নিখিল ফ্লয়েড ও অন্যান্য ঘটনা

গত ২৫ মে আমেরিকার মিনিসোটার মিনেয়াপলিসে পুলিশ অফিসার ডেরেক শভিনের হাঁটুর তলায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেল আফ্রিকান-আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েড তার কয়েকদিন পরে বাংলাদেশে পুলিশ অফিসার এএসআই শামীমের হাঁটুর তলায় মেরুদণ্ডের ভাঙ্গনে পিতৃদত্ত প্রাণ হারাল অনেক আগেই মেরুদণ্ড হারানো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিখিল তালুকদার অফিসার শামীম শভিনের কর্মকাণ্ড দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছজিল কিনা জানা যায়নি, তবে ঘটনা যে আমেরিকার তরুন সমাজের একটা বিরাট অংশের ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার আন্দোলনের মত বাংলাদেশের তরুন সমাজকে মাইনরিটি লাইফ ম্যাটার জাতীয় কোন আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, এখনও লিখছেন। বন্ধুদের অনেকে কবিতা লিখেছেন, কেউ কেউ  কবিতা পড়ছেন। সব মিলিয়ে এ মৃত্যু সবাইকে নাড়া দিচ্ছে। নিজেরও দুকথা বলার ছিল, আছে তবে রাশিয়া থেকে যেকোনো লেখাই যখন আজকাল আমেরিকার আসন্ন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ বলে মনে করা হয়, তাই লিখব না বলেই ভেবেছিলাম এর মধ্যে যোগ হল নিখিল তালুকদার তাই ভাবলাম দু কলম লিখে ফেলি। লিখি লিখব করে পেরিয়ে গেছে অনেক সময়। আমি মনে হয় সব সময় একটু দেরি করে যেকোনো ব্যাপারে রিয়াক্ট করি। আমার মনে হয় যখন কোন ঘটনা ঘটে তখন আবেগ আমাদের বুদ্ধিকে, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার শক্তিকে কিছুটা হলেও ভোঁতা করে দেয়। তখন আমরা কোন ঘটনার সম্পূর্ণ চিত্রটা দেখতে পাই না, তাই ঘটনার সার্বিক বিশ্লেষণে ভুল করার সম্ভাবনা থাকে। আমি জানি না কতজন লোক আমার লেখা পড়ে বা কতজন লোক আমাকে ফলো করে, কিন্তু যাই লিখি সেটার দায়িত্ব একান্তই আমার। আবেগের বশে লেখা আমার কোন স্ট্যাটাস পড়ে যদি কেউ ভুল কোন সিদ্ধান্তে আসে, সে দায় আমারই। তাই চেষ্টা করি, ঝড়ের পরে, যখন ধুলো সরে যায়, মন শান্ত হয়, তখন কিছু লেখার জন্য। তাতে একটু বেশি তথ্য পাওয়া যায়, ঘটনাকে বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। সেটা যে সব সময় ঠিক তা নয়, তবে ভুল হলেও সেটা অন্ধ আগেবের দোষে দোষী নয়। সেটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। আর আমার দৃষ্টিভঙ্গি যে অন্য সবার দেখার সাথে মিলতে হবে এমন কোন কথা নেই।   

আমি রাজনৈতিক ভাষ্যকার নই, যা লিখি সেটা ফিজিক্সের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অনেকেই বলতে পারেন সামাজিক অস্থিরতায় ফিজিক্স কেন নিউটনের যুগে ম্যাটার আর স্পেস-টাইম ভিন্ন হাঁড়িতে ভাত খেত, এখন সবাই একান্ন পরিবারের সদস্য, তাই মানুষ যেহেতু প্রকৃতির অংশ সে ইচ্ছা অনিচ্ছায় প্রকৃতির নিয়ম মেনেই চলে প্রকৃতি কি চায়? সবচেয়ে কম শক্তি ব্যয় করে শান্তিতে মানে স্থিতিশীল থাকতে মানুষও শান্তি চায় সমস্যা হল উন্নতির জন্য বসে থাকলে চলে না, স্থিতিশক্তিকে গতিশক্তিতে পরিণত করতে হয় সেটা করতে গেলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়, আসে অশান্তি তাই  মানব সমাজের উন্নয়নের গতিটা এমন পর্যায়ে রাখা দরকার যাতে সেটা উন্নতির চাকাও ঘোরায় আবার প্রকৃতির ভারসম্য নষ্ট না করে ঠিক একই ভাবে সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করা দরকার আর সেটা করতে হলে আমাদের সবাইকে সাথে নিয়েই করতে হবে, কাউকে এর বাইরে রেখে বা সমাজ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে নয় কেননা আমরা কাউকে সমাজ থেকে বের করতে পারলেও মহাবিশ্ব থেকে বের করতে পারব না একটা গল্প মনে পড়ল আমরা প্রতি বছর ছবি প্রদর্শনীর আয়োজন করি ক্লাবের সব সময়ই কিছু নতুন সদস্য আসে, ফলে সবাইকে সুযোগ দিতে গেলে অনেক সময় ছবির মানের সাথে কম্প্রোমাইজ করতে হয় একবার আমি বললাম, “আমরা কি ছবির মানের দিকে একটু দৃষ্টি দিতে পারি না, মানে যে সব ছবি বড় জোর ফ্যামিলি অ্যালবামে স্থান পেতে পারে সেগুলো বাদ দিলে হয় না?” “দেখ, প্রদর্শনী আমাদের কাছে পরীক্ষার মত সবাই চেষ্টা করে বছর শেষে নিজের সবচেয়ে ভালো কাজগুলো জমা দেয় ধর আমরা দশ জন এক জনের ছবি নিশ্চয়ই অন্য নয় জনের চেয়ে খারাপ হবে তাকে বাদ দিলাম এখন নয় জনের মধ্যে একজন অবশ্যই লাস্ট ম্যান তাকে বাদ দেব? এভাবে তো দেখা যাবে শুধু একজন বা একটা ছবি থাকছে এখানে তো আমরা সারভাইবাল অব দ্য ফিটেস্ট রুল প্রয়োগ করতে পারি না, বরং সবাইকে নিয়ে সামনে যেতে চাই যারা ভালো ছবি তোলে তাদের বেশি ছবি দিই, যারা নতুন বা তেমন ভালো ছবি তোলে না তাদের কম ছবি প্রদর্শনীতে যায়  আমরাও ছোটোখাটো একটা সমাজ, একটা দেশ আমাদের কাজ সবাইকে টেনে উপরে তোলা, কাউকে নীচে রেখে উপরে চলে যাওয়া নয় কথার উত্তর হয় না আর এভাবে চললে যেকোনো কালেক্টিভ স্থিতিশীল হয়, শান্তিপূর্ণ হয়  আরও একটা ব্যাপার হল পদার্থবিদ কোন তত্ত্ব তৈরি করেন না, তিনি প্রকৃতির গতিবিধি পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করে সেখানে ধারাবাহিকতা  খোঁজেন এবং তার উপর ভিত্তি করে এসব ঘটনার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেন সামঞ্জস্যপূর্ণ যেকোনো তত্ত্ব একটা নির্দিষ্ট গ্যারান্টিসহ ভবিষ্যত ঘটনাবলী প্রেডিক্ট করতে পারে এজন্যে স্থিতিশীলতা একটা বিরাট ফ্যাক্টর সমাজের ক্ষেত্রেও তাই সমাজের নিয়মকানুন যখন সঠিক ভাবে প্রয়োগ করা হয় তখন সে সমাজ সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করা সহজ হয় সে কারণেই বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা চায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা শুধুমাত্র তখনই তারা তাদের বিনিয়োগ সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হতে পারে একথা সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও সত্য আর অসৎ ব্যবসায়ীরা চায় এই স্থিতিশীলতা নষ্ট করে ঘোলা জলে মাছ ধরতে তাই সমাজে যখনই অরাজকতা তৈরি হয় বুঝতে হবে এর পেছনে কারও না কারও রাজনৈতিক ব্যবসায়িক (অর্থনৈতিক) স্বার্থ কাজ করছে তাছাড়া পদার্থবিদ্যার দৃষ্টি থেকে দেখলে এটাও মনে রাখতে হবে যে বর্তমান কনসেপ্ট অনুযায়ী মহাবিশের যেমন কোন হাইলাইটেড বা বিশেষ পয়েন্ট ডিরেকশন নেই, প্রানী জগতেও তেমনি কোন হাইলাইটেড প্রানী নেই মানুষ সৃষ্টির সেরা প্রানী নয়, সে আর সব প্রানীর মতই একজন সে অন্য সব কিছুর মতই এই বিশাল মহাবিশ্বের একটা ক্ষুদ্র অংশ               

 

বামদের মধ্যে এ বিশ্বাস বিদ্যমান যে গরবাচেভ আর ইয়েলতসিনের কারণেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেছে এদের মধ্যে খুব কম লোকই বিশ্বাস করতে চায় যে সমস্যাটা যত না লোকে, তার চেয়ে বেশি সিস্টেমে বা নিদেন পক্ষে মার্ক্সের তত্ত্বের প্রয়োগে বর্তমানে প্রকাশিত বিভিন্ন নথিপত্র থেকে প্রমানিত হয় যে স্টালিনের পর থেকেই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পার্টির নেতৃবৃন্দ জর্জরিত ছিলেন ছিল দলাদলি, গ্রুপিং সেই সাথে করাপশন আর এসবই শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ডেকে এনেছে এমন কি যখন নীচের তলার মানুষ ক্ষমতার পরিবর্তন চায়নি (তখনকার গণভোট সেটাই প্রমাণ করে) উপরের তলার নেতারা ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি এটা লেনিনের তত্ত্বের অ্যান্টিথেসিস হিসেবে কাজ করেছে

আমেরিকায় ট্রাম্পের জয়কে অনেকেই মস্কো বা পুতিনের কাজ বলে মনে করে
বর্তমানে কোভিডে ১৯ এক লাখের উপর মানুষের মৃত্যুতে কেউ মস্কোর হাত দেখে, কেউ বা ট্রাম্পের অযোগ্যতা দেখে কিন্তু সমস্যা কি আসলেই তাই? যেকোনো দেশ, বিশেষ করে আমেরিকার মত বিশাল সাম্রাজ্য একজন লোকের মর্জিতে চলে না যুগের পর যুগ ধরে একটা সিস্টেম গড়ে ওঠে সেই সিস্টেমই সব চালায় কোন প্রেসিডেন্ট এই চলার গতিতে বাড়াতে বা কমাতে পারে, যদি এই সিস্টেম সত্যিকারের অর্থেই স্ট্যাবল হয়, ছোটোখাটো ধাক্কায় তা ভেঙ্গে পড়ে না, ফলাফলে শুধু উনিশ বিশ হয় কিন্তু কোভিড ১৯ এ এক লক্ষের বেশি মানুষের মৃত্যু প্রমাণ করে সিস্টেমটা ভেতর থেকেই অসুস্থ মরার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত এল ফ্লয়েডের মৃত্যু গণতন্ত্র, ন্যায় বিচার, নাগরিক অধিকার ইত্যাদি বড় বড় বুলি কোথায় যেন হারিয়ে গেল শভিনের হাঁটুর তলায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তবে ঘটনা নতুন নয় এটা ঘটেছে বুশের সময় ১৯৯২ সালে, ঘটেছে ওবামা আমলে, যদিও অনেক আশা ছিল প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ধবল আমেরিকা সমাজের এই অংশের উপর কয়েক শবছরের অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইছে হয়নি পৃথিবীর দেশে দেশে আইন করে অনেক কিছুই বন্ধ করা হয়েছে বা নতুন অনেক কিছুই চালু করা হয়েছে আইন করে মানুষকে সেটা প্রকাশ্যে মানতে বাধ্য করা যায়, কিন্তু সেই আইনকে মান্য করার উপযুক্ত শিক্ষা না দিলে, শুধু সামাজিক নয়, সাংসারিক বা ব্যক্তিগত জীবনে সেটা চর্চা না করলে এসব আইন পুঁথিগত বিদ্যার মতই প্রয়োজনের সময় শুধু বইয়ের পাতাতেই থেকে যায় আর সেটা হয় পৃথিবীর সর্বত্রই সেটা ভারতে বিধবা বিবাহই হোক, দেশে দেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকারের মহান বাণীই হোক 
       
১৯৮৩ সালে যখন মস্কো আসি তখন ছিলাম সমাজতন্ত্রে অন্ধবিশ্বাসী
এখানে, মানে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় যে অন্যায় অবিচার থাকতেই পারে সেট বিশ্বাসই হত না কে জানে, তখনও আপেক্ষিক তত্ত্বের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয় ছিলনা বলেই হয়তো সমাজতন্ত্রের সাথে পুঁজিবাদের তুলনা করলেও সমাজতন্ত্রের আদর্শকে পরম বলে মনে হত, যা ছিল ধার্মিকেদের পরমেশ্বরের আদলে গড়া অবশ্য খুব দ্রুতই আমার ভুল ভাঙ্গে, তবে সেটা স্বপ্নভঙ্গ ছিল না আমি সময় মত সোভিয়েত ইউনিয়নের ভালমন্দ বিচার করার সাথে সাথে নিজের দৃষ্টিভঙ্গির ত্রুটিও ধরতে পারি সবাই সেটা পারে বা পেরেছে কিনা জানি না তবে যদি আমি না পারতাম, তার পেছনে কিছু অবজেক্টিভ কারণ থাকত আমি নিজে এদেশে এসেছি অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া এক দেশ থেকে ইংরেজদের ১৯০ আর পাকিস্তানের ২৪ বছরের শোষণে আমার মাতৃভূমির অবকাঠামো ছিল ধ্বংস প্রায় তার উপর দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ আন্তর্জাতিক মহলের চাপ, পঁচাত্তরের পট পরিবর্তন, ধীরে ধীরে একাত্তরের চেতনা থেকে দূরে সরে যাওয়া যদিও তখন বাংলাদেশ আর তলাবিহীন ঝুড়ি ছিল না, অবস্থা যে খুব ভালো ছিল সেটাও বলা যায় না তাই এই ১৯৮৩' সোভিয়েত  ইউনিয়নও ছিল আমাদের কাছে স্বপ্ন রাজ্য, আর সেটা আদর্শগত মিলের কথা বাদ দিলেও যদিও এমন কি মস্কোর দোকানেও অনেক সময় অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া যেত না, তার পরেও সেটাকে কখনোই আমার জন্য ফাটাল মনে হয়নি আসলে এর কারণ ছিল  সমাজতন্ত্রের যা কিছু ভালো আমরা ছিলাম তার ফলভোগী নিজেদের কোন কাজ করতে হত না হোস্টেল, টিউশন, মেডিক্যালসব ফ্রি প্লাস স্টাইপেন্ড যেটা দিয়ে একজন তরুণ বা তরুণী ভালভাবেই চলতে পারত সেই একই সময়ে সোভিয়েত   নাগরিকদের অধিকাংশই আমাদের স্টাইপেন্ডের চেয়ে কিছু বেশি রুবল বেতন পেয়ে সংসার চালাত না, তারা যে অভাবী ছিল তা নয়, তবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সাপ্লাই যথেষ্ট ছিল না তবে এসব আমরা তখন জানতাম না ছাত্র জীবনে যাও দুয়েক বার সোভিয়েত বন্ধুদের বাসায় বেড়াতে গিয়েছি বিভিন্ন জিনিসপত্রের প্রাচুর্য দেখে অবাক হয়েছি আবার অধিকাংশ সোভিয়েত নাগরিকদের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পেলেও মাঝে মধ্যে কিছু লোকের দেখা পেয়েছি যারা বিদেশীদের পছন্দ করত না, সুযোগ পেলে দুটো কথা শুনাত যেন তাদের সব কষ্টের মূলে আমরা বিদেশীরাই পরে যখন এদেশে থেকে যাই, আর মানুষ আগের মত রাখঢাক না করে কথা বলার সুযোগ পায়, তখন শুনেছি এই যে দেশে দেশে বিপ্লবের আয়োজন, এই যে আমাদের জামাই আদর করে লেখাপড়া শেখান এর জন্যে সাধারণ মানুষকে কম মুল্য দিতে হয়নি মস্কোয় অভাবটা বোঝা না গেলেও মস্কোর বাইরে সাপ্লাই ছিল অপ্রচুর এমন কি হাতে টাকা থাকলেও মানুষ সেসব খরচ করার জায়গা পেত না, প্রায়ই তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যের খোঁজে মস্কো যেতে হত আর এসবের ফলে ছিল অসন্তোষ কেননা এরা ছিল দেশের উন্নতির চালিকা শক্তি, সম্পদের ভাগীদার তারা কাজ করেছে নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য, কিন্তু চোখের সামনে দেখেছে নিজেদের স্বপ্নভঙ্গের বর্তমান হয়তো  সে কারণেই ১৯৯১ সালে যখন স্বপ্নে লালিত সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায় তখন তার এই অকাল মৃত্যুতে  কান্নার কোন লোক পাওয়া যায় না করোনা ভাইরাসে মৃতকে আমাদের দেশে সবাই যেমন ভয়ে ফেলে রেখে চলে যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নকেও তার সন্তানেরা সেভাবেই ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল যে রাজনৈতিক সংগঠন ৭১ বছর ধরে প্রচণ্ড দাপটে দেশ শাসন করেছে তার নেতাকর্মীরা কখন যে নাই হয়ে গিয়েছিল সাধারণ মানুষ সেটা টেরই পায়নি যদিও ১৯১৭ সালের তুলনায় মানুষের, হাতে গনা কয়েক পারসেন্ট বাদ দিলে প্রায় সমস্ত জনগণের সার্বিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল, পশ্চাদপদ কৃষি প্রধান দেশ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরিণত হয়েছিল শিল্পোন্নত দেশে, আন্তর্জাতিকতার স্লোগান দিয়ে তাদের আর ভুলিয়ে রাখা যায়নি শ্রেণীহীন সমাজের কথা বললেও, সামন্ত বুর্জোয়া শ্রেণীর বিলোপ ঘটলেও পার্টি ফাঙ্কশনারী নামে এক শ্রেনী গড়ে ওঠে আর এদের প্রতি সাধারণ মানুষের বিরক্তির অন্ত ছিল না অবস্থার যতই সার্বিক উন্নতি হোক না কেন যখন ধনী আর দরিদ্রের ব্যবধান হয় আকাশচুম্বী তখন সাধারণ মানুষকে আর উচ্ছিষ্ট দিয়ে ভুলিয়ে রাখা যায় না মানুষ প্রতিবাদ করে, পরিবর্তন চায়  

আমার মনে হয় আমরা দিন দিন  মানবিক হয়ে উঠছি বিশ্বাস হয় না? এই দেখুন আমি এর আগের বাসায় ছিলাম বিশ বছরের বেশি বাসায় বছর খানি কিন্তু প্রতিবেশীদের সাথে কখনই তেমন যোগাযোগ ছিল না লিফটে বা নীচে দেখা হলে জাস্ট হাই হ্যালো বাচ্চারা যখন ছোট ছিল তখন ওদের কথা জিজ্ঞেস করত, কখনও বা চকলেটটা বা বাগান বাড়ির ফলটা হাতে দিত এখানে মূলত চেনাজানা হয় উপরের আর নীচের তলার প্রতিবেশীকে তার কারণ কালে ভদ্রে উপরের ফ্ল্যাটের লোক জলটা বন্ধ করতে ভুলে গেলে আমাদের রুফ ভিজে যায়, তেমনটা ঘটে নীচের প্রতিবেশীর সাথে কিন্তু এসবের পরেও, মানে আশেপাশের লোকদের সম্পর্কে কমবেশি ইন্ডিফারেন্ট থাকার পরেও আমরা কোন কাজ করতে গেলে ভাবি, প্রতিবেশীরা কি বলবে, কি ভাববে একই ঘটনা দেখি বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রেও ভারত যদি পাকিস্তান বা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কোন কথা নাও বলে একটা নির্বাচনও ভারতকে বাদ দিয়ে হবে না একই ভাবে ভারতের নির্বাচনও বিশেষ করে পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে হবে না আমেরিকার নির্বাচনে রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছিল কিনা জানি না, কিন্তু সেখানে বিগত চার বছর ধরে যেভাবে রুশ হস্তক্ষেপ নিয়ে কথা বলা হয়েছে, হচ্ছে তাতে রাশিয়া কিছু না করলেও সে দেশের রাজনীতিতে একটা বিরাট ভুমকা পালন করবে আমেরিকা অবশ্য ব্যাপারে রাখ ঢাক করে না, রাশিয়ায় গণতন্ত্র বিকাশের জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অফিসিয়ালি খরচ করে আমার প্রশ্নটা অন্য জায়গায় যে দেশে গণতন্ত্রের বয়স কয়েকশ বছর, যে দেশের মানুষ স্বাধীন, তারা কেন কোন বিদেশী শক্তির কথায় কোন বিশেষ প্রার্থীকে ভোট দেবে? আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রশাসন বা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির রুশ হস্তক্ষেপের অভিযোগ কী তাদের গণতন্ত্রকেই আন্ডারমাইন করে না? দেশের জনগণের প্রতি তাদের আস্থাহীনতার কথা বলে না? ট্রাম্পের জয় রাশিয়ার চক্রান্ত য়, সেটা বর্তমান ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা কারণ তাই খুঁজতে হতে নিজেদের সিস্টেমে, মস্কো বা পিকিং- নয় বিগত বছরগুলোতে আমেরিকা সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে, কঙ্গো, চিলি বা বাংলেদেশের মত সমরিক বাহিনী ব্যবহার করে নয়, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে দেশে দেশে রঙ্গিন বিপ্লব ছড়িয়েছে আগে এসব নিজ দেশের মানুষের কাছ থেকে দূরে রাখা গেলেও এখন সেটা যাচ্ছে না, ফলে নিজেদের তৈরি অনেক দানোই বুমেরাং হয়ে নিজেদের পায়ে আঘাত হানছে তাই সময় এসেছে নিজেদের বদলানোর, শুধু নিজেদের নয়, এই পৃথিবীতে অন্যান্য দেশ জাতির অধিকারকে স্বীকার করার, শ্রদ্ধা করার  বিভিন্ন দেশকে নিজেদের প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়ার আগে ভাবতে হবে ছোট হয়ে যাওয়া এই পৃথিবীতে শুধু ভৌগলিক প্রতিবেশীই নয় অনেক দূরে অবস্থিত কেউও সময়ে সুযোগে মরণ কামড় দিতে পারে যেটা করেছে আল কায়েদা (সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, যদিও অনেকেই এটাকে সিআইএ-র ব্লু প্রিন্ট বলে মনে করে)।   

