শোকের দিন, শোকের মাস

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস, আগস্ট মাস শোকের মাস। এখনও মনে পড়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কথা। সকাল বেলায় প্রাইভেট পড়তে গেছি মাখন মাস্টারমশায়ের কাছে। সেই ছোট বেলা থেকেই ওনাকে দেখে এসেছি আমাদের ভাইবোনদের ইংরেজি পড়াতে। এখন অবশ্য বয়েস হয়েছে। স্কুলের ছেলেরা নতুন মাস্টারদের কাছে যায়। আমি যাই যতটা না পড়তে তার থেকে বেশি এই বৃদ্ধ বয়েসে তাকে সাপোর্ট করতে। বাবামা তাই চাইতেন। বরাবরের মত গেছি প্রাইভেট পড়তে। সাড়ে আঁটটার দিকে পড়া শেষ করে বাড়ি ফিরছি স্নান খাওয়াদাওয়া করে স্কুলে যাবো বলে। প্রাইমারী স্কুল পাড় হয়ে যখন বাজারে এলাম, দেখি আনন্দদা আর খীরোদের দোকানের সামনে বেশ ভীড়। থমথমে ভাব সবার মুখে।
-   কি হল আবার?
ঐ সময় এলাকায় প্রায়ই ডাকাতি হোত, সন্ত্রাসীদের হাতে মারাও যেত অনেকেই। আর বাজার ছিল এসব নিয়ে আলচনার উত্তম জায়গা।
-   শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে।
-   কি সব বাজে বকছো। হতেই পারে না।         
মুখে একথা বললেও বুকটা দুরদুর করে উঠলো।
-   যাকগে, স্কুলে যেতে হবে। চলি।
আশা-নিরাশায় দুলতে দুলতে হাঁটতে শুরু করলাম বাড়ির দিকে। কত কথা যে মনে পড়লো এই সময়টাতে।
আমাদের বাড়ি তরা। ঢাকা-আরিচা রোডের পাশে। এই সেদিন পর্যন্তও ঢাকা-আরিচা রোড ছিল ঢাকার সাথে পদ্মার ওপারের মানে উত্তরবঙ্গ (রাজশাহী বিভাগ) ও দক্ষিণ বঙ্গের (খুলনা বিভাগ) যোগাযোগের একমাত্র রাস্তা। শেখ মুজিব যখন পদ্মার ওপারে বা টুঙ্গিপাড়া যেতেন, এ পথেই যেতে হত তাঁকে। ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে তরার ব্রীজ হবার আগে পর্যন্ত ফেরী করেই পাড় হতে হতো কালীগঙ্গা নদী। গ্রাম ভেঙ্গে মানুষ যেত তাঁকে দেখতে, ঠিক যেমন যেত রাজ্জাক-কবরীসহ দেশের খ্যাতিমান নায়ক-নায়িকারা স্যুটিং করতে এলে। আমি ববাবরই আত্মকেন্দ্রিক ছিলাম, তাই যাওয়া হয়নি কোন দিন। ঐ সময়টা বসে বসে বই পড়তাম বা একা একাই খেলতাম কিছু একটা। এখন বাড়ি ফেরার শেখ মুজিবকে দেখতে না যাওয়ার জন্য মনঃকষ্ট হল, যদিও আশা ছিল, এ সবই মিথ্যে। বাড়ি গিয়ে দেখব সবাই বিবিসি ধরার চেষ্টা করছে, আর ওখান থেকে বলছে এ সবই গুজব, সবই বানোয়াট।
বাড়ি ফিরে সবাইকে পেলাম রেডিওর চারিদিকে হুমড়ি খেয়ে বসে থাকতে। এক ধরনের অবিশ্বাস, এক ধরনের হতাশা সবার চোখে-মুখে। আমাদের বাড়িতে তখন কেউ সক্রিয় রাজনীতি করত না তবে শুধু ভোট দেয়াই নয়, নির্বাচনের সময় শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারনায় নামত সবাই। দেশভাগের পর অনেক রিস্ক নিয়েই থেকে গিয়েছিলো আমাদের পরিবার, শুধু আমরা কেন গ্রামের প্রতিটি হিন্দু পরিবারই। বিভিন্ন নির্বাচনে ভোট দিয়ে শেখ মুজিবকে সমর্থন করেছে তারা, এ জন্যে কষ্টও কম পোহাতে হয়নি। একাত্তরে ভিটে ছাড়া হয়েছে গ্রামের প্রতিটি হিন্দু পরিবার, প্রান দিয়েছে বেশ কয়েকজন। তার পরেও আস্থা হারায়নি নেতার প্রতি। যুদ্ধের পরে শুন্য থেকে নতুন করে শুরু করেছে জীবন। আবার নতুন আঘাত, আবার অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা। আমার এই ১১ বছরের জীবনে বাড়িতে কেউ মারা যায়নি, যুদ্ধের আগে এক দিদিমা মারা গেলেও তিনি এতই বৃদ্ধা ছিলেন যে আমি তাঁকে চিনেই উঠতে পারিনি। তাই শেখ মুজিবকে হারানোর ব্যথা ছিল স্বজন হারানোর ব্যথা। আমার বিশ্বাস বাড়ির সবাই ব্যাপারটা এ ভাবেই নিয়েছিল। সবাই আশা করছিলো খালেদ মোশারফ কিছু একটা করবেন। সেটা যখন হল না, অপেক্ষা করছিল নতুন কোন নেতার। যতদুর মনে আছে, মোশতাক বা জিয়ার শাসনকে আমাদের বাড়িতে কেউই  কখনও মন থেকে গ্রহন করিনি।                       
অন্যদের কথ বলতে পারবো না, তবে আমার কাছে শেখ মুজিব ছিলেন হেরো যেমনটা  দেশের আপামর মানুষের কাছে ছিল উত্তম কুমার। আমার বুদ্ধি হবার পর থেকে পূর্বপাকিস্তানে রাজনীতি ছিল অন্যতম প্রধান বিষয়। ঊনসত্তর, একাত্তর এসব এখন চোখের সামনে ভাসে। বই পড়লে দেখি ১৯৪৭ থেকে একাত্তর পর্যন্ত পুরো সময়টাই ছিল রাজনৈতিক তরঙ্গে উত্তাল আর এই চব্বিশ বছরের একটা ব্যাপক অংশ জুড়ে এই উত্তাল সাগরে দেশ নামক নৌকার অন্যতম কাণ্ডারি   ছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ডাকাত আর সন্ত্রাসীদের ভয়ে গ্রামের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মানুষের ঘরের মেঝেতে রাতের পর রাত কাটানোর পরেও সেই ছবি ম্লান হয়নি। এরপর স্কুল শেষে কলেজে ভর্তি হওয়া, বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া, সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়তে আসা – নতুন করে সেই সময়কে মূল্যায়ন করতে শেখা। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে গান্ধী, নেহেরু, সুভাষ বোস, মৌলানা আজাদের লেখা, বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী আর জিন্নাহর জীবনী, বিভিন্ন লেখকদের লেখা ভারত বিভাগের ইতিহাস পড়ে শুধু যে অনেক প্রশ্নের উত্তরই পেয়েছি তা নয়, একটার পর একটা নতুন প্রশ্ন জন্ম নিয়েছে মনে, কোন কোন ঘটনাকে মনে মনে  অন্যখাতে প্রবাহিত করে দেখতে চেষ্টা করেছি দেশের ইতিহাসে সেই সিমুলেশনের পরিণাম। অবিভক্ত ভারতে বলা হত, “আজ বাংলা যা ভাবে, আগামী কাল সারা ভারতবর্ষ তা করে।“ সেই সময় কী সাহিত্য, কী সংস্কৃতি, কী বিজ্ঞান, কী সমাজ সংস্কার সব দিকেই বাংলা ছিল কয়েক কদম এগিয়ে। আর যদি তাই হয়, অবিভক্ত ভারতের রাজনীতি উত্তর প্রদেশের পরিবর্তে বাংলারই তো ডোমিনেট করার কথা ছিল আর উদীয়মান ও চ্যারিশম্যাটিক  রাজনীতিবিদ হিসেবে শেখ মুজিবের শুধু বাংলাদেশ কেন দিল্লীর মসনদে আরোহণ করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। হলো না। দেশ ভাগ হোল। আজ পেছন দিকে তাকালে দেখি যে উদ্দেশ্য নিয়ে দেশভাগ হোল তার একটাও বাস্তবায়িত হয়নি। সাম্প্রদায়িকতা তখন যেমন ছিল, এখন ঠিক তেমনটাই আছে। শুধু তাই হয় দুটো ধর্মীয় গোষ্ঠীর লড়াইয়ের সাথে যুক্ত হয়েছে দুই বা ততধিক দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধিতা। ব্রিটিশ ভারতের মুল রাজনৈতিক দলগুলো সর্বোতভাবে চেষ্টা করেছে স্বাধীনতা সংগ্রামকে অহিংস রাখতে। সিপাহী বিদ্রোহের পর কিছু সন্ত্রাসী ঘটনা আর আজাদ হিন্দ ফৌজের কথা বাদ দিলে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই মূলত অহিংস  ছিল যদিও হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের পারস্পারিক বিরোধ ছিল খুনে খুনে সয়লাব। আর এর ফলে শান্তিপূর্ণ উপায়ে, সমঝোতার মাধ্যমে উপমাদেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার রুপ কি হবে এই প্রশ্নে কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের রাজনৈতিক খেলায় ১৯৪৭ সালের আগস্টে দেড় কোটি মানুষ গৃহহীন হয়, সত্তর হাজার নারী হারায় সম্ভ্রম। সম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আর বিভিন্ন ক্যাম্পে মৃত্যুবরণ করে লাখ লাখ মানুষ। অথচ এই আগস্টে আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত হবার জন্য শোক পালন করি, ভারত আর পাকিস্তানের স্বাধীনতার ডামাডোলে হারিয়ে যায় এই লক্ষ লক্ষ মানুষের মরণকালের আর্তনাদ।
