পুজো
দেখতে দেখতে বছরটা পার হয়ে গেল আর
বছর ঘুরতেই বেড়াতে এলো দেবী দুর্গা। ছোটবেলায়, যখন নববর্ষ ছিল শুধুই হালখাতা,
ইংরেজি নববর্ষ পশ্চিমের হাঙ্গর সংস্কৃতি – তখন এই দুর্গা পুজোই ছিল বছর গড়ানোর সবচেয়ে
শক্তিশালী ইনডিকেটর। তবে সে অনেক আগের কথা, যখন বাঙ্গালী এক ধর্মনিরপেক্ষ দেশের
স্বপ্ন দেখতো, যখন সৃষ্টির আগেই মূর্তি ধ্বংসের প্রতিযোগিতা শুরু হতো না আমাদের দেশে।
বড় খাল জলে টইটুম্বুর, কাজের লোকেরা
ব্যস্ত খালের উপর কাঠের সাঁকো মেরামতে। রামার ভিটায় ফিরে এসেছে প্রান। বাঁশ ঝাড়ের
সব চেয়ে বড় বাঁশটা কাটা হয়েছে কাঠামো বানানোর জন্যে। এসেছে পাট,
শন আর এঁটেল মাটি। কুমুরের দক্ষ হাতে তিল তিল করে গড়ে উঠছে দুর্গা তার বিশাল
সংসার নিয়ে।
আমরা বাচ্চারা ঘুর ঘুর করছি প্রতিমার
চারিদিকে আর একে অন্যের সাথে তর্ক করছি লক্ষ্মী বড় না স্বরস্বতী বড়, কার্ত্তিক ভালো
না গনেশ ভালো এসব নিয়ে। এই দেবতারা কি ভাবছে তাতে আমাদের ভ্রুক্ষেপ নেই – আমরাই কাউকে
বড় করছি তো কাউকে করছি ছোট।
দেখতে দেখতে চলে আসে মহালয়া। বীরেন্দ্র
কৃষ্ণ ভদ্র সেই ভোর সকালে মাকে ডাকছেন ”যা দেবী সর্ব ভুতেশু মাতৃ রুপেন সংস্থিতা
...”, মানবেন্দ্র দরাজ গলায় গাইছেন “আজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারে
...”
পুজো যে শুধু মায়ের অপেক্ষা তাই নয়,
অপেক্ষা নতুন জামা কাপড়ের, নতুন পোশাকের। বছরে আর যখন যত পোশাকই
কেনা হোক না কেন, পুজোর পোশাকের মজাই আলাদা। সবাই নতুন পোশাক
পড়ছে, অন্যদের পোশাক দেখছে, নিজেরটা দেখাচ্ছে। ঐ দিনগুলোতে
রেডিমেইড কিছু পাওয়া যেতো না খুব একটা। গ্রাম আর শহরের দর্জিরা তখন দেবতাদের
মতই ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কতজন যে পুজোর পোশাক পড়েছে পুজোর অনেক দিন পরে।
প্রতিমা আর পোশাকের বাইরে ছিল নতুন
গানের অপেক্ষা – পুজোর গান। হেমন্ত না মান্না – কে করবে পুজোয়
হিট? অন্যেরাও কম যেতো না। তবে ফুটবলে যেমন মোহনবাগান – ইস্ট
বেঙ্গল, আবাহনী – মোহামেডান, গানে ছিল হেমন্ত আর মান্নার এল ক্লাসিকো। আর ছিলো শারদীয়া
দেশ আর আনন্দমেলা, ঠিক যেমন ঈদ সংখ্যা সন্ধানী আর বিচিত্রা।
পুজোর দিনগুলোতে এক মণ্ডপ থেকে আরেক
মণ্ডপে যেতাম প্রতিমা দেখতে। দেশে তখন সুন্দরী প্রতিযোগিতা হতো
কিনা জানি না, তবে কোন বাড়ির প্রতিমা বেশী সুন্দর সেই প্রতিযোগিতা তখন থেকেই শুরু হয়েছিল। কে জানে হয়তো
ঠাকুর দেবতার হাত ধরেই পশ্চিমের এই ফ্যাশনগুলো আমাদের দেশে ঢুকেছিলো।
একটা সময় ছিল, যখন মন্দিরমুখো হতাম
না পাছে সাম্যবাদ অছ্যুত হয়ে যায়। এখন যে ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস জন্মেছে
নতুন করে তা নয়, তবে মস্কোর একমাত্র পুজোয় যাওয়ার চেষ্টা করি, যাই। অনেকের সাথে
অনেক যুগ পরে দেখা হয়। ক্ষনিকের জন্য
হলেও ফিরে যেতে পারি ফেলে
আসা সেই দিনগুলোতে। মনে পড়ে বড় খালের কথা, রামার ভিটার কথা আর বিসর্জনের দিন
মাইকে সেই গান
গাঙ্গে ঢেউ খেলে যায় কন্যা মাছ ধরিতে
আয় জল তুলিতে যাইয়া কন্যা ডুবিস না।
************************
দেখতে দেখতে বছরটা হয়ে গেল পার
দুর্গা দেবী বপের বাড়ি এল যে আবার
বড় খালে জল এসেছে কেমনে হব পাড়
সময় এলো কাঠের সাঁকো মেরামত করার
রামার ভিটায় প্রান ফিরেছে উঠেছে মণ্ডপ
বাঁশের উপর শন পাট আর এঁটেল মাটির
স্তূপ
দুর্গা লক্ষ্মী স্বরস্বতী গনেশ কার্ত্তিক
অসুর ছাড়া করবে ধরা করেছে ওরা ঠিক
বড়দের এই যুদ্ধ খেলায় নেইকো মোদের
কাজ
নতুন জামা নতুন কাপড় নতুন মোদের
সাজ
ঘুরে ঘুরে প্রসাদ খাওয়া রাতের
বেলায় নাচ
আজকে শুধুই করবো মজা ভাববো না সাত
পাঁচ
দু’দিন পরেই দুর্গা যাবে বাপের
বাড়ি ফিরে
ঐ দিনটা কাটবে মোদের কোলাকুলি করে।
সবাইকে শারদীয়া শুভেচ্ছা।
দুবনা, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭
Comments
Post a Comment