এক চিলতে স্বপ্ন



ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ুচ্ছে অভি পাগলের মত। সোনালী হলুদ যে সর্ষে ফুলগুলো গতকালও মাথা দুলিয়ে স্বাগত জানাত আর জিজ্ঞেস করতো, “কোথায় যাচ্ছ খোকা?” আজ নিজেরাই যেন রাস্তা ছেঁড়ে দিচ্ছে। দেখতে দেখতে পরিচিত জায়গাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে অতীতে; সামনে, ভবিষ্যতে শুধু অজানার হাতছানি।   রাস্তার ধারে বাঁশঝাড়। তার নীচে বসে একা একা মার্বেল খেলছে সে। বন্ধুরা সব কে কোথায় গেছে কে জানে? আবার রাস্তায় নামে সে। হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে কুদ্দুস ভাইয়ের তালগাছের নীচে, যেখানে উঁচু আকাশে মৃদু বাতাসে দুলছে বাবুই পাখির বাসা। হঠাৎ  সে নিজেকে আবিষ্কার করে হিজল তলায়। কুম তখনও জলে ভরে উঠেনি। ওখানে নাকি চুল প্যাচানীর বাস। ছোট বাচ্চাদের চুল দিয়ে প্যাচিয়ে ধরে নিয়ে যায় পাতালপুরীতে নিজের ডেরায়। দেখতে দেখতে খাল ভরে যায় বানের জলে। বইরাগীর চকের সবুজ মাঠ এখন অন্তহীন সাগরের মত। খালের ধারে মানুষের ভিড়। একটা লাশ নাকি ভেসে যাচ্ছে ধলেশ্বরীর দিকে। অসহায় সে মানুষটাকে ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে হিংস্র মাছের ঝাঁক। হঠাৎ পুবাকাশে দেখা গেলো সহস্র সূর্যের আলো। সেই সূর্যের আলো আর তাপে শূন্যে হারিয়ে যায় চাঁদ আর তারা।  রেডিওর উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়লো সবাই। কী যেন একটা শুনতে চেষ্টা করছে। ছোট্ট অভি নিজের অজান্তেই চিৎকার করে উঠে “জয় বাংলা”।
অলসভাবে চোখ মেলে অভি। বাইরে গাড়ির শব্দ। খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে ঢুকছে শীতের হাওয়া। ১৭ কে ৭১ এর সাথে গুলিয়ে ফেলেছে অভি। স্পেস-টাইম ডায়াগ্রামে সব যেন একাকার হয়ে গেছে। স্বপ্ন আর বাস্তবতা সব মিলেমিশে এক অদ্ভুত অনুভুতির জন্ম দিয়েছে। একটা ঘোরের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে জীবনে ফিরে আসে সে। মনের আয়নায় দেখতে পায় লুটেরাদের তাণ্ডবের পর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা বাড়ি। স্বজন আর সহায় সম্বল হারানোর  বেদনায় অশ্রুসিক্ত চোখে ফুটে ওঠে বিজয়ের হাসি। দেশের অধিকাংশ মানুষ সাদরে গ্রহণ করে বিজয়ের নতুন সূর্য। অতীতের সব যন্ত্রণা ভুলে নতুন করে দেশ গড়তে নামে মানুষ। সমিতি ঘরে সারা দিন মানুষের আনাগোনা। জানালায় উঁকি দেয় অভি। মানুষের চোখে সে কী প্রত্যয় – নতুন দেশ গড়ার, নতুন জীবন গড়ার। বাজারে অনেক লোক। সবার মুখে আশঙ্কা। কী হবে পিতৃহীন এই দেশে? চোখেমুখে অবিশ্বাস নিয়ে দৌড়ায় বাড়ির দিকে যদি বিবিসি বা আকাশবাণী অন্য কিছু বলে! সময় বয়ে যায় উল্টোরথে চড়ে। ৭১ থেকে ঠিক ৩১ বছর পরে ২০০২ এ ৪০ যেন ফিরে আসে বাংলার বুকে। আবার খুন ধর্ষণ। আবার উন্মাদ সাম্প্রদায়িকতা।
বদলে যায় দেশ, বদলে যায় মানুষ। অদ্ভুত উটের পিঠে আলখেল্লা পড়ে পথ চলে স্বদেশ। কখনো সামনে, কখনো পেছনে। প্রগতি আর প্রতিক্রিয়ার দড়ি টানাটানিতে নাভিশ্বাস ওঠে সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে ধর্মীয়, জাতীয় আর আদর্শিক সংখ্যালঘুদের। একাত্তরের রাজাকারকে স্যালুট দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের সৈনিক, গাড়িতে তার লাল সবুজ পতাকা। আজ সেও বিজয়ের দাবীদার, তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতার মালিক আজ সেও।  ভোটের রাজনীতির জুয়া খেলায় জিম্মি হয় সাধারণ মানুষ, তাদের ধন, প্রান আর বিবেক।
স্বপ্নটাই ভালো ছিল। স্বপ্ন থাকে আকাশ জুড়ে, মানুষের অন্তরে অন্তরে। স্বপ্ন দেখতে মানা নেই, মনের মধ্যে স্বপ্ন পুষতেও মানা নেই। স্ব্বপ্নের কোন বাণিজ্যিক মূল্য নেই, স্বপ্ন অমুল্য – তাই কোটি কোটি মানুষ একটা স্বপ্ন দেখলেও তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু স্বপ্ন যখন বাস্তবে পরিণত হয়, আর সেই বাস্তবতার মুল্য যখন ডলার- পাউণ্ডে নির্ধারণ করা যায় তখন আর স্বপ্ন ফল সবার থাকে না। সে হয় কোন ব্যাক্তির, কোন দলের।
আকাশের দিকে তাকায় অভি। দুরে কোটি কোটি নক্ষত্রের মাঝে দেখতে পায় স্বপ্নের রেশ। একাত্তর, একাত্তরের চেতনা – এসবই আজ গ্রহান্তরের বাসিন্দা। সে চিৎকার করে বলতে চায় “জয় বাংলা”। কী এক অজানা কষ্ট তার কণ্ঠ রোধ করে। যাতে কেউ শুনতে না পারে তাই ফিসফিস করে সে বলে “জয় বাংলা”।      

দুবনা, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭       

          

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি