ করেই খেলোয়াড়দের
সমর্থন জানায়। তাই নোবেলের এই সাক্ষাৎকার
আসলে যে মানুষদের সমর্থনে সে আজ জনপ্রিয় তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। জানি দেশে
অনেকেই চায় জাতীয় সঙ্গীত বদলাতে। আর চায় মূলত ধর্মীয় মৌলবাদীরা। এই লোকেরা কিন্তু
জি বাংলার অনুষ্ঠান দেখে না, এই লোকেরা ফেসবুকে জি বাংলায় নোবেলের পারফর্মেন্সের
সমর্থনে পোস্ট করে না। করে তারাই, যারা বাংলাদেশ, লাল সবুজ পতাকা, জয় বাংলা, সোনার
বাংলা এসবকে এক ও অভিন্ন বলে জানে। এদেশের মানুষের ভালবাসা নিঃশর্ত নয়। তাদের
একটাই শর্ত – দেশকে, দেশের জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা এসবকে যথাযথ সম্মান করা।
সেটা করতে না পারলে দেশপ্রেম শব্দটা শুধু শব্দই থেকে যাবে। দুবনা, ০২ আগস্ট ২০১৯
Comments
Post a Comment