জিপি ৫ ও কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা

গত কয়েক দিন হলো ফেইসবুকে ঝড় বইছে, ঘূর্ণি ঝড় - ঘূর্ণি ঝড় কেননা চারিদিক থেকে হাজার রকম মতামত উছলে পড়ছে। সবাই যেখানে বলছে - আমিই বা কেন চুপ করে বসে থাকি - তাই এই লেখা। আর অপ্রাসঙ্গিক - কেননা অনেক কথায় আসবে যেটা ঘটনাটার সাথে সরাসরি যুক্ত নয়।

অনেক পড়ে একটু বিরক্ত হয়েই ভিডিও টা দেখালাম। অবাক হলাম, একটু দুখ:ও পেলাম। সন্দেহ নেই - দেশে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করা দরকার - আর সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই ছিল এই প্রতিবেদন। কিন্তু তার সাথে সাথে এইযে কিছু ছাত্র-ছাত্রীকে যার পর নাই লজ্জ্যা দেয়া হলো, তা কি ঠিক? ওরা কিন্তু পড়াশুনা করেই জিপি ৫ পেয়েছে - যদি যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আসে তবে সেটা ওদের কাছে নয়। কিন্তু রিপোর্ট দেখে মনে হবে কিছু অজ্ঞ আর মুর্খ ছেলে মেয়ে জিপি ৫ পেয়েছে যা পাবার যোগ্যতা তাদের ছিল না। আর তাদের এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী তারা নিজেরা আর শিক্ষা মন্ত্রী, সরকারসহ সবাই, কিন্তু এই যে আমাদের সন্তানরা এমনটা হচ্ছে তাতে যেন আমাদের কোনই দায়-দায়িত্ব নেই।   এক লেখায় দেখালাম, এক জন সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তাদের মুখগুলো ব্লার করা উচিত ছিল কিনা? একশ বার ছিল। কেননা জিপি ৫ পেয়ে ওরা দোষ করেনি, অন্যায় করেনি। তবে এখানে যে প্রশ্নটা আসা উচিত ছিল, সেটা কারো লেখায় দেখি নি, যদিও এটাও ঠিক আমি খুব বেশী লেখা এ ব্যাপারে পড়িও নি। আর সেটা হলো, ওই যে কিছু প্রশ্ন - বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে যা ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, মানে আমাদের স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস কবে সেটা তো বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকেরই জানার কথা, তার জন্য জিপি ৫ দরকার নেই - এ দেশে জন্ম নেওয়া, এ দেশে বড় হওয়াই যথেষ্ট। এ শিক্ষা তো স্কুল-কলেজের না, এটা পারিবারিক শিক্ষা। এ থেকে কি এটাই প্রমানিত হচ্ছে না, আমরা ছেলে মেয়েদের যে নুন্যতম পারিবারিক শিক্ষা দেবার কথা ছিল, সেটা দিচ্ছি না। কেন? ইদানিং বিভিন্ন দেশে, ইউরোপে ইতিহাস নতুন করে লেখার চেষ্টা হচ্ছে, আর নতুন করে কিছু লিখতে হলে আগে দরকার পুরানো শিক্ষা ভুলে যাওয়া বা ভুলিয়ে দেয়া। যদি জেনারেসনের পর জেনারেসন আমাদের জাতীয় দিনগুলি না জানে, ইতিহাস না জানে, তবে একদিন একাত্তরের গণহত্যাও ভুলে যাবে - আমরা কি জাতি হিসেবে, দেশ হিসেবে সেটাই চাইছি? দেশে তো আজ বিজয় মেলা হয়, জাতীয় দিবস গুলো নিয়ে অনেক অনুষ্ঠান হয়, তবে কি বুঝতে হবে বড় বড় বুলিই সব, ভেতরে সব প্রাণহীন? অবশ্য যে দেশে জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে শিক্ষককে অপমানিত করা হয়, সেখানে এর বেশি কিই বা আশা করা যায়? আমার খুব ইচ্ছে করছে জানতে ওই সাংবাদিক বা আমাদের মিডিয়াগুলো ইতিহাস সংরক্ষণে, আমাদের গৌরবময় ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে নিয়ে যেতে কি কি করেছেন?
ছাত্রদের ভবিষ্যত নিয়ে শুধু যে বাংলাদেশেই সবাই চিন্তিত তা নয়, রাশিয়ায় থাকার কারণে জানি, এখানেও কতটা চিন্তিত স্থানীয় জনগণ। ভোগ বিলাসের মার্কিন আদর্শ আজ এত বেশি সবাইকে পেয়ে বসেছে, যে সবাই শুধু চাইছে কিভাবে বৈষিকভাবে ভালো থাকা যায়। আমেরিকা খুব ভালো একটা উপায় আবিষ্কার করেছিল (মনে হয় নিজের দেশ থেকে সর্বহারা বিলোপ করতে, যাতে তারা বিপ্লবের ডাক না দেয়) - তা হলো ক্রেডিট দেয়া। যথেষ্ট আয় না করেও ক্রেডিট নিয়ে মোটামুটি ভালই থাকা যায়, সেই সাথে সর্বহারার খাতা থেকে নিজের নামটাও কেটে ফেলা যায়। ছাত্রদের দুর্ভাগ্য যে, ক্রেডিটে জ্ঞান দেয়া যায় না। আমরা বাবা-মারাও তো শধু রেজাল্ট চাই, সন্তান জানুক না জানুক, পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেলেই হলো। আর তাই চারিদিকে রেজাল্ট-ওরিয়েন্টেড পড়াশুনা, গল্প না পড়ে, গল্পের উপর করা প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করা বা পদার্থবিদ্যা বা গণিতের কোনো সুত্র না বুঝে ফর্মুলায় ফেলে শুধু উত্তর বের করা। তাই বর্তমান অবস্থার জন্য আমরা সবাই দায়ী। আমাদের সময়ে (আমি স্কুল শেষ করেছি ১৯৮০ তে) কুইজ ছিল না। মস্কো আসার পর এমন গল্প শুনেছি, কুইজ সিস্টেম চালু হবার পর এক ছেলে ইন্টারভিউ দিতে গেলে ওকে যখন বাবার নাম জিজ্ঞেস করে, ও বসে ছিল কি কি অপসন আছে সেটা পাবার আশায়। গল্পটা হয়তো বানানো, তবে অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়, ভালো নম্বর পাবর জন্য ঠিক যেটুকু জানা দরকার, আমরা তার বাইরে আর কিছু করতে রাজি নই। এখানে নিজের জীবনের একটা ঘটনা মনে পরে গেল। তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র।প্রথম সেমিস্টারের পরীক্ষা দিয়ে এসেছি। মেকানিক্স। ভালো লিখেছি, মৌখিক ও ভালো দিচ্ছি। টিচার বললেন কি চার দেব? আমি বললাম ৫। উনি আরেকটা প্রশ্ন করলেন - উত্তর জানা ছিল, তবে ভিসকোসিটি শব্দ ভুলে গেছিলাম - কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না, উনি যে মুহুর্তে ৪ লিখলেন, ঠিক তখনই মনে পড়ল, বললাম, কিন্তু উনি বললেন = দেরী হয়ে গেছে। বিকেলে আমরা আড্ডা দিতাম, আমি, রানা, পার্থ আর বিশ্বরূপ দা। বিশ্বরূপ দা জিজ্ঞেস করলে বললাম, ৪ পেয়েছি, তবে বিষয়টা আমি জানি। ও বলল, জানিস যখন, তখন ৫ পেতে অসুবিধা কোথায়? গল্পটা এজন্যেই বলা - যে আমরা যেন জানতে শিখি, জ্ঞান অর্জন করতে শিখি, ভালো জানলে নম্বর এমনিতেই আসবে। তাছাড়া বাস্তব জীবনে এই সব নম্বর হয়ত কোথাও ভর্তি হতে বা চাকরি পেতে সাহায্য করে, কিন্তু একবার জয়েন করলে লোকজন আর নম্বর দেখে না, কে কতটুকু কাজ করতে পারে সেটাই দেখে। আচ্ছা, এই যে কুইজ সিস্টেম, এটা কি TOEFL বা এ জাতীয় কোনো টেস্ট কে অনুসরণ করে বাংলাদেশে এসেছে?
আরো একটা ব্যাপার, এখন দেশে প্রতি অলিতে গলিতে কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছড়াছড়ি। প্রচুর প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান দেখি। ইটা একান্তই ব্যবসায়িক। কবে যে আমাদের শিল্পপতিরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরী করবেন, যেটা ইউরোপ-আমেরিকা বা ইন্ডিয়াতে আছে? আসলে শধু রাজনৈতিক স্বাধীনতা বা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করলেই হয় না, বর্তন যুগে পরিপূর্ণ জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, খেলাধুলা অনেক বিষয়েই উন্নত হতে হয়। আর এটার জন্য শুধু সরকারকেই নয়, সবাই মিলেই কাজটা করতে হয়। আশা করি এই ঘটনাটা যেমন ছাত্রদেরকে উদ্বুদ্ধ করবে ক্লাসের বাইরের কিছু জিনিস জানতে, তেমনি সাংবাদিকদের শেখাবে সঠিক ভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে। আর আমাদের শেখাবে সন্তানদের শুধু নম্বরের পেছনে তারা না করে তাদের মধ্যে সত্যিকার জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা জাগিয়ে তুলতে। আর শিক্ষা মন্ত্রনালয় ও সরকারকে ভাবতে বাধ্য করবে শিক্ষা ব্যবস্থা নতুন কে ঢেলে সাজাতে।
 দুবনা - মস্কো, ০৩ জুন, ২০১৬ 

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি