আমাদের একদিন
গতকাল ২
আগস্ট বউ এসেছিলো কয়েক ঘণ্টার জন্য। আসার কথা ছিল মঙ্গলবার রাতেই। তাই বেশ যত্ন করে খিচুড়ি রান্না করলাম। আসলে গত শনিবার বঙ্গবন্ধু পরিষদের পিকনিকে গিয়ে রাতের খিচুড়িটা এত পছন্দ
হয়েছিলো যে এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগটা হাতছাড়া করতে মন চাইল না। সকালে দিদি ফোন করলো, নতুন করে জেনে নিলাম কেমনে কি করতে হবে। বাকী শুধু চালডাল মাংস এসব এক সাথে মশলা দিয়ে মাখিয়ে তেলে জলে ছেঁড়ে দেয়া। যেমন ভাবা তেমন কাজ।
মহাবিশ্বের
উৎপত্তি নাকি চরম বিশৃঙ্খলা থেকে। আমারও তাই। কোন কাজ খুব বেশি যত্ন করে করতে গেলেই যত ঝামেলা। মঙ্গলবারও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সকালে সেভাকে খাবার দিয়েই অফিসে
চলে গেছিলাম, তাই ওর মতামত জানা হয় নি, তবে রাতে যখন আবার সেই খাবার দিলাম,
বললো
-
পাপ, তুমি স্পেশালি এরকম করে
রান্না করেছ?
-
কেন, কি হোল?
-
না, এই যে সব গলে জাউএর মত হয়ে
গেছে।
-
ইচ্ছে করে ঠিক এমনটি করিনি।
-
অসুবিধা নেই। খেতে ভালই লাগছে। তবে এতটা নরম না হলেই ভালো হতো।
সেভা
কখনো আমার রান্না নিয়ে ঝামেলা করে না। মার রান্না এদিক-ওদিক হলে খায়
না, তবে আমার রান্না অন্য কথা। খাবার আমার মাঝেমধ্যেই পুড়ে যায়। এটা যখন লিখছিলাম, মুরগী পুড়তে শুরু করেছিলো। রক্ষা করা গেছে। তাই কখনো খাবার পুড়ে গেলে বলি
-
স্যরি সেভ, খাবারটা একটু পুড়ে
গেলো।
-
তাতে কী? জানই তো আমি পোড়া খাবার
পছন্দ করি।
তবে
আজকের কথা আলাদা। আমাদের দু জনের স্নায়ু যুদ্ধ চলছে দু’দিন হোল। রোববার রাত ৪ টার দিকে উঠে দেখি
সেভা কম্পিউটারে বসে আছে।
-
যা, ঘুমুতে যা। অলরেডি আগস্ট মাস। একমাস পরে স্কুল। এখন থেকেই সকালে ওঠার অভ্যেস কর।
-
তোমার কোন চিন্তা করতে হবে না। স্কুল খুললে আমি ঠিক ঠিক সকালে উঠবো। সারা দিন তো আমার করার কিছুই নেই। এখানে বন্ধু বান্ধব নেই। আমার জন্য বরং দিনটা ঘুমিয়ে কাটানোই ভালো।
মেজাজটা
যদিও খারাপ হোল, বললাম না কিছুই। মনে পড়লো
নিজের স্কুল জীবনের কথা। বাবা প্রতি রাতেই কয়েকবার বলতেন
-
বাবা, ভাত ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। খেয়ে নাও।
-
এই তো খাচ্ছি। এই অংকটা করে নেই।
কত সকালে
যে রাতের খাবার রান্না ঘরে ফিরে গেছে! আমার মনে হয় গেম না খেলে সেভা যদি অংক কষতো
বা বই পড়তো তবে এতটা মেজাজ খারাপ হতো না আমার। কিন্তু কে জানে, আমার ছোট বেলায় যদি এসব থাকতো, আমিও হয়তো ওর মত কম্পিউটার
নিয়েই সময় কাটাতাম!
সোমবার
সকাল থেকে কোন কথা বলিনি। খাবার দিয়ে চলে গেছি। রাতে ও নিজেই আমার ঘরে এসে হাজির
-
পাপ!
-
কি হোল আবার?
-
তুমি অযথাই রেগে আছো। আমি তো বললামই স্কুল খুললেই সব আগের মত হয়ে যাবে।
-
তাই! কিন্তু শুধু না খেলে বই
পড়লেও তো পারিস।
-
আমার ভালো লাগে না বই পড়তে।
-
আমারও অনেক কিছুই ভালো লাগে না।
শুধু যা ভালো লাগে তাই করলেই কি চলবে?
-
তোমার তো এখন ছুটি, সেপ্টেম্বর
পর্যন্ত। তুমি অফিসে যাও কেন? তোমাকে তো এর এজন্য পয়সা দেয় না।
-
যাই, কারণ আমার কাজ করতে ভালো
লাগে। ছুটির সময় আমি অনেক বেশি কাজ করি। তা আমি অফিসে গেলে তোর সমস্যা কোথায়?
-
এই দেখ, ছুটির সময় সবাই রেস্ট
নেয়, ঘুরতে যায়, আর তুমি অফিসে যাও – তোমার ভালো লাগে। আমারও ঠিক তেমনি ছুটির সময় গেম খেলতে ভালো লাগে। তোমার কেন এতে এত সমস্যা হয়?
-
সমস্যা আমার নয়, তোর। এখন থেকে কাজ না শিখলে পরে খাবি কি করে?
-
কাজ করি না কে বললো। আজ আমি তোমার ঘর আর রান্না ঘর পরিষ্কার করেছি। তুমি তো দেখলেই না।
-
তাই! যাকগে কাল মামা আসবে। নিজের ঘরটা পরিষ্কার করিস। যা, এখন আইকাকে নিয়ে ঘুরে আয়।
এ এক বড়
সমস্যা। ছেলেমেয়েদের একটু ধমক দিলে, কটু কথা বললেই সাথে সাথেই
জবাবদিহি করতে হবে কেন এটা বললাম। তাই কিছু বলার আগে কারণদর্শাও
নোটিশের উত্তরটা তৈরি রাখতে হয়। গুলিয়া
প্রায়ই বলে
- ছেলেমেয়েরা আজকাল একটুও কথা শোনে না।
- ওদের কাজই বাবামার কথা না শোনা। আমরাই কি আমাদের বাবামাদের
কথা শুনতাম। তাহলে তো আমার এ দেশে থাকা হতো না, তোমাকে বিয়ে করাও হতো না।
- তোমার যত কথা। ছেলেমেয়েদের শাসন করতে হয়।
- কর। কে মানা করে?
আসলে আমি
দেখেছি ওদের কিছু না বললেই আর কথা না শোনার প্রশ্ন আসে না। তবে এটাও ঠিক, সেভা বা অন্যেরা যখন মস্কো থাকে আর আমি দুবনায় – ওদের কিছু
করতে না বললেও চলে। একসাথে থাকলেই ইচ্ছা অনিচ্ছায় কিছু উপদেশ দিতেই হয়, কথা
বলতেই হয় আর এ থেকেই কথা শোনা না শোনার ব্যাপারটা চলে আসে।
রাতের
খাবার খেয়ে টিভি দেখছি আর নেট করছি। গুলিয়া সাধারণত আসে রাত ১০ টার ট্রেনে বা ১১
টার বাসে, বাসায় এসে পৌঁছুতে পৌঁছুতে মাঝ রাত পেরিয়ে যায়। তাই ভাবলাম ১১ টার পরে
ফোন করে জানবো আসছে কি না। কিন্তু তার আগেই ফোন এলো। গুলিয়ার ফোন।
-
ফোন করছ না যে?
-
বা রে, ফোন করলে বলতে তোমাকে তৈরি
হতে ডিস্টার্ব করছি, আবার ফোন করিনি বলে কেন করিনি সেই প্রশ্ন। তুমি কি বামুনের
মেয়ে যে আগে হাঁটলেও দোষ, পেছনে হাঁটলেও দোষ? যাকগে, কখন পৌঁছুবে?
-
আমি আজ আসবো না। হঠাৎ মাথা ঘুরতে
শুরু করলো। খুব দুর্বল লাগছে। কাল সকালে আসবো।
-
ঠিক আছে, আসার আগে কল দিও।
সকালে ওর
ফোন এলো ১০ তার পরে, বুঝলাম আসতে আসতে ১২ টা বাজবে। বাঁচা গেলো। এখন তিন জনে মিলে
খিচুড়িটা শেষ করা যাবে। ফ্রিজ থেকে খিচুড়িটা বের করলাম, সাথে মাছ। ইদানিং কালে এক
অভিনব পদ্ধতিতে মাছ/মাংস রান্না করি। সেভার খুব পছন্দ। একটু জলে লবন আর হলুদ ছেঁড়ে
আগুনে বসাই, এর পর ওতে মাছ বা মাংস ছেঁড়ে দিই। ওগুলো সেদ্ধ হয়ে গেলে তাতে তেল আর একটু
গোল মরীচ দিয়ে ভাজি। এতে পোড়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। রান্নাটা সহজ আর সব চেয়ে বড়
কথা সেভার পছন্দ। আমার ভালো লাগে না, তবে সব সময় সব কিছু ভালো লাগতেই হবে এমন তো
কথা নেই।
এর
মধ্যেই আমি ভোল্গায় সাতার কেটে এসে সেভাকে নিয়ে খেয়ে ফেললাম। তার কিছুক্ষন পরে
আমাদের ফ্ল্যাটের কাজের তদারকি করে বাসায় এলো গুলিয়া, প্রায় ২ টার দিকে। একা নয়।
সাথে কুকুর। নতুন।
-
এটা আবার কি? কোত্থেকে?
-
আমাদের এক পরিচিতা মহিলা
হাসপাতালে কোমায় আছে। তাই আপাতত নিয়ে এসেছি। ও সুস্থ হয়ে উঠলেই নিয়ে যাবে।
-
আর যদি সুস্থ না হয়?
-
থাকবে আমাদের বাসায়। প্লাস মাইনাস
একটা কুকুর তো আর আবহাওয়া তৈরি করবে না।
-
হুম। সংখ্যালঘু ট্যাগটা মনে হয়
কখনই আমার পিছু ছাড়বে না।
-
মানে?
-
মানে আর কি? আমার বাবা মা ছিলেন
ব্রিটিশ ভারতের নাগরিক। তারপর দেশ ভাগ হোল ধর্মের ভিত্তিতে যাকে বলা হয় দ্বিজাতি তত্ত্ব।
তাঁরা রয়ে গেলেন পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হয়ে। পরে পাকিস্তান ভাঙ্গলো, জন্ম নিলো
বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীনতার তিন বছর পরে এই আগস্ট মাসেই শেখ মুজিবুর রহমানকে
হত্যা করে দেশ আবার ফিরে গেলো পুরানো পথে। আবার নতুন করে আমরা সংখ্যালঘু হলাম।
-
কিন্তু তার সাথে কুকুরের সম্পর্ক
কি?
-
এখন বাসায় আমরা মানুষ ৬ জন, কুকুর
১০ টা। যদি কোন দিন ওরা ভোটাধিকার দাবী করে আমি আবার সংখ্যালঘুদের দলে পড়ে যাবো,
তাই বলছিলাম আর কী!
-
তোমার কল্পনা শক্তির বাহবা না
দিয়ে পারা যায় না।
-
কল্পনা নয়। মানুষ যেভাবে অমানুষ
হচ্ছে, তাতে এক সময় কুকুররাই অনেকের চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য হবে।
দেখতে
দেখতে ৪ টা বেজে গেলো। আমরা হাঁটতে গেলাম ভোল্গার তীরে আইকা আর তোষাকে নিয়ে। মস্কোর
বাস পৌনে সাতটায়, তাই ঘণ্টা দুই হাঁটা যাবে।
-
গতকাল যা ভয় পেয়েছিলাম। বিউটি
পার্লারে হথাত মাথা ঘুরে উঠলো। ওলগা কি একটা ওষুধ দেবার পর কিছুটা সুস্থ হলাম।
ঠিক
বুঝলাম না, এটা অসুস্থতা সম্পর্কে বলা নাকি চুল কাটাটা কেমন হয়েছে সেটা জানতে চাওয়া। আমার
অবশ্য মনেই নেই আগেরটা ঠিক কেমন ছিল।
-
কুকুর বিড়াল নিয়ে অযথা টেনশন না
করলেই তো হয়। এজন্যেই মাথা ঘোরায়। দাঁড়াও
একটা ছবি তুলে নিই।
ওকে বাসে
ওঠিয়ে দেবার আগে গেলাম খোলা বাজারে বাবুশকাদের কাছ থেকে বেরি কিনতে। আমি সাধারণত
একটু দামাদামি করি আর কিনি পুরোটাই। ও বাবুশকাদের সাথে দামাদামি করে না,
ছেলেমেয়েরাও পছন্দ করে না। চার লিটার মত বিভিন্ন বেরি কিনে অর্ধেক নিয়ে গেলো মস্কো
আন্তন, মনিকা আর ক্রিস্টিনার জন্য, বাকী অর্ধেক রেখে গেলো সেভার জন্য।
বাসায়
ফিরে সেভাকে নিয়ে দোকানে গেলাম। প্যাকেট হোল ৫ টা। সেভা নিজেই করলো। আমার হাতে দুটো
হাল্কা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ও নিলো ভারী তিনটা। এবার ঘরে ফেরার পালা। আমি বেরিগুলো ধুয়ে ওকে দিলাম।
-
তুই কি রাতে খাবি?
-
না, আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। এই
বেরিগুলো খেলেই পেট ভরবে।
আজকাল
যখন আলসেমি লাগে, তখন ওকে এই প্রশ্ন করি। ও বুঝতে পারে, তাই আমার মনোমত উত্তরই
দেয়। তাছাড়া আমি ওকে নিয়ে দোকানে গেলে সব সময়ই ওর মনোমত কিছু হাবি আর কিছু জাবি
মানে হাবিজাবি কিনে দেই। মস্কোয় ওদের এসব মার কাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে খেতে হয়। আমার
এখানে কোন বাঁধা নিষেধ নেই। গুলিয়া দেখলে বলে
-
এসব কিনে দাও কেন? ছেলেমেয়েদের
মারতে চাও না কি?
-
এসব যারা খায় না তাদের মধ্যে যদি
একটাও অমর বের করতে পার, আর কিনবো না। তাছাড়া
তোমাদের স্বর্গে যেসব খাবারের কথা বলে, তা নাকি কখন নষ্ট হয়না, তার মানে জেনেটিক্যালি
মডিফাইড। তাই বরং এখানেই অভ্যেসটা করে
যাও। নইলে স্বর্গের খাবার আর মুখে উঠবে না, না খেয়ে মরতে হবে।
-
চুপ কর তো। কান ঝালাপালা করে
ফেললে।
বসে চা
খাচ্ছিলাম এমন সময় গুলিয়ার ফোন এলো।
-
আমি এইমাত্র বাসায় এসে পৌঁছুলাম।
প্রচণ্ড টায়ার্ড লাগছে।
-
তাহলে আর কি? শুয়ে পড়। শুভ রাত্রি!
দুবনা, ৩
– ৫ আগস্ট ২০১৭
Comments
Post a Comment