থিয়েটার

আমার থিয়েটার দেখা শুরু মস্কো এসে। ছোটবেলায় দেখতাম যাত্রা। গ্রামে দুটো যাত্রার দল ছিল - কার্ত্তিক সাহার অন্নপূর্ণা আর বড়দার (ভানু সাহা) অম্বিকা নাট্য প্রতিষ্ঠান। প্রথম কয়েক মাস রিহার্সাল  হত বাড়িতে। তারপর চলে যেত ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সেখান থেকেই শুরু হত পথ চলা। এরপর কোন এক সময়ে গ্রামে আসত। তখন কোন পালা মিস করতাম না। এছাড়া বড়দার দল এলাকায়, মানে মানিকগঞ্জ, জাগীর, কলতা, বালিট্টেক, জামসা - এসব এলাকায় এলে বড়দা আমাকে নিয়ে যেতেন কয়েকদিনের জন্য। তাছাড়া গ্রামে এর বাইরেও কোন না কোন দল আসত। তাই যাত্রা দেখা হত রেগুলার। সে সময়, বিশেষ করে যখন কলেজে পড়তাম, নৃপেন স্যারের নেতৃত্বে থিয়েটার হত কলেজে, তবে রাতে ফেরার সমস্যার কারণে দেখা হয়নি কখনই। একবার মির্জাপুর কুমুদিনি হোমসে গেছিলাম, তবে সেখানে খুব ছোট বলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ওখানে মা মূলত আমাদের বউদিকে দেখতে যান। বউদির রোল ছিল। এ ছিল ভিন্ন ধরণের মেয়ে দেখা। সেটা যুদ্ধের আগে।

মস্কো আসার পর ক্লাসের পর লাইব্রেরিতে বাড়ির কাজ করে যেতাম বিভিন্ন জায়গায়, মূলত আড্ডা দিতে বাংলাদেশী বন্ধুদের সাথে। তাই ছাত্র জীবনে সিনেমা দেখা হলেও (কখনও কখনও গ্রুপ থেকে বন্ধুরা মিলে চলে যেতাম, কখনও দেশীদের সাথে) থিয়েটার তেমন দেখা হত না। মূলত কালেভদ্রে রুশ ভাষার ক্লাস থেকে থিয়েটারে নিয়ে যেত। সেটা যত না রিক্রিয়েশন, তার চেয়ে বেশি ক্লাস। তাই গেলেও মজাটা ঠিক পেতাম না। 

১৯৮৮ সাল থেকেই আমার লাল রঙ ফ্যাকাশে হয়ে আসে, মানে কমরেডদের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। মনে মনে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হলেও পার্টি বা এসব সংগঠন থেকে দূরে চলে যাই। আগে আড্ডা হত মূলত রাজনৈতিকভাবে একই আদর্শে বিশ্বাসী মানুষের সাথে। এই ছারাছারির পর তাই আড্ডা কমে আসে। হাতে প্রচুর সময়। কি করা? বই পড়ে সময় কাটত আর ছবি তুলে। আড্ডা যে দিতাম না তা নয়, তবে আগের মত নয়। তাছাড়া তখন অনেকেই পড়াশুনার সাথে সাথে ব্যবসা শুরু করেছিলো। ফলে সেসব আড্ডায় আগের সেই মজা ছিল না। এসময় মামুন আসে ল্ভভ থেকে মস্কোয় পিএইচডি করতে। হতে পারে ও এখানে নিজেকে ঠিক সবার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি, অথবা আড্ডা ঠিক তেমন পছন্দ করে না - তাই প্রায়ই থিয়েটারে যাবার প্রস্তাব দিত। আমিও যেতাম। এভাবে থিয়েটারের প্রতি এক ধরণের অনুরাগ জমে যায়। বিশেষ করে দস্তয়েভস্কি, কাম্যু, কাফকা, সারত্রে - এদের কোন নাটক হলে দেখতামই। এভাবে মস্কোর শুধু নামকরা থিয়েটারগুলো নয়, ছোটখাটো প্রচুর থিয়েটারেও গিয়েছি অনেক। একই নাটক বিভিন্ন থিয়েটার বিভিন্ন ভাবে উপস্থাপন করত। সেটাও ছিল উপভোগ্য বিষয়। এরপর গুলিয়ার সাথে আলাপ। তখন তো প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আমরা যেতাম কোন না কোন থিয়েটারে। মনিকার জন্মের পর সেটা কমে যায়। যাও যেতাম, বাচ্চাদের কোন শো'তে। ক্রেমলিন হল থেকে শুরু করে লুঝনিকির আইস হকির স্টেডিয়াম পর্যন্ত। তবে দুবনা আসার পর সেটা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। সময়, সুযোগ - এসব ঠিক হয়ে ওঠেনা।

বিগত কয়েক বছর কোন থিয়েটার বা কনসার্টে গেছি ক্রিস্টিনার কারণে। ও কোথাও অংশ নিলে আমাদের ইনভাইটেশন কার্ড দেয়। আজকাল টিকেটের এত দাম যে চাইলেও যাওয়া সম্ভব হত না। আমি যাই ক্যামেরা নিয়ে। ওখানে ভাবে আমি কোন বিদেশি সাংবাদিক। সেটাও অনেক সময় কৌতূহলের সৃষ্টি করে। 

গত সপ্তাহে যখন দুবনা ফিরব, ক্রিস্টিনা বলল

- পাপ, আগামী রোববার আমাদের কনসার্ট। প্রভস্লাভ সংগীতের।   আসতে পারবে?
- রোববার? কয়টায়?
- সাত  টায়।
- ঠিক আছে।
- মামা আসবে?
- বলে দেখ। তবে মনে হয় পারবে না। কুকুর সামলাবে কে?

আসলে বিড়াল কুকুরও একটা বিশাল সমস্যা। তিন চারদিনের জন্য দুজনে যে কোথাও যাব, সেটা হয়ে ওঠে না। যাহোক, গত রোববার মস্কো গেলাম দুপুরের বাসে। বাসায় গিয়ে ব্যাগ রেখে খেয়ে গেলাম কনসার্ট হলের দিকে। সেটা সভেতনই বুল্ভারে। কথা ছিল ক্রিস্টিনা সাড়ে ছটায় বাইরে আমার অপেক্ষা করবে ইনভাইটেশন কার্ড দিতে। এদিকে আগে তেমন আসিনি। মেট্রো থেকে বেরিয়ে কিভাবে যাব ভাবছি। দুয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। কিছু বলতে পারল না। তখন দুই বয়স্কা মহিলাকে লিখভ পেরেউলক কোথায় জিজ্ঞেস করায় বললেন 

- আমরা ওদিকেই যাচ্ছি। তুমি ঠিক কোথায় যাবে?
- ওখানে আজ একটা কনসার্ট হবে। 
- হ্যাঁ, প্রভস্লাভ সংগীতের কনসার্ট। আমরা সেই কনসার্টে যাচ্ছি।
- আমার মেয়ে ওখানে গান গাইবে।
- খুব ভালো। আমরা তো ধীরে ধীরে যাব। চাইলে আমাদের সাথে আসতে পার, অথবা সামনের দিকে যাও। একই রাস্তা।

খুঁজে পেতে তেমন কষ্ট হল না। অনেক দিন পরে আবার কোন কনসার্ট দেখতে এলাম। এদের গান শুধুই ভোকাল, কোন রকম বাদ্যযন্ত্র ছাড়া। আমার মনে পড়ে যায় ছাত্রজীবনের কথা। ইউনিভার্সিটিতে বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক দল ছিল। আমাদের ছিল কোরাস বাংলাদেশ। বিভিন্ন দেশাত্মবোধক গান গাইতাম, গাইতাম বিপ্লবে গান - ক্যালকাটা ইউথ কয়্যার, উদীচী - এদের গান। সেই সময়ে সাউথ আফ্রিকার এক  সাংস্কৃতিক দল ছিল। ওরা গান গাইত কোন রকম বাদ্যযন্ত্র ছাড়া, নীচু গলায়। এখানে অবশ্য বাস, বারিটন, টেনর, কন্ট্রাল্টো, মেতসো সোপ্রানো, সোপ্রানো সবই থাকে। আমার ভালই লাগে। তবে চারিদিকে ধার্মিকদের ভিড়ে নিজেকে কেমন যেন বেখাপ্পা লাগে। মিউজিক শুনতে শুনতে হঠাৎ খেয়াল করি আমি আইনস্টাইনকে নিয়ে কী একটা ভাবছি। আসলে এটা আমার সমস্যা। কোন সেমিনারে গেলে মনে মনে অংক কষতে শুরু করি, যখন বাস্তবে ফিরি অনেক জল গড়িয়ে গেছে। সেদিন তিনটে টিমের উপস্থাপনা ছিল। ক্রিস্টিনা সলন্তসেভা গির্জা থেকে। দ্বিতীয় টিমে। ওদের পরে ছিল আকাদেমিচেস্কি খোর। শেষ হতেই দেখি ক্রিস্টিনা এসেছে আমার জন্য। মাঝে মনে হয় লিখেছিল, আমি খেয়াল করিনি। সকাল থেকে বাইরে। ক্লান্ত। বাসায় যাবে।

- খাবি কিছু? চল কোথাও যাই।  
- দেখি, যদি রাস্তায় ম্যাকডনাল্ড বা কেএফসি পড়ে।  
- দেখ।

শেষমেশ ঠিক করলাম, স্পোরতিভনায়া বিল্লায় যাব। ওখানে কিছু  কিনে বাসায় গিয়ে খাব। বাজার করে
ফেরার পথে ও অন্য এক দোকানে গেল। আমি বাসায় ফিরে স্যান্ডুইচ করে খেয়ে নিলাম। শরীরটা খুব একটা ভালো লাগছিল না, তাই ওদের অপেক্ষা না করে শুয়ে পরলাম, যদিও ঘুম হয়নি একেবারেই। পরের দিন সকালে চলে গেলাম ক্লাস নিতে। ফিরতে ফিরতে সাতটা। দেখি সেভা বাসায়, মনিকাও। দুবনা যাবার গাড়ি নেই, হয় রাত ১০ টায় ট্রেনে বা সাড়ে এগারোটায় ট্যাক্সিতে। হঠাৎ দেখি পৌনে আটটায় একটা ট্যাক্সি যাবে। ওর সাথে আগে অনেকবার গেছি। বুকিং দিয়ে ফোন করলাম, জিজ্ঞেস করলাম অপেক্ষা করতে পারবে কি না। রাজী হল। বাসা থেকে বেরুচ্ছি, ক্রিস্টিনা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে

- পাপ, তুমি চলে যাচ্ছ?
- হ্যাঁরে।

সেভাও বলছিল ওর সাথে দাবা খেলতে। চাইলে রাতটা থেকে আসা যেত। বা পরের কোন গাড়িতে। সবাইকে এক সাথে খুব কমই পাওয়া যায়। কিছু রান্না করে ওদের নিয়ে খেয়ে আসতে পারতাম। কিন্তু এক লোককে বলে ফেলেছি। অনেকদিন পরে কেমন এক বিষণ্ণ মনে দুবনার পথে পা বাড়ালাম।

দুবনা, ২৭ এপ্রিল ২০২১ 





Comments

  1. থিয়েটার /স্পেক্টাকল দেখতে আমার খুব ভালো লাগতো। তবে ঐ যে সিনেমার চেয়েও বেশী খরচা হতো বলে বিষন্ন বদনে ভালো কিছু থাকলেও বাদ দিতাম। আমি জানি না কেন যে মাসের শেষেই ভালো স্পেক্টাকলের সিডিউল দিতো। অনেক হিসেব করে চলেও আড়াই/তিন রুবল তখন এমন "অভিজাতপনা"য় হারিয়ে বিপদে পড়তে রিস্ক নিতাম না।
    তারপরও নামকরা সব সিনেমার জগতের অভিনেতা/নেত্রীদের দেখা পেতাম, ভালো লাগতো, মনটা দুই তিন সপ্তাহ প্রীত হয়ে থাকতো।
    আমার রুমমেট আনোয়ার এর নাম দিয়েছিল গরীবের ঘোড়া রোগ!
    আস্পিরান্তুরাকালে গালিনার সঙ্গ পেয়ে বেশ উপভোগ করেছি কিন্তু রুবলের কমতিতে ও টের পেয়ে ও মুখো আমরা কমই হয়েছি।
    রুশভাষা ছেড়ে পেডাগজিতে পড়ার চাপও ছিল, তবে সেটা গায়ে না মাখলেও সময় পাওয়া দুস্কর হতো আমার স্বভাব "গুণে"। অর্থাৎ সারাটা জীবন আমি যেন লাস্ট নাইট ফাইটার হয়ে সেমিনার পেপার, ভিস্তুপ্লেনিয়ে, জাচৎ, পরীক্ষা ইত্যাদির প্রস্তুতি এখনও করি, কেননা ভোঁতা মাথায় পরিকল্পনা করতেই সময় কাবার হয়ে যায়।
    তোমার এমন থিয়েটার নিয়ে লিখা পড়ছিলাম আর সেই ১৯৮০-৮৪ কালের মস্কোতে তুমি ফেলে দিলে আমাকে।
    মাঝে মাঝে মনে হয় জীবন মানুষকে একবারই দেয়া হয় আর আমার জীবন কোন কোন সময় প্রায় সম্পূর্ণ অপব্যয় করা হয়েছে গেল, একমাত্র মা'র সঙ্গ দেয়া ছাড়া। এরপর আব্বার মৃত্যুর পর জোশিতাকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পড়াতে ঢাকায় বাসাভাড়া, গাড়ি-ড্রাইভার যে খরচের বাহার! বিগত নয় বছরে মাসের হিসেবে অর্ধেকের বেশীই ছিলাম বেকার। পুরাতন স্কেলের পেনশন নিয়ে এতকিছু যে করেছি তারপর সাভার/উত্তরা থেকে রাজধানীর নাটকপাড়া বাদই দিলাম সাংস্কৃতিক জগতের সঙ্গে আমার কোন ভাবই জমে উঠেনি।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি