একটা সত্ত্বার মৃত্যু
আগামীকাল ১৪ ডিসেম্বর। জাতি পালন করবে
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। পত্রপত্রিকায়, টিভির পর্দায় এ নিয়ে কথা হবে। কথা হবে খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীদের
নিয়ে, আর যাদের খ্যাতি তার বাড়ি বা এলাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে বেশি দুর যেতে পারেনি তারা
থাকবেন শুধু তাদের ছেলেমেয়ে আত্মীয়-স্বজনদের স্মৃতিতে আর প্রার্থনায়। বিভিন্ন শহীদ সন্তানদের মধ্যে
শ্রেণী বিভাজন তৈরি হবে কাকে টিভিতে কতটা ফ্লোর দেয়া হয়েছে এ নিয়ে। তবে সেটা মাত্র এক দিনের জন্য। ১৫ ডিসেম্বর আমরা আবার সবাই তাদের কথা ভুলে যাবো। বিখ্যাত,
অখ্যাত সব শহীদরাই ফিরে যাবেন তাদের ঘরে, তাদের ছেলেমেয়েদের স্মৃতিতে যেমনটি তারা
করে এসেছেন বিগত প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে।
যুধিষ্ঠিরের সময় থেকে কিছুই বদলায়
নি। সেদিন যেমন, আজও আমরা মানুষ মরতে দেখি, কিন্তু সে মৃত্যু
যে আমাদের জন্যেও ঘাপটি মেরে বসে আছে তা ভুলে যাই। মনে হয় বিপদ আমাদের পাশ কেটে
যাবে। আসলেই কী তাই?
ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নিয়ে চললে বারবার হোঁচট খেতে হয়। তারপরেও আমরা চাই সব ঝামেলা পাশ
কাটিয়ে যেতে। তাতে সমস্যার সমাধান হয় না, সমস্যাটা বড় আকারে আসে, একটু পরে।
যারা স্রোতের বিপরীতে চলে, তারা
সব সময়ই হিসেব নিকেশ করে চলে, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে চলে। তাই রাজনৈতিক জীবনে তাদের
দায়বদ্ধতা অনেক বেশি। সেদিক থেকে একাত্তরে যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে তারা সচেতন ভাবেই এটা করেছে। আর এই স্বাধীনতা বিরোধীরাই ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছে শুধু
বুদ্ধিজীবীদের নয়, ৩০ লক্ষ মানুষ। এ দায়িত্ব তারা কোন দিনই এড়াতে পারবে না। বিজয়ের ৪৬ বছর
পরেও নয়।
সাম্প্রদায়িকতা এক ধরণের ব্যাধি,
সংক্রামক ব্যাধি। বিশেষ করে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, উগ্র
জাতীয়তাবাদ এদের সবারই সোনালী দিন অতীতে। তাই তারা ভবিষ্যতের কথা বললেও ফিরে যেতে
চায় অতীতে। এটা আধুনিকতার, বিজ্ঞান মনস্কতার ঠিক বিপরীত। তাই এক দিকে আধুনিকতার
কথা বলবো, আরেক দিকে বিভিন্ন রকম সেকটেরিয়ান মতবাদে বিশ্বাসী হবো সেটা হয়না। এরকম
জোট শেষ পর্যন্ত অতীতগামী হতে বাধ্য। এ ধরণের গাঁটছড়া ভোট এনে দিতে পারে, সাময়িক
ভাবে জনপ্রিয় করতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী বিচারে সেটা ক্ষতিই করে। ফল?
বাংলাদেশের আকাশে আবার সাম্প্রদায়িক শকুনের আনাগোনা, গ্রামেগঞ্জে হায়েনার
অট্টহাসি।
দেশে যখন ছিলাম, প্রায়ই মনে হতো
কেন “তোমরা যাদের মানুষ বল না ...” বা “তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয় ...” এ
ধরণের গান লিখা হচ্ছে না। আজ কালেভদ্রে দেশের টক শো দেখলে মনে হয় পাকিস্তান আর
তাদের দেশীয় দোসররা বাংলা ভাষা, বাঙ্গালীর মনন, বাঙ্গালীত্ব যাতে মাথা তুলে
দাঁড়াতে না পারে সে চেষ্টা ভালভাবেই করেছে। যে সাম্প্রদায়িকতাকে ত্যাগ করে
ধর্মনিরপেক্ষ দেশ গড়ে তুলেছিল তিরিশ লক্ষ মানুষ তাদের রক্ত দিয়ে সেই
সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ভরে গেছে দেশ। ধর্মীয় আলখেল্লায় ঢাকা পড়ে গেছে
জাতীয়তাবাদের চেতনা।
১৯৭১ সালে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা
করা হয়েছিলো তাদের মুক্তচিন্তার জন্য। মুক্তমনা মানুষগুলো আজও হামলার শিকার হচ্ছে,
আজও তাদের রক্তে সিক্ত হচ্ছে বাংলার মাটি। আর রক্ত ঝরাচ্ছে একাত্তরকে যারা
অস্বীকার করে তারা আর তাদের নব্য দোসররা। বর্তমান বাংলাদেশের অধিকাংশ
বুদ্ধিজীবীদের দিকে তাকালে মনে হয় এই সব বুদ্ধিজীবী আর শহীদ শব্দ দুটো এক সাথে যায়
ঠিক যায় না। বুদ্ধিজীবী মানে বুদ্ধি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ নয়, বুদ্ধিজীবী
মানে মুক্ত চিন্তা বিলিয়ে বেড়ানো।
তাহলে কি আমরা একটার পর একটা লড়াইয়ে
জয়ী হয়ে আসল যুদ্ধে হেরে গেলাম?
যুদ্ধ এখনও চলছে। আর সেই যুদ্ধে
শত্রু দিন দিন একটু একটু করে “বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল”
দখল করছে। আর সেটা করছে ক্ষমতার রাজনীতির কূটকৌশলে। আমরা একাত্তর থেকে যতই দূরে
সরে যাচ্ছি একাত্তরের চেতনাগুলো ততই বুলিতে পরিণত হচ্ছে শুধুমাত্র জাতীয় দিবসগুলোতে
উঁচু মঞ্চ থেকে আওড়ানোর জন্য আর বছরের বাকি দিনগুলোতে আমরা ফিরে যাচ্ছি একাত্তরের
আগের দিনগুলোতে, অন্তত মানসিক দিকে। এখনই সতর্ক না হলে একদিন ফিরে আসার পথ কালো
রাতের গহন আঁধারে হারিয়ে যাবে সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ খুব একটা নেই বললেই চলে।
দুবনা, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৭
Comments
Post a Comment