অতি বুদ্ধির গলায় দড়ি
সেদিন
ছিল শুক্রবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৭। সেভাকে নিয়ে মস্কো যাচ্ছি ব্লাব্লাকারে করে।
আলুম্নাই গেট টুগেদারে যোগ দিতে। সেভার স্কুল, ট্রেন বাসের টাইম টেবিল সব মিলে সে
এক যাচ্ছেতাই কাণ্ড। যা হক, শেষ মুহূর্তে একটা ব্লাব্লাকার পাওয়া গেল। ও যেখান
থেকে আমাদের তুলে নেবে আর যেখানে নামাবে সেটা দেখে মনে হোল আমি ওর সাথে আগেও একবার
গিয়েছি, তবে গাড়িতে বসে ঠিক মনে করতে পারলাম না। তাই জিজ্ঞেস করলাম
-
আমরা কোন রাস্তায় যাবো?
-
দ্মিত্রভস্কয়ে শচ্ছে হয়ে। তেমন জ্যাম নেই সেখানে আজ।
-
কিছুদিন আগে আমাদের ইয়ারোস্লাভকা হয়ে নিয়ে গিয়েছিলো একজন।
-
হ্যাঁ, রাস্তায় জ্যাম থাকলে সেটা ঘটে।
-
তুমি যেখানে আমাদের গাড়িতে তুললে আর যেখানে আমাদের নামাবে তা দেখে মনে
হয়েছিলো এর আগেও এই গাড়িতে গিয়েছি।
-
আমিই সেই লোক। তোমাকে কিন্তু আমি ঠিক চিনেছি।
-
তাই বল। আসলে পৃথিবীর এই কর্নারে আমি রেয়ার একজামপ্লেয়ার। তাই আমাকে চেনা
সোজা।
-
তা যা বলেছ।
যাচ্ছি,
যাচ্ছি। গাড়ির সামনের স্ক্রীনে দেখছি যুদ্ধের উপর একটা মুভি। নিঃশব্দ। জানি না
দিমা (ড্রাইভার) ইচ্ছে করেই মিউট করেছিলো কি না। দিমা বলল
-
ইদি ই স্মত্রি (যাও আর দেখ)। বেলারুশিয়ায় নাজী আক্রমনের উপর সিনেমা।
-
আমি দেখেছি এটা ১৯৮৭ সালে ভিতিয়ায সিনেমা হলে। ভয়ঙ্কর সুন্দর এক সিনেমা।
আমাদের
সাথে আরও একজন যাত্রী। ও যাবে এয়ারপোর্টে। এর মধ্যেই জ্যাম শুরু হয়ে গেছে। দিমা ওকে
বলল অনলাইনে আরেকটা কার দেখতে। ও যে গাড়ি পেল সেটা জ্যামে আমাদের ঠিক তিন গাড়ি
পেছনে ছিল। তাই এক সুযোগে দিমা ওকে সে গাড়িতে ট্রান্সফার করে দিল। আমরা এগিয়ে
চললাম।
এবার
দিমা কার সাথে যেন কথা বলতে চেষ্টা করলো। এক সময় দেখি সিনেমাটা চলছে না। ওখানে
পরিচিত একমুখ। যেন ট্যাক্সি ড্রাইভার। অন্তত লোকটার উপর যেভাবে আলো পড়ছিল, তাতে
সেটাই মনে হচ্ছিলো। এটা কি দিমা? দেখতে ঠিক তেমনি। হাল্কা চুল। ওর হাবভাব বলছে ও
ড্রাইভ করছে। আমি মাঝে মধ্যে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি কে এটা। দিমা কার সাথে কথা
বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে। এক সময় খেয়াল করলাম দিমা যা বলছে তার সাথে লোকটার ঠোঁট
নাড়ানো মিলছে না। ঐ লোকটার মুখে কেমন এক হাসি। পেছনে বসে থাকায় দিমার মুখ আমি
দেখতে পাচ্ছিলাম না। তারপরেও মনে কেমন এক খটকা লাগলো। মনে পড়লো ১৯৯৯ সালের কথা।
আমি তখন
ইতালীতে। চার মাসের সফরে আইসিটিপিতে। যুগোস্লাভিয়ায় ন্যাটোর বোম্বিং শুরু হয়েছে। রাব্বির সাথে এ নিয়ে প্রায়ই মত বিনিময় হতো ই-মেইলে।
তখন ফোনেরা স্মার্ট ছিল না, না ছিল ম্যাসেঙ্গার বা অন্য কিছু। হঠাৎ একদিন রাব্বি
একটা সফট পাঠাল।
-
এটা ক্যামেরা। এখানে ক্লিক করলে ছবি পাবে।
আমি তো
অবাক। এভাবে যে ছবি তোলা যায়, জানতাম না। কি মেকানিজম হতে পারে বুঝে উঠতে পারছিলাম
না। প্রায় সারাদিন ভেবে রাতের দিকে ক্লিক করলাম। ওখান থেকে বেড়িয়ে এলো এক
শিম্পাঞ্জীর ছবি, অনেকটা আমার বন্ধু শুভর প্রোফাইল পিকচারের মত, তবে পাসপোর্ট
সাইজ। রাব্বিকে লিখলাম
-
রাব্বি, এটা মনে হয় পোলারইড ক্যামেরা। তুমি তোমার লাস্ট ছবিটা নিতে ভুলে
গেছ।
এরপর
রাব্বি আমাকে অনেক দিন লেখেনি। লোকজনকে তাদের জিনিষ ফেরৎ দিলে এমনটাই হয়।
আমি ঐ
সময় সেই মেইলটা ফিওদর নামে আমার এক বন্ধুকে পাঠিয়েছিলাম। আমরা একই রুমে বসতাম। ও
আমার থেকে বছর দশেকের বড়। উত্তর পাইনি। কয়েক দিন পড়ে এলো হবিক। আর্মেনিয়ান,
ফিওদরের চেয়ে এক বা দু বছরের বড়। তবে রিসার্চ ইন্সিটিটিউটে বছর ১০ – ১৫ কোন
ব্যাপার নয়, আমরা সবাই সবাইকে তাই তুমি বলেই ডাকি। ও আগে কাজ করতা দুবনায়, তখন
লন্ডনে। এসেছে দুবনা হয়ে। দেখা হতেই বলল
-
কি খবর? কেমন আছো?
-
ভালো। তুমি ভালো?
-
হ্যাঁ, চলছে।
-
ফিওদর কেমন আছে?
-
ও তোমার উপর রাগ করেছে। গত কয়েক ধরে বোঝার চেষ্টা করছে কিভাবে একটা ফাইল
ছবি তুলতে পারে। এখনও বের করতে পারে নি। কাজ করতে পারছে না।
ট্যাক্সিতে
বসে আমারও সেই ফিওদরের অবস্থা। কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না স্ক্রীনে কে? হঠাৎ দেখি
দিমার চোখে চশমা, আর স্ক্রীনের লোকটার খালি চোখ। মানে এটা দিমা নয়। তাহলে কি দিমা
কোন মুভি অন করেছে? কিন্তু কোন মুভিতে কেউ কি এতো সময় ধরে গাড়ি ড্রাইভ করে? তাহলে?
-
ইউরেকা, ইউরেকা। এটা দিমার বন্ধু যার সাথে ও কথা বলছে।
একেই বলে
অতি বুদ্ধির গলায় দড়ি।
দুবনা,
১৫ ডিসেম্বর ২০১৭
Comments
Post a Comment