হাতের পাঁচ আঙ্গুল
১৯৮৯ সাল। মাস্টার্স শেষে করে দেশে বেড়াতে গেছি। ছিলাম প্রায় সাড়ে তিন মাস। রাশিয়ায় আসার আগেই ছাত্র ইউনিয়ন আর খেলাঘর আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলাম। তাই ছুটিতে এসেই খেলাঘর, ছাত্র ইউনিয়ন, সিপিবি, ক্ষেতমজুর সমিতি, কৃষক সমিতির বিভিন্ন প্রোগ্রামে প্রায়ই যেতাম। গল্প-গুজব আড্ডা সব কিছুর কেন্দ্রে ছিল রাজনীতি - বাম রাজনীতি আর সোভিয়েত দেশ। এই সময়ই একদিন বাড়িতে এলেন সামসু চাচা - খুব ভালো মানুষ।
বললেন, "আচ্ছা বাবা, এইযে তোমরা সব সময় সমাজতন্ত্র সমাজতন্ত্র বলো, তা মানুষ কি কখনো সব সমান হয়? এইযে হাতের পাঁচ আঙ্গুল - এরা তো কখনো এক সমান হয় না, তাহলে তোমরা সব মানুষকে সমান করতে চাও কেন? এটা কি কখনো সম্ভব?"
"সমান মানে তো আর কেটে কেটে সমান করা নয়, সমান মানে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা। এই যে আপনার কয়েক জন ছেলে মেয়ে। আপনি তো তাদের সমান ভাবেই ভালোবাসেন, সবার জন্যই সমান সুযোগ তৈরির চেষ্টা করেন, যাতে তারা সফল মানুষ হতে পারেন। তার পরেও কেউ বেশি সফল হয়, কেউ কম। কাউকে নিয়ে আপনি বেশি গর্ব বোধ করেন, কাউকে নিয়ে কম। কিন্তু ভালোবাসেনতো সবাইকে একই রকম। তাইনা?"
"তাহলে তোমাদের রাশিয়ায় ঈশ্বর বিশ্বাস করেন কেন? আল্লাহর দুনিয়ায় তো সবাই সমান।"
"ব্যাপারটা মনে হয় বিশ্বাস অবিশ্বাসের নয়, রাজনীতিতে। আপনিই বলেন, ঈশ্বর সর্ব শক্তিমান। তাহলে উনি চাইলেই সবাইকে সমান করতে পারেন, চাইলেই সবাইকে বলতে পারেন এক ধর্মে বিশ্বাস করতে। তার পরেও এতো ধর্ম কেন? আর ঈশ্বর নিজে যেটা করছেন না, এই মানুষ ধর্মের নামে কেন একে অপরকে মারছে কাটছে? তার মানে হলো একদল মানুষ ধর্মের নামে আরেক দল মানুষকে শোষণ করছে, তাদেরকে অধিকার বঞ্চিত করছে। রাশিয়া বা সমাজতন্ত্র এই শোষণটার বিপক্ষে।"
"তাই যদি হয়, তবে রাশিয়ায় মানুষকে ধর্ম পালন করতে দেয় না কেন?"
"কথাটা কিন্তু ঠিক নয়। ওখানেও গির্জা আছে, মসজিদ আছে। লোকজন যায়, তবে খুব বেশি একটা না। আবার দেখেন, এই আমাদের দেশে লোকজন ধর্ম বিশ্বাস করে, মুসলমানরা রোজা রাখে, নামাজ পড়ে, হিন্দুরা পূজা-পার্বন করে। আপনি নিজেই বলেন ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ আর ভগবানে কোনো পার্থক্য নেই। আবার এরাই কিন্তু মারামারি-হানাহানি করে। সোভিয়েত দেশে কিন্তু বিভিন্ন ধর্মের মানুষ আছে। তারা কিন্তু এই নিজে মারামারি করে না। কারণ ধর্ম তারা রাষ্ট্র থেকে আলাদা করতে পেরেছে। ওরা মনে করে মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করলো কি না করলো তার থেকেও বড় কথা মানুষ তার পাশের মানুষটার প্রতি কেমন ব্যবহার করলো। আপনার এক সন্তানকে কষ্ট দিয়ে অন্য সন্তানকে কেউ যতই আদর করুক - এতে যেমন আপনি খুশি হতে পারেন না, ঠিক তেমনি ভাবে তার এক সৃষ্টিকে আঘাত দিলে ঈশ্বরেরও তা ভালো লাগার কথা নয়।"
"হ বাবা, কথাতো ঠিকই কও, তার পরও ধর্ম-কর্মটা থাকলে ভালো হয়।"
Comments
Post a Comment