বিশেষজ্ঞ

বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে বাড়ছে গবেষণার ক্ষেত্র আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিশেষজ্ঞের দল। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে সংখ্যাটা গাণিতিক হারে বাড়লেও সমাজবিজ্ঞান ও রাজনীতিতে তাদের সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে, মানে ব্যাঙের ছাতার মতো। যার ফলে আজকাল কেটলির সুইচ অন করতে বা জামা কাপড় আয়রন করতেও ভয় পাই, পাছে কেটলি বা আয়রন থেকে বিশেষজ্ঞরা বেরিয়ে জ্ঞান দিতে শুরু করে।

যাকগে বিশেষজ্ঞের কথায় আসা যাক। এর একটা পোশাকী সংজ্ঞা আছে - বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী। আমি অনেক আগেই নিজের জন্য একটা সংজ্ঞা ঠিক করেছি - বিশেষ ভাবে অজ্ঞ। যেহেতু আমি গবেষনা করি, তাই ছেলে মেয়েরা অনেক সময় জিজ্ঞেস করে -
"পাপা, তুমি কি অনেক জানো?"
আমি বলি, "আমি জানি যে আমি যত জানি, তার চেয়ে অনেক বেশী জানিনা।"
"তা কি করে হয়?"
আমি ওদের বিভিন্ন গল্প বলি।
"এই ধর, আমাদের ঘর। আমরা কখনো এর থেকে বাইরে যাইনি। একটু চেষ্টা করলে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ঘরের কোথায় কি আছে, আমরা জানতে পারবো। এরপর বাইরে গেলে দেখবো আমাদের ফ্লোরে আরো কয়েকটা ঘর আছে। যদিও আমরা জানি ঐ ঘরগুলো একই রকম, তার কোথায় কি আছে আমরা ঠিক বলতে পারবো না।
তার মানে ঘরের বাইরে এসে আমরা অনেকটা বেশি জানলাম, জানলাম শুধু আমাদের ঘরটাই শেষ নয়, এরকম আরো অনেক ঘর আছে। আবার একই সাথে আমরা এটাও জানলাম, আমাদের আরো অনেক কিছু অজানা রয়ে গেলো।"
"ছোট বেলায় তোমরা যখন শুধু বর্ণমালা বা দশ পর্যন্ত গুনতে শেখেছিলে ভাবতে সব শেখা হয়ে গেছে। কেউ এলেই তাদের শোনাতে কত কিছুই তোমরা জানো। আর এখন, যখন তোমরা জানো ঐ বৰ্ণমালা দিয়ে লাখ-লাখ শব্দ তৈরি করা যায়, মোটামোটা বই লেখা যায়, তখন কিন্তু আর মনে করো না সব জানা হয়ে গেছে।"
"আসলে নতুন জ্ঞান আমাদের প্রশ্ন করতে শেখায় - আরো আরো জানতে আগ্রহী করে তোলে।"
তাই দেখা যাচ্ছে বিশেষজ্ঞর সংজ্ঞাও আপেক্ষিক - কোনো বিশেষজ্ঞ নিজেকে ভাবে সে সবজান্তা, কেউ নিজেকে আবিষ্কার করে অজানার হিমালয়ের পাদদেশে যেখান থেকে শুরু হয় তার অন্তহীন নতুন যাত্রা।
ছাত্রজীবনে প্রায়ই সব মুখস্ত করতাম বা মূল ফর্মুলাগুলো মনে রাখতাম যেটা ব্যবহার করে অন্য অনেক কিছু পাওয়া যেতে পারে। এখন প্রায় প্রতিদিনই যখন কয়েক শ' পেপার বেরোয়, তখন আর সব মনে রাখা যায় না। তাই সবাই চেষ্টা করে অন্তত কোথায় কোন জিনিষটা পাওয়া যেতে পারে সেটা মনে রাখতে। কোনো কলিগ "এই জিনিসটা জানো কিনা না” জিজ্ঞেস না করে জানতে চায়, “বলতে পারো এই ব্যাপারটা কোন বইয়ে বা কোন পেপারে পাওয়া যেতে পারে।"
তত্ত্বিয় পদার্থবিদ্যায় এটা কাজ করলেও বাস্তব জীবনে, বিশেষ করে রাষ্ট্র চালনায় এই পদ্ধতি কাজ করে না। তাই যখন শুনি আমাদের মন্ত্রীরা একের পর এক বিরোধী দলের মধ্যে বর্তমানে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন খুনের ক্লু খুঁজছেন, বেশ অবাক লাগে। তাই যখন শুনি আমাদের মন্ত্রীরা একের পর এক বিরোধী দলের মধ্যে বর্তমানে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন খুনের ক্লু খুঁজছেন, বেশ অবাক লাগে। অবাক লাগে এই জন্যে যে, তারা এসব বলে যতটা না খুনী ধরার চেষ্টা করছেন, তার চেয়ে বেশি বিরোধী দলগুলোর ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চাইছেন। আজকাল এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পরীক্ষিত সৈনিকদের ভারতের দালাল বলে আখ্যায়িত করতে পিছু পা হচ্ছেন না।
যদি খুনিরা ওখানে থেকে থাকে, তাহলে ধরুন ওদের, ধরে উপযুক্ত শাস্তি দিন। সেটা না করে শুধু মাত্র দোষারোপ করলে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, এটা কি অপরাধীদের ধরার চেষ্টা, নাকি আবারো ভোটের রাজনীতি করা। খুন করার দায়ে ঐ দলগুলোকে আপনারা শুধু দোষী হিসেবে সন্দেহই করতে পারেন, তবে জনগণকে সঠিক নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হবার জন্য আপনাদের সন্দেহ না, দোষী সাব্যস্ত করার অধিকার জনগণের আছে, আর সেটা যদি জনতা করে, তখন যেন জনগণকে দোষ দেবেন না।
কারা খুন করছে এটাকে গবেষণার ব্যাপার না করে কেন এই খুন গুলো হচ্ছে সেদিকটা বিশ্লেষণ করে শ্রেয়। খুনীরাতো আর রাখ-ঢাক করছে না, দিনের বেলায় খুন করছে, দ্বায়িত্ব নিচ্ছে - তাই ওদের ব্যাপারে আলোচনা শুধু ওদের পিআর কেই সাহায্য করবে, আর নতুন নতুন যুবক ওদের দলে যোগ দেবে। এর চেয়ে বরং ওদের ধরার ব্যবস্থা করে, ক্রস রোডে ক্রস ফায়ারে নয়, আদালতে ওদের মুখোশ খুলে দিন, বিচার করুন - তাহলে যেমন জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে, খুনের রাজনীতিও মানুষের কাছে ধিকৃত হবে। শুধু মাত্র এভাবেই দেশকে স্বাভাবিক ট্র্যাকে ফিরিয়ে না সম্ভব।
ও হ্যা, আরেকটা কথা, যারা ভাবেন ওদের সাথে আঁতাত করে খুন-খারাবী কমানো যাবে, তারা বোকার স্বর্গে বাস করেন। মনে আছে ইরানের কথা? তুদেহ পার্টি (ইরানের কম্যুইনিস্ট পার্টি) কিন্তু মৌলবাদীদের সাথে এক হয়েছিল শাহের বিরুদ্ধে, পরে ওদের সবাইকে শুলে চড়ানো হয়েছিল। একটু সামরিক শাষনের কথা মনে করুন। ভাবুন কেমন ছিল জিয়া বা এরশাদের সামরিক শাসনের সময়। মিটিং, মিছিল, টি-স্টলে আড্ডা - সব তো শিকেয় উঠেছিল। কিছু করতে গেলেই আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে শ্রীঘরে ঢুকিয়ে দিতো। আপনাদের হাত ধরে এই মৌলবাদীরা ক্ষমতায় এলে আপনাদের আর আইন-শৃঙ্খলা বিরোধী বলবে না, বলবে ইসলাম বিরোধী, ইসলামের শত্রু। আর তখন ধর্মভীরু বাংলার মানুষ আর আপনাদের পাশে এসে দাঁড়াবে না। তাই চারা গাছে জল ঢেলে মহীরুহ তৈরি না করে গোড়াতেই ওদের সমূলে উৎপাটন করুন, তাতে নিজেও বাঁচবেন, আম-জনতাও বাঁচবে।
ভুলেই গেছিলাম, এই যে রানা দাশগুপ্ত কে দেশদ্রোহী করার জন্য উঠে পরে লেগেছেন, আপনার কি জানা আছে এটা আপনার থেকে জামাত-শিবির আর স্বাধীনতা বিরোধীরা আরো বেশি করে চায়? আজ রানা দাশগুপ্তের বিচার চান, কাল রানা দাশগুপ্তকে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তা করার অভিযোগে এই আপনিই শেখ হাসিনার বিচার চাইবেন, তাই না কি? অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে সর্ষের মধ্যে ভুত না ভুতের মধ্যে সর্ষে এটা বুঝাই কষ্ট। তবে আশা একটাই - যে দেশে বাহান্নর সূর্য উঠেছে, উঠেছে একাত্তরের সূর্য - যেখানে হাজারো বিপত্তির মধ্যেও এ দেশের মানুষ সময় মতো ঠিক রুখে দাঁড়িয়েছে - এদেরকে দুদিন দাবানো যায়, দশ দিন দাবানো যায়, কিন্তু চিরকালের জন্য দাবানো যায় না।

দুবনা , ২১ জুন, ২০১৬

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি