মিঃ এক্স

জুনের প্রথম দিকে যখন লেখাটা শুরু করি নাম দিয়েছিলাম "এক রতনের কথা"। পরবর্তীতে রতন সম্পর্কে বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন মূল্যায়ন শুনে মনে হয়েছে মিঃ এক্স-ই হবে ফিটিং টাইটেল।  


বরাবরের মতই গত রোববার মানে ৩০ মে মস্কো গেলাম। সোমবার ক্লাস। বাসায় পৌঁছতে প্রায় সাড়ে আটটা। বাসায় ঢুকতেই কতিয়া, রিস আর নাওমি মিউমিউ করে আমাকে স্বাগত জানাল। ঘর থেকে আইকার ঘেউ ঘেউ। জিজ্ঞেস করলাম বাসায় কে আছে। সেভা ওর ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বলল ও একা, মনিকা পেত্রজাভদস্ক গেছে, ক্রিস্টিনা কোন এক শহরে। মনিকা দুপুরেই গেছে। বাসা থেকে বেরুনোর আগে ফোন করেছিল। ক্রিস্টিনা গত রোববার গেছিল পিতেরে, চলে এসেছে। ভাবছি কোথায় গেল, তখন মনে পড়ল আজ রিবিনস্কে যাবার কথা গান গাইতে। সেভাকে নিয়ে দোকানে গেলাম। রাত এগারটার দিকে ক্রিস্টিনার কাছে জানতে চাইলাম ও কোথায় আছে। ওরা তখন রাস্তায় ছিল। প্রায় একটা পর্যন্ত বসে থেকে ঘুমুতে গেলাম। পরের দিন শুনলাম ওরা এসে পৌঁছেছে ১২.৫০ এ। কোন রকমে মেট্রো পেলেও পার্ক কুলতুরির পর আমাদের লাইনে ঢুকতে পারেনি, হেঁটে এসেছে। মিনিট কুড়ি/পঁচিশের রাস্তা। যদিও বলেছিলাম ট্যাক্সি নিতে - কে শোনে কার কথা। অবশ্য আমি নিজেও ওই বয়সে এমন রাত-বিরাতে এতটা রাস্তা হেঁটেই পাড়ি দিয়েছি।  পরের দিন ক্লাস নিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে প্রায় সাতটা। গাড়ির বুকিং ৯.২০ তে, মানে আর ঘণ্টা দেড়েক পরে বেরুতে হবে। কিছুক্ষণ পরে ক্রিস্টিনা ফিরল, বলল আমার সাথে ঘুরতে যাবে। এরপর কীসব কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বেড়ানো তাই হল না। আমি অপেক্ষা করছি কখন সাড়ে আটটা বাজবে, আমি বেরুবো সেলিগারস্কায়ার উদ্দেশ্যে। তখনই ফোন বেজে উঠল। আমাদের গ্রুপের প্রধান এডিক ফোন করেছে। ও সাধারণত ফোন করলে অনেকক্ষণ কথা বলে। ধরব কি ধরব না ভেবে ধরেই ফেললাম

- এডিক, আমি শুনছি।
- প্রিভিয়েত বিজন। তুমি দুবনায়?
- না, আমি মস্কোয়। রাতে ফিরব।
- এলগিজ ফোন করেছিল। আমি জানতাম না যে নীল হাসপাতালে। ও নাকি অনেকদিন হাসপাতালে ছিল, আমাকে ফোন করেনি। এলগিজও  বলেনি। আজ নীল মারা গেছে। এমন ঘটনা আগে তো ঘটেনি, মানে বিদেশী কেউ এভাবে মারা যায়নি। তাই ভাবছি কী করা। তুমি কি তোমাদের দূতাবাসে একটু খোঁজ নেবে?
- ঠিক আছে, আমি কাল অফিসে তোমার সাথে দেখা করব। চেষ্টা করব একটু আগেই আসতে। তারপর ঠিক করব কী করা।

এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। ক্রিস্টিনা পাশেই ছিল। ওকে বললাম, দ্যাদ্যা রতনকে মনে আছে তোর? ও মারা গেছে। পরে অবশ্য মনে হল ক্রিস্টিনার ওকে মনে থাকার কথা নয়। ওর ছোটবেলায় রতন প্রায় প্রতিদিনই আমাদের বাসায় আসত। ২০০০ সালে ৯ ডিসেম্বর ক্রিস্টিনার যখন দুই বছর পূর্ণ হল ওকে আসতে বললাম। দুবনায় আমাদের পরিচিত তেমন কেউ নেই। রতন একমাত্র বাংলাদেশি। তাই সব সময়ই ওই আমাদের একমাত্র অতিথি।
- না, আমি আসব না।
- কেন, কি হল?
- কাজ আছে।
- দেখ, আমরা তো বাসাতেই। যদি পার কাজ শেষ করেই এসো।

বলতে গেলে ওটাই আমাদের শেষ কথা। এরপর ও আমার সাথে আর কথা বলেনি। কেন বলেনি সেটাও জানায়নি।

রতনের সাথে আমার পরিচয় ১৯৮৪ সালে ও যখন মস্কো আসে।  আমি এসেছিলাম এক বছর আগে ১৯৮৩ সালে। ও যেহেতু ফিজিক্সে পড়বে তাই একটু আলাদা ভালবাসা ছিল ওর প্রতি। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসে সাবজেক্ট চেঞ্জ করে ফিজিক্সে এসেছিলাম, রতন চেষ্টা করেছিল উল্টোটা করতে। সাধারণত লোকজন ফিজ-ম্যাথ থেকে টেকনিক্যাল সাবজেক্টে যেত। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের বাজার সব সময়ই চড়া ছিল। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছে ছিল ওর প্রচুর। যাহোক, শেষ পর্যন্ত ফিজিক্সই পড়তে হয়। আমি যখন আসি তখন এখানে কাউকে চিনতাম না, ১৯৮১ সালে সালাম ভাই আর পরের বছর সাত্তার ভাই এসেছিল মানিকগঞ্জ থেকে। ওদের সাথে আগে যোগাযোগ ছিল না, যদিও বন্ধু বিচিত্র বলেছিল ওর রুমে সাত্তার ভাইয়ের সাথে আমার দেখা হয়েছে। আর জানতাম মিন্টু দার (সুপ্রভাত) নাম। বুয়েটের আহসানউল্লাহ হলে ওর বড়ভাই দেবু দা আমার রুমমেট ছিল। আমি এসেছি পার্টির স্কলারশীপে, তাই দেশে থাকতে আরও নয় জনের সাথে পরিচয় হয়েছিল। বলতে গেলে মস্কোয় আমি ছিলাম অজ্ঞাতকুলশীল। কিন্তু সেদিক থেকে রতন ছিল  হিরো। শুনেছি ঢাকা কলেজে পড়াকালীন কী একটা কারণে ছাত্র দলের ছেলেরা হাইজ্যাক করে নিয়ে ওর উপর অত্যাচার করেছিল। এত অত্যাচারের পরেও ও ছাত্র দলের ছেলেদের কোন প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। এতে বোঝা যায় ওর জেদি চরিত্রের দিকটা। পত্রিকায় নাকি উঠেছিল। আমি পড়িনি। একাডেমিক্যালি রতন দেশে আমার এক বছরের সিনিয়র ছিল, যদিও বয়সে ছিলও প্রায় ৫ বছরের বড়। আমার জন্ম ১৯৬৪ সালে, ওর ১৯৫৯ এ। দুই বছর গ্যাপ দিয়ে সোভিয়েত দেশে আসে। ঢাকা কলেজ, মৈত্রী সমিতি ইত্যাদির সুবাদে ও ছিল অনেকের পরিচিত।  তবে বয়সে বড় বলে ওর ইয়ারমেটরা ওকে আপনি করে আর দাদা বলে সম্বোধন করত। কালাম মনে হয় ছিল ব্যাতিক্রম।        

আমরা থাকতাম একই হোস্টেলে, গণ মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর ব্লকে। আমি ৫১০ নম্বর রুমে আর ও ৫২১ নম্বরে। দেখা হত রেগুলার। মাঝে মধ্যে একসাথে খেতাম, তবে মেস হয়নি। আমি ছিলাম বাউন্ডুলে তাই কেউ মেসে নিতে চাইত না। খেতাম স্তালভায়া বা ক্যাফেতে। ওরা রাত আটটায় ঝাপ তুলে দিত, তাই যখন রাতের খাবার মিস হয়ে যেত ছুটতাম আজান দিতে ১০ নম্বর, ৭ নম্বর, প্লেখানভ, ফার্স্ট মেডিক্যাল, মেই, পাভলভস্কায়া বা অন্য কোথাও। মস্কোয় আজান দেওয়া মানে অনাহুত ভাবে কারও ঘরে গিয়ে খাওয়া। মাঝে মধ্যে রতন বা রেজার ওখানেও খেতাম। আমি নাকি খুব কম খেতাম, তাই আমার খাওয়া না খাওয়ায় কারও হাড়িতে ভাতের টান পড়ত না, ঠিক যেমনটি আমার কারণে লিফটে সাধারণত ওভার ওয়েট হত না। তবে ১৯৯১ সালের পরে আজান দেবার জায়গার সংখ্যা কমে যায় রাজনৈতিক বলয় থেকে দূরে ছিটকে পড়ায়। সেটা দাঁড়ায় গিয়ে টিটু, সৌমিত্রের ঘর বা দ্বিজেন কাকুর বাসা। রতনের সাথে সম্পর্ক ছিল মোটামুটি। আমাদের মিলের চেয়ে  অমিল ছিল বেশি। ও ছিল ফিটফাট, ওর জীবনে পান থেকে  চুন খসার উপায় ছিল না। আমি বিশৃঙ্খলার প্রতিমূর্তি। বিছানায় বই খাতা দিয়ে ভর্তি। ক্লাস থেকে ফিরেই যাচ্ছি ছবি তুলতে বা আড্ডা দিতে। এক কথায় আমরা ছিলাম পরস্পরের আন্টিপোড। মতাদর্শ নিয়েও পার্থক্য ছিল। আদর্শের প্রশ্নে ও ছিল মৌলবাদী, আমি লিবারেল - যদিও দু জনাই সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী। আমার রুমমেট কুমার, রতন আর আমি মাঝে মধ্যে আড্ডা দিতাম। তখন আমরা পশ্চিম ইউরোপে যেতাম না, পার্টির মানা ছিল। রতন ছিল এর অন্ধ সমর্থক। আমি বলতাম, পশ্চিম ইউরোপে গিয়ে কাজ করায় কোন দোষ দেখি না, তবে সেখানে টাকা উপার্জন করে কালো বাজারে টাকা ভাঙ্গালে সেটা নিন্দনীয়। এক কথায় আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নে আছি সে দেশের নিয়ম না ভাঙলেই হল। আর ছিল স্পারতাক। আমি স্পারতাকের সমর্থক ছিলাম, জিতলে খুশি হতাম, কিন্তু হারলে খুব একটা মন খারাপ হত না। আসলে মন খারাপ করার সময়, সুযোগ, ইচ্ছে আমার কখনই তেমন ছিল না। রতন ছিল উগ্র স্পারতাক সমর্থক। এখানেও বিতর্ক হত, তবে সেসব কখনই মুখ দেখাদেখি বন্ধ করেনি।  রতন সব সময়ই এক্সেপশনাল থাকার চেষ্টা করেছে। ছাত্র সংগঠনের বিভিন্ন সভায় ভোটের ক্ষেত্রে এটা দেখা যেত। এমনকি বন্যা দুর্গত দেশের মানুষকে সাহায্য পাঠানোর প্রস্তাবেও ও ভোটদানে বিরত থাকত, যদিও ফাণ্ড কালেকশনের জন্য আয়োজিত বিভিন্ন সুব্বোৎনিকে অংশ নিত সবার আগে। প্রস্তুতি পর্ব শেষ করেই ও সাইবেরিয়ায় কাজ করতে গিয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই এসব জায়গায় ছেলেমেয়েরা কাজের পাশাপাশি রেস্ট নেয়, বিভিন্ন ফান করে। তাই প্রায় প্রতি ঘন্টায়ই ইন্টারভ্যাল বা পিরিকুর আয়োজন করে। সবাই যখন রেস্ট নিচ্ছে, রতন একা একা কাজ করে যাচ্ছে। রতনের ধারণা ছিল অন্যরা সব ফাঁকিবাজ, দুর্বল। এটা করে ও নিজেকে শক্তিশালী মনে করত, নিজেকে অন্যদের চেয়ে বড় মনে করত আর এ নিয়ে গর্ব করত। কিন্তু এতে করে কালেক্টিভে অস্বস্তির সৃষ্টি হয়, অন্যেরা মনে করে তাদের সবাইকে অবহেলা করা হল। কাজ থেকে ফিরে অনেকেই রতনের এ ধরণের ব্যবহারের জন্য ওকে ক্রেইজি বলেছে। মনে পড়ে সে যুগের কফির বা স্তালোভায়ার লাইনের কথা। সবাই চেষ্টা করত কোন না কোন ভাবে লাইনে ঢুকে যেতে। রতন সেটা দু' চক্ষে দেখতে পারত না। নিজে তো কখনই ঢুকতই না, যদি কেউ ওর সামনে দাঁড়াতে চাইত এমন ভাব দেখাত যেন সেই লোক ভ্রাগ নারদা মানে গণশত্রু। তবে এটাও এক ধরণের মানসিকতা, জীবন দর্শন।  কিন্তু সমস্যা হল সবচেয়ে স্বাধীন মানুষটাও প্রায়ই তার ইগোর কাছে পরাধীন, স্বাধীনতা প্রদর্শন করতে গিয়ে নিজের ইগোর কাছে হার মানে বারবার। আর এটা করে স্বাধীন তো হতেই পারে না, বরং আরও বেশি করে অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।


১৯৯০ সালে ও মাস্টার্স   কমপ্লিট করে। যেহেতু আমাদের ব্লকে তাই বললাম, চল একটু ফুর্তি করি। ও তেমন রাজী ছিল না, তবে প্রেমানন্দের আর্থিক সহায়তায় নিজের উদ্যোগেই রুটি, মাংসের আয়োজন। ও ড্রিঙ্ক করে না, তাই বিয়ার ছিল না। ছিল এক বোতল শ্যাম্পেন। আমি আর এমদাদ ভাই বলতে গেলে জোরাজোরি করেই ওকে এক পেগ শ্যাম্পেন খাওয়াই। ওটাই প্রথম। শেষ কিনা জানি না। তবে আমার সামনে আর কখনও খায়নি। সে বছর সামারে এক সন্ধ্যায় নিশিথ স্যান্নাল এসে হাজির কিয়েভ থেকে। সেও রতনের মতই ঢাকা কলেজের ছাত্র, নেতা, সোভিয়েত দেশে আমার ইয়ারমেট। তবে বিভিন্ন কারণে ওর সাথে আমাদের সম্পর্ক তেমন গড়ে ওঠেনি। কেন, সেটাও জানি না। কিয়েভ সংগঠনের কোন সমস্যা থেকেই হয়তো। তবে এ নিয়ে আমার মাথা ব্যথা ছিল না। এরকম অনেকের সাথেই আমার সম্পর্ক ছিল। ওর সাথে না থাকার কারণ ওর "আমিই ঠিক, অন্যেরা ভুল" এ ধরণের মানসিকতা। রতনও ছিল অনেকটা সেরকমই। রতনকে রুমে না পেয়ে নিশিথ আমার রুমে এসে হাজির। পরের দিন আমার কান্দিদাতস্কি মিনিমাম। ও ব্যাগ রেখে নিজের কাজে চলে গেল। অনেক রাতে ফিরে এসেও রতনকে পেল না। রতন কখনোই কারও ওখানে থাকে না। কি করা, আমি আফগানিস্তানের নুরুদ্দীনকে বলে ওর ঘরের খালি সীটে নিশিথের থাকার ব্যবস্থা করলাম। ওই রাতে রতন সবাইকে অবাক করে কালামের ওখানে ছিল, যদিও নিশিথ ওকে খবর দিয়েই এসেছিল। পরের দিন পরীক্ষা দিয়ে ফিরছি, দেখি রতন জানালায় দাঁড়িয়ে। রুমে এসে ওর ওখানে নক করলাম, কেউ দরজা খুলল না। এরপর রতন আমার সাথে কথা বলেনি। কেন? ওই জানে।   

১৯৯৪ সালে আমি দুবনা চলে যাই চাকরি নিয়ে। ১৯৯৬ সালে গুলিয়া মনিকা আর আন্তনকে নিয়ে দুবনা চলে আসায় মস্কো আসি কালে ভদ্রে, তাও ডিপার্টমেন্টে কাজ থাকলে। ১৯৯৭ সালের মে মাসের কোন একদিন আমার পিএইচডি সুপারভাইজার গিওরগি নিকোলায়েভিচ শিকিন বললেন, "তোমার দেশি তোমাকে খুঁজছিল"। দেশি তো আমার শ' খানেক।  কোন দেশি, সেটা কিছুতেই বের করতে পারলাম না। বসে বসে কি একটা ক্যাল্কুলেশন করছি

- দেশে যাও সেটা সবাই বলে, আপনি আমাকে দুবনায় চাকরি ম্যানেজ করে দিতে পারেন কিনা সেটা বলেন।

১৯৯০ সালের পর এটাই ছিল আমার উদ্দেশ্যে রতনের প্রথম কথা।

- আমি তো চাকরি দেই না। তবে আসতে পার। আমি দু একজনের কাছে নিয়ে যাব। যদি তাঁরা নিতে চান নেবেন।

একটা দিন ঠিক করা হল। আমাদের ইনস্টিটিউটে চাইলেই কেউ ঢুকতে পারে না। পারমিশন লাগে। সেটা পাওয়ার জন্য একটু দৌড়ঝাঁপ করতে হয়। রতন এল। আমি ওকে নিয়ে গেলাম আমার লোকাল বস ভ্লাদিমির মিখাইলোভিচ দুবোভিকের কাছে। আরও দু একজনের সাথে কথা বললাম। তাঁরা উপদেশ দিল অন্য ল্যাবে ইয়েভগেনি পেত্রভিচ ঝিদকভের সাথে কথা বলতে। তবে সেটা পরের সপ্তাহে। আমি বাসায় খেতে যেতাম দুপুরে। রতনকে বললাম যেতে। রাজী হল না। ওকে কীভাবে আমার বাসায় যেতে হয় সব বুঝিয়ে চলে গেলাম। আমি যখন খেয়েদেয়ে অফিসে যাব, রতন এসে হাজির। খাওয়া দাওয়া করতে বললাম। ও খেলো না। আমি রেডি হয়ে ওকে ডাকলাম যেতে

- আপনি যান, আমি আসছি।
- ঠিক আছে। আমি মনিকার সাথে বাইরে খেলছি, তুমি আস।

ভাবলাম হয়তো বাথরুমে যাবে। যাহোক কিছুক্ষণ পরে রতন আমাকে এসে ধরল। ও গেল ট্রেন স্টেশনে, আমি অফিসে। রাতে বাসায় ফিরলে গুলিয়া আমার হাতে একটা ইনভেলাপ দিল।

- এটা কি?
- আমি কোত্থেকে জানি? তোমার বন্ধু বলল তোমাকে দিতে। তুমি নাকি জান।

খুলে দেখি সেখানে ৫০ ডলারের একটা নোট। এর আগে মস্কোয় টিচারদের অনেকেই বলেছিলেন রতনকে দুবনার ব্যাপারে সাহায্য না করতে। ও বলতে গেলে কাজ কিছুই শেখেনি। শুধু ওকে বিদায় করতেই কোন ভাবে পি এইচ ডি করার অনুমতি দেয় ডিপার্টমেন্ট। ও ইতিমধ্যে ওর সুপারভাইজার তুরিকভের নামে বেশ কিছু মিথ্যা গুজব ছড়িয়েছিল। এখন গুলিয়া বলল, এই লোকের সাথে কোন কাজে যাওয়া ঠিক নয়। আমি একটা কথাই বলেছি, এই ছেলে ৭ বছর অজ্ঞাত কারণে আমার সাথে কথা বলেনি। সে যেহেতু নিজেই এসেছে সাহায্যের জন্য, নিশ্চয়ই কাজ করবে। পরবর্তী কালে দেখা গেল কত ঠিক ছিল মস্কোর বন্ধুদের আর গুলিয়ার ইন্টুইশন। পরের সপ্তাহে রতন এলে ওর হাতে ইনভেলপটা ফেরত  দিয়ে বললাম

- আমি ঘুষ নিই না। এমন কাজ আমার সাথে আর করো না। 

অবশ্য রতন তার প্ল্যান থেকে একটুও সরেনি। পরের বছর ৮ মার্চ এসেছিল গুলিয়াকে অভিনন্দন জানাতে। ও বাসায় ছিল না। এবার আমার কাছ ওর জন্য উপহার রেখে গেল। গুলিয়া খুলে দেখে অনেক দামী এক সেন্ট। গুলিয়া এতে খুশির চেয়ে কষ্টই বেশি পেয়েছিল। কেন না তখন সবার অবস্থাই ছিল  খুব খারাপ। এ ধরণের সেন্ট কেনার সামর্থ্য তখন আমাদের ছিল না। সেন্টটা ও আর কখনোই ব্যবহার করেনি।

যাহোক,  দুবনায় কথাবার্তা বলে রতন দেশে ফিরল। চাকরিটা ম্যানেজ করতে বেশ খড়কুটা পোড়াতে হল। ইয়েভগেনি পেত্রভিচকে আগে থেকেই চিনতাম। উনি ছিলেন আমার সুপারভাইজার রীবাকভের ডিএসসির অপনেন্ট। আমি দুবনায় কাজে জয়েন করি ১৯৯৪ সালের ১৮ মে। ইউরি পেত্রভিচ ডিফেন্ড করেন ওই বছর ২৮ ডিসেম্বর। তার সমস্ত কাগজপত্র, তাদের করেনপন্ডেন্স আমার মাধ্যমেই বিনিময় হত। সেই থেকে ঝিদকভ আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ওনার অনুপ্রেরণাতেই আমি নিজে পরে ডিএসসি থিসিস লিখতে শুরু করি ও ডিফেন্ড করি, যদিও তার আগেই উনি মারা গিয়েছিলেন। একদিন তিনি জিজ্ঞেস করলেন রতনের ব্যাপারে ইউরি পেত্রভিচের মতামত।
- ইউরি পেত্রোভিচ বলেছেন অদক্ষ সৈনিককে যেমন অবসরে পাঠানোর জন্য জেনারেল পদে উত্তীর্ণ করা হয়, নীলকে সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই পিএইচডি ডিফেন্ডের অনুমতি আমরা দিয়েছিলাম।
- হুম। ইউরি পেত্রোভিচ  মনে হয় ঠিকই বলেছে। কিন্তু তুমি এখানে একজন দেশি পেয়ে খুশি হবে সেটাও ঠিক। তোমার কী মত?
- ও যেহেতু অনেক কিছুর পরেও আমার কাছে অনুরোধ করেছে কাজের জন্য, নিশ্চয়ই করবে। গবেষনায় অনেক কিছুই নতুন করে শিখে নিতে হয়। আশা করি ও সেটা করবে।  তবে ওকে সুযোগ দেওয়া না দেওয়া একান্তই আপনাদের ব্যাপার।
- যদি নেই তবে শুধু তোমার কথার উপর ভিত্তি করে নেব। সব দায় দায়িত্ব তোমার।

আসলে গবেষণা কেন্দ্রে ব্যক্তিগত রিকমেন্ডেশন খুব গুরুত্বপূর্ণ। তখন সেটা বুঝিনি। ফলে পরবর্তীতে বার বার এ নিয়ে কথা শুনতে হয়েছে। এর পরে রেজা সহ বেশ কিছু লোক যারা এখানে আসার জন্য আমাকে লিখেছিল, অনেকদিন পর্যন্ত তাদের জন্য কিছু করতে পারিনি। ওই একই কথা। একবার তোমাকে সুযোগ দিয়েছি। তুমি সেটার সদ্ব্যবহার করতে পারনি।

তখন ওই ল্যারেটরির ডাইরেক্টর ছিলেন ইগর ভিক্তরভিচ পুজিনিন। একদিন ওনার কাছে গেলাম।
- আমাকে ঝিদকভ বলেছেন। মস্কো থেকে রীবাকভ বা সেভাস্তিয়ানভ পজিটিভ কিছু বলেননি। শধু তোমার কথার উপর নিচ্ছি। সেটা যেন মনে থাকে।
- ঠিক আছে।
- তোমার বেতন কত।
বললাম।
- ওকে আরেকটু বেশি দিলে কিছু মাইন্ড করবে না তো?
- না। বরং খুশি হব।
- অবাক করলে  তো।
- দেখুন, বন্ধু বা প্রতিবেশিরা যখন ভাল থাকে আমার সমস্যা কম হয়, কেননা ওরা নিজেদের সমস্যা নিয়ে আমাকে বিরক্ত করে না।
- সেটাও ঠিক।

আমার কখনই মনেই হয়নি বেতন বাড়ানোর জন্য দরখাস্ত লেখার কথা। ১৯৯৯ সালে আমি থিওরেটিক্যাল ল্যাব ছেড়ে এখানে চলে এসেছি।  একদিন ঝিদকভের অফিসে বসে আছি, পুজিনিন এসে বললেন 

- নীল বেতন বাড়াতে বলছে। তুমি তো চাইবে না। যদি ওর বেতন বাড়াই, তোমারটাও বাড়াবো।

এটা অবশ্য রতন আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করার পর।


শেষ পর্যন্ত  চাকরিটা ম্যানেজ হল।  আমি ডিসেম্বরে ওর ইনভাইটেশন নিয়ে দেশে গেলাম। সেখান থেকে পুনা। আমি দুবনা ফিরলাম ২৯ ডিসেম্বর। রতন এসেছিল কিছুদিন আগে। বাংলাদেশ থেকে আমিই মনে হয় দুবনায় প্রথম কাজ করতে আসি। রতন যখন এল উপমাহাদেশ থেকে আমি একাই এখানে ছিলাম। এখানে তখনও প্রায় সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থা। বাজার অর্থনীতির হাওয়া খুব একটা লাগেনি। দোকান-পাট সেই আগের মতই ফাঁকা। অবশ্য আমার পকেটও ভরা কিছু ছিল না। তবে রতন আসায় আমাদের জীবন একটু বদলে যায়। ও প্রায়ই আমাদের বাসায় আসত। গল্পগুজব হত। তবে সমস্যা একটাই। ও এসেই আমাদের ঘরদোর পরিষ্কার করা শুরু করত আর চলে গেলে দেখতাম টিভির চ্যানেলগুলো আগের জায়গায় নেই, হাড়ি পাতিল, চামচ, কাটা চামচ সব অন্য জায়গায় সাজানো। সে সময় ক্রিস্টিনা পেটে। গুলিয়া চাইলেও অনেক সময় সব গুছিয়ে রাখতে পারত না। আমি সারাদিন কাজে। মনিকা আন্তন সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে। আমি ওকে কিছুতেই বুঝাতে পারতাম না যে পরের মন্দিরে নিজের অনুশাসন নিয়ে ঢুকতে নেই বিশেষ করে সেই মন্দিরের পুরহিত যদি মহিলা হয়। তবে এটা নতুন কিছু নয়। ছাত্র জীবনে রতনের কাছে আমার ঘরের চাবি ছিল। ও এসে টিভি দেখত, চা খেত। কিন্তু সমস্যা হল, যখন রুমমেটরা অন্য কিছু দেখতে চাইত, রতন তাদের সাথে বিতর্ক শুরু করত। ফলে এক সময় আমাকে চাবিটা নিয়ে নিতে হয়েছিল। তারপরেও ওর উপস্থিতি আমাদের ভাল লাগত। ১৯৯৯ সালে আমি চার মাসের জন্য ইতালী যাই। রতনকে বলে যাই দরকারে যেন গুলিয়া আর বাচ্চাদের হেল্প করে। আমাদের ঘরে টেলিফোন ছিল না, গুলিয়া বাচ্চাদের নিয়ে রতনের ওখানে যেত আমার সাথে কথা বলতে। এছাড়া সে সময় আমি থিওরেটিক্যাল ল্যাবরেটরি চেঞ্জ করে  ইনফরমেশন টেকনোলজিতে চলে যাই। সেটাও স্থানীয় এক জার্মান ভদ্রলোকের কারণে যার সাথে আমরা এক সময় একই কটেজে থাকতাম। ইতালী থেকেই আমাকে এসব করতে হয়। আমার কাগজপত্র রতনই ঝিদকভের কাছে পৌঁছে দিত। সেটা কিছুটা হলেও আমার মানসিক চাপ কমাত। এক কথায় আমাদের একঘেয়ে দুবনা জীবনে কিছুটা হলেও বৈচিত্র্য আসে রতনের আগমনে। এ সময় শহর ছিল বলতে গেলে ফাঁকা, বাড়িঘর কম। আজ যে সব জায়গায় সুপার মার্কেট, সেখানে আমরা পিকনিক করতাম। রতন অল্প সময়ের মধ্যেই আমার চেয়েও বেশি করে দুবনা চিনে ফেলে। আমি যখন দুবনা আসি, প্রায় দুই মাস পরে জানতে পারি যে আমি যে ডেস্কটপে বসে কাজ করি তার সাথেই একটা ফ্রিজ আছে। আমার মনেই হয়নি যে এখানে ফ্রিজ থাকতে পারে। তাই ওর দুবনা চেনা যেমন ছিল সাধারণ ব্যাপার আমার না চেনাটাও তেমনি স্বাভাবিক। এখানে ১৯৯৪ সাল থেকে থাকলেও মাত্র গত বছর, মানে ২০২০ সালে আমি ভোলগার অন্য তীর ধরে হেঁটেছি। তখন আমরা প্রায়ই একসাথে ভোলগার তীরে যেতাম। এভাবেই চলছিল। কিন্তু সমস্যা হল ও কিছুতেই নতুন কাজের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারছিল না। গবেষক শুধু অন্যের কাজ আয়ত্ব করে না, নিজের চিন্তা ভাবনা দিয়ে সে কাজ ডেভেলপ করে। ওর ধারণা ছিল সবাই ওকে কঠিন কঠিন সমস্যা সমাধান করতে বলে। ওকে বোঝানোই যেত না যে সহজ সমস্যা বলে কিছু নেই। যেহেতু আমার রিকমেন্ডিশনেই ও এসেছিল, তাই পরোক্ষ ভাবে ঝিদকভ আমাকে দোষী করতেন আর সে কারণেই আমি ওকে বলতাম কষ্ট হলেও চেষ্টা করে যেতে। এক সময় আমার সাথে কাজ করার জন্যেও বলেছি। তবে রাজি হয়নি। তারপরেও তেমন কোন সমস্যা হয়নি। রতন আসার পর ১৯৯৮এর ডিসেম্বরে ক্রিস্টিনার জন্ম হয়। তখন ও আমাদের খুবই সাহায্য করেছে। ওর প্রথম জন্মদিন একসাথে  পালন করেছি। কিন্তু দ্বিতীয় জন্মদিনে ও আসেনি। পরের দিন কি কাজে আমি দোকানে যাচ্ছি জরুরি কিছু কিনতে, রতনের সাথে দেখা। হাত নেড়ে চলে যাই সময় ছিল না বলে। এরপরে রতন আর কথা বলেনি। হতে পারে এটা আমার মনে হচ্ছে। আবার হতে পারে ঘটনা আরও গভীরে কোথাও। গুলিয়া আমাকে বলে আমি যত মুখ বন্ধ করে রাখি ততই ভাল। আসলে আমি যে খুব বেশি কথা বলি তা নয়, তবে যে কোন বিষয় নিয়ে ঠাট্টা করার সুযোগ থাকলে ছাড়ি না। একদিন আমরা বসে গল্প করছিলাম। রতন ওর স্বভাবসুলভ  ভঙ্গিতে বলল 

- আমি সবচেয়ে স্বাধীন মানুষ। 

ও অবশ্য আমাদের সংসার আর ছেলেমেয়েদের কারণে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা বোঝাচ্ছিল। তখন এখানে একটা জোক খুব চালু ছিল এক এক্স সোভিয়েতের রিপাবলিক নিয়ে - আনা সামাইয়া নিজাভিসিমায়া স্ত্রানা, তাক কাক আত নিও নিচিগ নি জাভিসিত (এটা সবচেয়ে স্বনির্ভর দেশ কেননা তার উপর বিশ্বের কিছুই নির্ভর করে না। (ছন্দ ঠিক রাখার জন্য স্বাধীনের পরিবর্তে স্বনির্ভর শব্দটা ব্যাবহার করলাম।) এই জোকটা বলে আমি আরও বললাম

- দেখ আজকের পৃথিবীতে একমাত্র নাগা সন্ন্যাসী ছাড়া আর কেউই স্বাধীন নয়। এমনকি সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিরাও তাদের সম্পদের সুস্বাস্থের জন্য আমাদের মত গরীবদের উপর নির্ভরশীল। আর আমরা কে? হয়তো অতি প্রতিভাবান কিছু মানুষ তাদের কাজের জন্য ভাবে না, তাদের কাজ দিতে পেরে অন্যেরা ধন্য হয়, কিন্তু তোমার আমার মত লোকের চাকরি আমাদের বসদের মর্জির উপর নির্ভর করে। তাই তোমার এই স্বাধীনতা তোমাকে দু' বেলা  ভাতের ব্যবস্থা করতে পারবে না। 

রতন আর কিছু বলেনি। একটু পরে চলে গেছিল। গুলিয়া পরে বলল আমি নাকি খুব কড়া ভাবে কথাগুলো বলেছি, যদিও আমার বিশ্বাস এতে বিন্দুমাত্র ভুল ছিল না। হতে পারে আমার এরকম সোজাসাপটা কথায় বিরক্ত হয়েই ও সুযোগ  বুঝে যোগাযোগ বন্ধ করেছিল। এতে আমার সমস্যা ছিল না। সমস্যা হল, যখন ও রাস্তা ঘাটে দেখা হলে গুলিয়া, আন্তন, মনিকা -  ওদেরও এড়িয়ে যেতে শুরু করল। আমাকে প্রায়ই ওদের বোঝাতে হত আমাদের দেশের সবাই এরকম নয়, এটা স্কারেয়ে ইচক্লুচেনিয়ে চেম প্রাভিলা মানে এটা এক্সেপশনাল কেস।

সে সময় মূল সমস্যা ছিল ইয়েভগেনি পেত্রোভিচকে নিয়ে। দুপুরে লাঞ্চের পরে আমরা অনেকেই ওনার ওখানে চা খেতে যেতাম। উনিই ব্যবস্থা করতেন। উনার বয়স তখন পঁচাত্তর পেরিয়ে গেছে। তাই চায়ের নামে কিছু আড্ডা, অতীতের গল্প - এসব। আগে আমরা দুজন এই আড্ডায় বেশ অগ্রণী ভূমিকা রাখতাম। এখন সেই পরিবেশ আর রইল না। ঝিদকভ সহ অনেকেই এটা মার্ক করে আমাকে বলেন নিজেদের ঝামেলা মিটিয়ে নিতে। সমস্যা হল  ঝামেলাটা যে কী  সেটা আমার জানা ছিল না। আমি বললাম, আমার কোনই অসুবিধা নেই ওর সাথে কথা বলতে। দুবনায় এসেছি কাজ করতে, ঝগড়া করতে নয়। আপনারা হাই হ্যালো যেটুকু না বললে লোকজন মার্ক করে অন্তত সেটুকু বলতে ওকে রাজী করান।  তবে যতদূর বুঝলাম ওরা রতনকে রাজী করাতে পারেনি।

গত মঙ্গলবার যখন ইলগিজের সাথে দেখা ও বলল

- আমি কতবার ওকে বলেছি, "আমরা চেষ্টা করি তাতাররা একসাথে থাকার।  তোমরা বাংলাদেশ থেকে দু' জন মাত্র লোক। কথা বললে কী সমস্যা?" ও আমাকে বলেছে কখনও যেন ওকে তোমার সম্পর্কে কিছু না বলি। তাই ও অসুস্থ থাকার সময় তোমাকে বলিনি পাছে ও মাইণ্ড করে। এ কারণেই তোমাকে ওর মৃত্যু সংবাদও জানাইনি।

প্রথম দিকে আমাদের কথা না বলা (আসলে ও আমাকে দেখলেই অন্য পথে চলে যেত, করিডরে দেখা হলে অন্য ঘরে ঢুকে যেত) নিয়ে অনেকে একটু অবাক হলেও পরে কেউই এ নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি।   অনেকের সাথেই ও প্রথমে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশে কথা বন্ধ করে দিয়েছিল ইতিমধ্যে। তাই প্রায় সবার কাছে এটাই ছিল রতনের বেসিক স্টেট। আসলে বন্ধু আমাদের কী জন্য দরকার? অনেক পরে যখন রেগুলার মস্কো আসতে শুরু করি সেটা নতুন করে বুঝি। তখন মুকুল ভাই, সানু, অমল, কল্লোল - ওদের সাথে নতুন করে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। মনে সাহস জাগে এই ভেবে যে যদি কোন সমস্যা হয় ওদের কাছে সেটা বলা যাবে, ওদের পাশে পাওয়া যাবে। এরপর এক সময় জিয়াউদ্দীন নামে এক ভারতীয় ছেলে আমার কাছে পোস্ট ডক করে। আমি একা থাকতাম। ওর উপস্থিতি আমাকে সাহস যোগাত। জানতাম কোন সমস্যা হলে ওকে ডাকতে পারব। কেউ আছে, কেউ পাশে দাঁড়াবে এই বিশ্বাস - এটা যেকোনো সাহায্যের চেয়ে হাজার গুণ বড়। তাই রতনের কথা না বলা যে একেবারেই ট্রেসলেস ছিল তা নয়। তবে মানুষ সব অবস্থার সাথেই মানিয়ে চলতে শেখে। ধীরে ধীরে আমরাও রতনকে ছাড়াই দিন কাটাতে শিখি। এরপর এক সময় গুলিয়া বাচ্চাদের নিয়ে মস্কো চলে যায়। ২০১০ বা ২০১১ সালের দিকে হঠাৎ সানু ফোন করল। ও এমনিতেই মাঝে মধ্যে ফোন করে।

- বিজন দা, আপনার কাছে কি রেজার নম্বর আছে?
- হ্যাঁ। লাগবে? দেশে যাবে নাকি?
- নীলরতন যাচ্ছে। ও আপনার কাছে চাইতে লজ্জা পায়, তাই আমাকে বলেছে নিয়ে ওকে দিতে।
- ও দেখি আমার বৌয়ের মত। আমার সাথে তাঁর ঘর করতে আপত্তি, অথচ টাকা নিতে মোটেই মাইণ্ড করে না। 

ওই সময় গুলিয়ার সাথে আমার সম্পর্কের টানাপোড়ন চলছিল। আমি তখন ডিএসসি থিসিস ডিফেন্ড করা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। বিভিন্ন সেমিনারে টক দিতে হত, বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হত। কখনও ভালো, কখনও মন্দ। আমার কাজে কোন সমস্যা বা ব্যর্থতা নিয়ে গুলিয়া তখন প্রায়ই খোটা দিত। পরে শুনেছি রতন ছিল ইনফরমার। যাহোক সানুর ফোন পেয়ে আমি নিজে রতনের অফিসে গিয়ে রেজার নম্বর দিলাম আর বললাম, আমার ভাই দেখা করে কিছু দিলে যেন নিয়ে আসে। ও হ্যাঁ না কিছু বলেনি। তবে নম্বর দেবার জন্য আমি মজুরি নিয়েছি। রেজা আমার ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে কিছু জিনিস পাঠিয়েছিল। ও অন্যদের মাধ্যমে সেটা আমার কাছে পৌঁছে দেয়। আমি অবশ্য ওর অফিসে গিয়েই স্পাসিবা বলে আসি। আরও একটা উপকার হয়েছিল রতনের কারণেই। ওর দেশে যাওয়া থেকেই আমি জানতে পারি ভাল করে চাইলে ইনস্টিটিউট দেশে পাঠাতে পারে কিছু দিনের জন্য। আর সেই সূত্র ধরেই ১৪ বছর বনবাসের পর ২০১১ আমার দেশে ফেরা তিন মাসের জন্য। ঢাকায় এসেই গেলাম রেজার ওখানে। আমি আর আমার ভাই রতন। ওরা বলল, রতন নাকি বলেছে "ও দুবনায় রাজার হালে থাকে। আমি চাইলেই আমিও নাকি অনেক ভালো ভাবে থাকতে পারি, মাঝে মাঝে দেশে আসতে পারি।" আমার আর কি বলার আছে। শুধু বললাম, "রাজারা কাজ করে না, অন্যের শ্রমের উপর বাঁচে। তাই রতন যে রাজার হালে থাকে সেটা মিথ্যা বলেনি। আমি সাধারণ সোভিয়েত পদার্থবিদ। আমাকে কাজ করতে হয়। রাজার হালে থাকা আমার সাজে না।" 

 

দেশে অনেকের সাথে দেখা। অনেকেই রতনের খবর জানতে চেয়েছে। শুভেচ্ছা দিয়েছে। দেশ থেকে ফিরে একদিন রাস্তায় রতনের সাথে দেখা। আমি বললাম

- যুগল, আহসান সহ অনেকেই তোমাকে শুভেচ্ছা দিয়েছে। তোমাকে ফোন করতে বলেছে। 

কিন্তু তাকিয়ে দেখি এর মধ্যেই ও অনেক দূরে চলে গেছে। এরপর যুগল আসে দুবনা বেড়াতে। পরে মুকুল ভাই। ওদের নিয়ে গেছি রতনের ওখানে (ওরা গেছে, আমি নীচ থেকে চলে এসেছি)। আমাদের শেষ বার কথা হয় মনে হয় নুরু ভাই বা অমলের অসুখের জন্য যখন টাকা তুলি তখন। ওর অফিসে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ও এদের জন্যে কিছু কনট্রিবিউট করতে চায় কিনা। কিন্তু কিছু বলা তো দূরের কথা ফিরেও তাকায়নি। তাই এরপর থেকে কোন কথা বলার আর প্রয়োজন মনে করেনি।

আমি বলব না, রতনকে আমি মিস করেছি। গুলিয়া যখন বাচ্চাদের নিয়ে মস্কো চলে যায় হাতে প্রচুর সময় পাই। আগে সকাল ৭ টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত কাজ আর বাচ্চাদের দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করেই দিন যেত। এখন নতুন করে লেখালেখি করা  শুরু করি। হয়তো রতনের সাথে সম্পর্ক থাকলে তখন আমাদের সম্পর্কের টানাপোড়নে গুলিয়াকে দোষী করার চেষ্টা করতাম। এটাই তো সাধারণত হয়। কথা বলার লোক থাকলে অনেক কিছু যা ফেসবুকে লিখি, লেখা হত না। কেননা তখন বিশেষ করে দেশের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করার লোক থাকত। সে যাই হোক, আমি সব কিছুতেই পজিটিভ দেখতে চাই, তাই ও নিয়ে ভাবি না। 

আগে রতন হোটেলে থাকত, খুব ছোট্ট একটা রুমে। সময় মত অফিসে যেত। এখানে এক হাজিরা খাতা আছে। রতন রেগুলার সাইন করত "নীরস"। রতন বাদে আর কেউই সেখানে সাইন করে না। আচ্ছা, হাজিরা খাতা কি এখন একেবারেই বেকার হয়ে গেল? দোকান আর নীচে রিসেপসনের লোকজনের সাথে মাঝে মধ্যে আড্ডা। কখনোই ভোলগার ধারে হাঁটতে দেখিনি। বছর দেড়েক আগে হোটেলে রিকনস্ট্রাকশন শুরু হলে সবাই যে যার মত শহরে থাকতে শুরু করে। ওর মৃত্যুর পর শুনলাম ও থাকত এক প্রাইভেট হোটেলে। দীর্ঘ লকডাউনের পর যখন কাজে যেতে অনুমতি দিল রতনকে দেখে আশ্বস্ত হই ভালো আছে জেনে। এই মৃত্যু সময়ে এটা ছিল সুসংবাদ।

আমার ধারণা ছিল কয়েকদিন আগেও ওকে দেখেছি। তাই এলগিজ যখন বলল ৮ মে থেকে ও হাসপাতালে বিশ্বাস হচ্ছিল না। এডিক যখন ওর মৃত্যু সংবাদ দেয় কোন রকম অনুভূতি জাগেনি। যদিও যখনই কারও মৃত্যু সংবাদ শুনি মন খারাপ হয়। দুবনায় অনেকের সাথে দেখা হলে দাঁড়িয়ে কথা বলি, কাউকে শুধু প্রিভিয়েত বলে চলে যাই, কাউকে দেখে মাথা নাড়িয়ে একটু হাসি। এমনকি যখন কোন পরিচিত লোক দেশে বা বিদেশে মারা যায় যাদের সাথে জীবনে দেখা হবার সম্ভাবনা নেই, তবুও মনে হয় - ইস, আর দেখা হবে না। ইস, আর দেখা হবে না, কথা হবে না - এটাই আমাদের দুঃখিত করে। কিন্তু রতনের ক্ষেত্রে বেঁচে থাকুক আর নাই থাকুক কোন রকম ইন্টার‍্যাকশন হবে না এটাই ছিল সত্য। হয়তো তাই কোন রকম অনুভূতি জাগেনি। আমার কেন যেন মনে হয়েছিল শেষের দিকে ও আমাকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বলেনি। আগের মত আমাকে দেখে অন্য দিকে চলে যেত না। কিন্তু নিজের অহং বোধ ওকে হয়তো সেটা করতে দেয়নি। 

অনেকেই রতনের মৃত্যুকে নিঃসঙ্গ মরণ বলে অভিহিত করেছে। আমার মনে হয় এটাই ছিল ওর চয়েস। বিভিন্ন সময়ে আমাদের বিভিন্ন বন্ধুরা ওর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু ও নিজেই সেসব সম্পর্ক রাখেনি। মাঝেমধ্যেই নম্বর বদলিয়েছে। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ও বেশ কেয়ারিং ছিল। যাদের সাথে মিশত তাদের জন্য অনেক কিছুই করত। কিন্তু কী এক অজ্ঞাত কারণে কিছু না বলেই যোগাযোগ বাদ দিত। মাঝে বেশ কয়েকবার দেশেও গেছে। প্রথম দিকে রেজার ওখানে উঠত, দেখা করত, ফোন করত। গত ২০১৮ সালে দেশে গিয়েও যোগাযোগ করেনি। এমনটা ঘটেছে মস্কোর অনেকের সাথেই। যেন পৃথিবীর সবার প্রতি ওর কোন রাগ ছিল কোন এক অজ্ঞাত কারণে। অনেক আগে, খুব সম্ভব দুবনার  জীবনে প্রথম দিকে একবার বলেছিল ছোটবেলায় ওদের সাথে কেউ মিশত না। কেন? এ ব্যাপারে আমি কখনোই জিজ্ঞেস করিনি। হতে পারে সেই তখন থেকেই ওর মানুষের সাথে না মেশার এক স্বভাব গড়ে উঠেছিল। এখন ওর ভাইয়ের সাথে কথা বলার সময় জানলাম ও ছোটবেলা থেকেই কারও সাথে মিশত না। ওর মৃত্যুর পর অনেকেই আমাকে ফোন করেছে। এদের কেউ কেউ ঢাকা কলেজে ওর রুমমেট ছিল, ছিল সহযোদ্ধা। কিন্তু ওদের কারও সাথেও ও কী এখন, কী সোভিয়েত জীবনে (যদিও অনেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিল) তেমন যোগাযোগ রক্ষা করেনি। তবে যে জিনিসটা ও বুঝতে পারেনি সেটা হল, সমাজে বাস করলে তুমি সমাজকে যতই এড়িয়ে চল, সমাজকে বাদ দিয়ে তুমি খুব বেশি দূরে যেতে পারবে না। সেটা করতে হলে সমাজের বাইরে থাকতে হবে আক্ষরিক অর্থেই - মানে লোটা-কম্বল নিয়ে হিমালয়ে যেতে হবে অথবা রবিনসন ক্রুসোর মত নির্জন দ্বীপে। সমাজ হল চোরাবালি - বেরুনোর জন্য যত ছটফট করবে তত বেশি ডুবে যাবে।

আমার অফিসটা উইংসের মঝামাঝি - এদিকে ওদিকে ৫০ মিটার। আমি সাধারণত কাজে এসে অফিসে ঢুকে যাই। মাঝে দু' তিনবার ওয়াশরুমে যাই। তখনই ওর সাথে দেখা হত, মানে আমি বেরুলেই ও ঘরে ঢুকে যেত। গত কয়েকদিন বেরুলেই মনে হয় এই বুঝি রতনের ঘরে ঢুকে যাচ্ছে সেটা দেখতে পাব। আসলে এমনকি কথা না বললেও, এমনকি অপরিচিত হলেও যদি হঠাৎ করে কেউ দৈনন্দিন জীবন থেকে হারিয়ে যায় - সেটা অনেক দিন পর্যন্ত মেনে নিতে কষ্ট হয়। যে গাছটা রাস্তার পাশে সব সময় ছিল, হঠাৎ সেটা কেটে ফেললে অনেকদিন পর্যন্ত মানুষ তার অভাব অনুভব করে। আসলে প্রায় সমস্ত অভ্যস্ত জিনিস আমাদের স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসে। একদিন এটা কাটবে। কিন্তু রতন ফিরে আসবে না। এতদিন আমরা দু জন বাংলাদেশি এই শহরে ছিলাম যদিও সেটা ছিল নামেমাত্র, এখন আমি একা বাংলাদেশি, আক্ষরিক অর্থেই।  

অলরেডি ৮ দিন পেরিয়ে গেছে। গত শুক্রবার অনেক চেষ্টা করেও মিখাইলকে পাইনি। ধারণা ছিল সোমবারের মধ্যে ক্রিমেশন হয়ে যাবে। সোমবার জিজ্ঞেস করায় জানা গেল সবাই একে অন্যের উপর ভরসা করে বসে আছে। আজ গেলাম দ্মিত্রভে জাফরের সাথে। ডেথ রিপোর্ট আনতে হবে আর ক্রিমেশনের ব্যাপারে চুক্তি করতে হবে। রাস্তায় জাফর বলল

- রতন তোমার নাম পর্যন্ত শুনতে পারত না। এখন দৌড়াদৌড়ি করতে খারাপ লাগছে না?
- আমার খারাপ লাগবে কেন? না গেলে খারাপ লাগত এই ভেবে যে কিছুটা হলেও পাশে দাঁড়াতে পারতাম, সেটা করলাম না। এসব তো আমি নিজের জন্যই করছি। তবে খারাপ লাগছে তোমাদের জন্য।
- কেন?
- আমি শিওর রতন এখন আমাকে ডাকার জন্য তোমাদের সবার শ্রাদ্ধ করছে।
- তা তুমি ঠিক বলেছ। রতন আমাদের এটা কোনদিনই ক্ষমা করবে না।

দ্মিত্রভ গিয়ে রিপোর্ট নিলাম। ব্রেইন হ্যামারেজ ও আভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ, নিউমনিয়া ও করোনা - মৃত্যুর কারণ। এরপর শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করতে হবে। হিসাব করে বলল ১ লাখ রুবল লাগবে। কিন্তু যেহেতু টাকা যাবে ইনস্টিটিউটের ফাণ্ড থেকে তাই আমি চুক্তিতে সই করতে পারব না, এ জন্যে ওদের কাছ থেকে পাওয়ার অফ এটর্নি লাগবে। তাই আজ খালি হাতেই ফিরে এলাম। আবার আগামীকাল নতুন করে যাত্রা শুরু করতে হবে। আবার বুঝলাম, বাঘে ধরলে এক ঘা, আর আমলা ধরলে দশ ঘা।

এর মধ্যে মস্কো থেকে সানু, প্রেমানন্দ, অমলরা ফোন করেছিলো। সাহায্য লাগবে কিনা জানতে চাইছিল। জীবিত মানুষ অনেক সময় অনেককে একত্র করতে পারে না, মৃত মানুষ পারে। এটাই মনে হয় মৃত্যুর শক্তি। মনে আছে একটা মাত্র মৃত্যু মোবারককে পর্যন্ত  মিশরের সিংহাসন থেকে ছুঁড়ে ফেলেছিল।

আবার মনে পড়ছে স্বাধীনতার কথা। ভাগ্যিস মানুষ মরে বেঁচে থাকে না। তা নাহলে রতন যদি দেখত আমি ওর মৃত্যু পরবর্তী সবকিছু নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছি, তাহলে রাগে ক্রোধে ও হার্টফেল করে মারা যেত। আমি জীবনে কখনোই কোন মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করিনি। আমার বাবা-মা, ভাইবোন মারা গেছে দেশে আমার অনুপস্থিতিতে। এখানে গুলিয়ার মা যখন মারা যায় আমি এসব পছন্দ করিনা বলে আমাকে আর মস্কো ডাকেনি। ওরাই সব কাজ শেষ করেছে। এই প্রথম আমি এরকম কাজে জড়িয়ে পড়েছি। এটাও অভিজ্ঞতা। অন্তত জানা গেল মৃত্যুর পর আমাকে কি রকম আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আর জানলাম আজকাল বাঁচার চেয়ে মরাটা অনেক বেশি এক্সপেনসিভ, যদিও সেটা ওয়ান টাইম। হ্যাঁ রতন, জীবনে তো নয়ই এমনকি মৃত্যুর পরেও আমরা স্বাধীন না, আরও বেশি করে অন্যদের উপর নির্ভরশীল। 

রতন কি একজন সফল গবেষক ছিল? বলা কষ্ট। যাদের সাথে ও ইদানিং কালে কাজ করত তাদের কথায় যেটুকু না করলে নয় সেটুকুই করত, মানে রুটিন মাফিক কাজ। রুটিন মাফিক  কাজ করে গবেষক হওয়া কঠিন। একজন বিজ্ঞানীর মূলমন্ত্র প্রশ্ন করা, উত্তর খোঁজা। অবিশ্বাসকে পুঁজি করে সত্যের সন্ধান করা। কিন্তু ব্যক্তি জীবনে ও প্রায় সব কিছুই হয় অন্ধভাবে বিশ্বাস করত অথবা অন্ধভাবে অবিশ্বাস করত।  এমনকি মানুষের সাথে সম্পর্কেও ও ছিল এই অন্ধবিশ্বাসের কাছে বন্দী। ব্যক্তি জীবনে অন্ধবিশাসী হয়ে বিজ্ঞানী হওয়া যায়না বলেই আমার বিশ্বাস। তবে এটাই যে বিজ্ঞানীর একমাত্র সংজ্ঞা সেটাও ভাবার কারণ নেই।

আমাদের ইনস্টিটিউট একটা গবেষণা কেন্দ্র। রতন ছিল সব সময় যাকে বলে স্যুটেড বুটেড। পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন। আমার এমনও হয়েছে ভুলে উল্টো করে সোয়েটার পরে চলে গেছি, কোন লোক সেটা খেয়ালই করেনি। এখানে কেউ জামা কাপড় নিয়ে মাথা ঘামায় না। কেউ গাড়ি বাড়ি নিয়ে কথা বলে না। কার কোন মডেলের ফোন সেটা জিজ্ঞেস করে না। যদি কিছু জিজ্ঞেস করে তা হল গবেষণা। খুব কম লোককেই পাওয়া যাবে ঠিক মত চুল আঁচড়ানো। সামারে নামকরা বিজ্ঞানীরা হাঁফ প্যান্ট পরে অফিস করছে। কেউ ভোলগার তীরে বসে বই পড়ছে। এই বেখেয়ালী বিজ্ঞানীদের জগতে রতন ওর চাল চলনে, পোশাকে আশাকে ছিল একেবারে ভিন্ন জগতের মানুষ। এটাও মনে হয় অন্যদের থেকে আলাদা থাকার ওর একান্ত প্রয়াস।

আমি একটা জিনিস খেয়াল করেছি প্রায় সমস্ত দুর্ঘটনাই আমাকে অনেক কিছু শেখায়, অনেক কিছু জানি এসব খবর থেকে। ১৯৯১ সালে ইরাক যখন কুয়েত আক্রমণ করল, কোথায় ইরাক আর কোথায় কুয়েত সেটা জানার জন্য বিশাল এক ম্যাপের বই কিনলাম। যুদ্ধের সাথে সাথে সেটা আমাকে ভূগোলও  শেখালো কিছুটা হলেও। একই কথা বলা চলে লেনিনাকানের ভূমিকম্প বা চেরনোবিলের ক্যাটাস্ট্রফির ক্ষেত্রে। গত মঙ্গলবার মানে ১ জুন যখন অফিসে আসি আমার অফিস থেকে একটু দূরে দেখা এক কলিগের সাথে।
- না আসলেই পারতে।
- কেন, কী হল?
- চারিদিকে কত লোক মারা যাচ্ছে। নীল মারা গেছে।
- হ্যাঁ, এডিক বলেছে। আর কে মারা গেল? 
- বগলিউবস্কি।
- কবে?
- ফেব্রুয়ারিতে।

কয়েক দিন থেকেই বগলিউবস্কির কথা মনে হচ্ছিল, কিছুতেই ওর নাম মনে করতে পারছিলাম না। পরিচিত, প্রায়ই দেখা হত, হাই হ্যালো বলতাম, কিন্তু নাম মনে আসছিলো না। ওর সাথে আমার বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে দোকানে। ওর মৃত্যুর পরে তিন মাস কেটে গেছে, কিন্তু জানতাম না। দেখলাম ওর রুমের নেমপ্লেট বদলে গেছে। ও অবশ্য করোনায় মরেনি, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে। তারপরেও জানা ছিল না, যদিও দু মাসের বেশি প্রতিদিন অফিসে আসছি। আসলে করোনা সবাইকে এতখানি বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে যে আর কে যে কখন মারা যাচ্ছে কেউ জানতেই পারছে না। অদ্ভুত এক সময়ের মধ্য দিয়ে চলছি আমরা।

আচ্ছা রতন কি সুখি ছিল? এ প্রশ্ন অনেকের মনেই আসে। একসময়, ও যখন আমাদের সাথে মেলামেশা করত, তখন বাসায় ফেরার সময় ভাবতাম, আচ্ছা, এই যে আমি বাসায় ফিরছি, সেখানে বউ, ছেলেমেয়েরা আমার অপেক্ষা করছে, বাসায় ফিরলে সবাই স্বাগত জানাচ্ছে, ছোটরা অপেক্ষা করছে কিছু আনলাম কিনা তার জন্য - রতনের তো সেরকম কিছু হয় না। ওর খারাপ লাগে না? অথচ মাত্র কয়েক বছর আগেও যখন হোস্টেলে থাকতাম, তখন কিন্তু ওর মত আমার জন্যেও কেউ অপেক্ষা করত না। মানুষ তার জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায়, সে তখন অন্য কিছু খুঁজলেও যা আছে তাই নিয়েই দিব্যি বেঁচে থাকে। কিন্তু আমরা সবাই নিজেদের দাঁড়িপাল্লা দিয়ে অন্যদের সুখ দুঃখ মাপি। সে একা কেমনে থাকে? এই স্বামীর সাথে ঘর করা যায়? এ কেমন বউ? আরও কত কী! আমরা সবকিছুই নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার করি, সেভাবেই মাপি। রতনের জীবন ছিল একান্তই ওর চয়েজ। বর্তমান যুগে মানুষের সাথে, বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখা কোন ব্যাপারই না। রাখতো না। কারণ অন্যদের থেকে দূরে থাকতে, সবাইকে এড়িয়ে চলতেই ও কমফোর্ট  ফিল করত। তাই আমাদের হাহুতাশ এসবই আমাদের তৈরি আলখাল্লা যেটা আমরা অন্যদের পরিয়ে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করে থাকি। 

কিছু লোক আছে যারা খুবই অধিকার সচেতন কিন্তু নিজেদের যে একটা দায়িত্ব আছে সেটা নিয়ে তেমন ভাবে না। আবার কিছু লোক প্রচণ্ড দায়িত্ববোধসম্পন্ন কিন্তু নিজেদের অধিকার নিয়ে তেমন ভাবে না। এই দুইয়ের অপটিমাল মিলন খুব কমই দেখা যায়। এই যে দায়িত্ব তার মধ্যে শুধু দশটা পাঁচটা অফিস নয়, এর বাইরেও অনেক কিছুই পড়ে, যেটাকে আমরা বলি মানবিক দায়িত্ব, সামাজিক দায়িত্ব। দুবনায় বিভিন্ন দেশ থেকে লোকজন আসে কাজ করতে, কেউ স্বল্পকালীন কেউবা দীর্ঘমেয়াদী। প্রথমে তাদের অধিকাংশই থাকে ইনস্টিটিউটের হোটেলে যেখানে রতন থাকত। ইন্ডিয়া থেকে অনেকেই আসে। এদের প্রায় সবাই এর আগে ইউরোপ আমেরিকা ঘুরে এসেছে। কিন্তু রাশিয়া এলেই এরা কেমন যেন অসহায় বোধ করে, অন্তত প্রথম দিকে। ইউরোপের অনেক দেশে জানা সত্ত্বেও অনেকেই ইংরেজি বলে না, কিন্তু রাশিয়ায় কেউ দু' চার শব্দ জানলেও বলার চেষ্টা করে। তারপরেও রাশিয়ায় এসে সবাই ধরেই নেয় তারা ভাষা সমস্যায় পড়বে। তাই উপমহাদেশের কাউকে দেখলে তারা যেন হাতে চাঁদ পায়, ভাবে প্রয়োজনে এদের কাছে দৈনন্দিন জীবনের টুকিটাকি জানতে পারবে, কোথায় চালটা, কোথায় ডালটা পাওয়া যায় সেটা জানতে পারবে। ইন্ডিয়ার বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে আমার পরিচিত অনেক লোকজন আছে।  এরা আমাকে চেনে বিভিন্ন সূত্রে। কারও সাথে কলাবরেশনে কাজ করেছি, কেউ চেনে পাবলিকেশন থেকে।  তাই ওখান থেকে যারা আসে তাদের অনেকেই আমার কথা জানে। কিন্তু রতন যেহেতু হোটেলে থাকত, তাই নীচে দেখা হলে ওর কাছেই ওরা জানতে চাইত দুবনা সম্পর্কে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাউকে কোন উত্তর না দিয়ে স্বভাবসিদ্ধ রীতি অনুযায়ী ও নিজের ঘরে চলে যেত। এটা জেনে পরে হোটেল বা অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করত। হ্যাঁ, এটা রতনের দায়িত্বের মধ্যে পড়ত না, তবে আমরা যেহেতু সমাজে বাস করি এ সব ক্ষেত্রে আমাদের আচার ব্যবহার আমাদের সম্পর্কে অন্যদের মতামত তৈরি করে। রতনের আগেও অনেকেই মারা গেছে, পরেও যাবে। কিন্তু গত কয়েকদিন ওর ব্যাপারে দৌড়াদৌড়ি করে দেখলাম, সবাই যা করছে সেটা শুধু করতে হয় বলে, এর পেছনে বন্ধু বা কলিগ হারানোর ব্যথা নেই। অনেকটা দশটা পাঁচটা অফিসের মত - যান্ত্রিকভাবে। ওর অভাবটা কেউই ফিল করছে বলে মনে হয় না। হয়তো এই ইনডিফারেন্সের কারণেই সমস্ত সব কিছু ঝুলে গেছে। 

কেন এমন হয়? আমার মনে আছে আমি যখন ১৯৮৩ সালে মস্কো আসি, তার কয়েক দিন আগে ইত্তেফাকের একটা শিরোনাম ছিল স্ট্যালিনের লৌহ যবনিকা ভেঙ্গে মস্কোর মেয়েরা রাস্তায়। বিশ্বাস হয়নি। যেদিন দেশ থেকে আসি, জ্যাঠামশাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলে উনি বলেন, "সব জায়গায় ভালো আর মন্দ মানুষ আছে। ভালোদের সাথে মিশবে।" "ওখানে মন্দ লোক নেই" এই ছিল আমার উত্তর। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে যেসব বই আসত, কমরেডদের কাছ থেকে যা শুনতাম - তাতে আমাদের এরকম মনোভাব গড়ে উঠেছিল এ দেশ সম্পর্কে। ঠিক উল্টো মনোভাব ছিল সোভিয়েত বিরোধীদের। কিন্তু এখানে আসার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বুঝলাম, যা জেনেছি তার অনেক কিছুই ভুল।  নিজেকে বুঝিয়েছি এই বলে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন তো পৃথিবীর বাইরের কিছু না, এখানকার মানুষ আমাদের মতই দোষেগুনে গড়া। তাই একটু কষ্ট পেলেও হতাশ হইনি। রতন বরাবরই ক্যাটাগরিক্যাল। ও ছিল লেনিনের চেয়েও বড় কমিউনিস্ট। তাই হোস্টেলে কারও বান্ধবী এলে ও বিভিন্ন মন্তব্য করত, অনেক সময় এ নিয়ে বাক বিতণ্ডা হত, বিশেষ করে আফ্রিকার লিওনের সাথে। অথবা এমন হতে পারে ও নিজেকে ঠিক বোঝাতে পারত না। এমন একটা ঘটনার কথা মনে আছে। নব্বইয়ের দশকে ও প্রায়ই সাইফুল-কুমুর ওখানে বেড়াতে যেত। একদিন কী প্রসঙ্গে যেন সাইফুল রতনের সাথে মনোমালিন্যের কথা বলল। 
- আচ্ছা বিজন দা, প্যাকেট থেকে জুস ঢালতে দুটো ছিদ্র করতে হয় তাই না?
- হঠাৎ এ প্রশ্ন?
- এ নিয়ে গতকাল রতন দার সাথে এক পশলা কথা কাটাকাটি হয়েছে।
- কী ব্যাপার, একটু খুলে বলবে।
- আমাদের রুমে আড্ডা হচ্ছিল। রতন দাকে বললাম সবাইকে জুস ঢালতে। উনি একটা ছিদ্র করে ঢালছেন দেখে আমি দুটো ছিদ্র করতে বলি। উনি রেগে বললেন একটাই যথেষ্ট। আমরা তো বইয়ে পড়েছি দুটো ছিদ্র করার কথা।
- দেখ, সমস্যা একটা বা দুটো ছিদ্রে নয়। তুমি যখন প্যাকেট থেকে জুস ঢাল ভেতরে শূন্যতার সৃষ্টি হয়। বাইরের বাতাস সেই শূন্যতাকে পূরণের জন্য সেখানে যেতে চেষ্টা করে। ফলে তা প্যাকেট থেকে জুস বেরুতে বাধার সৃষ্টি করে। এজন্যেই আমরা আরেকটা ছিদ্র করি। তবে তুমি যদি একটা ছিদ্রই একটু বড় করে কর বা এমন ভাবে জুস ঢাল যে বাতাস ভেতরে ঢুকতে পারছে তাতে আর দ্বিতীয় ছিদ্রের প্রয়োজন পড়ে না। ফিজিক্সটা এখানেই, বাকিটা টেকনিক। তাই এখানে ঝগড়ার প্রশ্ন দেখি না। রতন যেহেতু ফিজিক্সে পড়ে ওর উচিৎ ছিল এটা পরিষ্কার করে বোঝানো। 


আসলে এখানেই মনে হয় মূল সমস্যা, নিজের মতামত কাউকে পরিষ্কার করে না বোঝানো আর অন্যের মতামত গ্রহণ করার অপারগতা। বাংলাদেশের বাটখারায় ও এখানকার অনেক কিছু মাপত। বাস্তবতাকে মেনে নেবার অপারগতাই হয়ত ওকে এমন করেছে। ছাত্র জীবনে কখনও ডিস্কথেকায় গেছে বলে জানা নেই। শুনত মূলত বাংলা গান, যাকে বলে একেবারেই বাঙালি। এতে অবশ্য খারাপের কিছু নেই। সেদিন ত্র্যম্বকের সাথে কথা হচ্ছিল। ও ভারতীয়। এখানে কাজ করে। জিজ্ঞেস করল রতন কিভাবে মারা গেছে। রতন প্রসঙ্গে  বলল 

- একদিন হোটেলে হঠাৎ শুনি পাশেই কোন ঘরে হেমন্ত মুখপাধ্যায়ের গান বাজছে। আমি তো অবাক। এখানে বাঙালি ছাড়া কে বাজাবে এই গান। নক করলাম দরজায়। ঘর খুলল। দু চারটে বাক্য বিনিময় হল। এভাবেই পরিচয়। তবে এরপরে দেখা হলে কখনই আগে থেকে কিছু বলত না, যদি আমি দুয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতাম, উত্তর দিত। এতুকুই। 

বিগত কয়েক বছর দুবনায় জনা ১০ -১৫ ভারতীয় এসেছে কাজ করতে, ওদের বেশির ভাগ বাঙালি। থাকত একই হোটেলে। তাই কথাবার্তা বলতে চাইলে কোনই সমস্যা হত না। আসলে কোন এক অজ্ঞাত কারণে ওর হয়তো সারা পৃথিবীর উপর ছিল প্রচণ্ড আক্রোশ। নইলে সবার সাথে সম্পর্ক কাট আপ করার কোন কারণ ছিল না। আসলে ওর চরিত্র এত বিচিত্র যে কোন এক রৈখিক মাপকাঠি দিয়ে সেটা বিচার করা কষ্ট।   

দু সপ্তাহর বেশি হল রতন মারা গেছে।   ১১ জুন ওর ক্রিমেশনের খবর পেয়েছি। এখনও ওর চিতাভস্ম হাতে পাইনি। এরই মধ্যে জেনেছি ওর কিছু সেভিংস ছিল। প্রশ্ন কীভাবে সেটা উদ্ধার করে আত্মীয় স্বজনদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। কোথায় ব্যাংকের কার্ড, কোথায় চাবি - কিছুই তো জানা নেই। গত ১৫ জুন দেখা জাফরের সাথে।
- আমাকে যখন নীলের স্মার্টফোন, পাসপোর্ট ওরা দেয়, সাথে জ্যাকেটও ছিলও আলাদা প্যাকেটে। এত দিন ভয়ে খুলিনি। আজ খুলে ওর পকেটে চাবি আর কিছু কাগজ পত্র পেলাম। কাল অফিসে জমা দেব।
- হ্যাঁ, সেটাই করো।
মনে পড়ল যখন জাফর আমাকে ওর স্মার্টফোন দিল ওখানে কোন আত্মীয় স্বজনদের নম্বর আছে কিনা দেখতে,  আমি ওকেই বলেছিলাম দেখতে। নিজে ধরতে চাইনি। হ্যাঁ, করোনা মাথায় বসে আছে। হুট করে কারও, বিশেষ করে করোনার রোগীর জিনিসপত্র ধরতে একটু অস্বস্তি লাগে। ঠিক করেছি চিতাভস্ম পেলে সেটার একটা গতি করে নিজেরা বসে ওকে স্মরণ করব। আমিরখানভ খুব খুশি। ও আমাকে প্রস্তাব দিতে ইতস্তত করছিল রতনের সাথে আমার স্পেসিফিক সম্পর্কের কারণে।

দু' দিন মস্কোয় কাটিয়ে দেখা এডিকের সাথে। ডাকল। কথা বললাম।
- নীলরা কয় ভাইবোন?
- সে তো জানি না। ও কখনই নিজের কথা আমাদের সাথে শেয়ার করত না। অনেক কষ্টে ভাইয়ের নম্বর যোগাড় করা গেছে।
- হ্যাঁ, জানি ও একেবারেই অন্য রকম মানুষ। কারও কাছেই মনে কথা খুলে বলত না। তা তোমার আত্মীয় স্বজন কোথায় থাকে?

এই সুযোগ কি আর ছাড়া যায়? বললাম
- নীল মারা যাবার পর ওর ছবি খুঁজে পাচ্ছিল না। আমি তখন তানিয়াকে (আমাদের সেক্রেটারি) বলেছিলাম ওর কাছে আমার কিছু ছবি দিয়ে যাব। কখন মারা যাই কে জানে?
- বিজন, আমি ওটা মনে করে বলিনি। এমনিতেই জানতে চাইলাম। এই ধর আমরা সাত ভাইবোন। তোমরা?
- আমরা সাতভাই, এক বোন।

অনেকক্ষণ কথা হল নিজেদের নিয়ে। এরপর এডিক বলল
- ইনস্টিটিউট ঠিক করেছে নীলের পরিবারকে ১০০ মিলিয়ন রুবল দেবে।
- এডিক আ মোঝনা ইয়া তোঝে উম্রু। ( এডিক, আমিও কি মরতে পারি?)
- ইজভিনি, ইয়া ইমেল ভভিদু ১০০ তীসিচ (সরি, আমি বলতে চাইছিলাম ১ লাখ)
- তাই বল। তাহলে বেঁচেই থাকি। অল্প টাকায় বাঁচার মজাই আলাদা।
- হুম। তোমরা দুজন মাত্র বাংলাদেশ থেকে আমাদের ইনস্টিটিউটে, তাও আবার আমার গ্রুপে। অথচ তোমরা কথা বলতে না। এ নিয়ে উপরেও অনেকেই জিজ্ঞেস করত। তবে আমার বিশ্বাস এটা তোমার পক্ষ থেকে হয়নি। তুমি যেভাবে মানুষের মুখের উপর চ্যাটাং চ্যাটং কথা বল, তাতে আর যাই হোক তুমি যে কথা বলা বন্ধ করনি এতে কারোই কোন সন্দেহ নেই।

মনে মনে ভাবলাম স্কোর  ২ - ১। আমি দু দুবার ওকে বেকায়দায় ফেললাম, সুযোগ পেয়ে ও আমাকে একটু শুনিয়ে দিল।

আসলে আমরা সবাই বিভিন্ন কালেক্টিভের অংশ, তাই রতনের সাথে আমার কথা বলা বা না বলা নিজেদের মধ্যে কোন সমস্যা তৈরি না করলেও কালেক্টিভে তার প্রভাব পড়ে। মনে পড়ল ছাত্র জীবনের কথা। টিটু আর সৌমিত্র আমাদের দুজনকেই খুব পছন্দ করত। প্রায়ই রান্না করে খাওয়াত। তবে একসাথে ডাকতে পারত না। রতন আসত না। একই ভাবে বছর পনের আগে যখন ইব্রাগিম ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করে তখন শুধু রতনের জন্য আলাদা একদিন ওকে আয়োজন করতে হয়েছিল। আসলে সমাজ এক বিশাল জিনিস। এখানে আইসোলেটেড থাকতে চাইলেও কেউ পারে না। জীবনের তাগিদে প্রত্যেককেই কারও না কারও সাথে মিশতে হয়, সে দোকানদারই হোক, আর কলিগই হোক। তাই মিনিমাম সম্পর্ক কাট আপ করে আমাদের নিজেদের কোন ক্ষতি না হলেও বন্ধুদের আমরা প্রায়ই বিভিন্ন অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলে দিই। 

স্বাভাবিক ভাবেই অনেকেই জানতে চেয়েছিল রতনের কোন বান্ধবী ছিল কিনা। না, শুধু আমাদের লোকজন নয়,  ইনস্টিটিউটের লোকজনও। বিশেষ করে যখন আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগের কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল না তখন অনেকেই এদিকে খুঁজতে শুরু করে। যেহেতু শেষ দিকে জাফারের সাথেই ওর মেলামেশা ছিলও, প্রশ্নটা ওকেই করছিল। 

- জাফার, রতনের কি কোন বান্ধবী ছিল?
- শুধুই অনলাইন!

পরে ওর আত্মীয় স্বজনের খোঁজে যখন আমরা ওর স্মার্টফোনে কন্টাক্ট খুঁজতে শুরু করি সেখানে রাশিয়ার বিভিন্ন শহরের মেয়েদের নম্বর দেখে আমরা দু' জনেই  খুব অবাক হয়েছিলাম। আরও যে কথাটা জানতে পারি, সেটা ওর দেশে ফেরার প্ল্যান। ওর ভাই আর এখানে ওর ঘনিষ্ঠ কয়েক জন বলল ও ২০২০ সালেই একেবারে দেশে ফেরার প্ল্যান করেছিল। কিন্তু করোনার কারণে সমস্ত পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়। ও আরও ৫ বছরের এক্সটেনশন নেয়। আমার বিশ্বাস দেশে গেলে ও অনায়াসে কোন কলেজ বা প্রাইভেট ভার্সিটিতে জয়েন করতে পারত।  সবচেয়ে বড় কথা সেখানে কথা বলার মানুষ পেত। এখানে যে কথা বলার লোক ছিল না তা নয়, তবে রতন নিজে বিভিন্ন ব্যাপারে ছিল খুবই কনজারভেটিভ, হয়তো এ কারণেই মানুষের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারেনি। বন্ধুত্ব মানেই  সমতার মধ্যেও ছাড় দেওয়ার ক্ষমতা - তুমি আমাকে ছাড় দিচ্ছ, আমি তোমাকে। কোন পক্ষ যদি নিজের জায়গা থেকে এতটুকু সরতে রাজী না হয়, বলে "বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদিনী" সেক্ষেত্রে বন্ধুত্ব করা সমস্যা। দেশে সেক্ষেত্রে অপশন অনেক বেশি, তার উপর নিজের ভাইবোন, আত্মীয় স্বজন - সব মিলিয়ে আমার বিশ্বাস ও যদি দেশে ফেরার সুযোগ পেত প্রায় ২৪ বছর বলতে গেলে বনবাসের পর জীবনের  শেষ বছরগুলো আনন্দেই কাটত। কিন্তু অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, আজকাল আমাদের ভাগ্য করোনার মন মেজাজের উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। রতনও ব্যতিক্রম ছিল না।
 

২১ জুন শেষ পর্যন্ত চিতাভস্ম দিয়ে গেল। আমি রতনের ভাইকে ফোন করলাম। তাদের এটা নেওয়ার ইচ্ছা নেই, নদীতে ভাসিয়ে দিতে বলল। এখানে কর্তৃপক্ষও উৎসাহী নয় কিছু করার। বলল তুমি নিয়ে যাও, তোমাদের রীতিনীতি মত যা খুশি কর। এখানে এই ব্যাপারটা দেখেছি, শেষ পথটা তারা চায় মৃত ব্যক্তি যেন নিজ নিজ জাতীয় বা ধর্মীয় অনুশাসন মেনেই পার হয়। মস্কোয় দেশি কেউ মারা গেলে যদি তার সামর্থ্য না থাকে, আমরা চাঁদা তুলে শেষকৃত্য সম্পন্ন করি। মুসলিম হলে মসজিদে, হিন্দু হলে ইস্কনে কিছু সামাজিকতা পালন করা হয়। রতন মারা যাবার খবর পেয়েই সানুকে জানিয়েছি এখানকার আলুম্নির সভাপতি প্লাস ওর ক্লাসমেট বলে। সবাই শোক প্রকাশ করেছে। কিন্তু এর বাইরে কে কীইবা করতে পারে। বিশেষ করে করোনা কালে। প্রেমকে ফোন করলাম। প্রেম ছাত্র জীবন থেকেই রতনকে বিভিন্ন সময়ে সাহায্য করেছে। ওর ইচ্ছা ছিল কিছু করার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অন্তত কিছু লোককে তো পেতে হবে। হয়তো সেটা ম্যানেজ করতে পারেনি।  তবে সেদিন শুনলাম ও নিজেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আছে, তাই এ ব্যাপারে ওকে আর বলতে চাইনি। 

এখানে রতনের ভাইদের সমর্থনে দুটো কথা বলা দরকার। হিন্দু নিয়ম অনুযায়ী সাধারণত শবদাহ করে চিতাভস্ম গঙ্গায় (মানে নদীতে) বিসর্জন দেওয়া হয়। যদিও কোন কোন সম্প্রদায়ে মৃত ব্যক্তিতে সমাহিত করা হয়, তবে সেটা বসানো অবস্থায়। আবার কোন কোন জায়গায় শব নদীর তীরে রেখে যায় আত্মীয়রা। এটা আমি দেখেছি এলাহাবাদে। যাহোক, সেই নিয়ম অনুযায়ীই রতনের আত্নীয়রা ওর চিতাভস্ম ভোলগায় বিসর্জন দেওয়ার কথা বলেছে। সমস্যা হল দেশে ব্যাপারটা  ডালভাত হলেও এদেশে এটা যাকে বলে রাজ্য ছাড়া ঘটনা। এটা কেউ করে না, কেউ করলে অন্যেরা সেটা বোঝে না, সন্দেহের চোখে, ঘৃণার চোখে দেখে। আর এ কারণেই ইনস্টিটিউটের লোকজন এটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি আর তারা নিজেদের এ কাজের সাথে জড়াতে চায়নি।

ছাত্র জীবনে যখন কেউ আমার ওখানে বেড়াতে আসত, রতন বিভিন্ন ভাবে আমার নামে এটা সেটা বলার চেষ্টা করত। মানে জ্বালাত। সেই জ্বালানো মৃত্যুর পরেও শেষ হচ্ছে না বলেই মনে হয়। আজ ২৫ জুন। রতনের চিতাভস্ম আমার টেবিলে। সত্যি বলতে কী, বেশ অস্বস্তিই লাগছে। বন্ধুরা এর মধ্যেই বলেছে আমি যেটা ভালো মনে করি সেটাই যেন করি। চেষ্টা করছি যদি কোন জায়গা পাওয়া যায় সমাধিক্ষেত্রে। নাহলে হয়তো ভোলগাই শেষ গতি। কিন্তু সেটা করা কি ঠিক? যদি কেউ এসে জিজ্ঞেস করে? একই কথা বনে পুঁতে রাখার ক্ষেত্রেও। তবে কিছু একটা করতে হবেই। সারা জীবন তো আর চিতাভস্মের সাথে পাশাপাশি অফিসে বসে কাজ করা যাবে না। এমনকি জীবিত (ঘনিষ্ঠ) মানুষও একটা সময় পরে গলগ্রহ বলে মনে হয়, মৃত ব্যক্তি ব্যতিক্রম নয়।  আজকাল যখন রাত গভীর হয়, ইনস্টিটিউটে আর কেউ থাকে না, আমি অফিসে বসে কাজ করি রতনের ভস্ম পাশে রেখে, মনে হয় আমি যেন একা নই, আরও কেউ এখানে বসে আছে। জানি এটা একেবারেই মনে ভুল। তবে ব্যাপারটা অস্বস্তিকর।

ওর রুমটাও খোলা দরকার, কিন্তু কে খুলবে? ধারণা ছিল এরা নিজেরাই কিছু করবে। চাবিও হ্যাণ্ড ওভার করা হয়েছে। যদিও হোটেলের ভাড়া এখন এদেরই বহন করতে হবে, তবে ভাব খানা এই মৃত ব্যক্তি তো আমাদের এমপ্লই নয়। কয়েকবার বলেছিলাম। এখন নিজেরই লজ্জা লাগে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে, হয়তো ভাববে "তুমি ভাবছটা কি , আমাদের কি অন্য কাজ নেই?" রতনের মৃত্যুর পরপরই এরা দূতাবাসে খবর পাঠিয়েছে, সেখান থেকে কোনই সাড়াশব্দ পায়নি। মনে হয় দেশের নাগরিকদের প্রতি দূতাবাসের এই মনোভাবও এদের আর রতনকে নিয়ে তেমন ভাবাচ্ছে না। আইনত আমরা রাস্তার লোক, শুধুমাত্র দূতাবাস বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আর ইনস্টিটিউট এমপ্লয়ার হিসেবে কিছু কিছু আইনগত অধিকার রাখে। এদের, বিশেষ করে আত্মীয় স্বজনদের আর দূতাবাসের রতনের চিতাভস্ম ক্লেইম না করায় ও এখন যাকে বলে বেওয়ারিশ হয়ে গেছে। 

আচ্ছা, আমি কি বিরক্ত হচ্ছি? তাই তো মনে হয়। কেন? আমি নিজেও যে লোকজনের সাথে খুব একটা যোগাযোগ রাখি তা নয়। এটা ঠিক, ফেসবুক, টুইটার, গুগল ব্লগে রেগুলার লিখি আর এভাবেই অন্যদের জানাই নিজের ভালমন্দের খবর। তবে নিজে থেকে কাউকে যে ফোন করব, সেটা হয়ে ওঠেনা। এমনকি ছেলেমেয়েদেরও ফোন করা হয় না। এতদিন নিজেকে বলতে পারতাম আমিই শুধু এমন নই, আমার চেয়েও এক কাঁঠি সরেস একজন আছে। রতন মারা যাওয়ায় আর কাউকে দেখিয়ে সেটা বলা যাবে না, আমাকেই সব দোষ ঘাড়ে নিতে হবে। আসলে আমাদের অমিলের চেয়ে মিলই মনে হয় বেশি ছিল। দু জনই  প্রচণ্ড আরোগ্যান্ট। তবে আমি সরবে বা লেখার মাধ্যমে নিজের অবস্থান ডিফেণ্ড করি। যদি কেউ নিজেদের আইডিয়ার উৎকর্ষতা প্রমাণ করতে পারে, সেটা নিয়ে ভাবতে পারি, গ্রহণও করতে পারি প্রয়োজনে। রতন নিজের কথা না বলে চুপচাপ সরে যায়। এতে হয়তো অন্যদের সাথে বাকবিতণ্ডা এড়ানো যায়, কিন্তু বন্ধুত্ব রক্ষা করা যায় না।  চাপা স্বভাবের মানুষের চেয়ে খোলামেলা কারও সাথে মেলামেশা করা অনেক বেশি রোম্যান্টিক। 

গতকাল ইকবাল ফোন করেছিল। বলল চেষ্টা করে দেখতে দেশে কোন এজেন্সী পাওয়া যায় কিনা। রতনের কল্যাণে প্রায় এগার বছর পরে রুমা আর ইকবালের সাথে অনেকক্ষণ কথা হল। এটা নীল পজিটিভ। এদিকে এডিক নিজে কিছু একটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। ফলে রতন এখন আমার অফিসেই পড়ে আছে। সবাই সবার মুখাপেক্ষী হয়ে বসে আছে। বারবার এটা নিয়ে বলায় ওরাও মনে হয় একটু বিরক্ত। এডিক আজ তো বলেই বসল
- এই যে তুমি আর জাফর দৌড়াদৌড়ি করছ, যদি তোমার বা জাফরের বা আমার সাথে এমন ঘটনা ঘটতো নীল বি পালেতস আ পালেতস নি উদারিল মানে রতন  হাতের আঙ্গুল পর্যন্ত নাড়াত না।
- মনে হয় এজন্যেই আমরা নীল নই।
- দেখ, জীবিত নীল আমাদের কোনই উপকারে আসেনি। বিজ্ঞানী হিসেবে সে কখনই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। তবে বড় কালেক্টিভে এটা সমস্যা করেনি, যদিও বলতে গেলে প্রায় কারও সাথেই নর্মাল সম্পর্ক না রাখায় একটু টেনশন ছিল, তবে পরের দিকে সবাই বুঝত অন নিইস্প্রাভিম, ওকে মানুষ করা যাবে না। হ্যাঁ, মাসে মাসে একটা বেতন দিতে হত, তবে ইনস্টিটিউটের বিশাল বাজেটে এটা কোন ব্যাপার ছিল না। কেউ ওকে কষ্ট দিতে চায়নি। কিন্তু এখন দেখছি মৃত নীল জীবিত নীলের চেয়ে বেশি জ্বালাচ্ছে। যাকগে, এতদিন তো অপেক্ষা করলেই, আরও দুদিন অপেক্ষা কর। এর মধ্যেই কিছু একটা ভেবে বের করব। না হলে ভোলগা তো আছেই। 

 স্তালিনকে মনে পড়ল। উনি বলেছিলেন "নিয়েত চেলাভেকা, নিয়েত প্রব্লেম", মানুষও নেই, সমস্যাও নেই। সেক্রেটারিকে স্তালিনের কথা উল্লেখ করে বললাম, এখন তো দেখছি "চেলাভেকা নিয়েত, আ প্রব্লেম স্তালো ইশো বলশে", মানুষটা নেই, কিন্তু সমস্যা শুধু বাড়ছেই। উনি সায় দিয়ে বললেন, সময়ই এখন এরকম। এখন রতনকে নিয়ে কাউকে কিছু বলতে গেলে ভাবখানা এই, "আরে বাবা, এ নিয়ে এত কথার কী আছে। ছাইটা কোথাও ফেলে দিলেই তো হয়"। আমার তখন মনে হয় ছোটবেলার কথা।  অনেক সময় বন্ধুরা মিলে কাউকে পাঠাতাম পাশের কোন বাড়িতে আম বা শসা চুরি করতে (চুরি ঠিক নয়, এটা ছিল এক ধরণের ফান)। যদি ধরা না পড়ত, সবাই ওকে বাহবা দিত, কিন্তু ধরা পড়লেই "শেষ পর্যন্ত তুই এটা করলি। এমনটা তোর কাছে থেকে আশা করিনি।" আমার অবস্থাও এখন সে রকম। যদি সবার অগোচরে ভস্মটা নদীতে ফেলে আসতে পারি, তাহলে সবাই বলবে মালাদেস, সাবাস। কিন্তু যদি কেউ দেখে ফেলে আর এ নিয়ে হৈচৈ করে তখন বলবে, "বিজন, তুমি কীভাবে এ কাজটা করতে পারলে?" আমিও ওটার কোন গতি না করে কোন কাজে হাত দিতে পারছি না। দায়িত্বটা যেন আমার মাথার উপর খাড়া হয়ে ঝুলছে। এদেরও দোষ দিতে পারি না। অন্য কোন দেশের লোকেদের সাথে এমনটা ঘটলে দূতাবাস এ নিয়ে ভাবে, খোঁজ খবর নেয়। অনেকেই বলে "তুমি তো এটা দূতাবাসে রেখে এলেই পার?" কিন্তু সব দূতাবাস তো সমান নয়! রতন বরাবরই ছিল এক্সেপশনাল, এমনকি মরেও সেটাই রয়ে গেছে। স্তালিনের মুখে ছাই দিয়ে ও দেখিয়েছে যে লোক না থাকলেই সমস্যা পালিয়ে যায় না। 

আজ ভস্মটা আমাদের ল্যাবের তত্ত্বাবধায়কের হাতে দিয়ে দিলাম। সময় করে কোন এক সময় দেলতাপ্লান বা হ্যাং গ্লাইডার থেকে ভোলগার উপরে ছড়িয়ে দেব রতনের দেহাবশেষ। এটাই মনে হয় ঠিক হবে। রতনের সাথে গত এক মাসের বসবাস নতুন করে অনেক ভাবনার জন্ম দিল। এই যে আমরা কথা বলতাম না এতে কারও কোন ক্ষতি না হলেও কোনই লাভ হয়নি। এখনও অনেকের সাথেই আমার কথা হয় না, কাউকে কাউকে নিজেই এড়িয়ে চলি, কেউ আবার নিজেরাই আমাকে এড়িয়ে চলে। আসলে অনেক দিন কারও সাথে মেলামেশা না করলে, কথা না বললে এক ধরণের জড়তা আসে। ঠিক বুঝে ওঠা যায় না কি বলব। মনে পড়ে প্রথম যখন দেশে ঘরে ঘরে গ্রামীন ফোন এল, কল চার্জ কমায় বাড়িতে ফোন করার সুযোগ এল দিদি বা অন্য কাউকে ফোন করলে কথা খুঁজে পেতাম না। আসলে দীর্ঘ দিনের গ্যাপে আমাদের চিন্তাভাবনা, অভ্যেস - অনেক কিছুই বদলে যায়। কিন্তু কয়েক বার ফোন করার পরেই বুঝলাম, কি বলছি সেটা বড় কথা নয়, এই যে বলছি - সেটাই আসল কথা। সেভার যখন ছয় বছর, ওরা মস্কো চলে যায়। সেভাকে প্রায়ই ফোন করতাম। ও কথা বলতে বলতে ফোন রেখে খেলতে শুরু করত। বিল উঠছে বলে লাইন কেটে দিলেই ও কল ব্যাক করে কান্নাকাটি শুরু করত। কথা নয়, তারের এপাশে এই যে আমি আছি, সেটাই ছিল ওর জন্য বড় পাওয়া। আজ সকালে মস্কো জীবনের খুব প্রিয় একজন মানুষকে, যার সাথে প্রায় বছর ৭-৮ যোগাযোগ নেই, ইনবক্সে লিখতে গিয়ে বাদ দিলাম। উত্তর দেবে না সেটা ধরেই নিতে পারি, সমস্যা হল যদি উত্তর দেয় বলার কিছুই থাকবে না, কথা চালিয়ে যেতে পারব না। মনিকার ছোটবেলায় ও প্রায়ই সমবয়েসী কাউকে দেখলে জিজ্ঞেস করত
- পাপা, আমি ওর সাথে কথা বলব?
- বলবি না কেন? অবশ্যই বলবি।
- কি নাম তোমার?
- সাশা। তোমার?
- মনিকা।
বলেই ও দৌড়ে চলে আসত আমার কাছে। খেয়াল করেছি, যখন কোথাও যাই বা ভোলগার তীরে ঘুরি, কেউ এসে কথা শুরু করলে কোনই সমস্যা হয় না। অনায়াসে অনেকক্ষণ কথা বলতে পারি। যেহেতু বিভিন্ন বিষয়ে আমার ইন্টারেস্ট আর কিছুটা হলেও সেন্স অফ হিউমার আছে, কথা চালিয়ে যাওয়া কোন ব্যাপার বলেই মনে হয় না। তবে পুরনো বন্ধুদের ব্যাপারে এক ধরণের স্টেরিওটাইপ গড়ে উঠেছে। হয়তো এ কারণেই মনে হয় জীবনের অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমরা অনেকেই একে অন্যের  থেকে কী চিন্তা ভাবনায়, কী মন মানসিকতায় এতই দূরে সরে গেছি যে একে অন্যেকে আর বুঝতে পারব না। তারপর কোন এক সকালে আমাদের কেউ শুনবে সে আর নেই। হয়তো মনে হবে আর কখনও কথা বলা হবে না, আর কখনও ইনবক্স করা হবে না। অথবা ইন্ডিফারেন্স বা উদাসীনতা এমন পর্যায়ে পৌঁছবে যে কিছুই মনে হবে না। পুরনো বন্ধুদের প্রতি অনুভূতি অনেকটা সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিয়ে আমাদের নস্টালজিয়ার মত। দেশটা নেই বলেই এত মায়া অথবা মায়াকান্না, থাকলে কী এমনটা হত? মৃত্যু মানুষের মধ্যে শুধুই শূন্যতাই আনে না, অনেক কিছুই শেখায়। আসলে প্রতিটি ঘটনাই আমাদের অনেক কিছু শেখায়। শিখব কি শিখব না সেটা নির্ভর করে একান্তই আমাদের নিজেদের উপরে। 

আজ ০২ জুলাই আমরা কয়েকজন মিলে রতনকে স্মরণ করলাম। আমিই প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম। তবে এলগিজ আমিরখানভ ওর সাথে অনেকদিন কাজ করেছে বলে নিজেই সমস্ত খরচ বহন করেছে, আমাদের কিছু কিনতে দেয়নি। এলগিজ তাতার, তবে ওর জন্ম আর বেড়ে ওঠা তাসখন্দে, দুবনায় সেই ১৯৬৮ থেকে। এছাড়াও ছিল ইব্রাগিম, জারিফ ও জাফার। ওরা তিন জনেই তাজিকস্তান থেকে। প্রায় ঘণ্টা তিনেক আড্ডা। এর আগে কখনোই এরকম হয়নি। হয়নি রতনের জন্য, আজ হল রতনকে কেন্দ্র করে। ওদেরই কথা। বিভিন্ন কথাই ওরা বলল। রতন সব সময়ই বুফেতে যেত কফি খেতে। একবার নাকি সেখানে গিয়ে এসি অফ করে দেয় ঠাণ্ডা লাগছে বলে। ওখানে যারা কাজ করে বলে, "দেখ আমরা সারাদিন এখানে কাজ করি, ঘেমে যাই। তুমি চাইলেই তো আর সবার কথা না ভেবে এসি অফ করতে পার না।" ও নাকি সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। পরবর্তী ছয় বাস বুফেতে যায়নি। এমনকি আমিরখানভ বাসা থেকে কাপ প্লেট এসব এনে দিলে ওকেও অনেক কথা শোনায়। সবার এক কথা, "ও কোন রকম সমালোচনা পছন্দ করত না। আমরা কেউ কিছু বললেই কথা বন্ধ করে দিত। পরে আমরা নিজেরাই কনফ্লিক্ট এড়িয়ে চলতাম। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ও সব সময় দেখাত যে ও প্রচণ্ড স্বাধীন মানুষ, কারও করুনার উপর নির্ভর করে না। অথচ ওর এখানে থাকা, কাজকর্ম এমনকি এই যে আমরা তিন চার জন লোক শেষ পর্যন্ত ওর সাথে মিশতাম, সেটাও করুনা করেই। তবে এমনিতে খুব ভাল ছিল। কার কবে জন্মদিন সব মনে রাখত। অভিনন্দন জানাত। ল্যাবরেটরিতে কে কী পোশাক পরে, কোন কফি খায়, কোন নেল পালিশ ব্যবহার করে, কে বিবাহিত, কার ছাড়াছাড়ি হয়েছে এসব ছিল ওর নখদর্পণে। অনেকটা বাড়ির সামনে বেঞ্চে বসে থাকা বুড়িদের মত। ও যদি এই মনোযোগ কাজে দিত আজ এই অবস্থা হত না। এসবও হয়তো তেমন ক্ষতিকর ছিলও না। নীল আমাদের এসব বললে আমরা বলতাম, কে কী করল এনিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই। তুমি বরং কাজের কথা বল। ও শব্দ করে দরজা বন্ধ করে চলে যেত আর কথা বন্ধ করে দিত। ওকে খেলার স্কোর জিজ্ঞেস করলে বলত, "আপনি ফুটবল ফ্যান নন, আপনাকে বলব না।" অথবা কেউ যদি ওকে বলত, "কোটটা তো বেশ সুন্দর। তোমাকে খুব মানিয়েছে। ও কোথায় ধন্যবাদ দেবে, বলত "এ নিয়ে তোমার এত মাথা ব্যথা কেন?" ওর এসব ব্যবহারে মাঝে মাঝে খুব মেজাজ খারাপ হয়ে যেত, পরে ভেবে দেখতাম ও সেই স্কুলেই রয়ে গেছে। ওকে আর বদলানো যাবে না।"  কথায় বোঝা গেল ওরা নিজেরা রতনকে নিয়ে খুব একটা খুশি ছিল না। জারিফ আর জাফার তুলনামুলকভাবে আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, তবে খুব কর্মঠ। রতন ওদের অধীনে কাজ করত, কিছু কিছু কাজে সাহায্য করত, তবে গবেষণার মূল কাজ হত ওদের হাত দিয়েই। অনেক সময়ই ওদের হাজার পনের রুবল পর্যন্ত দেওয়া হত না দেশে গিয়ে স্থানীয় ইনস্টিটিউটে কাজ করার জন্য, সেক্ষেত্রে রতন কীভাবে কীভাবে যেন ৭০ হাজার রুবলের টিকেটসহ আরও কিছু এক্সট্রা টাকা ম্যানেজ করে ফেলত বসদের ধরে যদিও ও যেত স্রেফ বেড়াতে, কোন ইনস্টিটিউটে কোলাবরেশনের জন্য নয়। তবে এটা রতনের দোষ ছিল না, এটা ছিল ওর গুন, সময় মত দরকারি লোকদের ধরে নিজের কাজটা বের করে আনা। তবে যারা সত্যিকার অর্থে কাজ করে সামান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় তাদের এটা বোঝানো কষ্ট।  রতনের প্রিয় চুটকি কি ছিল জান? "Слово из трех букв, середине буква у. Когда стоит он параллелен к земле, а лежит перпендикулярно?" সবাই হোহো করে হেসে উঠত। ও তখন বলত "Это не то что вы думали. Это душ." সবাই হেসে বলত "Нил, это не то что ты думаешь. Любой мужик знает это что." ও আবার রাগ করে চলে যেত। আসলে কি বললে যে ও মাইন্ড করবে আর কি বললে করবে না সেটাই ছিলও বিরাট পাজল।" আমি বললাম, আমাদের দেশে ব্রাহ্মণদের সম্পর্কে বলা হয়, ওদের আগে হাঁটলেও দোষ, পিছে হাঁটলেও দোষ। আর সাথে হাঁটা নিষিদ্ধ।" রতন মনে হয় স্বঘোষিত ব্রাহ্মণ।" 

মনে পড়ল অনেক আগের এক ঘটনা। একদিন রতন হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে এল আমার কাছে।

কি হল?
আচ্ছা বলুন তো, দোকানে গেছি টুকিটাকি কেনাকাটা করতে। ভদ্রমহিলা আমাকে একগাদা খুচরো পয়সা ধরিয়ে দিল।
তাই? তাতে কী হল?
বা রে? এই পয়সা দিয়ে আমি এখন কি করব?
পরের দিন কিছু কিনতে গেলে দিয়ে দিও।
না, এই মহিলা ইচ্ছে করেই আমার কাছে এতগুলো কয়েন গছিয়ে দিয়েছে।
আচ্ছা যেখানে সমস্যা নেই সেখানে তুমি সমস্যা খোঁজ কেন? তুমি যদি পদার্থবিদ্যার সমস্যা এত মনোযোগ দিয়ে খুঁজতে তাহলে তো কোন সমস্যাই থাকত না। 

হ্যাঁ, এটাই। অনেকেই যেখানে সমস্যা এড়ানো যায় সেখানেই সমস্যা খুঁজে পায় আর যেখানে সমস্যা খুঁজে বের করা দরকার সেদিকে পা মাড়ায় না।  

ঐ দিনের স্মরণ সভায় (যদি এটাকে সভা বলা যায়)  একটা জিনিস পরিষ্কার হল। গুলিয়া আমাকে প্রায়ই খদিয়াচি আনেকদত বা চলমান হাঁসির বস্তু বলে অভিহিত করে। ঐ মিটিং-এ রতনকে নিয়ে বিভিন্ন কথা শুনে সেটাই বুঝলাম, ও ওর ব্যবহারের জন্যের সবার হাঁসির পাত্রই ছিল। পেছন থেকে সবাই ওকে নিয়ে হাসাহাসি করত। 

০৯ জুলাই শুক্রবার রতনের ঘর খুললাম। এর আগে ও কুড়ি বছরের বেশি সময় কাটিয়েছে ইনস্টিটিউটের হোটেলে, খুব ছোট্ট একটা রুমে। অনেক সময় খারাপ লাগত এই ভেবে যে দীর্ঘ দিন এভাবে থাকলে মানুষ মানসিক ভারসাম্য হারাতে পারে। গত দেড় বছর ও যেখানে ছিল সেটা হোটেল হলেও রুমটা বেশ বড়। সব কিছু খুব ফিটফাট, সাজানো গোছানো। সারি সারি ইস্ত্রি করা জামা কাপড়। শুধু স্যুটই দশ সেট। আমি পরিচিতা এক মেয়েকে ডাকলাম। কিছুদিন আগে আমাদের অনেক জিনিসপত্র ওকে দিয়েছি যাদের এসব দরকার তাদের হাতে পৌঁছে দেবার জন্য। ও এসে নিয়ে গেল। না হলে কোন চার্চে দিয়ে আসতাম। জানি না, ও এই মাপের কাউকে খুঁজে পাবে কি না। সাথে এক গাদি শার্ট, জ্যাকেট ইত্যাদি। কয়েক জোড়া জুতা জাফার ওর এক পরিচিত ছেলেকে দিয়ে দিল। ফ্রিজ আর ইলেকট্রনিক্স জাফার নিল। হাড়ি পাতিল আমার বাসায় দিয়ে গেল। সেই তপু, রেজা থেকে শুরু করে কত মানুষ যে আমাকে হাড়ি পাতিল দিয়ে গেছে তার হিসাব রাখে কে। তবে কেউই আমাকে রান্না করতে শেখায় নি, রতনও পারবে বলে মনে হয় না। সব চেয়ে বড় কথা ও দেশে যে ঠিকানায় টাকা পাঠাত সেই চেক পেলাম আর টাকা। ওর ভাইকে জানিয়েছি। ব্যাঙ্কে খোঁজ নিয়ে দেখলাম টাকা পাঠাতে অনেক ঝক্কি। এমনকি  টাকার উৎস কি সেটাও দেখাতে হতে পারে। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে কিস্তিতে কিস্তিতে অবশ্য পাঠানো যায়। তাই প্রেমানন্দের সাথে কথা বললাম। মনে হয় সেটাই বেটার অপশন। এখন সময় করে মস্কো গিয়ে টাকাটা দিয়ে আসতে হবে। তার আগে ডিএইচএল করে ডেথ সার্টিফিকেট, ডিপ্লোমা এসব পাঠাতে হবে। 

আজ ২০ জুলাই শেষ পর্যন্ত রতনের ডকুমেন্টগুলো ডিএইচএল করলাম। ডেথ সার্টিফিকেট, ডেথ রিপোর্ট, পিএইচডি আর মাস্টার্সের ডিপ্লোমা, বিভিন্ন আইডেন্টি কার্ড আর একটা অ্যালবাম। অ্যালবামে ওর কলেজের বিভিন্ন ছবি, ছাত্র জীবনের কিছু ছবি। জানি না এটা ওর ভাইদের দরকার ছিলও কিনা, তবে আমার মনে হয়েছে ও এত যত্ন করে এসব রেখেছিল দেশে নিয়ে যাবে বলেই।  

ঝামেলার কোন শেষ নেই। আজ ২২ জুলাই মস্কো থেকে ফোন করে জানাল আরও কি কি সব ডকুমেন্ট তৈরি করে পাঠাতে হবে। মুস্কিল!
 
গতকাল ২৫ জুলাই গুলিয়া হঠাৎ জিজ্ঞেস করল রতনের কথা, মানে কবে মারা গেছে। বললাম ৩১ মে। ও বলল চল্লিশ দিন অনেক আগেই পার হয়ে গেছে। তবুও চল ওকে স্মরণ করি। একটা জর্জিয়ান ওয়াইন খুলে ওকে স্মরণ করলাম। 

১৮ জুলাই অফিস থেকে ফিরছি, ভালোদিয়ার সাথে দেখা। ও আমাদের ল্যাবেই কাজ করে, আমার ছবির অনুরাগী।

- ভ্যাক্সিন নিয়েছ?
আজকাল লোকজন কেমন আছ সেটা জিজ্ঞেস করে না। ভ্যাক্সিন নিলাম কিনা সেটাই যেন আসল কথা।
- না, এখনও নেইনি। কয়েকদিন পরে নেব।
- তুমি যে বেঁচে আছ তা দেখে আমি খুব খুশি। ভেবেছিলাম আর দেখাই হবে না।
বুঝলাম ও রতনের সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলেছে। আমারও এমনটা হয়। কাউকে নামে জানি তো কাউকে মুখে। তাই কেউ মারা গেলে কত মুখ যে চোখের সামনে ভাসে। কয়েক বছর আগে এক লোক মারা যায়। গোটা এক বছর কত লোককে যে মৃত ভেবেছি। শুধু বছর ঘুরলে যখন তার জন্য স্মরণ সভা করা হয়, সেখানে টাঙানো ছবি দেখে বুঝি কে মারা গেছে। আমরা প্রায়ই মেলামেশা করতাম, রাস্তায় দেখা হলে কথাবার্তা হত। কিন্তু নাম জানা হয়নি। মানে নাম আর উপাধি। তাই এই দুর্দশা।
- কি আর করা। আমার দেশি মারা গেছে।
- হ্যাঁ, ছারকার (ওরা সরকারকে ছারকার বলে)। কর্ম, সব কর্ম।
- বাদ দাও তোমার কর্ম। কর্মের অর্থ জান? কাজ। আমাদের প্রতিটি বর্তমান অতীতের কাজের ফল। এই যে তোমার সাথে আমার দেখা হল সেটাও একই সময়ে হেঁটে বাসার দিকে ফেরার ফল। একে ভিন্ন অর্থ দেওয়া হল আবমান ত্রুদিয়াশিখসা। রাজনীতিবিদ আর ধর্ম ব্যবসায়ীরা কর্ম বিশেষ অর্থে ব্যাখ্যা করে আসলে মানুষ ঠকায়।
- যাই বল, অন সাম ভিনাভাত, ও নিজেই দায়ী। গরমের সময় কে বলেছে এত কফি খেতে। তা না হলে প্রেসারের সমস্যা হত না, হাসপাতালে যেতে হত না।
- দেখো, দিনের শেষে আমরা সবাই নিজ নিজ মৃত্যুর জন্য নিজেরাই দায়ী। যদিও কেউ কেউ ঈশ্বরের ঘাড়ে দায় চাপায় আর মানুষকে (নিজেই হোক আর অন্যেই হোক) নিমিত্ত মাত্র বলে ভাবে। কফি না হলে তুমি ঠিকই আরও একটা কারণ বের করতে। যতসব।

৩০ জুলাই মস্কো গিয়ে প্রেমানন্দের হাতে টাকাটা দিয়ে এলাম। যাক, একটু স্বস্তি পাওয়া গেল। সেই সাথে অনেক দিন পরে ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা হল। দু দিন বেশ আনন্দেই কাটল ওদের সাথে।

২ আগস্ট ভোলগায় সাঁতার কাটতে গিয়ে কোষ্ঠীর কথা মনে পড়ল। ভোলগায় ভাসিয়ে দিলাম সেটা। রতনের ভাইই বলেছিল। ওর মা নাকি বলে গেছে মৃত্যুর পর কোষ্ঠী জলে ভাসাতে। এখন বাকি শুধু দেহাবশেষের একটা গতি করা। এর মধ্যে বাসার সামনে লাইলাক আর জেসমিন গাছ লাগিয়েছি। ইচ্ছে ছিলও ওখানে রতনের ভস্ম রাখব। গুলিয়াও সেটাই বলছিল। তবে সেটা করতে পারব যদি ইনস্টিটিউট থেকে কেউ ওটা বের করে দেয়। অপেক্ষায় আছি।  

ঠিক করেছি বাসার ওখানেই রতনের চিতাভস্ম রাখব। আমি ইতিমধ্যেই মঝঝেভেলনিক কিনেছি। গুলিয়া এর সাথে সস্না (পাইন), বারবারিস, চেরেইওমুখা, লাইলাক, জাপানী আইভা, গোলাপ, ফার্ন আর বিভিন্ন ফুলের গাছ যোগ করেছে। সব মিলিয়ে গোটা তিরশ। ইতিমধ্যে কিনেও ফেলেছি। আর শ দুই লিটার মাটি ও গাছের গুড়ি। ছোটখাটো একটা বাগান করব বাসার পেছনে। আসল সমস্যা হবে মাটি কাটতে আর সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ছাই ফেলতে। দেখি। অনেক বার ভেবেছি কী দরকার আমার এসব করে? পরে মনে হয়েছে যদি সেরকম না হয় অনেকেই বলবে, যদি রতনের সাথে বিজনের সম্পর্ক খারাপ না থাকত, ও এভাবে দায়সারা গোছের কাজ করত না। আমি নিজেই অবাক হয়ে গেছি এই ভাবনায়, কেননা সমাজ নিয়ে আমার নিজেরও কখনই কোন মাথা ব্যথা ছিল না। তবে যে কারণেই করি না কেন, এ উপলক্ষ্যে যেসব ফুলের গাছ লাগানো হবে তাতে আমার ছবি তোলার বেশ কিছু উপকরণ যোগার হবে। এখন আর অন্যের গাছ থেকে ফুল আনতে হবে না। হ্যাঁ, এর মধ্যে আরও একটা কাজ বেড়ে গেছে - প্রতিদিন বিকেলে গাছে জল দেওয়া। আশা করছি আগামী দু চারদিনের মধ্যেই কাজটা সম্পন্ন হবে।  গুলিয়াও কুকুরদের বাইরেও গাছ নিয়ে সময় কাটাতে পারবে। 

আজ ০৯ আগস্ট। সকালেই ঢাকা থেকে রতনের ভাইঝির মেসেজ পেলাম। ডিএইচএল করে পাঠানো ডকুমেন্টগুলো হাতে পেয়েছে। প্রেম ওর আকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন বাকি চিতাভস্মের  একটা গতি করা। সকাল থেকেই অপেক্ষা করছি। ফোন এল। জানতে চাইলো কখন গাছগুলো পৌঁছে দিতে হবে। কথা হল দুপুর একটার পরে। এর মধ্যে অফিসে গিয়ে রতনের দেহাবশেষ নিয়ে এলাম। আমরা বাগান করছি দেখে সবাই খুশি কিন্তু সেখানে কারও দেহাবশেষ থাকবে সেটা জানলে নিশ্চয়ই কেউ খুশি হবে না। তাই এসব করতে হবে গোপনে। সময় মত সব কিছু এল। জাফরকে ফোন করলাম। একটু দূরে গিয়ে একটা প্যাকেটে ভস্মটা ঢেলে পাত্রটা ফেলে দিলাম ডাস্টবিনে। ভস্ম যে এরকম সাদা হবে সেটা ধারণা করতে পারিনি। দেশে অনেক সময় বলতে শুনেছি হাড্ডি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেব। এখন দেখলাম হাড্ডি গুঁড়া করলে তার অবস্থা কী হয়। সাশা ব্যস্ত থাকায় নিজেদের সব করতে হল। জাফর বেশ কিছুটা সময় সাহায্য করল। বড় একটা গর্তে দেহাবশেষ ঢেলে তার উপর মঝঝেভেলনিক লাগালাম। ৩১ মে থেকে ৯ আগস্ট। দীর্ঘ ৭০ দিন ঠিকানাবিহীন থেকে রতন শেষ পর্যন্ত একটা ঠিকানা পেল। জাফরকে বললাম, রতনের ছেলেমেয়ে তো হল না, জীবদ্দশায় কোন গাছও লাগাল না, এখন না হয় ওর উপর গাছ গজাক। প্রায় ঘণ্টা পাঁচেক গাছ লাগানোর পরে প্রচণ্ড  টায়ার্ড। বাগান দেখে গুলিয়া বলল, "দেখতে কিন্তু বেশ হয়েছে।" "হ্যাঁ, আমার তো নিজেরই মরে যেতে ইচ্ছে করছে।" "কি যে বল?" "দেখ, রতনকে দেশে ফিরিয়ে দিলেও এত ভাল বাগান সেখানে হত না। আমরাও যদি মারা যাই, সেখানেও সেটা হবে না। তোমাদের পারিবারিক কবরে কি? কালেভদ্রে গিয়ে দু একটা গাছ লাগাও। এর বেশি কিছু?" 

ঘরে যখন ফিরলাম ক্লান্ত, অবসন্ন। কেন যেন মনে হল এখন ভোলগায় গিয়ে ডুব দিয়ে আসা দরকার। তখন প্রায় সাড়ে  ছয়টা। জল বেশ ঠাণ্ডা। তাই খুব বেশিক্ষণ সাঁতার কাটা হল না। এরপর রান্নার পালা। যদিও সাধারণত মাংস করি আজ কেন যেন মাছ রান্না করলাম। আর ছিল জর্জিয়ান ওয়াইন। রতনকে স্মরণ করে টোস্ট হল। জানি না বাগান করাটা ভাল হল কিনা। অনেক দিন থেকেই কয়েকটা গাছ লাগানোর প্ল্যান ছিল। এখন রেগুলার সেটার দেখভাল করতে হবে। একটা এক্সট্রা দায়িত্ব। যদিও মস্কোয় কাকুর বাগান করা দেখে এমন একটা ইচ্ছা মনে মনে সব সময়ই পোষণ করতাম। অন্য দিকে যেহেতু রতনকে ঘিরেই এটা হল, ইচ্ছা হোক বা না হোক, ওর একটা অশরীরী উপস্থিতি সব সময়েই থেকে যাবে। তবে আসল সমস্যা হল, গুলিয়া এখন কিছুদিন পরপরই বলবে গাছ কিনতে। কিন্তু গাছ কেনাই তো শেষ কথা নয়, তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক অনেক কিছু আর গাছ লাগানো। আর সবচেয়ে বড় কথা নিয়মিত জল দেওয়া। এক কথায় জীবদ্দশায়, মৃত্যুর পরে, এমনকি শেষকৃত্যের পরেও রতন কিছু কিছু সমস্যা রেখেই যাচ্ছে আমার সামনে।

যা ভেবেছিলাম তাই হল। সকালে উঠেই গুলিয়া বলল আরও দুটো চেরিওমুখা কিনতে। বিকেলে বাসায় ফিরে দেখি ও আরও অনেক গাছ কিনে লাগিয়েছে। এখন ওদের সংখ্যা ৪০। প্রায় আধা ঘন্টা লাগল গাছে জল দিতে। বলছে আগামী কাল আরও কিছু কিনবে। আশা করছি দু একদিনের মধ্যেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে।

হ্যাঁ, গুলিয়া আরও ১০ টা গাছ কিনে লাগিয়েছে। আরও চারটের প্ল্যান আছে।  আমি নিজেই বিরক্ত। যেন বাগান ছাড়া আর কোন কাজ নেই। যদিও আমি কিছু পদস্নেঝনিকি লাগানোর পক্ষে যাতে বসন্তের শুরুতে বনে বনে ঘুরতে না হয় ফুলের ছবি তোলার জন্য।

গত কয়দিন রতনের কথা বারবার ফিরে এসেছে বাসায়। মূলত বাগান করতে গিয়ে। গুলিয়া অনেক বারই বলেছে "যদিও রতন আমাদের সাথে মিশত না, তবুও ওর মৃত্যুটা দুঃখজনক। সব কিছুর পরেও ওর উচিৎ ছিল  তোমাকে জানানো, অন্তত হাসপাতালে যখন গেল।" আমি কী বলব? জানলেই বা কিছু করতে পারতাম? তাছাড়া কেউই তো ভাবে না যে মারা যাচ্ছে। সবাই বাঁচার আশা নিয়েই জেগে থাকে। সেদিন প্রেমের সাথে কথা হল। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ও ২০ দিনের বেশি হাসপাতালে ছিল। এরমধ্যে ৮ দিন আইসিইউ-তে। বলল, "বিজন দা, বিশ্বাস করবেন না, এই আট দিন আমি ঘুমুইনি। মনে হয়েছে চোখে একবার বন্ধ করলেই আর খুলতে পারব না। মৃত্যুর মুখ থেকে ঘুরে এসেছি।" কিন্তু রতন তো সে অবস্থায় ছিল না। ২৮ মে শুক্রবার ফোন করে বলেছে যে ভালোর দিকে, এক সপ্তাহ পরেই বাসায় ফিরবে। আর ৩১ তারিখে ব্রেন হ্যামারেজে মৃত্যু। আমাদের জীবন তো বটেই, সমস্ত বিশ্বটাই যাকে বলে র‍্যান্ডম প্রসেস বা এলোমেলো প্রক্রিয়া। সব কিছুই কোন না কোন ভাবে সব কিছুর সাথে জড়িত। তাই আপাত দৃষ্টিতে ভালো কিছুও ফাটাল হয়ে দেখা দিতে পারে। রতন আমাকে বা আমদের কোন বন্ধুকে ফোন করলে কিছু বদলাত কিনা জানি না, তবে হয়তো আমরা একটু সান্তনা পেতাম মনে।   

 
মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে খারাপ বলতে নেই, তবে মনে হয় এই লেখায় আমি সেটা মেনে চলতে পারিনি। না, ওকে ছোট করা নয়, গত ৩৭ বছরে যথেষ্ট কাছ থেকে ওকে দেখার সুযোগ হয়েছে, তার একটা নিরপেক্ষ চিত্র আঁকার চেষ্টা করেছি। তবে যেহেতু নিজেও জড়িত সেটা ততটা নিরপেক্ষ নাও হতে পারে। যেহেতু গত ২০ বছরে আমাদের কোন রকম ইন্টার‍্যাকশন ছিল না, তাই দূর থেকে যেটা দেখেছি বা শুনেছি সেটাই লেখা। তবে এটা ঠিক, সবই সত্য ঘটনা। এটা রতনকে নিয়ে লেখা হলেও শুধু ওকে নিয়েই নয়।  রতন মারা গেছে, তবে এরকম লোক যে একেবারেই নেই তা কিন্তু নয়। এটা সেই সব জীবিতদের জন্য যারা মনে করে তারা সম্পূর্ণ স্বাধীন, কোন কিছুর উপর তাদের নির্ভরতা নেই, তাই কারও সাথে কোন রকম সম্পর্ক রাখার দায়ও নেই তাদের। রতনের জীবন আর মরণ উল্টোটাই প্রমাণ করে।

রতনের মত্যু সংবাদ পেয়ে ইভান সাইমন আর গারফুঙ্কেলের এই গানটা দিয়েছি ফেসবুকে স্ট্যাটাস হিসেবে

He was a most peculiar man
He lived all alone within a house
Within a room, within himself
A most peculiar man
He had no friends, he seldom spoke
And no one in turn ever spoke to him
'Cause he wasn't friendly and he didn't care
And he wasn't like them
Oh, no, he was a most peculiar man
He died last Saturday
He turned on the gas and he went to sleep
With the windows closed
so he'd never wake up
To his silent world and his tiny room
And Mrs. Reardon says
he has a brother somewhere
Who should be notified soon
And all the people said,
"What a shame that he's dead
But wasn't he a most peculiar man?"
Simon & Garfunkel - A most Peculiar Man

ইভান ঠিকই বলেছে। তবে আমার মনে হয়েছে বিটলসের সেই গানের লাইন

He's a real nowhere Man
Sitting in his Nowhere Land
Making all his nowhere plans
For nobody


দুবনা, ৩১ মে - ১৩ আগস্ট, ২০২১




Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

রাজনীতি

স্মৃতি