বালি ও বরফের কথা



আমার মস্কো জীবনের শিশুকালে শীত ছিল একেবারেই অন্যরকম। নভেম্বর থেকেই ইলশেগুঁড়ি বরফ পড়া শুরু হতো। মনে পড়ে ১৯৮৩ সালের সেই দিনের কথা যখন বড় ভাইদের কে একজন বললেন
-   আগামীকাল বরফ পড়বে।  
টেনশনে রাতে আমার ঘুম হলো না। দেশ থেকে ছাতি নিয়ে আসিনি সাথে করে। ভাবছি বরফ মানেই তো শিলাবৃষ্টির মত কিছু একটা। সৈয়দ মুজতবা আলীর  কাবুলে তুলার মত বরফ পড়ার কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছি। ভাবছি, কি ভাবে মাথা বাঁচিয়ে সকালে ক্লাসে যাবো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি চারিদিক সাদা, কে যেন ব্লিচিং পাউডার ছড়িয়ে দিয়েছে  বনবাদাড় আর রাস্তাঘাট জুড়ে। বার্চ বনের ভিতর দিয়ে বাতাসে ভেসে বেড়ানো বরফগুলোকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম ক্লাসে। মনে পড়লো বাড়ির কথা। আমাদের রঙের কারখানা ছিল। সেখানে প্রচুর ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করা হতো। বরফ তেমনটাই  সাদা ধবধবে, তবে গন্ধবিহীন। আর বাতাসে ভেসে বেড়ানো বরফগুলোকে মনে হলো আমাদের বাড়ির শিমূল গাছ থেকে নেমে আসা সেই শিমূল তুলা, যার পেছনে ছোটবেলায় সবাই দল বেঁধে ছুটতাম কে আগে ধরবো বলে।
এই বরফ থাকতো অনেক দিন, একেবারে মে মাস পর্যন্ত। এর মাঝে হতো মস্কো মেলা, আসতো নতুন বছর। বন্ধুদের সাথে রাস্তায় বরফ ছুঁড়াছুঁড়ি করতাম। মনেই হতো না আমরা ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রী। যেন স্কুলে পড়ছি সবাই। তবে এটাও ঠিক, যেহেতু নতুন দেশে নতুন পরিবেশে নতুন ভাষা শিখে নতুন জীবন শুরু, আমরা যেন সবাই নতুন করে শৈশবে ফিরে গিয়েছিলাম।
পরবর্তীতে যখন সংসার জীবন শুরু শীতের আগেই শুরু হতো শীতের প্রস্তুতি। শীতের পোশাক বের করা, স্কী, স্লেজ এসব ঠিক করা। তবে ছেলেমেয়েরা মস্কো চলে গেলে এটাও আর করা হয় না। মাঝে মধ্যে বনে যাই ছবি তুলতে, দাঁড়িয়ে দেখি বাচ্চাদের স্লেজে চড়ে বরফের ঢিবি থেকে নেমা আসা। কখনও ভোলগার তীরে ঘুরতে যাই ছবি তুলবো বলে।  
তবে গত কয়েক বছর যাবত বরফের বড়ই আকাল। এমনকি নববর্ষেও বেচারীর দেখা মেলে না। এবারও বরফ তেমন ছিল না এতদিন। কিন্তু গত পরশু থেকে প্রকৃতি পণ করেছে ঋণ শোধ করার। সারাদিন ঝরছে তো ঝরছেই। এর যেন কোন শেষ নেই। খালবিল, নদীনালাতো অনেক আগেই ভরেছে, এখন রাস্তাঘাট সবই উপচে পড়ছে বরফে। বরফ পরিষ্কার করার গাড়িগুলো এদিকটা পরিষ্কার করতে না করতেই অন্যদিকটায় পাহাড় প্রমাণ বরফ জমে যাচ্ছে। বরফের ভারে নুয়ে পড়ে গাছগুলো যেন বলছে
        - অনেক তো হলো, এবার ক্ষেমা দাও শীত ঠাকরুন।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। এখন বাজার অর্থনীতির জমানা। অসম বণ্টনই তার মুল মন্ত্র।
শীতের সময় আরও যে ব্যাপারটা ঘটে তা হল মানুষের বলা নেই কওয়া নেই হুট করে পড়ে যাওয়া। আজও  দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। হঠাৎ মনে হল কে যেন ভদ্রলকের পায়ের নীচের মাটি টেনে নিল।
-       বুঝলে হে, বয়েস হয়েছে। আজকাল আর পায়ে তেমন জোর পাই না।
-       আরে না। কি যে বল। পৃথিবী বুড়িটার মাথা খারাপ হয়েছে, ঘাড় শক্ত করে ধরে রাখতে পারে না।
-       তা যা বলেছ।
আমরা আবার   হাঁটতে থাকি যে যার পথে। পায়ের নীচে বরফের কচকচ শব্দ। চোখ বন্ধ করে দেখতে পাই চৈত্রমাসে কালীগঙ্গার বুকের বিশাল চর, শুনতে পাই গরম বালির কচকচ শব্দ।

দুবনা, ০৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৮ 


        

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা