আগস্টের দিনগুলি – তিরিশ বছর পর
(১)
নারুদা বলে আমাদের এক সিনিয়র বন্ধু গল্প করতেন, “আমার দাদা কয়েকদিন পরপর দাড়িগোঁফ রাখে আবার ক’দিন পরেই ছেঁটে ফেলেন। বলেন এটা গরীবের ফ্যাশন, রাখতেও পয়সা লাগে না, কাটতেও না।“ আমার মত লোকেরা যাদের খুব বেশি পয়সাও নেই আবার বাহারী দাড়িগোঁফও নেই – তারা ফ্যাশন করবে কি করে? অন্যেরা কি করে জানি না, তবে আমি মাঝেমধ্যে ঘরের টেবিলচেয়ার, বইপত্র এদিক ওদিক করে ফ্যাশন করি। এ যেন লেনিন সুব্বোতনিক, এ বছর এখানকার ময়লা সেখানে ফেল তো পরের বছর সেখানকার ময়লা এখানে। এমন এক সকালে ঘরের আসবাবপত্র এদিক ওদিক করার সময় দরজায় টোকা পড়ল। দরজা খুলে দেখি শাহীন দাঁড়িয়ে। শাহীন, মানে শাহীন আক্তার হামিদ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার শিক্ষক। এখন পি এইচ ডি করছে দনেপ্রোপেত্রভস্কে। মস্কো এলেই দ্বিজেন কাকুর ওখানে উঠত। ওখানেই পরিচয়। কাকুরা ক’দিন আগে চলে গেছেন গ্রীষ্মের ছুটিতে ইংল্যান্ড বেড়াতে। ও রয়ে গেছে। কিন্তু ওকে চা খাওয়া তো দূরের কথা ঘরে ঢুকতেও বলতে পারলাম না। গতকালের এই অনিচ্ছাকৃত পরিস্থিতির জরিমানা হিসেবে আজ সকালে ওকে চায়ের নেমন্তন্নে ডেকেছি। বেশ ক’দিন হল ঘুমটা ভালো হচ্ছে, খিদেটাও বেড়েছে। তাই ন’টা বাজতে না বাজতেই উঠে পড়েছি ঘুম থেকে। শাহীন আসবে সকাল দশটায়। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করলেও অপেক্ষা করছি। শত হলেও ভদ্রতা শব্দটি তো উঠে যায়নি পৃথিবী থেকে!
ঘুম ভাঙলেই যে কাজগুলো প্রথমে করি তা হল ঘড়ি দেখা আর পর্দার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখা। জেগে উঠেই উজ্জ্বল নীলাকাশ আর হাসিখুশি মেঘ না দেখলে মেজাজ বিগড়ে যায়। শীতপুরী মস্কোতে সূর্য খুব একটা দেখা যায় না। এবার গ্রীষ্মেও তার দেখা নেই। প্রায়ই ছিঁচকাঁদুনে বৃষ্টি। মস্কোতে রোদ ভরা দিনগুলো যেমন হাসিখুশি, বৃষ্টি ভেজা দিন তেমনই গোমড়া, বিষণ্ণ; দেখলেই মন খারাপ হয়ে যায়।
কী ধূসর, কী বিষণ্ণ যে মেঘে ঢাকা মস্কোর আকাশ!
আজও বাইরে তাকিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। আরেকটা সূর্যহীন দিন, মেঘের চাদর গায়ে দিয়ে ঘরে বসে থাকা আরেকটা দিন। সেতারে নিখিল ব্যানার্জির মেঘ রাগ বাজছে, চায়ের জল ফুটছে শোঁ শোঁ করে। সাড়ে দশটা বাজতেও শাহীন না আসায় ভদ্রতায় ক্ষান্ত দিয়েছি। কিছু না খেলেই নয়। ক্যাসেটটা বদলিয়ে দেবব্রতের বর্ষার গান বসিয়ে কেবলই কসমোলজির একটা প্রবলেম দেখতে শুরু করেছি, দরজায় টোকা পড়ল। “সরি ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেল” বলে শাহীন ঘরে ঢুকল। এই বৃষ্টি ভেজা দিনে কে-ই বা সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে? অনেকেই ওঠে। এমন রাতে অনেকে ঘুমায়ই না। সে কথা পরে।
চা খেতে খেতে আমরা আইভাজভস্কি, সেরভ, শিশকিন, ব্রুলভ আর ৎসিয়ানের এ্যালবাম দেখছিলাম। এমন সময় ঘরে ঢুকল আমার রুমমেট ইয়েভগেনি।
“আমি মস্কোর রাস্তায় ট্যাঙ্ক দেখে এলাম। ব্যাপার কি, কিছু জানিস?” ঢুকেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল আমার উদ্দেশ্যে। “কই, নাতো। গতকাল বিবিসি ইয়েলৎসিন আর নাজারবায়েভের নাগোরনি কারাবাখ সম্পর্কে গরবাচভকে হুঁশিয়ার করে দেওয়ার খবর দিয়েছে।
এছাড়া সায়ুজ (সোভিয়েত ইউনিয়ন) সম্পর্কে অন্য কোন খবর ছিল না।“
“এটা মস্কোয় ট্যাঙ্ক নামানোর কারণ হতে পারে না” বলেই চলে গেল ইয়েভগেনি।
আমরা আবার ছবি দেখায় মন দিলাম। বেলা তখন ১ টা, ১৯ আগস্ট ১৯৯১।
প্রায় আধঘণ্টা পরে শাহীন চলে গেলে জামাকাপড় পড়ে বেরুচ্ছি খেতে যাব বলে। করিডোরে দেখা রেজার সাথে।
“সব তো বন্ধ হয়ে গেল। অলরেডি চে পে।”
“মানে?”
“মানে আবার কি? জরুরী অবস্থা (রাশান ভাষায় জরুরী অবস্থাকে বলে চ্রেজভিচায়নয়ে পালাঝেনিয়ে বা সংক্ষেপে চে পে)। গরবাচভ ক্ষমতাচ্যুত। ইনায়েভ, পাভলভরা ক্ষমতা নিয়েছে।“
“হতেই পারে না। ঠাট্টা করছ।“ অবিশ্বাস ভরে মাথা নাড়ালাম আমি। যতক্ষন পর্যন্ত না নিজকানে বিবিসি শুনলাম, নিজ চোখে দেখলাম টিভি বুলেটিন ততক্ষন পর্যন্ত এই অবিশ্বাস ছিল। গরবাচভ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন বলে যে দুঃখ পেয়েছি তা নয়, কষ্ট লাগছিল গণতন্ত্রের জন্যে, বাক স্বাধীনতার জন্যে। ভয় পেয়েছিলাম কমিউনিস্ট ত্রাসের আগমনের আশঙ্কায়। গরবাচভকে প্রথম দিকে সাপোর্ট করলেও তাঁর প্রতি মোহ কেটেছে অনেকদিন। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ক্রুচকভ, পাভলভ, ইনায়েভদের নিজের চারপাশে জড়ো করার পর থেকেই বরং তাঁর বিরোধী হয়ে উঠেছিলাম এই অর্থে যে তাঁর মিশন শেষ। এখন উচিত বরং রেডিক্যাল কারো হাতে ক্ষমতা দিয়ে কেটে পড়া। তবুও এভাবে গরবাচভের অপসারনে খারাপ লাগছিল। এলেনা বোনার (আন্দ্রে শাখারভের স্ত্রী) যেমন লিখেছিলেন “আমি কখনই গরবাচভের ভক্ত ছিলাম না, আবার তাঁর শত্রুও নই। ......... ভাবতে চাই না যে তিনি নেই। তাঁর ভালমন্দ দোষত্রুটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার মালিক আমরা, তারা (ইনায়েভ অ্যান্ড কোং) নয়।“ মনে করার চেষ্টা করলাম পুরানো ঘটনাবলী। ইনায়েভ যেদিন ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন, এক সাংবাদিক অনেকটা এ ধরণের প্রশ্ন করেছিলেন “আপনার সাথে তো গরবাচভের বিভিন্ন প্রশ্নে দ্বিমত। কাজ করতে পারবেন কি?” উত্তর শুনে বুঝতে পেরেছিলাম এর কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না। এতো রক্ষণশীল মানুষ পেরেস্ত্রইকার হাল ধরতে পারে না। মনে পড়লো পাভলভের নাদুসনুদুস মুখখানা। আসলে এই ইনায়েভ অ্যান্ড কোং প্রথম দর্শনেই এমন এক বিরূপ অনুভুতির জন্ম দেয় যে আপনা থেকেই মন এদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ওঠে।
ঠিক করলাম, ঘরে বসে না থেকে সেন্টারে যাব। নিজের চোখে দেখব ব্যাপারখানা। এছাড়া টিভিতে ইনায়েভদের সাক্ষাৎকার দেখে বুঝেছিলাম তেমন কড়াকড়ি নেই। ওকে দেখে লাগছিল ঠিক যেন যাত্রার দলের রাজা। আত্মবিশ্বাসে তার এতো ঘাটতি। এই লোক যে কীভাবে ক্যু করলেন ভেবে পাচ্ছিলাম না। ওঁর সাক্ষাৎকার দেখে আমরা সবাই হেসে খুন। গরবাচভকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে এ সহজ সত্যটা স্বীকার করার মত হিম্মৎ পর্যন্ত নেই। বলে কিনা, “গরবাচভ আমার বন্ধু। এখন অসুস্থ, চিকিৎসা চলছে। সেরে উঠলেই এসে কাজে যোগ দেবেন বলে আশা করি।“ অথবা গরবাচভের শাস্তির প্রশ্ন উঠলে বলে, “মিখাইল গরবাচভ সম্মানীত ব্যক্তি। তাঁর শাস্তির প্রশ্নই ওঠে না।“ এক কথায় ক্যু’র পর থেকেই ইনায়েভ অ্যান্ড কোং সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। সব দেখে শুনে সেন্টারে যাওয়া আশঙ্কাজনক হবে না বলেই মনে হচ্ছিল। তবে বন্ধুদের অনেকেই বাধা দেওয়ায় সেদিন আর যাওয়া হল না। সকালের বিষণ্ণ আকাশ ইতিমধ্যেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে। ভীত, হতচকিত মানুষের প্রাণের আর্তি মিশেছে আকাশের সে অশ্রুবর্ষণে।
সেন্সরের বেড়াজাল টপকে রাতের খবরে এল ইয়েলেৎসিনের দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। বেলি দম বা রাশান ফেডারেশনের সুপ্রীম সোভিয়েতের সামনের রাস্তায় দেখা গেল নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং তাকে ঘিরে ব্যারিকেড তোলার দৃশ্য। এছাড়া মৌখিক খবরও আসতে লাগল একটু আধটু করে। ২০ আগস্ট সকালে ঘুম থেকে উঠেই ক্যামেরা হাতে সোজা ছুটলাম রেড স্কয়ারের দিকে। সতর্কতার জন্যে প্রথমে ঢুকলাম রেড স্কয়ারের সাথেই মস্কোর সবচেয়ে দোকান গুমে। রেড স্কয়ারে ঢোকার পথ বন্ধ। বিশেষ পারমিশনে ঢুকছে কেউ কেউ। এদিকে কোন ট্যাঙ্ক বা সাঁজোয়া গাড়ি না দেখে ভাবলাম “ক্যু কি শেষ হয়ে গেল?” এদিক ওদিক তাকিয়ে খানিক ঘুরে মস্কো হোটেলের সামনে আসতেই চোখে পড়লো সাঁজোয়া গাড়ির সারি। তাদের ঘিরে মানুষের ভিড়। এক সৈনিককে দেখলাম ছোট এক বাচ্চাকে কোলে তুলে দেখাচ্ছে সাঁজোয়া গাড়ির ভেতরটা। চটপট ছবি তুলে এগুলাম সামনের দিকে। সৈন্যদের ঘিরে ধরেছে মানুষ। এক বুড়ি শুনলাম সৈন্যদের বলছে, “তোমরা এখানে কাকে রক্ষা করছ? ঐ দস্যুদের? যাও, বেলি দমে যাও। ওখানে আমাদের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তাকে গিয়ে রক্ষা কর।” কেউ তার সমর্থনে বলছে, কেউ বা বিপক্ষে। গেকাচেপে মানে জরুরী অবস্থাকালীন রাষ্ট্রীয় কমিটির পক্ষেও আছে কেউ কেউ। সেটাও বোঝা যাচ্ছে বেশ। বেশ মজাই লাগছিল। বলতে গেলে ক্যুর দেশেই আমার জন্ম। ১৯৬৪ সালে আয়ুব শাহীর আমলে জন্ম নিয়ে ১৯৮৩ পর্যন্ত যে উনিশ বছর দেশে ছিলাম ১৯৭২ থেকে ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে তিন বছর বাদ দিলে বাকি সবটাই কেটেছে স্বনামী বা বেনামী সামরিক শাসনে। তিন তিনটে ক্যু তো দেখলাম নিজের চোখেই। তাই সব দেখে কেন যেন মনে হল এ ক্যু টিকতে পারে না, সাত দিনের বেশি তো নয়ই।
পেরেস্ত্রোইকার ধাক্কায় রুশীদের কাছে আমাদের আদর কমে গেলেও মধ্য এশিয়া প্রজাতন্ত্রের লোকেরা এখনও আমাদের দিকে তাকায়। ইন্ডিয়ান ভেবে ছুঁড়ে দেয় প্রশ্নের বাণ। বাঙ্গালিদের দমন করতে ইংরেজ যেমন গুরখা, রুশীদের দমন করতে জার যেমন কসাকদের ব্যবহার করত, তেমনি মস্কো নিয়ন্ত্রণ করতে ইনায়েভ ও তার কোম্পানি নিয়ে এসেছিল মধ্য এশীয় সেনা সমৃদ্ধ ব্রিগেড। আমাকে দেখেই হেসে উঠলো এক কাজাখ। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই কি আমাদের গুলি করবি?” (রুশ ভাষায় সমবয়েসীদের সাধারণত তুই করেই বলে, এদেশে আপনি আর তুইয়ের মাঝামাঝি কিছু নেই।) “গুলি করার আদেশ নেই, তাছাড়া আমাদের কাছে প্যাট্রনও নেই।” “যদি আদেশ দেয়?” “তবুও করব না। নিজের দেশের মানুষের উপরে কিছুতেই গুলি চালাব না।” “তোর কাছে যে প্যাট্রন নেই সেটা বিশ্বাস করি কিভাবে?” চার চারটে কার্তুজ বের করে ও বলল, “কোনটা দেখবি বল? সবগুলোই ফাঁকা।” নেড়েচেড়ে দেখে বললাম, “যাই বলিস, ক্যু সফল হবে না। দে না একটা ফাঁকা শেল, স্মৃতি হিসেবে রেখে দেব।” ওকে ইতস্তত করতে দেখে এগিয়ে এল এক রুশ ছেলে। একটা ফাঁকা শেল দিয়ে বলল, “রেখে দে স্মৃতি হিসেবে।” ধন্যবাদ দিয়ে চলে যাচ্ছি, রুশ ছেলেটা ডেকে বলল, “ওপেনার হিসেবে ব্যবহার করিস।” পকেট হাতড়ে স্যুভেনির জাতীয় কিছুই পেলাম না। ভাবলাম, “ইস, যদি একটা বোতল থাকতো, ওকে দিয়েই শুরু করতাম বোতল খোলার কাজটা।”
ঐ জটলার মধ্যেই কয়েকজনকে দেখলাম মেগাফোন মানে লাউড স্পীকার দিয়ে সবাইকে আহ্বান করছে মস্কো সোভিয়েত চত্বরে সমাবেশে যোগ দিতে। সব দেখে তো চক্ষু স্থির। কয়েক শ’ ট্যাঙ্ক আর সাঁজোয়া গাড়ি এলো মস্কোতে, অথচ ক্যু হল কিনা বিনা রক্তে। সংখ্যাটা ঠিক মনে নেই তবে ট্যাঙ্ক আর সাঁজোয়া গাড়ি মিলে হাজার খানিক ছাড়িয়ে গেছিল। পাঁচ জনের বেশি সমাবেশ নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। অথচ খোদ রেড স্কয়ারেই কিনা চলছে সমাবেশের প্রচারণা। দোকানপাট যেমন মানুষে গিজ গিজ করছে, রাস্তায়ও তেমনি ঢল নেমেছে মানুষের। সেন্টারে ঘুরে মানুষ বানের জলের মত ছুটে চলছে মস্কো সোভিয়েত হয়ে বেলি দমের দিকে। বানের জলে ফেনার মত ভাসতে ভাসতে আমিও চললাম মস্কো সোভিয়েত অভিমুখে। গোর্কি স্ট্রীট (অধুনা তভেরস্কায়া) ধরে হেঁটে যাওয়া। মস্কোর প্রাণকেন্দ্রে ব্যস্ততম রাস্তার শিরদাঁড়া ধরে দিনে দুপুরে হেঁটে বেড়ানো – এও কি সম্ভব! সারা রাস্তা লোকে লোকারণ্য। মানুষ আর সৈন্যের ছড়াছড়ি। সব একাকার হয়ে গেছে আজ। সবার মুখে চোখে বিস্ময়! মানুষ যেমন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে সৈনিকদের, সৈনিকরাও তেমনই হতবাক অগণিত মানুষের অবিরাম গতিতে। শুধু হাসি নেই অফিসারদের মুখে। সেখানে শুধুই পেশাদার কাঠিন্য। কেন্দ্রীয় টেলিগ্রাফ অফিসের সামনে দেখলাম জেনারেলকে। তার বুকভরা ব্যাজের বাহার দেখে অন্তত তাই মনে হল। সৈন্য আর মানুষের উপর কি তার হম্বিতম্বি। কিছুটা হেঁটে পৌঁছে গেলাম মস্কো সোভিয়েত চত্বরে। সেখানে পড়ে শোনানো হচ্ছে ইয়েলেৎসিন আর হাজবুল্লাতভের আহ্বান। মানুষের পদভারে কম্পিত চত্বর। তিরতির করে কাঁপছে বাতাস সংগ্রামী প্রত্যয় মেশান শ্লোগান আর হাততালিতে।
বেলা হয়েছে বেশ।
হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত দেহ। খিদেটাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে হাঁটছি পাতাল রেলের দিকে।
পুশকিন স্কয়ারে এসে দেখি খাঁ খাঁ করছে ম্যাকডোনাল্ড। কোথায় সেই বিশাল লাইন? ভোজবাজির মত কোথায় হারিয়ে গেছে সে? ঠিক উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো ট্যাঙ্ক। সৈন্যদের ঘিরে ভিড় করেছে মেয়েরা। হাসছে। কথা বলছে।
ট্যাঙ্কের উপর দাঁড়ানো সৈনিকের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে দুটো মেয়ে উঠে গেল তাতে।
ওদের হাসির দমকে চিড়ে গেল বাতাসের বুক, যেন পাহাড়ের বুক বেয়ে নামল ঝরনার জল। কি যে ঘটছে চারিদিকে, বুঝে উঠতে পারছি না। একটা ক্যু যে হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই,
সন্দেহ নেই যে ওরা সফল হলে এদেশ আবার অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। সন্দেহ ছিল না তেমনি এদের অবশ্যম্ভাবী পরাজয়েও।
বুঝছিলাম না শুধু এদেশের মানুষগুলোকে। এদের লাখ লাখ সৈন্য আর সাধারণ মানুষজনকে। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল,
অথছ মানুষ কেমন শান্ত। অতি উৎসাহী কিছু লোক বাদ দিলে সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। বরাবরের মতই দোকানে দোকানে ভিড়। প্রেমিকের বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্ত প্রেমিকা। সর্বত্র যেন উৎসব।
মস্কোর রাস্তায় রাস্তায় যে হাজার হাজার মানুষ তাতে সংগ্রামের, প্রতিরোধের, প্রতিবাদের চেয়ে নারদনয়ে গুলিয়ানিয়ে বা উৎসবের চরিত্রই প্রকট।
যদিও যত জনকে জিজ্ঞেস করেছি প্রায় সবাই ক্যুর বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছে, সমর্থন ব্যক্ত করেছে ইয়েলেৎসিনের পক্ষে।
শুধুমাত্র ট্যাঙ্কের পটভূমিতে ছবি তোলার জন্য কত লোক যে বেরিয়েছে রাস্তায়!
পাতাল রেলে ঢুকে দেখলাম জটলা পাকাচ্ছে মানুষ।
হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ইয়েলেৎসিন, সিলায়েভ, হাজবুল্লাতভদের আহ্বান সম্বলিত লিফলেট
“রাশিয়ার জনগনের প্রতি”
১৮ আগস্ট ১৯৯১ দিবাগত রাতে দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। এই ক্ষমতাচ্যুতিকে যেভাবেই যৌক্তিক প্রমানিত করা হোক না কেন, ডানপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলচক্র দ্বারা এই ক্ষমতা দখল অসাংবিধানিক। জনগণের
শত দুঃখ-কষ্ট ও কঠিন অভিজ্ঞতা সত্বেও দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া গভীর হচ্ছে যা কিনা পরিবর্তিত হবার নয়। কমিউনিস্ট পার্টিসহ অন্যান্য অসাংবিধানিক সংগঠনসমূহের ক্ষমতা যথেষ্ট খর্ব করে দেশের মানুষ নিজেদের ভাগ্যের মালিক হচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও রাশিয়ার একতা রক্ষাকল্পে রুশ দেশের নেতৃত্ব ইউনিয়ন প্রসঙ্গে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান ইউনিয়ন চুক্তির প্রক্রিয়াকে গতি দিয়েছে, অন্যান্য প্রজাতন্ত্রের সম্মতি লাভ করতে সাহায্য করেছে। ঠিক হয়েছে ২০ আগস্ট এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। ঘটনার এই ডেভেলপমেন্ট প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে ক্ষুব্ধ করেছে, তাদেরকে এই জটিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে বলপ্রয়োগের মত দায়িত্বহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ সমাধানের পথে যেতে বাধ্য করেছে। এর আগেও সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালান হয়েছে। আমরা মনে করি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা গ্রহণযোগ্য নয়। এটা বিশ্বের সামনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্মান ধূলিসাৎ করেছে, আমাদের শীতল যুদ্ধের যুগে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে, বিশ্ব সমাজে সোভিয়েত ইউনিয়নকে একঘরে করেছে।
এসব ঘটনা আমাদের বাধ্য করেছে তথাকথিত কমিটির ক্ষমতা দখলকে বেআইনি ঘোষণা করতে। আমরা এই কমিটির সমস্ত সিদ্ধান্ত ও আদেশ অবৈধ বলে ঘোষণা করছি। আশা করছি স্থানীয় সংস্থাগুলো রাশিয়ান ফেডারেশনের সংবিধান ও প্রেসিডেন্টের নির্দেশ মেনে চলবে।
আমরা জনগনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি এই সামরিক জান্তাকে রুখে দাঁড়িয়ে দেশকে স্বাভাবিক সাংগঠনিক বিকাশের পথে ফিরিয়ে আনতে। এখন প্রয়োজন দেশের প্রেসিডেন্ট গরবাচভকে জনতার সামনে তার বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দেওয়া। দরকার সুপ্রিম সোভিয়েতের জরুরী অধিবেশন ডাকা।
আমরা বিশ্বাস করি যে প্রিয় দেশবাসী এই অরাজকতা, এই আইনহীনতাকে গ্রহণ করবে না। সৈনিকদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি নাগরিক দায়িত্ব পালন করতে এবং এই প্রতিক্রিয়াশীল অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ না করতে। আমাদের দাবী আদায়ের জন্য অনির্দিষ্ট কালের জন্য সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানাচ্ছি। সন্দেহ নেই যে বিশ্ব নেতৃবৃন্দও এই ডানপন্থী অভ্যুত্থানের সঠিক মূল্যায়ন করবে।
প্রেসিডেন্ট, রুশ ফেডারেশন ইয়েলেৎসিন
প্রধানমন্ত্রী, রুশ ফেডারেশন সিলায়েভ
ভারপ্রাপ্ত স্পিকার, রুশ পার্লামেন্ট হাজবুল্লাতভ
১৯ আগস্ট ১৯৯১, সকাল ৯ ঘটিকা।
পরিচিত অপরিচিত কত লোকের সাথে যে ঐদিন কথা হয়েছে! অধিকাংশের চোখেমুখে বিস্ময় আর উৎকণ্ঠা। স্বস্তির নিঃশ্বাস যে কেউ কেউ ফেলেনি তাও নয়। অনেকেই এই ভেবে খুশি হয়েছে যে অবশেষে আইন শৃঙ্খলা ফিরে এলো। এরকম কথা যে শুধু এদেশের মানুষই বলেছে তাই নয়, অনেক বিদেশী বন্ধুদের মুখেও একথা শুনেছি। পরে পত্রিকায় দেখেছি ও লোক মুখে শুনেছি যে এ নিয়ে ঢাকা, লন্ডন সহ অনেক জায়গায়ই মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। হায়রে কপাল – হায়রে শৃঙ্খলার পূজারী! এরাই আবার দেশে যখন সামরিক শাসন আসে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে বলে গলা ফাটান “দেশ গেল, গণতন্ত্র গেল”
বলে। এরা কি বোঝেন না যে বেআইনিভাবে কখনও আইন প্রতিষ্ঠিত হয় না, যেমন কিনা শৃঙ্খল দিয়ে আনা যায় না শৃঙ্খলা। তাহলে তো সারা পৃথিবীটাকেই জেলখানা বানাতে হয়।
ঐ লোকগুলো হয়তো সচেতনভাবেই এটা চান।
জেলে তো তারা যাবেন না, যাবে তাদের সাথে ভিন্ন মত পোষণকারীরা। আলো বাতাসে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলো যদি এক রকম না ভাবে, একই ভাবে না চলাফেরা করে, তাবে সাম্যবাদ আসবে কেমন করে? এর জন্যে যদি পাঁচ মহাসাগর রক্তে ভেসেও যায়,
ভূস্বর্গ থেকে দেবতারা যদি নির্বাসিতও হন, দানবের সাম্যবাদ তবুও চাই-ই-চাই।
(২)
অনেকে শুধু পেরেস্ত্রোইকার খারাপ দিকগুলোই দেখেন, দেখেন সোভিয়েত সমাজে পশ্চিমা সংস্কৃতির দ্রুত বিকাশ। অনেক বন্ধুকে দেখি এ নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখি করতে যেন পশ্চিম থেকে শুধুই পর্ণ পত্রিকা আর গুণ্ডামির আগমন ঘটেছে এদেশে। আগে কি এখানে মাফিয়া ছিল না? নিশ্চয়ই ছিল। আর তার সাথে যুক্ত ছিল পার্টির এলিট আর আমলারা।
এখন সেটাতেই গণতন্ত্র এসেছে। সমাজের সাধারণ মানুষের এক অংশ জড়িয়েছে এই চক্রে। কিছু লোকের প্রকাশ্যে ক্যুর সমর্থন করতে দেখে, অনেককে উৎসবের আমেজে রাস্তায় নেমে ছবি তুলতে দেখে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম মনে মনে। মানুষের প্রতি অবিশ্বাস গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছিল। কিন্তু ঘরে ফিরে একটু গভীরভাবে চিন্তা করতেই সেটা কাটল। নিষেধ উপেক্ষা করে এই যে হাজার হাজার মানুষের রাস্তায় নেমে আসা, তা সে ছবি তুলতেই হোক, বেআইনিভাবে ক্ষমতা দখলের প্রতিবাদেই হোক অথবা সমর্থনেই হোক, সেটা কি কিছু নয়? পাঁচ বছর আগে এটা কি ভাবা যেত? বিষয়বস্তু নয় আকার, মানে আইন অমান্য করে মানুষের এই পথে নামাই জানিয়ে দিয়ে গেল এ রাশিয়া সেই রাশিয়া নয়। এখনকার মানুষ শুধু মুখ বন্ধ করে আদেশ মেনেই চলে না, তা অমান্যও করে, কেউ কেউ সেটা রুখেও দাঁড়ায়।
প্রায় অনাহারে কাটিয়ে দিনের শেষে যখন ঘরে ফিরলাম, ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়েছে শরীর। এমন সময় শুভ, মানে শুভঙ্কর এলো। বলল বেলি দম ঘিরে পাহারা দেবে হাজার হাজার মানুষ। ও যাচ্ছে। আমি যাব কি না জানতে চাইল। রাজি হয়ে গেলাম সাথে সাথেই। কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার। এগর ওঘর থেকে কিছু আলু পেঁয়াজ জোগাড় করে রান্না চাপাল শুভ। খাওয়া শেষে রাত এগারোটা প্রায় বাজলো। এর মধ্যে কারফিউ জারী হল মস্কো শহরে। শুভ’র সাংবাদিকের পাস ছিল, কিন্তু আমার ওসব কিছুই ছিল না। একটু ভেবে তাই না যাওয়াটাই ঠিক করলাম। শেষ পর্যন্ত শুভও অবশ্য যেতে পারেনি যানবাহনের অভাবে।
সকালে ঘুম ভাঙ্গল শুভ’র ডাকে। বলল, রাতে গোলাগুলি হয়েছে। গুলিতে আর ট্যাঙ্কের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা গেছে বেশ কয়েকজন (পরে জেনেছি চার জন)। এই প্রথম নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় বোধ করলাম। গতকাল তিল তিল করে যে আশা জাগিয়ে তুলেছিলাম এই ক্যুর ক্ষনস্থায়ীত্ব সম্পর্কে, রক্ত ঝরার ঘটনায় সে আশা, সে স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। মনে হল এ দানব সহজে বিদায় নেবে না। আরও রক্ত চাই তার, চাই আরও আরও তাজা প্রাণ। প্রথমেই যে কথাটা মাথায় এলো তা হচ্ছে, আর এ দেশে থাকা নয়, মাথায় থাক পি এইচ ডি ডিগ্রী। এবার বাড়ি ফিরতে হয়। শত উদ্বেগ, শত আশঙ্কার মধ্যেও ঠিক করলাম, বেলি দমে যাবই যাব, তা সে যত কষ্টের, যত ঝুঁকিরই হোক না কেন।
ঘরে বসে চা খাচ্ছি আর অপেক্ষা করছি কখন বারোটা বাজবে। গতকালের অভিজ্ঞতা থেকে ঠিক করেছি না খেয়ে আর নয়।
আমাদের ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিন বারোটায় খোলে, তাই এই অপেক্ষা। এমন সময় এলো আমার ক্লাসমেট লেভ। এক মুখ খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ও আরও বিষণ্ণ, আরও হতাশাগ্রস্ত। গত রাতটা ওরা কাটিয়েছে বেলি দমের চত্বরে। ওর মুখে শুনলাম গত রাতের বর্ণনা। কিছু কথা আছে যা বুঝিয়ে বলা যায় না। সেগুলো হয়তো সম্পূর্ণ বাক্যও নয়, হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা দু’
চারটে শব্দমাত্র। কিন্তু এই দু’ চারটে শব্দও কখনও কখনও পুরো কাহিনী হয়ে হাজির হয় শ্রোতার সামনে, সমস্ত ইন্দ্রিয়কে গ্রাস করে শ্রোতাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কোন সে কল্পলোকে। ধূসর, বিষণ্ণ আকাশ। সে বিষণ্ণতার আড়ালে মুখ লুকিয়েছে চাঁদ। তারারা নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে।
আর সে জল আকাশের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টি হয়ে। এই হাতাশা, এই বিষণ্ণতা, এই তারাদের চোখের জলের পটভূমিতে বেলি দমকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে একদল মানুষ। হতাশ, বিষণ্ণ, কিংকর্তব্যবিমুঢ় মানুষ। ইঁট, কাঠ, পাথরের তৈরি ব্যারিকেডের ওধারে সারি সারি ট্যাঙ্কের বহর।
এ যেন বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপে একদল মানুষরূপী
পাগল। কি এক নেশার টানে নিরস্ত্র দাঁড়িয়ে ট্যাঙ্কের মুখোমুখি। নতুন দিনের অপেক্ষায় নয়, ভোরের সূর্যের অপেক্ষায় নয়,
রাতের অন্ধকারে ভয়ঙ্কর মৃত্যুর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে সবাই।
কথা শেষ না করেই উঠে গেল লেভ।
ঘরে থাকতেই খবর পেলাম সৈন্যবাহিনীর একাংশের ইয়েলৎসিনের পক্ষাবলম্বনের কথা। কিছুক্ষণ পরে ভয়েজ অফ অ্যামেরিকা খবর দিল ইনায়েভ অ্যান্ড কোং এর পালিয়ে যাবার চেষ্টার কথা। এরই মধ্যে চলে এলো শুভ আর ভ্যালেরা। ক্যামেরার ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বেলি দমের উদ্দেশ্যে। পথে দেখালাম ট্যাঙ্ক আর সাঁজোয়া গাড়ির বহর সারি বেঁধে ফিরে যাচ্ছে নিজেদের আস্তানায়। বেলি দমের চত্বর লোকে লোকারণ্য। পশ্চিমাকাশে এক খণ্ড কালো মেঘের নীচ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে বিজয়ের সূর্য। সেই সূর্যের সোনালী আলো ধুয়ে দিচ্ছে বেলি দমের চুড়া আর মস্কো নদীর বুক। বাবাকে মনে পড়লো। মনে পড়লো ছোটবেলায় বাবার এনে দেওয়া সেই গ্লোবের কথা আর তার উপরের দিকে প্রায় পুরোটা জুড়ে লালচে বেগুনী রাশিয়ার মানচিত্র। বাঁধভাঙ্গা জলের মত হু হু করে ছুটে এলো এদেশের স্মৃতি। হায়রে রাশিয়া! হৃদয় যেন তার এক সজারুর দেহ। নানা মত নানা পথ সজারুর কাঁটা হয়ে খুঁজে ফেরে আলো। কিন্তু সবারই যে মাথায় বসে কালো বাদুড়। কালো ডানা মেলে ঢেকে রাখে আলো। দীর্ঘ নিঃশ্বাসের বিষে তাতে ধরেছে ফাটল, ঠিক বায়ুমণ্ডলে ওজোন স্তরে গহ্বরের মত, তা দিয়ে আসছে ধেয়ে শক্তি ভীষণ, বুকের উপর চেপে বসা সাম্যবাদী ভূতের পাপিষ্ঠ জীবন নাশ করবে বলে। ঐ আলোটুকুও ওরা বন্ধ করতে চায়, ট্যাঙ্কের গোলা আর মানুষের রক্তে একাকার কালো পর্দায় ঢাকতে চায় ঐ সামান্য পথটুকুও। তা কী হতে দেওয়া যায়? মানুষ কী তা হতে দিতে পারে? তাই বেলি দম ঘিরে গড়ে ওঠে ব্যারিকেড। ইট, কাঠ, গাড়ি ঘোড়ার প্রতীকী খাঁচাকে ঘিরে থাকে লক্ষ মানুষের ভালোবাসা আর ভাললাগা। চীনের প্রাচীর হয়ে সেখানে দাঁড়ায় কোটি কোটি প্রাণ। সাধ্য কি ইনায়েভ, পুগো, ইয়াজব, ক্রুচকভ আর পার্টি এলিটদের এ বাধা অতিক্রম করার? এ বাঁধ ভালবাসার বাঁধ, দানবের হাত থেকে মানুষকে, জীবনকে আর আলোকে রক্ষা করার বাঁধ।
আমি উনসত্তরের গণআন্দোলন দেখিনি। খুব ছোট ছিলাম তখন। মনে আছে সে দিনগুলোতে গতানুগতিক জায়গার পরিবর্তে বাজার লাগত বৈরাগীর ভিটায়। আমরা বন্ধুরা, যাদের বয়স ছিল চার পাঁচ বছরের মত, দল বেঁধে যেতাম সেই নতুন বাজারে। দেখি ৯০ এর এরশাদ বিরোধী গণআন্দোলন আর বিজয় মিছিল। কিন্তু ১৯৯১ এ মস্কোর বুকে বিজয়ী জনতাকে দেখলাম। মুহুর্মুহু উল্লাস ধ্বনি কাঁপিয়ে দিচ্ছিল ইউক্রাইন হোটেলের পেছনে ঝুলে থাকা কালো মেঘ, তুফান উঠেছিল মস্কো নদীর শান্ত বুকেও। এই প্রথম মানুষ বুঝেছিল কোন কুতুজভ, চাপায়েভ বা ঝুকভ নয়, এ বিজয়ের নায়ক তারা নিজেরা। এতদিন এ দেশের রাজনীতি আর সামাজিক জীবনের সর্বত্র ভিড় করে ছিল পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষেরা। এই প্রথম তাদের সাথে কাঁধ মিলালো, এমন কি তাদের ছাড়িয়েও গেল রাস্তার রকার, হোলিগানসহ সোভিয়েত যুবসমাজ।
অনেকে এ বিজয়ে সোভিয়েত মানুষের চেয়ে আর্মির ভাঙ্গনটাকে বড় করে দেখেন। লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা ঝিরিনভস্কি, যিনি ক্যুর সমর্থক ছিলেন, দাবী করেন, নির্বাচন দিলে ৭০% মানুষ গে কা চে পে সমর্থন করবে। অনেকে বেলি দম রক্ষায় এগিয়ে আসা জনতার ভিড়ে উঠতি পুঁজিপতিদের কালো টাকা আর মদের ফোয়ারা দেখতে পান। কেউ দেখে অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ, জার্মান চ্যান্সেলর কোল বা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মেজরের কালো হাত। সব কিছুর পরেও যেটা সত্য সেটা হল সামরিক জান্তার পতন আর গণতন্ত্রের বিজয়। যে জন্যে ঝরেছে অনেক তাজা প্রাণ। গে কে চে পের বিজয়ে ভবিষ্যতে প্রচণ্ড নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হবে জেনেও মস্কো, লেনিনগ্রাদসহ দেশের অনেক শহরে নেমেছে লাখ লাখ মানুষ, খনি শ্রমিকেরা গেছে ধর্মঘটে। আর্মিতে যে ফাটল ধরেছে সেটাও সাধারণ মানুষের গে কা চে পেকে প্রত্যাখ্যান করার ফলেই। শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ গে কা চে পে সমর্থন করবে বলে যে দাবী উঠেছিল, সেটা হতে পারলেও হয়নি। লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মত জাতীয়তাবাদী সংগঠন আর কমিউনিস্ট পার্টি ঘেঁষা সংগঠন বাদে কেউই গে কা চে পে সমর্থন করেনি, এমন কি কমিউনিস্ট পার্টিও নয়, যদিও তারা ভেতরে ভেতরে জড়িত ছিল ক্ষমতা দখলের এই লড়াইয়ে। বুশ, মেজর, কোল যাই করুন না কেন, করেছে প্রচলিত বিশ্ব রীতিনীতির আওতায় এবং গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই। আর বেলি দম রক্ষায় সবার আগে যে ছুটবে উঠতি পুঁজিপতিরা সেতো স্বাভাবিক। এখন পর্যন্ত দেশের পরিবর্তনে তারাই তো সবচেয়ে লাভবান। তবে বেলি দম রক্ষায় শ্রমিক, বেকার, যুবক, বৃদ্ধ – এদের উপস্থিতিও কম ছিল না। আর পয়সা বা মদের ব্যাপারে অনেকে যেটা বলেন, তাদের বলা যায়, এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় টোপটা ফেলেছিল ইনায়েভরাই। রাতারাতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম কমানো, বেতন বাড়ানোসহ বিভিন্ন লোভনীয় ঘোষণা এসেছিল তাদের কাছ থেকেই। তারপরেও মানুষ গেছে ইয়েলৎসিনের পেছেনে। বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। আর্মির বিভাজন, বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সমর্থন – এসবই এ বিজয়ের ভাগীদার। তবে এ বিজয়ের মুলে ছিল ইয়েলৎসিন, শেভারনাদজে, ইয়াকভলেভদের সময়োচিত সঠিক নেতৃত্ব আর ইয়েলৎসিন ও গণতন্ত্রের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন।
আবার ফেরা যাক বেলি দমে। শুভ, ভ্যালেরা আর আমি ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছি। তিন জনের ক্যামেরায় স্থির হয়ে আছে অনেকের মুখের অভিব্যক্তি। থেকে থেকে হৈচৈ করে উঠছে জনতা। এখানে শোনা যায় ইনায়েভদের গ্রেফতার করা হয়েছে, ওদিকে কেউ বলে এক্ষুনি গরবাচেভ আসবেন এখানে। এভাবেই মানুষ এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে। তাদের সামনে পেছনে স্টিল আর মুভি ক্যামেরা হাতে ছুটছে দেশ বিদেশের সাংবাদিকদের দল। জনস্রোতে আসে জোয়ার। প্রায় তিন ঘণ্টা এদিক ওদিক ছোটাছুটির পর সত্যিই হাঁপিয়ে উঠলাম। শুধু চলার ক্লান্তিতেই নয়, ইনফরমেশন গ্যাপেও। মনে পড়লো লেভের কথা। এ যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। সারা পৃথিবীর সমস্ত সংবাদের শিরোনামে যে ভূমি, যে উত্তাল জনসমুদ্র, তারাই সব খবর থেকে বিচ্ছিন্ন। শুধু কিছু গুজব আর রুশ সোভিয়েতের সেশনের ধারাবিবরণী থেকে ভেসে আসা কিছু কথা ছাড়া আর কোন খবর নেই। কি হল গরবাচেভের, কি হল ইনায়েভের – এ প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছিল না কেউ। আমি তাই শুভ আর ভ্যালেরাকে বললাম, “এভাবে আর কতক্ষন? আমি বরং ঘরে ফিরে বিবিসি শুনব। তোমরা যাবে?” “আর মিনিট পনের দেখি।” বলল শুভ। এর মধ্যেই সূর্যটা হেলে পড়েছে। অনেকে পা বাড়িয়েছে বাড়ির দিকে। বিজয়ের আনন্দে উৎফুল্ল কেউ কেউ সরাচ্ছে ব্যারিকেড। এমন সময় বেলি দম থেকে আহ্বান এলো সবাই যেন চলে না যায়। আরও একটা রাত যেন মানুষ কাটিয়ে যায় এ চত্বরে। এখনও আশঙ্কা আছে ইউক্রাইন হোটেলের দিক থেকে স্পেশাল বাহিনী আক্রমন চালাতে পারে বেলি দমে। মানুষের মধ্যে আবার চাঞ্চল্য। বিভিন্ন ব্রিগেডে নাম লিখিয়ে ফেলল অনেকেই। তারা বিভিন্ন রাস্তা রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়ে চলে গেল নির্দিষ্ট স্থানে। তাদের চোখে মুখে দৃঢ়তার ছাপ, আগামী কালের সূর্যকে স্বাগত জানানোর সংকল্প।
অনেক রাত পর্যন্ত বসে রইলাম টিভির সামনে। শুনাম বিবিসির খবর। শেষ পর্যন্ত অবশ্য গরবাচেভের ফেরা না দেখেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ২২ আগস্ট ঘুম থেকে উঠেই টিভি চালিয়ে বসে রইলাম খবরের অপেক্ষায়। ১২ টার দিকে মিটিং শুরু হবে বেলি দমের সামনে। এদিকে আমাকে আবার দুটোর সময় দেখা করতে হবে সুপারভাইজারের সাথে। তাই মিটিং এ আর যাওয়া হল না। টিভির সামনেই ঠায় বসে রইলাম। সভার শুরুতেই রুশ সোভিয়েতের চূড়ায় ওড়ানো হল তিনরঙ্গা রাশান পতাকা। ইয়েলৎসিন আন্তরিক অভিনন্দন জানালেন সবাইকে। বেলি দমের সামনের চত্বরের নামকরণ করা হল “স্বাধীন রাশিয়া চত্বর।” মস্কোর মেয়র পপভ ইয়েলৎসিনকে মিনিন ও পঝারস্কির মতই মস্কোর সম্মানিত নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করলেন। বক্তব্য রাখলেন আলেক্সাদার ইয়াকভলেভ, এদুয়ারদ শেভারনাদজেসহ অনেকেই। প্রায় এক মিলিওন মানুষের বিজয়োল্লাসে মুখরিত হল মস্কোর আকাশ বাতাস।
এরপরই শুরু নতুন নাটকের। ইয়াকভলেভ যেমন বলেছিলেন, “এখন প্রচুর বীর জন্ম নেবে। আমাদের সতর্ক হতে হবে।” ঠিকই তাই। নিত্যদিন বীরেরা জন্মাতে লাগলো। মস্কো, লেনিনগ্রাদসহ বিভিন্ন শহরে ভেঙ্গে পড়তে লাগল কমিউনিস্ট নেতাদের স্ট্যাচু, ভেঙ্গে পড়তে লাগল সোভিয়েত ইউনিয়নও। মানুষ স্বাধীনতা চাইলে দেশ স্বাধীন হবেই, এক্ষেত্রে বলার কিছুই নেই, যদিও মন থেকেই চাইছিলাম শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন দেখতে। তবে স্ট্যাচু ভাঙ্গার ব্যাপারটা অত ভাল চোখে দেখতে পারি না। ভালো হোক, মন্দ হোক এরা সময়ের সাক্ষী, ইতিহাসের অংশ। ইতিহাস তো কাগজের উপর পেন্সিলের লেখা নয় যে রাবার দিয়ে ঘষে তুলে দেওয়া যাবে। তাছাড়া আপাতদৃষ্টিতে বিপ্লবী বলে মনে হলেও এ সবই নাশকতামূলক কাজ। গণতন্ত্রীদের মনে রাখতে হবে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অজুহাতেই ক্যু হয়েছিল এবং অনেক মানুষ মনে মনে তাকে সমর্থনও জানিয়েছিল অন্তত আইন শৃঙ্খলা ফিরে আসবে এই আশায়। স্ট্যাচু ভাঙ্গার মত কাজকে অথবা পার্টি অফিস ভাঙচুর করার মত ক্রিয়াকলাপকে বরদাস্ত করলে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটবে। যারা সুযোগসন্ধানী তারা এ সুযোগটা নিতেও পারে। মানুষ কিন্তু ধ্বংসের জন্য লড়াই করেনি, লড়াই করেছিল নতুন কিছু সৃষ্টির জন্যে। মানুষের এ লড়াকু মনোভাবকে সৃষ্টির কাজে যত বেশি লাগান যাবে, ব্যক্তি ও বাক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ ততই নিষ্কণ্টক হবে।
(৩)
সোভিয়েত
ইউনিয়ন আজ অতীত। অন্তত তার শারীরিক উপস্থিতি আর নেই। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সবাইকে হতবাক
করে দিয়ে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেছিলেন রাশিয়া, ইউক্রেইন আর বেলোরুশিয়ার তৎকালীন
তিন নেতা। তারা তখন কতটুকু দেশের আর দেশের মানুষের কথা ভেবেছিলেন আর কতটুকু
নিজেদের ক্ষমতার কথা সেটা তারাই জানেন। রাশিয়ায় প্রথমেই যেটা শুরু হয় সেটাকে বলা
চলে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিত্তি সমূলে উৎপাটন করা। শত ভুলের পরেও সোভিয়েত ব্যবস্থা যে
অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে তুলেছিল দেশে আর যার উপর দাঁড়িয়ে গণতান্ত্রিক রাশিয়া নতুন
সময়ের নতুন চ্যালেঞ্জের উত্তাল সমুদ্রে পাড়ি জমাতে পারত নতুন বিপ্লবের কাণ্ডারিরা
সেটাকে ধ্বংস করতে উঠেপড়ে লাগে। জলের দামে বিক্রি করে দিতে থাকে কল-কারখানা। ধীরে
ধীরে বন্ধ হতে থাকে কল-কারখানা। প্রথমবারের মত এ দেশে দেখা যাবে বেকার মানুষ।
বেকারত্বের সাথে সাথে বাড়বে অপরাধ। না, মানুষ এই গণতন্ত্রের জন্য সেদিন প্রাণ
দেয়নি, মানুষ এই গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেনি। এরপর এদেশের মানুষ দেখবে পশ্চিমা দুনিয়ার হাসি আসলে হাসি ছিল না, সেটা ছিল হায়েনার দাঁতের ঝলকানি। বিভিন্ন সময়ে রাশিয়াকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভেঙ্গে ন্যাটো কড়া নাড়বে রাশিয়ার দোর গোঁড়ায়,
কারণে অকারণে আরোপ করবে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা। একদিন এদেশের অধিকাংশ মানুষ দেখবে স্বপ্ন সেটা শুধুই স্বপ্ন,
বাস্তবটা অনেক কঠিন। এ এক কঠিন বাস্তবতা যাকে মেনে নেওয়া আরও কঠিন।
একটা আনেকদত ছিল। এক বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করল
- সুখ কী?
- সুখ? এটা এ দেশে জন্ম নেওয়া।
- আর দুঃখ?
- দুঃখ? এটা এমন সুখ অর্জন করা।
হ্যাঁ, এ দেশের অধিকাংশ মানুষের জন্য গণতন্ত্রের রঙিন স্বপ্ন একই সাথে তাদের সুখ আর দুঃখ।
আমরা যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে আসি কমিউনিস্ট মানেই ছিল সম্মানিত লোক। যদিও পরে বুঝেছি
ব্যাপারটা তেমন নয়। সুযোগ সুবিধা আদায়ের জন্য অনেকে পার্টিতে নিজেদের নাম লিখিয়েছে। আজ
অনেক দেশেই লোকজন সরকারি দলে নাম লেখায়। দোষ যত না সাধারণ মানুষের তার চেয়ে বেশি
সিস্টেমের। যদি সিস্টেম শুধুমাত্র রাজনৈতিক মত পার্থক্য থাকায় বা পার্টি মেম্বার
না হওয়ায় যোগ্য লোককে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে তাহলে শুধু যোগ্যরাই যে পার্টি
মেম্বার হবে তা নয়, এই সুযোগে অনেক সুবিধাবাদী পার্টিতে নাম লেখাবে। ফলে এতে
পার্টি ও দেশ দুটোই ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তারপরেও তখনও পর্যন্ত পার্টি মেম্বার কোন গালি
ছিল না। কিন্তু গত শতকের নব্বুইয়ের দশকে পার্টি মেম্বার বলতে গেলে গালিতে পরিণত
হয়। মানুষ ঝাঁক ধরে পার্টির মেম্বারশিপ ত্যাগ করতে শুরু করে। তখন ফ্যাসন ছিল
ডেমোক্র্যাট আর লিবারেলদের। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই এরা নিজেদের এমন ভাবে পচায়
(আসলে ওদের মূল লক্ষ্যই ছিল দেশ ভাঙ্গা, সোভিয়েত ব্যবস্থা যাতে আর কখনও মাথা তুলে
দাঁড়াতে না পারে সেটা নিশ্চিত করা) লিবারেল মানে হয়ে দাঁড়ায় প্রায়
বিশ্বাসঘাতক।
মনে পড়ে ১৯৮৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে আসার ঠিক পরের দিনগুলোর কথা। আমি এসেছি বাংলাদেশের এক ছোট্ট গ্রাম থেকে। অনেক সময় এমনকি মস্কোয়ও এমন সব টুকুটাকি জিনিস পাওয়া যেত না যার অভাব কখনও আমার গ্রামেও অনুভব করিনি। অবাক হতাম। শুনেছি সামান্য জিনসের জন্য মানুষ পুরো মাসের বেতন দিয়ে দিতে রাজী। সেটা ছিল কালো বাজারে। নিজে এ কাজ করিনি, তাই এটা সত্য হলেও একেবারেই শোনা কথা। তখন মনে হত কেন মানুষ সামান্য জিনসের জন্য দেশ, আদর্শ সব বিক্রি করতে রাজি। এখন ভাবি, কেন সরকার জিনস কিনে এদেশের মানুষের কাছে বিক্রি করত না। তাহলে কালো বাজারি বন্ধ হত, মানুষের হাতেও অতিরিক্ত টাকা থাকত না আর মানুষও হয়তো এভাবে নিজেদের আদর্শ ভুলে যেত না। কেন যেন মনে হয় পুঁজিবাদকে ঘৃণা করে সমাজতন্ত্রের কাণ্ডারিরা পুঁজিকেই ঘৃণা করেছে। বিপ্লবের পর ধনীদের টাকা পয়সা গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে কিছুদিন চলা যায়, তবে নতুন করে পণ্য উৎপাদন না করলে, সেটা থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি না করলে জনগণকে বেতন দেওয়া যায় না আর প্রতিনিয়ত সেই উদ্বৃত্ত মুল্যের পরিমাণ না বাড়লে জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নত করা যায় না। আসল কথা কী পুঁজিবাদী, কী সমাজতান্ত্রিক - উভয় সমাজে পুঁজিই মূল চালিকা শক্তি। পুঁজির বিকল্প পুঁজিই। সব কিছুর মতই পুঁজিও পরিবর্তনশীল। দক্ষ হাতে সে বৃদ্ধি পায়, অদক্ষ হাতে কর্পূরের মত উবে যায়। তবে যেকোনো দেশের দক্ষ সরকারের কাজ দেশের পুঁজি বৃদ্ধি করা। আর সেই উদ্বৃত্ত মূল্য কীভাবে জনগণের মধ্যে বণ্টন করা হবে তার উপর নির্ভর করে ব্যবস্থা পুঁজিবাদী হবে নাকি সমাজতান্ত্রিক। এই সহজ সত্যটা ঠিক মত অনুধাবন না করার কারণে বিশাল পটেনশিয়াল থাকার পরেও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারেনি।
রাশিয়ার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে এখানে মানুষ সব সময়ই শক্তিশালী শাসক পছন্দ করে। সেটা ইভান দ্য টেরিবল হোক, পিটার দ্য গ্রেট হোক, স্ট্যালিন হোক আর পুতিন হোক। হতে পারে এটাই এ দেশের, এ সমাজের বিশেষত্ব। এটা ভালও নয়, মন্দও নয়। এটা বাস্তবতা। মনে রাখতে হবে এসব দেশ হাজার বছর ধরে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেলেও যুগ যুগ ধরে কিছু কিছু ট্র্যাডিশন বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সেটা আমরা আমাদের দেশেও দেখতে পাব। সাংবিধানিক ভাবে অনেক প্রথা উঠিয়ে দিলেও আমাদের সব দেশে সেসব বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। এখানেও তাই। হয়তো আমেরিকা, ক্যানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জীল্যান্ড ইত্যাদি হাতে গোনা কয়েকটি দেশ সব নতুন করে শুরু করতে পেরেছে। তবে তার মুল্যটা কী? স্থানীয় জনগণকে বলতে গেলে নিশ্চিহ্ন করে একেবারে নতুন করে শুরু করেছিল তারা। আর এরা কারা? মুলত নিজ দেশের প্রান্তিক মানুষ যাদের কোন নৈতিকতা ছিল না। তাদের একটাই লক্ষ্য ছিল যে করেই হোক সম্পদশালী হওয়া। অসীম আকাশ তাদের সীমানা। কিসের? লোভের। সেটাই তাদের স্লোগান। এমনকি আজও। তাই সেখানে ব্যক্তি মানুষ সবার উপরে। তবে সে শুধু নিজেই নিজের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণকারী। ফলে পশ্চিমের সাথে এদের যে যাবে না সেটা জানা কথা। আসলে যখন থেকে রাশিয়া ক্যাথলিক না হয়ে প্রভস্লাভ হয় তখন থেকেই সমস্যার শুরু। আমরা শুধু ক্রিস্টান আর মুসলিমদের মধ্যে ক্রুসেডের কথা শুনেছি, কিন্তু পশ্চিমা ক্রিস্টানরা এর চেয়েও বেশিবার আক্রমণ করেছে প্রভস্লাভ রাশিয়াকে। তাই এই দুই সভ্যতার দ্বন্দ্বের ইতিহাস সুপ্রাচীন। আর এ কারণেই পশ্চিমারা এদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার পরিবর্তে গণতান্ত্রিক রাশিয়া তাদের লক্ষ্য ছিল না, তাদের লক্ষ্য নো রাশিয়া। সেটা এখনও আছে। মানুষ সেটা বোঝে বা বলা যায় বিশ্বাস করে। আর এ কারণেই ঠাণ্ডা যুদ্ধের পর যখন সত্যিকার অর্থেই একটা নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার সুযোগ ছিল পশ্চিম সেটা গ্রহণ করেনি। আজ আমরা যা দেখছি সেটা সেই রাজনীতির ফল।
সোভিয়েত
ইউনিয়নের পতনের কারণ নিয়ে এখনও আলোচনার শেষ নেই। যদিও আমেরিকা সহ পশ্চিমা বিশ্বের
চাপ, আন্তর্জাতিক বাজারে ইচ্ছে করে তেলের দাম হ্রাস করা এসব সোভিয়েত অর্থনীতিকে
অচল করে তার পতন ত্বরান্বিত করে, তবে মূল কারণ যে ছিল আভ্যন্তরীণ সে ব্যাপারে
সন্দেহ নেই। এ নিয়ে বিভিন্ন মতামত আছে। অনেকের ধারণা এর পেছনে রয়েছে গরবাচভের অদক্ষতা। তিনি উঠে এসেছিলেন স্তাভ্রপলের মত প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। কৃষি প্রধান এ এলাকায় বড় হয়ে এত বড় পার্টির দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতা – কোনটাই তাঁর ছিল না। তিনি মস্কো আসেন আন্দ্রপভের হাত ধরে, কিন্তু বেশি দিন তাঁর ছত্রছায়ায় থেকে মস্কোর রাজনীতি শেখার আগেই আন্দ্রপভের মৃত্যু ঘটে। এছাড়াও তিনি ছিলেন স্ত্রী রাইসা মাক্সিমভনার প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল। এমনকি ক্যুর পরে ফরস থেকে ফেরার পর সরাসরি রুশ পার্লামেন্ট বেলি দমে আসার পরিবর্তে তিনি অসুস্থ স্ত্রীর সাথে নিজ দাচায় ফিরে যান। নিয়তির নির্মম পরিহাস এই যে স্ত্রীর প্রতি অতিরিক্ত আনুগত্যের ফলে শেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাই সাম্রাজ্য হারান। প্রথমে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন আর অক্টোবর বিপ্লবের পর সপরিবারে প্রাণ হারান। একই ভাবে স্ত্রীর প্রতি অতি অনুরক্ততার কারণে গরবাচভ দেশ হারায়। সে সময় এ দেশে একটা জোক চালু ছিল যে গরবাচভ নয়, রাইসা মাক্সিমভনাই দেশ চালান। এছাড়াও অনেকের ধারণা সে সময় যদি পার্টি ও সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কিছু লোক জরুরি অবস্থা ঘোষণা না করে ২০ আগস্ট বিভিন্ন রিপাবলিকের মধ্যে পূর্ব পরিকল্পিত চুক্তি সই করার সুযোগ দিতেন ঘটনা অন্য দিকে মোড় নিতে পারত। তবে গরবাচভ আর ইয়েলৎসিনের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব যে দেশের মেরুদণ্ড চূড়ান্ত ভাবে ভেঙ্গে দিয়েছিল সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এর উপর ছিল ইতিমধ্যে পাওয়া স্বাধীনতার স্বাদ। তবে এ সবই সম্ভব হয়েছে রাজনৈতিক অব্যবস্থার কারণে। একদলীয় শাসন এক ব্যক্তির হাতে অপরিসীম ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্তু সেই ক্ষমতাকে দেশের উন্নতির কাজে লাগানোর জন্য যে মানসিক দৃঢ়তা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দরকার সেটা সবার থেকে না। রাজনৈতিক মনোপলি সব দেশেই
দুর্নীতির জন্ম দেয়, জন্ম দেয় জবাবদিহিতার অভাবের। অনেকেই বলেন
মাল্টিপার্টি সিস্টেম যেহেতু সমাজতন্ত্রের অস্তিত্বকে হুমকির সম্মুখীন করত, তাই এক
পার্টি অথবা বহু পার্টির এক কোয়ালিশন, যা ছিল পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে,
সমাজতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত। কিন্তু কথা হল যদি সমাজতন্ত্রকে সাংবিধানিক ভাবে
প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশের মত যেসব দল এই সংবিধান মেনে চলে
তারাই রাজনীতি করার অধিকার পায়, তাহলে সমস্যা কোথায়? গণতন্ত্রের সাথে তো
সমাজতন্ত্রের সমস্যা নেই, সমস্যা পুঁজিবাদের সাথে জাতীয় সম্পদ বন্টনের প্রশ্নে। কিন্তু
যদি দেশে একাধিক রাজনৈতিক দল থাকত আর নির্বাচনে ক্ষমতা হারানোর সম্ভাবনা থাকত,
তাহলে সিপিএসইউ এত দুর্নীতিগ্রস্থ হতে পারত না। সে জবাবদিহিতার পথ থেকেও সরতে পারত
না। তবে এই সমস্যা শুধু সমাজতন্ত্রের নয়। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশেও ক্ষমতাসীন দল
তাদের শাসন দীর্ঘস্থায়ী করতে বিরোধী দলগুলোকে দুর্বল করে। এর ফলে ক্ষমতাসীন দলের
সাময়িক লাভ হলেও গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলাফল স্বৈরাচারের আবির্ভাব, অরাজনৈতিক
পরিবেশের জন্ম। অনেকের ধারণা গরবাচেভ যদি চীনের মত রাজনৈতিক পুনর্গঠনের পরিবর্তে
অর্থনৈতিক পুনর্নির্মাণের কাজ শুরু করতেন ফলাফল অন্য রকম হত। এটা ঠিক যে রাজনৈতিক
স্বাধীনতা দেবার ফলে কমিউনিস্ট পার্টির ভিত্তি নড়ে ওঠে, দেখা দেয় রাজনৈতিক শূন্যতা।
এমতাবস্থায় অর্থনৈতিক রিফর্ম মুখ থুবড়ে পড়ে অথবা তাকে সাবোটেজ করে দেশে অস্থিতিশীল
পরিবেশ তৈরি করা হয়। তবে আসল কথা হল একদলীয় শাসনই সোভিয়েত ইউনিয়নে বিভিন্ন সমস্যার
জন্ম দিয়েছে আর পার্টিকেও করে তুলেছে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র। তাই পরবর্তী
পর্যায়ে যদি সোভিয়েত টাইপ কোন সমাজ গড়ার প্রচেষ্টা নেওয়া হয় এক দলীয় শাসনের
ব্যাপারটা বিশেষ ভাবে খতিয়ে দেখতে হবে।
সোভিয়েত ইউনিয়নকে রুখতে গিয়ে পুঁজিবাদী বিশ্ব নিজেদের আভ্যন্তরীণ অবস্থার পরিবর্তন
করতে, সমাজতন্ত্র না হলেও অনেক সামাজিক সংস্কার করতে
বাধ্য হয়। অর্থাৎ পুঁজিবাদী বিশ্ব কিছুটা হলেও সমাজতন্ত্রের দিকে এগোয়। অন্য দিকে সোভিয়েত
ইউনিয়নের পতনের পরে রাশিয়াও পুঁজিবাদী পথে চলতে শুরু করেছে যদিও এখনও পর্যন্ত সামাজিক
রাষ্ট্রের অনেক কিছুই রয়ে গেছে। যদি নব্বইয়ের দশকে
আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার শিল্প ধ্বংস না করে তার অর্থনীতি গড়ে তুলতে
সাহায্য করত, আমার বিশ্বাস আজকে আবার নতুন করে ঠাণ্ডা যুদ্ধ শুরু হত না, বিশ্বে
বিভিন্ন ধরণের ধর্মীয় মৌলবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠত না।
আজ সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, নেই সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী রাশিয়া। কিন্তু এত কিছুর পরেও পুঁজিবাদী রাশিয়া পশ্চিমের বন্ধু হতে পারেনি। এদেশের মানুষ এক সময় ভেবেছিল যুদ্ধ বিধ্বস্ত জাপান আর জার্মানিকে যেভাবে সাহায্য করেছিল, আমেরিকা রাশিয়াকেও সেভাবেই সাহায্য করবে। এমনকি রাশিয়ার যে সংবিধান সেটা আমেরিকান স্টাইলেই লেখা হয়েছিল। তারপরেও শেষ রক্ষা হয়নি। পাকিস্তানের যেমন নিজের অস্তিত্বের জন্য শত্রু হিসেবে ভারত থাকা দরকার,
আমেরিকারও তেমনি দরকার শত্রু
– সেটা সোভিয়েত ইউনিয়ন হোক, চীন হোক, রাশিয়া হোক। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় রাশিয়াই সবচেয়ে কম্ফারটেবল, অন্তত সেক্ষেত্রে অনেক সহযোগী পাওয়া যায়, বিশেষ করে ইউরোপ, সমাজতান্ত্রিক ব্লকের দেশগুলো আর কিছু কিছু এক্স সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র, বিশেষ করে যারা রুশ বিরোধিতাই তাদের জাতীয় আদর্শ মনে করে। তবে সে কথা এখন থাক। শত হলেও আমরা সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে কথা বলছি।
এই তো সেদিন টোকিও অলিম্পিক
শেষ হল। বন্ধু সুমিত অলিম্পিকের পদক তালিকা দিল। এবার রাশিয়া স্বর্ণ পদকে পঞ্চম আর মোট পদক সংখ্যার দিক থেকে তৃতীয় স্থান পেয়েছে। আর সেটাও প্রচুর চাপের মধ্যে থেকে, কোন কোন ক্ষেত্রে বাজে বিচারের শিকার হয়ে। তবে যেটা লক্ষ্য করার মত তা হল, সোভিয়েত রিপাবলিকগুলোর মোট পদক সংখ্যা অন্যদের ছাড়িয়ে গেছে। একটা দেশ তিরিশ বছর নেই, তবে তারা যে ইনফ্রাস্ট্রাকচার, বিশেষ করে খেলাধুলার ক্ষেত্রে, গড়ে দিয়ে গিয়েছিল, সেটা আজও কাজ করছে, কাজ করেছে ১৯৯১ সালের পর থেকে প্রতিবারই। এর সাথে যদি সেসব খেলোয়াড় এই ভূখণ্ড ছেড়ে অন্য দেশের হয়ে লড়াই করছে তাদের পদক যোগ করা হয়, ফারাক আরও বাড়বে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল সমালোচনা ছিল বাক স্বাধীনতার অভাব, ভিন্ন মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা।
বর্তমান পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা কী দেখি? হ্যাঁ, ভিন্ন মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা। সেটা যেমন নিজেদের দেশে তেমনি অন্য
দেশে। যার ফলে মিসাইল ভরা জাহাজ আর ফাইটার বিমান ছুটছে দেশ থেকে দেশান্তরে পশ্চিমা
ধাঁচের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। আবার নিজেদের স্বার্থে এরাই বিভিন্ন স্বৈরতান্ত্রিক
দেশকে দিব্যি সার্টিফিকেট দিচ্ছে গণতন্ত্রের। সোভিয়েত সমাজের মতই এখন বিভিন্ন দেশে
বিরোধীদের নামে শুধু অভিযোগই আনা হচ্ছে না, তাদের অপরাধী বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। বর্তমানে
আমেরিকার পাবলিক ও প্রাইভেট কারাগারে যত বন্দী সোভিয়েত গুলাগেও সেটা ছিল না। বড় বড়
মিডিয়া গ্রুপ নিজেদের ইচ্ছেমত সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য বলে প্রচার করছে। খুব
ভাল করে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হবে না যে সোভিয়েত সমাজের সবচেয়ে খারাপ দিকগুলো এখন পশ্চিমা
বিশ্বে অনুকুল পরিবেশে বিস্তার লাভ করছে ঠিক যেমন করে রাশিয়ায় ডালপালা মেলছে পশ্চিমের
দুর্বৃত্ত পুঁজিবাদ।
সেই দেশ আজ নেই, তবে সে বেঁচে আছে হাজার মানুষের অন্তরে,
বিশেষ করে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে যারা এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নে লেখাপড়া করেছে। দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যেসব দেশ উপনিবেশিক শোষণের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে সোভিয়েত
ইউনিয়ন বেঁচে সেসব দেশের মানুষের হৃদয়ে। সোভিয়েত বিস্তারকে রোধ করার জন্য পুঁজিবাদী
বিশ্ব তাদের শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি করতে বাধ্য হয়েছে। সমাজতন্ত্রের আদলে গড়ে উঠেছে
ওয়েলফেয়ার স্টেট। এসবও আমাদের বারবার মনে করিয়ে দেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা। আর আছে
স্পুটনিক, গ্যাগারিন আরও কত কী!
গত শতকের নব্বুইয়ের দশকে মস্কোয় একটা চুটকি চালু ছিল
অক্টোবর বিপ্লবের সময় রাস্তায় শোরগোল শুনে এক অভিজাত বৃদ্ধা তার পরিচারিকাকে জিজ্ঞেস করলেন
- মাশা, দেখ তো বাইরে এত হৈচৈ করে কারা? ওরা কী চায়?
- এরা এ দেশের শ্রমিক কৃষক। ওরা চায় সব মানুষ সমান হোক।
- আমরাও তো সেটাই চাই। আমরাও চাই ওদেরও আমাদের মত ঘরবাড়ি থাক। আমাদের মতই স্বাচ্ছন্দ্য থাকুক ওদের ঘরে ঘরে। কিন্তু এভাবে ভাংচুর করে সবাইকে গরীব বানিয়ে ওদের কী লাভ?
আমরাও যেন সব ছোট গাছে জল ঢেলে ওদের বড় করে সাম্য আনি, বড় বড় গাছগুলো কেটে নয়। ওয়েলফেয়ার স্টেটগুলো অন্তত সমাজের নীচু তলার মানুষকে উপরে আনার চেষ্টা করছে যদিও সবাইকে সমান করা তাদের এজেন্ডায় নেই। আমরা ওদের কাছ থেকে হয়তো পথ নির্দেশ পেতে পারি।
মস্কো, ১৫ – ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৯১
দুবনা, ১১ – ১৬ আগস্ট ২০২১
লেখাটি তিন পর্বে প্রগতির যাত্রী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
প্রথম পর্ব ১৯ আগস্ট
https://www.progotirjatree.com/2021/08/19/%e0%a6%86%e0%a6%97%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%9f%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%a6%e0%a6%bf%e0%a6%a8%e0%a6%97%e0%a7%81%e0%a6%b2%e0%a6%bf-%e0%a7%a7-%e0%a6%a4%e0%a6%bf%e0%a6%b0%e0%a6%bf%e0%a6%b6/?fbclid=IwAR0zPfr1U56cX8Vkhp-TWyVEuw1AlAIy3YSc6w0aqIOvfznTwbuQlsDZDHo
Comments
Post a Comment