যেকোনো মৃত্যুরই প্রতিবাদ হওয়া উচিৎ, কিন্তু তাই বলে সব মৃত ব্যক্তিই যে আইকন হয়ে উঠবে তার কোন মানে নেই। ফ্লয়েড আর যাই হোক, প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিল না। আমেরিকায় (সারা বিশ্বে) প্রচুর মানুষ আছে যারা প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে, চরম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, হচ্ছেন। ফ্লয়েড কিন্তু সে পথে যায়নি।  হ্যাঁ, সে পড়াশুনা করেছে, ডিগ্রী নিয়েছে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত চুরিকে বেছে নিয়েছে এই অবস্থা থেকে বেরুনোর জন্য, আশ্রয় নিয়েছে নেশার। আর সেজন্যেই একাধিকবার শাস্তি পেয়েছে। তার মৃত্যু ছিল দুঃখজনক, পুলিশি সন্ত্রাস। এই মৃত্যুর, এই সন্ত্রাসের প্রতিবাদ হতেই পারে, হওয়া দরকার। কিন্তু তাই বলে ফ্লয়েডকে আইকন বানান যায় না। অনেক দিন আগে আমার এক বন্ধু যে নিজে প্রগতিশীল, দেশে রাজনীতি করেছে, এখন পশ্চিমে থাকে কথা প্রসঙ্গে আমাকে এলজিবিটি আন্দোলন সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো। সে এর সমর্থনে অনেক সময় পোস্ট দিয়েছে আগে। আসলে পশ্চিমে এখন রাজনীতিটাও ফ্যাশন, যেমন কিনা ফ্যাশন এলজিবিটি আন্দোলন নিয়ে কথা বলা। হতে পারে সে সত্যি সত্যি সেটা বিশ্বাস করে, মন থেকেই এসব করে। কিন্তু আমাদের দেশে তো অনেক মানুষই আছে যারা রাস্তায় প্রগতির কথা বলে ঘরে প্রতিক্রিয়াশীল সাজে, রাস্তায় নারী নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন করে ঘরে নারী নির্যাতন করে। যাই হোক আমার মনে হল, ওর এ প্রশ্নের কারণ ছিল রাশিয়ায় এলজিবিটি সোসাইটির ব্যাপারে কিছু আইন-কানুন পাশ করার কারণে। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নে সমকামী ছিল, এখনও আছে, তাদের অনেকেই যাকে বলে ওপেন সিক্রেট, বিভিন্ন বড় বড় পোস্টে আছে এবং যতদূর জানি আর্মি বাদে অন্যান্য কোন চাকরিতে ঢুকতে সমস্যা হয় না (আসলে আর্মিতে ঢোকার সময় সেক্সুয়াল অরিয়েন্টেশন নিয়ে প্রশ্ন করে, অন্য কোথাও করে না) তবুও এখানে প্রকাশ্যে সমকামীতার প্রোপ্যাগান্ডা করতে দেওয়া হয় না, যাতে সেটা অপ্রাপ্ত বয়স্কদের প্রভাবিত না করে। আমাকে যখন প্রশ্ন করল, আমি উত্তরে বললাম, আমার ছাত্রজীবনে খুব সম্ভব কলম্বিয়ার এক ছেলে এমন ছিল। ক্লাসে বা রাস্তাঘাটে দেখা হলে কথা বলতাম। আমাদের ছিল কমন বাথরুম। ও প্রায়ই ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকত আর লোলুপ দৃষ্টিতে অন্যদের দেখত। তখন প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। আমার ধারণা যে কোন মানুষের দিকে অনেকক্ষণ হ্যাংলার মত তাকিয়ে থাকলে সে বিরক্ত হতে বাধ্য। তাই বলতে পার কারও সমকামিতা আমার উপর চাপিয়ে দেওয়া না হলে আমি এ নিয়ে ভাবি না। তবে শুধু সমকামিতার জন্য কারও উপর যদি অত্যাচার করা হয়, কাউকে অধিকার বঞ্চিত করা হয় সেটার নিন্দা করি। ঠিক যেমন করি দেশে দেশে বিভিন্ন ধরণের সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদ। যেকোনো ধরণের শোষণের আমি আগেও বলেছি, এখনও বলি। সেটা কে করল বা কোন ধর্মের, কোন জাতির বা কোন দেশের মানুষ করল সেটা ব্যাপার নয়।  আমি ওই বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা তোমার তো দুটো বাচ্চা আছে।  ধর তোমার বাচ্চারা যদি সমকামী হয় তুমি কি সেটা মেনে নেবে? “আপনি কিভাবে এটা ভাবতে পারলেন?” আমি বল্ললাম, “আমি তোমার মত এসব নিয়ে লিখি না, এদের সমর্থনে স্ট্যাটাস দিই না, তবে আমার ছেলেমেয়েরা যদি এটা করে আমি আগের মতই তাদের ভালবাসব, এমনকি তাদের বকবও না।“ আমাদের সমস্যা এখানেই। যেসব বন্ধুরা আবেগের বশে ফ্লয়েডকে নিয়ে বীর গাঁথা লিখছে, তাকে আইকন করছে, তাদের ক’ জন নিজেদের ছেলেমেয়েরা ফ্লয়েডের মত হতে চাইলে সেটা মানতে পারবে? ফ্লয়েড মারটিন লুথার কিং নয়, চে গুয়েভারা নয়। সে এই সমাজের একজন উপেক্ষিত, অবহেলিত মানুষ, যে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করেনি, বরং এই ব্যবস্থা যেসব অপরাধের সুযোগ দেয় সেটা গ্রহণ করেছে। তাই আমি বলব অন্যায়ের প্রতিবাদ হোক, ফ্লয়েড হত্যার বিচার হোক, কিন্তু তাকে আইকন বানিয়ে নয়। সে পথ  যাকে বলে ওয়ে টু নোহয়ার।

 

ফ্লয়েডের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আন্দোলন হচ্ছে, একের পর এক স্ট্যাচু ভাঙ্গা হচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস কী বলে? আমরা কি চাইলেই একদিনে আজকের অবস্থায় আসতে পারতাম? আদিম সমাজ, দাসপ্রথা, সামন্তবাদ সব কিছুকে বাইপাস করে কী শুধু পুঁজিবাদ নয়, আজকের এই উন্নত পুঁজিবাদে আসা সম্ভব ছিল? অ্যামেরিকার ইতিহাস ঘাটলেই দেখা যাবে, শুধু আফ্রিকান নয়, ইউরোপ থেকে অনেক সাদা মানুষকেও ওখানে নিয়ে যাওয়া হত দাস হিসেবে। তাছাড়া ইউরোপে প্রচুর জাতি আছে যারা নিজেরা সাদা হলেও সব সময়ই অবদমিত ছিল, অন্যদের দাস করা দূরের কথা, নিজেরাই দাসের মত পরাধীন জীবন যাপন করেছে যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী। তাহলে এদের লাইফ কি ম্যাটার নয়?

একসময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা দেখে হতাশ হতাম আর ভাবতাম অ্যামেরিকায় কত সুন্দর সিস্টেম, জনতার ভোটের রায় কিভাবে মেনে নিচ্ছে। কিন্তু প্রথম ধাক্কা খেলাম গোর আর বুশের নির্বাচন পরবর্তী অবস্থা দেখে। ২০১৪ সালে ভোটের আগে বিএনপি জামাত সারা দেশ জুড়ে যে তাণ্ডব শুরু করল তাতে মনে হল ক্ষমতাই আসল, মানুষ নয় মাটিই আসল। গত চার বছরে আমেরিকায় যা ঘটছে তা আমাদের দেশের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির একটাই এজেন্ডা – ট্রাম্প হটাও। আমেরিকার মত দেশে একজন প্রেডিক্টেবল প্রেসিডেন্ট থাকবেন সেটাই স্বাভাবিক। ট্রাম্পকে সেটা বলা যায় না। কিন্তু তাদের বর্তমান ক্যান্ডিডেট কী কোন অংশে সরস? ইউক্রাইনের উচ্চপদস্থ আমলাদের নিয়োগ বদলী সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন, আর সেটা করেছেন নিজের ছেলেকে অর্থনৈতিক সুবিধা দেওয়ার জন্য। দেশে কী আর কোন লোক ছিল না ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লরাইয়ের জন্য, স্যান্ডারস কী ট্রাম্পের চেয়েও খারাপ? আজ ফ্লয়েড প্রীতি সেটা কতটা মানব প্রীতি আর কতটা চুলচেরা রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ সেটাই দেখার ব্যাপার। শোনা যায় করোনা ঘিরে এত মৃত্যু, এত অরাজকতা – এটা শুধু ট্রাম্পের খামখেয়ালী নয়, ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ক্ষমতা আর ভোটের রাজনীতির ফল। 

এই মহাবিশ্বে সব কিছুই পরিবর্তনশীল। আসলে পরিবর্তনই একমাত্র ধর্ম। কিন্তু সেটা অতীতের সবকছু অস্বীকার করে নয়। ফারাওনরা অনেক আগেই বিদায় নিয়েছে, কিন্তু আছে তাদের তৈরি পিরামিড। গ্রীক বা রোমান সাম্রাজ্য নেই। আছে তাদের রেখে যাওয়া জ্ঞানের ভাণ্ডার, স্থাপত্য, শিল্প। মুঘলেরাও নেই, কিন্তু তাদের তৈরি তাজমহল, লাল কেল্লা তাদের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, কিন্তু সেই দেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় কলোনিয়াল শাসন থেকে মুক্তি পাওয়া শত শত দেশের পতাকা আজ মুক্ত আকাশে পতপত করে উড়ছে। সোভিয়েত ইউনিয়নকে সামাল দিতে গিয়ে পুঁজিবাদী বিশ্বে এসেছে উন্নততর সামাজিক ব্যবস্থা, ওয়েল ফেয়ার। দুটো স্ট্যাচু ভাঙ্গলেই সব বদলে যায় না। আমাদের সভ্যতার ইহিতাস কয়েক হাজার বছরের, মানব জাতির ইতিহাসের কাছে সেটা অতি নগন্য। ভেতরে ভেতরে আমাদের অধিকাংশই সেই আদিম যুগেই রয়ে গেছি, লোভ লালসা এসবই আমাদের অন্যতম চালিকা শক্তি। তা না হলে হাজার হাজার মানুষের রক্ত, ঘাম, অশ্রু আর হাড়ের উপর কিছু লোক, সমাজে সবচেয়ে আদৃত, পূজনীয় কিছু মানুষ প্রাসাদ গড়ত না। ধর্ম, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি মিষ্টি  মিষ্টি আদর্শের বুলি আওরিয়ে লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করা হত না।  

অনেক বন্ধু যারা আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছে, তাদের অনেকেই আফ্রিকান -আমেরিকানদের বর্তমান অবস্থার জন্য ওদের দায়ী করে। হয়তো বা তাই। তবে এটাও মনে রাখা দরকার, আমাদের সব দেশ থেকে লোকজন যাচ্ছে উন্নত আমেরিকায়, আর এই আফ্রিকান-আমেরিকানরা জেনারেশনের পর জেনারেশন অনেক কষ্ট, অনেক লাঞ্ছনা – বঞ্চনা সহ্য করে দেশটাকে গড়ে তুলেছে। তাই তাদের দাবী যে একটু বেশি হবে, হতে পারে সেটা কি এতটাই অযৌক্তিক? বিভিন্ন দেশে প্রায়ই ব্রেন ড্রেন বলে একটা কথা আছে। আমাদের দেশে একসময় আমরা সুই পর্যন্ত চীন থেকে আমদানি করতাম আর তাই সরকারকে দোষারোপ করতাম। কিন্তু আমেরিকা যেভাবে সারা বিশ্ব থেকে মেধা আমদানি করে, সেটা কি তাদের নিজেদের মানুষদের শিক্ষিত করে তুলতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না? সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে অনেক দেশেই কিন্তু শিক্ষার হার ১০০% করা হয়েছিল আর এই শিক্ষাই তাদের দ্রুত উন্নতি করতে সহায়ক হয়েছিল। আমেরিকায় এই যে দুই পার্টির ক্ষমতার লড়াই, ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার আন্দোলন, মাঝে মধ্যেই এমন কি স্কুলের ছেলেমেয়েদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে মাস কিলিং, অথবা বিশ্বের দেশে দেশে মার্কিন মাস্তানির প্রতি জনতার সমর্থন – এসব কি তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি নয়?          

 

তাই সিস্টেম পরিবর্তনের দাবি না তুলে ট্রাম্প হটাও স্লোগান - এটা এক ধরণের হঠকারিতা। উপর তলার মানুষদের ভাগবাটোয়ারার যজ্ঞে নিজেদের আহুতি দেওয়া। আচ্ছা, যদি ফ্লয়েড একজন প্রতিবাদী কণ্ঠ হত,  বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই যে তাদের মানে আফ্রো-আমেরিকানদের পিছিয়ে থাকার মূল কারণ এ ব্যাপারে সোচ্চার হত, হত একজন মারটিন লুথার কিং বা চে গুয়েভারা তবে কি আমেরিকান মিডিয়া, ডেমোক্র্যাটিক পার্টি তাকে নিয়ে এতটা মাতামাতি করত? নাকি রাশিয়া চর বা কমিউনিস্ট বলে তার থেকে দূরে দূরে থাকত। স্যান্ডারসের ঘটনা তো সেভাবেই ভাবায়।

আজকাল এসব লেখা মানে স্রতের উল্টোদিকে চলা। জর্জিয়ার দার্শনিক মেরাব মামারদাসভিলি একবার বলেছিলেন, “আমার দেশের মানুষ যদি গামছাহুরদের পক্ষে দাঁড়ায়, আমি সেই জনগণের বিপক্ষে দাঁড়াব”। আমি নিজেকে কখনোই ক্রাউড বা উন্মত্ত জনতার একজন মনে করি না। হয়তো নামের কারণে। মা বলতেন আমার জন্মের সময়ে এলাকার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছিল, গ্রাম থেকে অনেকেই পালিয়ে গিয়েছিল। তাই আমার নাম রাখা হয় বিজন। আমার  গবেষণার প্রথম বিষয়বস্তু ছিল সলিটন বা সলিটারি ওয়েভ। একা চলা তাই আমার জন্য নতুন কিছু নয়। আমি কাউকে ডাকি না। আমার সাথে কেউ আসবে সেটাও আশা করি না। একলা চলি।

দুবনা, ১৬ জুলাই ২০২০



   

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি