টিকা নিয়ে টীকা
করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে অনেকেই লিখছেন। ভ্যাকসিন বেরুনোর আগে পর্যন্ত সেসব ছিল গুজব, রাশিয়া ভ্যাকসিনের সফল টেস্টের ঘোষণার পর সেটা নিয়ে চলছে আবার স্পেকুলেশন। অনেকেই টিভি প্রোগ্রামে কথা বলছেন, ফেসবুকে লিখছেন। আমাকে দু এক জন ফোন করেছেন, কেউ কেউ ইনবক্স করেছেন। জানতে চাইছেন ব্যাপার কি? আমি ডাক্তার নই, তাই এ ব্যাপারে সঠিক কিছু বলতে পারব না। দুএকটা ব্যাপারে আমি বিশেষজ্ঞ ঠিকই, তবে এ ব্যাপারে বিশেষ ভাবে অজ্ঞ। তাই যা বলব, সেটা মূলত কমনসেন্সের উপর ভিত্তি করে।
মনে পড়ে বললে ভুল হবে, কেন না সেসব ঘটেছে আমার জন্মের পূর্বে অথবা খুব ছোট বেলায়। বিভিন্ন কাগজপত্র পড়ে এ সব জেনেছি। তবে শুরু করব একটু দূরে থেকে। অনেক আগে মানুষ একে অন্যকে জানিয়ে যুদ্ধে নামত। যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েও চেষ্টা করত যুদ্ধ এড়াতে। মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ঘটনা আমাদের সে ধারনাই দেয়। এমন কি ট্রয়ের যুদ্ধেও সে চেষ্টা করা হয়েছে, যদিও পরবর্তীতে ট্রয়ের ঘোড়া বানিয়ে আক্রমণ করা হয় অতর্কিতে। এর পরে অবশ্য ১২০১ সালে বখতিয়ার খলজির আক্রমন ছিল অতর্কিত, যেমন ছিল ১৯৪১ সালে জার্মানির সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ বা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ। তখনকার স্ট্রাটেজিই ছিল শত্রুকে অপ্রস্তুত করা। তাই মহাকাশে প্রথম স্পুটনিক, মহাকাশ বা চাঁদে প্রথম মানব পাঠানো – এসব হয়েছে গভীর গোপনীয়তায়। কিন্তু করোনার ভ্যাকসিন নিয়ে যে ডামাডোল তাতে বোঝাই কষ্ট এটা কতটা সত্য আর কতটা প্রোপ্যাগান্ডা। এটা অনেকটা বিচারের আগেই অভিযুক্তকে ক্রস ফায়ারে দেওয়া। এমনকি অপরাধ করার আগেই অপরাধ করতে পারে সেই যুক্তি দেখি প্রিভিন্টিভ মেজার হিসেব কিছু শাস্তি দেওয়া। সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে আসার আগেই নিজেকে জয়ী ঘোষণা করার চেষ্টা করছে। এমন কি কাজে নামার আগেই অক্সফোর্ডের গবেষণা নিয়ে এত ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে যে মনে হয় ভ্যাকসিন তৈরিই ছিল, শুধু নাটকীয় ভাবে সেটাকে মঞ্চে আনা হবে, ঠিক যেমন অনেক সময় অনেক আসামিকে বন্দী করা হয় কোন বড় ঘটনাকে সামনে রেখে।
আসলে আমি লোকটা পেসিমিস্টিক্যালি অপ্টিমিস্ট। মানে? ফিজিক্সে বলা হয় নেগেটিভ রেজাল্টও রেজাল্ট। আমরা যখন কোন কাজ করে আশানুরূপ ফল না পাই, ভুল ফল পাই, তার অর্থ আমরা জানি কোন পথে যেতে নেই। লেনিনের মত বলি, আমরা ভিন্ন পথে যাব। সেদিক থেকে আমি অপ্টিমিস্ট, মানে ফল পাবই পাব। পেসিমিস্ট কেন? কারণ, আমরা সব সময়ই জানি, দুদিন আগে হোক আর দুদিন পরে হোক এই রেকর্ড ভেঙ্গে যাবে, মানে আরও বেটার রেজাল্ট, বেটার থিওরি আবিষ্কৃত হবে। সেদিক থেকে আমরা পেসিমিস্ট। আর সেকারণেই ভ্যাকসিন নিয়ে কিছু প্রশ্ন জাগেই।
না, আমি বলছে না যে ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি। আলবৎ হয়েছে। কিন্তু ঠিক যেভাবে এ নিয়ে হৈচৈ হচ্ছে, সেটা মনে হয় একটু বেশি। কেন? হ্যাঁ, এখনও পর্যন্ত করা টেস্টগুলো পজিটিভ রেজাল্ট দিচ্ছে, মানে এরা সঠিক পথে যাচ্ছে। কিন্তু টেস্ট হয়েছে মাত্র জনা পঞ্চাশেক লোকের উপর, সঠিক ভাবে বললে ৩৮ জন। এরা ছিল সবই সুস্থ্য মানুষ, কোন রোগে আক্রান্ত নয়, ছিল ২৪ ঘণ্টা ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে। এত অল্প সংখ্যক লোক, বিশেষ করে যারা কোন মতেই স্বাস্থ্যগত ব্যাপারে গড়পড়তা মানুষ নয়, তারা আর যাই হোক স্ট্যাটিস্টিকস গড়ার মত ফলাফল দেয় না। তার মানে যতক্ষণ না অন্তত কয়েক হাজার গড়পড়তা মানুষের উপর, মানে যাদের মধ্যে থাকবে বাছাই করা লোকদের মত সুস্থ্য, আবার বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত (করোনা বাদে) অপেক্ষাকৃত দুর্বল মানুষ, যাদের অনেকেই ২৪ ঘণ্টা ডাক্তারদের পর্যবেক্ষণে না থেকে বাড়িতে থাকবে (কেননা ভ্যাকসিন নিয়ে অধিকাংশ মানুষই বাড়িতেই থাকবে) আর এ পরীক্ষায় যদি প্রায় ১০০% ভ্যাকসিন প্রাপ্ত মানুষ সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়, তবেই শুধু বলা যাবে একটা কার্যকরী ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে। আরও একটা কথা, আপাতত এ ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা মাত্র কয়েক সপ্তাহ। কিছু কিছু ভ্যাকসিন আমরা জীবনে একবারই নিই, কিছু কিছু প্রতি বছর। কিন্তু কোন ভ্যাকসিনের মেয়াদ যদি ছ মাসের কম হয়, মানে ছয় মাসের আগেই
আবার নতুন করে ভ্যাকসিন নিতে হয়, সেটাকে নিশ্চয়ই খুব একটা কার্যকর ভ্যাকসিন বলা যাবে না। আর এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের আরও কয়েক হাজার লোকের মধ্যে টেস্ট করতে হবে এবং সেসব ফলাফলের জন্য কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। সেদিক থেকে আমার মনে হয় ঠিক এই মুহূর্তে এতটা উচ্ছ্বাস দেখানোর কারণ নেই। আশাবাদী
হতে হবে, কিন্তু সেটা হতে হবে যুক্তি দিয়ে, আবেগ দিয়ে নয়।
সাফল্য ছোট হোক আর বড় হোক, সেটা সাফল্যই। কিন্তু এর মধ্যেই সেটাকে আন্ডারমাইন করার চেষ্টা চলছে পশ্চিমা দেশে, বলছে হ্যাকাররা ওদের তথ্য হ্যাক করেছে। সত্য মিথ্যা জানি না, তবে বলব, শিল্প ক্ষেত্রে গোয়েন্দাগিরি নতুন কিছু নয়। নিজেদের টেকনোলজির নোহাউ গোপন রাখার দায়িত্ব নিজেদের, সেটা যদি কেউ না পারে, এ জন্যে কাউকে দোষ দেওয়া নিজেদের শুধু দুর্বলতা নয়, অক্ষমতার পরিচয়। করোনা যুদ্ধে নাস্তানাবুদ পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের মুখ রাখতে এখন একটার পর একটা অভিযোগ তুলে যাচ্ছে। কিন্তু কথা হল, এমনকি অক্সফোর্ডে তৈরি ভ্যাকসিন বানিজ্যিক স্কেলে তৈরি হবে রাশিয়াতেও। রাশিয়ার এক কোম্পানী অনেক আগেই সেই রাইট কিনে নিয়েছে। রাশিয়ার ফার্স্ট মেডিক্যালে সফল টেস্টের খবর সবাই জানে, আর্মির তত্তাবধানে আরও একটা টেস্ট আজই
সফল ভাবে শেষ হয়েছে। এর বাইরেও আরও ডজন খানেক রুশ গবেষণা দল ভ্যাকসিনের উপর কাজ করে যাচ্ছে। জানা মতে এ বছর আভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য এরা ৩০ মিলিয়ন ভ্যাকসিন তৈরি করবে আর অন্যান্য দেশের জন্য অর্ডার পেলে আরও ২৭০ মিলিয়ন পর্যন্ত ডোজ তৈরি করতে পারবে। অনেকেই জিজ্ঞেস করছে বাংলাদেশে এ ভ্যাকসিন যাবে কি না। যতদূর বুঝলাম, বাংলাদেশ কেন, যেকোনো দেশের সরকারই চাইলে সেটা অর্ডার দিতে এবং পেতে পারে।
এখানেই শেষ করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু গতকাল কিছু টক শো দেখে আর আহসানের সাথে কথা বলে মনে হল আরও দু কলম লেখা দরকার। ফিজিক্সে আমরা সব সময়ই বলি, এখানে মুখস্ত করে কিছু হবে না, সাবজেক্টটা তোমাকে বুঝতে হবে, কেন আপেলটা মাটিতে পড়ছে সেটা বুঝতে হবে। ডাক্তারীর ব্যাপারে একটা কথা আছে, সঠিক ডায়াগনোসিস অর্ধেক চিকিৎসার সমান। তবে সঠিক ডায়াগনোসিসের জন্য মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কিভাবে কাজ করে সেটা বুঝতে হবে আর বুঝতে হবে ওষুধ কিভাবে কাজ করে। শুধু বই পড়ে মুখস্ত করে গড় রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া যায়। গতকাল দেশের টক শোতে একজন
ডাক্তার ভ্যাকসিন নিয়ে কথা বলছিলেন। শুনে মনে হল বেশ কিছু মৌলিক ব্যাপার উনি হয় ইচ্ছে
করে এড়িয়ে গেলেন, অথবা কোন কারণে সেটা ওনার জানা নেই। একারণেই ভ্যাকসিন নিয়ে আরও দুটো কথা বলছি। ছেলেমেয়েরা যখন ছোট ছিল, যখন ঘরের চাবি তাদের দেওয়া ততটা নিরাপদ মনে হত না (হারিয়ে ফেলতে পারে বিধায়), বাসায় ফিরে ওরা কলিং বেল টিপত। ঐ সময় অনেকেই বাসায় কলিং বেল টিপত – কেউ যীশুর কথা বলতে, কেউ আলুটা, মুলোটা বেচতে। তাই আমাদের বেল টেপার একটা সাংকেতিক পদ্ধতি ছিল। ওভাবে টিপলেই আমরা নির্দ্বিধায় দরজা খুলে দিতাম। ভ্যাকসিন সে কাজটাই করে, টোকার পদ্ধতি শুনে কাউকে দরোজা খুলে দেয়, কারও জন্য আটকে দেয়। আধুনিক ও বোধগম্য ভাষায় বললে ভ্যাকসিন – এটি একটা আন্টিভাইরাস। আন্টিভাইরাস কিছু কোড ব্যবহার করে, কোন ভাইরাস কম্পিউটার আক্রমণ করলে তার কোড দেখে আন্টিইরাস সেটা আটকে দেয়। একই ভাবে ভ্যাকসিনও কোন নির্দিষ্ট রোগের ভাইরাস আমাদের আক্রমণ করলে প্রয়োজনীয় আন্টিবডি তৈরি করে সেটাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। যদি ঈশ্বরকে সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা হিসেবে মানা হয়, এক্ষেত্রে তিনি হ্যাকারের ভূমিকা পালন করেন আর যারা ভ্যাকসিন তৈরি করে তারা আন্টিভাইরাস প্রস্তুতকারী বিভিন্ন ভালো প্রোগ্রামারের ভূমিকা পালন করে। ভ্যাকসিন কবিরাজ নয় পাহারাদার। সমস্ত পাহাদারের মত এরাও কখনও কখনও ঘুমিয়ে পড়তেই পারে, তাই বলে তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করার উপায় নেই, অন্তত নতুন অতন্দ্র প্রহরী খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত।
দুবনা, ২০ জুলাই ২০২০
Comments
Post a Comment