পাকিস্তান সম্পর্কে যে কোন বই পড়লেই দেখি এই নামটি পাঞ্জাবের পি, কাশ্মীরের কে, সিন্ধুর এস আর বেলুচিস্তানের স্তান নিয়ে গঠিত, মানে বাংলার কোন নাম গন্ধই ছিল না সেখানে, যেমন ছিল না দক্ষিন ভারতের মুসলমানদের ভালোমন্দ সম্পর্কে কোন ভাবনা। অথচ বাংলার ভোটই পাকিস্তানকে বার্থ সার্টিফিকেট দেয় আর এই জয়ের পেছনে শেখ মুজিবের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা তিনি নিজেই বর্ণনা করে গেছেন। পাকিস্তান অবশ্য কালিদাসীয় স্টাইলে তার প্রতিদান দেয়। শেখ মুজিব মুসলিম লীগের রাজনীতির লাইম লাইট থেকে ছিটকে পড়েন, আর বাংলা হয় পাকিস্তানের কলোনি। তবে বাংলার মানুষকে আরও ১৯০ বছর অপেক্ষা করতে হয়নি, মাত্র ২৪ বছর দাসত্বের পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত আর ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্য দু দুটো গনহত্যা – খুব বেশি মুল্য নয় কি? এখনও কি সময় আসেনি দেশভাগের ইতিহাস নতুন করে পর্যালোচনা করে দেখার, ঐ সময়ের সমস্ত নেতাদের ভুমিকা নতুন আলোকে বিচার করার? না হলে এই যে উপমহাদেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক হানাহানি, উন্নয়নের নামে এই যে প্রহসন তা কোনদিন শেষ হবে না।  
গান্ধী বা জিন্নাহর ভুমিকা নিয়ে বিভিন্ন মতামত থাকলেও ভারত আর পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের যথাযথ মর্যাদা দেয়। বাংলাদেশে সেটা দেখা যায় না। যদিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে বঙ্গবন্ধুর ডাকেই বাংলার মানুষ যুদ্ধ্বে নেমেছিল। বঙ্গবন্ধু ডাক না দিয়ে দেশ কি স্বাধীন হতো? তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি সুযোগ নেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে কোটি মানুষের অস্ত্রহাতে লড়াই করার ইতিহাস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব অস্বীকার করা যেমন ইতিহাসের অবমাননা ঠিক তেমনি কোটি মানুষের অবদানকে অস্বীকার করে শুধু মাত্র বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার একক নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও ইতিহাসের অবমাননা। নিজের কাজের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু অনেক আগেই জাতীয় সম্পদে পরিনত হয়েছেন। বাইবেলে আছে সীজারকে সীজারের প্রাপ্য দাও আর ইশ্বরকে ইশ্বরের প্রাপ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা যদি একই ভাবে বঙ্গবন্ধু ও অন্যদের অবদান স্বীকার করে নিতে পারি তবেই বাংলাদেশের রাজনীতি সুস্থ ধারায় বইবে, একমাত্র তখনই বাংলাদেশের ইতিহাস পরিপূর্ণতা লাভ করবে, একমাত্র তখনই বঙ্গবন্ধু দলমত নির্বিশেষে সবার বন্ধু হয়ে উঠবেন, একমাত্র তখনই শোক শক্তিতে পরিণত হয়ে বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রুপান্তরিত করবে।


মস্কো, ১৩ আগস্ট ২০১৭        


                            

Comments

  1. খুব ভালো লেগেছে।বাস্তব সত্যের প্রকাশ।

    ReplyDelete
  2. Thank you Pronob! Sotyotao apekkhik.

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি