জন্মদিন
এই বয়েসে
জন্ম নেয়াটা এক বিশাল হ্যাঙ্গামার ব্যাপার। ছোট বেলার কথা আলাদা, একবার কেন, বছরে
কয়েকবার জন্ম নিতেও গায়ে লাগে না। মনে পড়ে তখন ভোরে উঠে ক্ষেতে যেতাম মটর শাঁক
তুলতে। সাথে থাকতো খিচুড়ি আর মিষ্টান্ন বা পায়েস। এটা ছিল আমার জন্মদিন স্পেশাল।
অন্য ভাইবোনদের জন্মদিলে পোলাও আর মাংস থাকলেও আমার জন্য এটাই ছিল প্রথা। আর আসতো
সবাই। আমার বন্ধুরা, ভাইবোনদের বন্ধুরা সবাই। কে জানে, বড়দিনের ছুটি থাকতো বলে কি
না। তবে আমি খুব এঞ্জয় করতাম। আগের রাতেই অপেক্ষায় থাকতাম কখন সকাল আসবে আর আমি
বন্ধুদের নিয়ে যাবো আমাদের সেই জমিতে যেখানে মটর চাষ হয়।
মস্কো
আসার পরে মটর শাঁক বিদায় নিয়েছে, সাথে খিচুড়িও। মোটরবিহীন মটর শাঁক এতটা পথ আসতে
পারেনি বলেই হয়তো। সেখানে এসেছে কেক। অবশ্য এই দিন আরও কয়েকটা জন্মদিন থাকায় আর
আমি অপেক্ষাকৃত বাঙ্গালীবিহীন হোস্টেলে বাস করায় জন্মদিনের আনন্দটা আমাদের রাস্তা
পর্যন্ত গড়াতো না। তবে এ নিয়ে আমার মাথাব্যাথা ছিল না। আমার হোস্টেলের পাশের ছিল
ট্যুরিষ্ট বিল্ডিং। প্রতি রবিবার ওখান থেকে ইভুশকা নামে কেক কিনে আনতাম ৪ রুবল
দিয়ে আর বন্ধুদের আমার জন্মদিনের নেমতন্ন করতাম প্রতি রবিবার। থাকতো মূলত রুশ
বন্ধুরা। দু একবার অবশ্য ২৫ শে ডিসেম্বর যৌথভাবে জন্মদিন পালন করার চেষ্টা করেছি,
তবে পরে বুঝেছি জন্মটা একান্তই ব্যক্তিগত, কোন যৌথ প্রোজেক্ট নয় (সত্যি কী?)।
দুবনা
আসার পর জন্মদিনগুলো ছিল আমাদের ছোট্ট সংসারে স্থানীয় নতুন বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা
দেবার উপায় বা নিমিত্ত। যতটা না নিজেরা, বাচ্চারাই এ থেকে মজা লুটত বেশী। পরে ওরা
বড় হয়ে গেলে সেটাও কমে যায়। আজকাল ওরা নিজেরাই নিজেদের জন্মদিন পালন করে বন্ধুদের
নিয়ে। তবে এখন ফেসবুকের কল্যানে শুভ
কামনার অভাব নেই। সময়ের ব্যাবধানে রাতের বারোটা বাজার আগেই একের পর এক আসতে শুরু
করে শুভেচ্ছাবার্তা। ফলে আজকাল জন্মদিন আর ঘরোয়া থাকে না।
অন্যান্য
বার জন্মদিন পালন করি মস্কোয়, ছুটির দিনে। আবার কখনও সেভার সাথে ২ জানুয়ারি। বছরের
শেষ, কাজের চাপ। তার উপর নববর্ষ আর সেভার জন্মদিন। তাই আলাদাভাবে সব কিছু করার সময়
কোথায়? তবে আমি যেখানেই থাকি না কেন বাসায় এ দিন কেক কাটা হয় আর তরায়, আমার
গ্রামের বাড়িতে এখনো মটর শাঁক আর খিচুড়ির আয়োজন হয়।
এবারই প্রথম
মনে হল হাড্ডিগুলোতে জং পড়ে গেছে। কেন যেন আলসেমী লাগছিল কিছু করতে। নতুন বাসায়
উঠছে সবাই, তাই বৌয়ের ইচ্ছা ছিল জন্মদিনে কিছু একটা করা। এবার থেকে মাস্টারি করি, সকালে
পরীক্ষা। তাই বললাম
- এখন মরার সময় নাই, জন্ম তো দুরের
কথা। নববর্ষে সবাই আসবে, তখন না হয় কিছু একটা করা যাবে।
গুলিয়া
কিছু বললও না। আমি ওর ওখান থেকে বাসায় আসলাম। ভোর ৫ টায় মস্কো যাবো। কিছুক্ষন পর ও
এলো একটা লিকিওর নিয়ে।
- রেখে দাও এখন। কাল খাওয়া যাবে। ভোর
চারটেয় উঠতে হবে। দেখি, যদি পারি, সকালেই যাবো মনিকা আর ক্রিস্টিনার সাথে দেখা
করতে।
সকাল
সাতটায় মস্কো পৌঁছুলাম। সোজা চলে গেলাম
স্পোরতিভনায়ায় মনিকাদের ওখানে। ওরা মাত্র সাত দিন হয় এ বাসায় এসেছে। এখনো কাজ চলছে
বাসায়। আমার কথা ছিল গত রাতেই এখানে এসে থাকার। তবে কাজ চলছে বলে আসিনি। রাস্তায়
কেক, জুস, চকলেট কিনে ফোন করলাম। আমার কাছে চাবি নেই। কোন রকমে ঘুম ঘুম চোখে ঘর
খুলে দিল মনিকা।
- এখানে কেক, জুস আর চকলেট আছে।
রেখে দে। আমাকে এক্ষুনি বেরুতে হবে। ছাত্ররা অপেক্ষা করবে। ক্রিস্টিনা কোথায়?
- ঘুমুচ্ছে।
- ক্রিস্টিনা, ওঠ। কি খবর তোর? আর
শোন, তোরা চাইলে আমাকে অভিনন্দন জানাতে পারিস। কিচ্ছুক্ষন আগে মাত্র জন্ম নিয়েছি।
- পাজদ্রাভলিয়াইয়েম (অভিনন্দন)।
একটু
অপ্রস্তুত হয়ে একসঙ্গে বলে উঠলো ওরা।
- স্পাশিবা। আমি চলি। নিউ ইয়ার্সে
আসিস। আমি অপেক্ষা করবো। চললাম।
- তুমি আজ আর আসবে না?
- নারে, সময় হবে না। পাকা (বাই
বাই)।
ভার্সিটি
গিয়ে দেখি ছাত্ররা বসে আছে। ওদের যাচত। এই প্রথম সবাই এসেছে।
- কি, রেডি? প্রশ্নগুলো আগেই
পাঠিয়েছিলাম। এখন সাদা কাজ নাও, যে কোন দুটো প্রশ্নের উত্তর লিখ। গত ছয়মাস যথেষ্ট
বোর করেছ। আর নয়। আজ যতক্ষন না যাচত পাচ্ছ, এখানেই বসে থাকতে হবে।
- কিন্তু আমাদের আরও দুটো যাচত আছে।
- সেটা তোমাদের সমস্যা। টেলিফোন, বই
খাতা সব সরিয়ে ফেল।
ঘণ্টা দু’এক
পর দেখি কেউই তেমন কিছু বলতে পারছে না।
- এখন আমার অন্য ক্লাস। ওখানে যাচ্ছি।
১২-৩০ এ এসো।
অন্য
ক্লাসেও একই অবস্থা। আজ অবশ্য কন্সালটেশন।
- প্রশ্ন আছে কোন? ওকে, কে কে দুই
পেতে চাও (মানে ফেল করতে চাও), হাত তোল। পরীক্ষা ছাড়াই দুই দেব। এমন সুযোগ আর পাবে
না।
সবাই
নিশ্চুপ।
- দেখ, এতদিন আমরা ছিলাম প্রতিপক্ষ।
আমি তোমাদের শেখাতে চেয়েছি, আর তোমরা কিছু না শিখে শুধু নম্বর পেতে চেয়েছ। এখন
একটা জায়গায় আমরা একমত। তোমরা আমার হাত থেকে রেহাই পেতে চাও, আমিও তোমাদেরকে বিদেয়
করতে পারলে বাঁচি। কী করতে হবে? একটু পড়াশুনা আর ২২ জানুয়ারি পরীক্ষা দেয়া। যদি
কোন রকম কন্সালটেশনের দরকার হয় মেইল করো বা ফোন করো।
এর মধ্যে
ইউরি পেত্রভিচ চলে এলেন। ঠিক করলাম, ছাত্রদের যাচত দেব। ওরা যখন রেডি হয়ে আসলো, আমি
ওদের অবাক করে যাচত বসিয়ে দিলাম, বেরিয়ে পড়লাম অন্য কাজে। প্রোফসাউজনায়ায় কাজ শেষ
করে আন্তনকে ফোন করলাম একটা গাড়ীর বুকিং দিতে।
- দুবনার পরের গাড়ী ৬.২০ এ। ৪.৩০ এ
বাস আছে, তবে ওটা মনে হয় ধরতে পারে না। এখন ৩.৫০।
- ধরব। পরে কথা হবে।
শুরু হল
সময়ের সাথে পাল্লা। দুটো চেঞ্জ। তবুও দেখা যাক। সেকেন্ড প্ল্যান হিসেবে রইল ৬.২০
গাড়ী। সেক্ষেত্রে শাহীনকে ফোন করবে। আজ মানে ২৫ শে ডিসেম্বর ওর ও জন্মদিন। মনে পড়লো
ওর বউ ইউলিয়ার কথা
- তোমাদের সবার জন্মদিন ডিসেম্বরে
হয় কেন?
- জান না বুঝি? বছরের শেষ। প্ল্যান
পূর্ণ করতে হবে না? তাই সারা বছরের অপূর্ণ জায়গাগুলো পুরন করার জন্য আমাদের দেশে সবাইকে
ডিসেম্বর মাসে পাঠিয়ে দেয়।
ভাবলাম,
বাস মিস করলে শাহীনকে কল করবো, ফ্রি থাকলে ওদের ওখানে ম্যাকে বসে খাব আর গল্প
করবে। সাভিওলভস্কায়া এসে দেখি বাস ছাড়তে ৭ মিনিট বাকী, ওখানে যেতে আমার লাগবে ৬
মিনিট। আবার সময়ের সাথে একশ মিটার দৌড়। জিতে গেলাম এবারের মত।
বাসায়
পৌঁছতে প্রায় ৭ টা বেজে গেল। সাথে সাথেই গুলিয়ার ফোন
- আমি কিয়েভস্কি কেক কিনেছি। আর
অপেক্ষা করতে পারছি না।
এটা ওর
সবচেয়ে প্রিয় কেক। একটু ফ্রেশ হয়ে ওর বাসায় গিয়ে দেখি কেক নিয়ে বসে আছে। সেভা আর গুলিয়ার
বোন গালিয়াও অপেক্ষায়। কেক খেতে খেতে ৯ টা। মাংস বের করা আছে আমি এসে রাঁধবো বলে।
- তোমরা এখন খাবে?
কেউই
খেতে চাইল না।
- তাহলে আমি মাংস নিয়ে যাই। বাসায়
গিয়ে রান্না করবো। কাল খাওয়া যাবে।
বাসায়
এসে মাংস বসিয়ে বাথরুমে গেলাম। এর মধ্যে গুলিয়াও চলে এল। গতকালের লিকিওরটা খেয়ে
দেখতে হবে না?
- বোতলটা সুন্দর। ছবি তোলা যাবে।
- বোতলের জন্যেই কেনা। তবে ওটা
খেতেও নাকি ভালো।
- আমার এখানে আপেল, আঙ্গুর, কমলা,
চিপস এসব আছে। খাবে কিছু?
- আপেল দিতে পার।
- এটুকু চলবে, নাকি বাকাল (গ্লাস)
ভরে দেবো?
- তোমার জন্য।
- আমাদের জন্য।
মাংসটা এখনো
তৈরি হয়নি। একটু জল ঢেলে আঁচ কমিয়ে গেলাম সাবের পিকনিকের ছবি দেখতে। মাসুদের কল এল
তখন। অনেকক্ষণ গল্প করলাম। এর মধ্যে গুলিয়া এল রান্না ঘর থেকে।
- আমি খুব টায়ার্ড, রিসকাকে (আমাদের
বিড়াল) নিয়ে অনেক ধকল গেল সারাদিন। আলট্রাসনো করালাম, রক্ত দিলাম। ওর ডায়াবেটিকস,
পাকস্থলীর সমস্যা, আরও অনেক কিছু। ডাক্তার বললও ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে ফেলতে। মনিকাকে
বললাম, ও তাই বলছে। কী করবো, বুঝে উঠতে পারছি না।
- দেখ যেটা ভালো মনে কর। তবে ও যে খুব কষ্টে আছে সেটা ঠিক।
- ঠিক আছে। কাল ভোরে মস্কো যাবো।
দেখি মেয়েদের সাথে কথা বলে। এখন কম্পিউটার অফ করে শুয়ে পড়।
রিসকা। ক্রল্যা (খরগোশ), জেইসি (কুকুর), চিপকা (বিড়াল) – এবার রিসকা। নিজেদের অজান্তেই ওরা কখন যে ফ্যামিলি মেম্বার হয়ে যায়? আমার কেন যেন মৃতদের কথা বেশী মনে পড়ে। বনে গেলেই চিপকার কথা মনে হয়। লাদাকে প্রায়ই জেইসি নামে ডাকি। জীবনটা ক্ষণস্থায়ী আর মৃত্যুটা স্থায়ী বলেই হয়তো।
রিসকা। ক্রল্যা (খরগোশ), জেইসি (কুকুর), চিপকা (বিড়াল) – এবার রিসকা। নিজেদের অজান্তেই ওরা কখন যে ফ্যামিলি মেম্বার হয়ে যায়? আমার কেন যেন মৃতদের কথা বেশী মনে পড়ে। বনে গেলেই চিপকার কথা মনে হয়। লাদাকে প্রায়ই জেইসি নামে ডাকি। জীবনটা ক্ষণস্থায়ী আর মৃত্যুটা স্থায়ী বলেই হয়তো।
রাত
তিনটায় ঘুম ভাঙ্গলো। মনে পড়লো মাংসের কথা। রান্না ঘরে গিয়ে দেখি আমাদের জন্য রাঁধা
ঝালমসলা দেয়া মাংসটা পুড়ছে। সেভা আর গালিয়ার জন্য যেটা সেদ্ধ করছিলাম সেটা তখনও
পুড়ে উঠতে পারেনি। তাড়াতাড়ি চুল্লী অফ করে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোর পাঁচটায় গুলিয়ার
ডাক।
- কি যেন পুড়ছে মনে হয়। তুমি মাংস
অফ করেছিলে?
- হ্যাঁ। রাতে উঠে অফ করেছি। আমি তো
ভাবলাম তুমি অফ করে এসেছিলে। রাতে উঠে দেখি আমাদের মাংসটা পুড়ে গেছে।
আমি
অবশ্য কিছুই ভাবিনি। দোষটা শুধু আমার ঘর থেকে বৌয়ের ঘাড়ে শিফট করা বা করার চেষ্টা
করা এই আর কি। একটু শুয়ে থেকে গেলাম রান্না ঘরে চুল্লীটা অফ করেছি কি না সেটা
দেখতে। না, অফ করিনি। আমি মনে মনে অংক কষার মত অনেক কাজই এভাবে করি, যেমন কারো
সাথে কথা বলা, কাউকে হ্যালো বলা। সেভাদেরটা ঠিকই বন্ধ করেছিলাম, আর আমাদেরটা বন্ধ
করবো বলে ভেবেছিলাম। মাংসগুলো পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। না জন্মদিনেও আমি অরিজিনাল হতে
পারলাম না। সারা বছর যেমন, ঠিক তেমন করেই খাবার পুড়ল। খাবার কোন ব্যাপার নয়, কপাল
না পুড়লেই হল।
গতকাল
অনেকেই অনেক ভালো ভালো উইশ করেছেন। কেউ কেউ আরও একশ বছর বাঁচতে বলেছেন। সেটা হচ্ছে
না। আপনারা স্বর্গে গিয়ে মজা লুটবেন আর আমি একশ বছর হা পিত্যেস করে বসে থাকব সেটি
হচ্ছে না। আর অন্য উইশগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছি আকাশে – আমাদের সবার জন্য। একা একা ভালো
থাকা যায় না, সবাইকে নিয়েই ভালো থাকতে হয়, ভালো থাকা যায়। সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ
মনে করার জন্য, মনে রাখার জন্য। শুধু জন্মদিনে নয় সবাই দিনে ২৪ ঘণ্টা আর সপ্তাহে ৭
দিন সুখে থাকুন, ভালো থাকুন, সুস্থ্য
থাকুন।
সবার
জন্য আগত নববর্ষের শুভ কামনা।
দুবনা,
২৬ ডিসেম্বর ২০১৭
Comments
Post a Comment