ভাষার সেকাল একাল
বর্তমানের তথ্য প্রযুক্তি বা
ইনফরমেশন টেকনোলজির যুগে তথ্যের গুরুত্ব যে কত সেটা নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না। এই তথ্যই একদিকে আমাদের ভবিষ্যৎ
দিনের রুপরেখা তৈরি করতে সাহায্য করে, অন্যদিকে সে জানায় আমাদের ফেলে আসা সময়ের
কাহিনী। তথ্য প্রসারিত করে আমাদের জ্ঞানের ভাণ্ডার। শুধু আজ নয় মানব সভ্যতার পুরো
ইতিহাস জুড়েই তথ্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে এসেছে। এই তথ্যের জন্যই মানুষ জীবন বাজি
রেখে কখনো হাজির হয়েছে পাহাড়ের চুড়ায়, কখনো বা সাগরের তলায়, কখনো গেছে বন্ধুর ঘরে,
আবার কখনো শত্রু শিবিরে। কারণ মানুষ
জানে তথ্যই জ্ঞান, জ্ঞানই শক্তি। জীবন যুদ্ধে জিততে হলে সঠিক তথ্যের কোন বিকল্প নেই।
সত্যি বলতে কি এই তথ্যই, বা
তথ্যের আদানপ্রদানই মানুষকে অন্যান্য জীব থেকে আলাদা করেছে, যথেষ্ট দুর্বল শারীরিক
গঠন নিয়েও সে পেরেছে অন্যান্য জীবদের পরাজিত করে পৃথিবীর বুকে নিজেকে সবার সেরা
হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। আর সে এসব
পেরেছে – কারণ তার ছিল তথ্য আদানপ্রদানের অস্ত্র – ভাষা। সেই
আদিম যুগে, যখন না ছিল রাষ্ট্র, না ছিল ধর্ম, এই ভাষা মানুষকে সংঘবদ্ধ করেছে। মনে পড়ে ভাষার সংজ্ঞা? মনের ভাব
প্রকাশ করার জন্য বাগযন্ত্রের সাহায্যে আমরা যে সকল অর্থপূর্ণ সাঙ্কেতিক ধ্বনি
উচ্চারণ করি সেটাই হল ভাষা। এর অর্থ দাঁড়ায় ভাষা হচ্ছে যোগাযোগের মাধ্যম, বন্ধুত্ব করার মাধ্যম। এক সময় এর কোন লিখিত রূপ ছিল না,
এখনো পৃথিবীতে অনেক ভাষা আছে যার কোন লিখিত রূপ নেই। তাই আমরা দেখছি যে কোন কমিউনিটি
গঠনে ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। অনেক আগে, যখন মানুষ খাদ্যের সন্ধানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেত, তখন
ভাষাটাই ছিল একদল মানুষকে একত্রিত করার একমাত্র মাধ্যম। এই ভাষাকে কেন্দ্রও করেই গড়ে
উঠেছিলো জাতির প্রোটোটাইপ। পরবর্তীতে মানুষ যখন চাষাবাদ করতে শুরু করলো, যখন স্বেচ্ছায় যাযাবর জীবন
ত্যাগ করে নিজেকে কোন গণ্ডীর মধ্যে আটকে রাখতে শুরু করলো, তখন এই ভাষাকে কেন্দ্র
করেই গড়ে উঠলো জাতি। সাথে যোগ হলো
ভৌগলিক উপাদান মানে আঞ্চলিক সীমারেখা। পরে জাতি গঠনে ধর্মও বিশাল ভূমিকা রাখে। তবে এটা মানতেই হবে জাতির জন্য
ভাষাটা অনেকটা কর্নার স্টোনের মত। এখন বহু ভাষাভাষী অনেক দেশ আছে,
যেমন ভারত, বেলজিয়াম, ক্যানাডা, আবার একাধিক দেশে একই ভাষা আছে, যেমন ল্যাটিন
অ্যামেরিকার দেশগুলো। তার পরেও জাতির জীবনে ভাষার গুরুত্ব কমে নি, বরং সেটা আরও
বেড়েছে, বাড়ছে।
ভাষার গুরুত্ব কলোনীয়াল শক্তি সব
সময়ই বুঝত। তাই
অ্যামেরিকা, অস্ত্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে তারা স্থানীয়দের ধ্বংস করেছে আর যারা ছিল
তাদের ভাষা বিকাশের কোন পদক্ষেপ নেয়নি। ভারতে তারা সেটা পারেনি, তাই এ দেশকে জানার জন্য লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি
ভাষাকে জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে, নিজেরা স্থানীয় ভাষা শিখেছে আর একই সাথে স্থানীয়দের
ইংরেজি শিক্ষা দিয়েছে যারা এ দেশ শাসনে, শোষণে তাদের দোসর হবে, স্থানীয় হবার পরেও
ইংরেজি জানায় যারা নিজেদের অন্য শ্রেনীর মনে করবে। এক কথায় ইংরেজি ভাষাই হবে এদেশ
শাসনের অন্যতম প্রধান অস্ত্র।
দীর্ঘ ইংরেজ শাসনের পর দেশে আসে
পাকিস্তানি শাসন। আর এই ভাষার
প্রশ্নে আবার আমাদের পরাধীন করার প্রয়াস চালানো হয়। পাকিস্তানি
শাসকগোষ্ঠী ভালো ভাবেই জানতো যদি জাতি হিসেবে বাঙালির মেরুদণ্ড ভাঙ্গতে হয়, তবে
ভাষা দিয়েই শুরু করতে হবে। কিন্তু যে বাঙালি মুসলমান মাত্র কিছুদিন আগে ভোট দিয়ে পাকিস্তান প্রকল্প
বাস্তবায়িত করেছিল, আজ তারাই বাদ সাধলো। বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারী মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র
জনতার রক্তে রঞ্জিত হলো ঢাকার রাজপথ। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বাঙালি পেল নিজের ঠিকানা, পেল স্বাধীন দেশ –
বাংলাদেশ। সে আজ ইতিহাস। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশই মনে হয়
একমাত্র দেশ যাকে ২৪ বছরের ব্যবধানে দু’ দু’ বার স্বাধীন হতে হলো, দু’ দু’ বার
ভাঙতে হলো পায়ের শৃঙ্খল।
আজ বাংলাদেশ স্বাধীন। একুশে ফেব্রুয়ারী শুধু বাঙালির
একার নয়, সারা বিশ্বের। একুশ আজ
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিগত কয়েক দশকে বিশ্বের বহু দেশ মুক্তি পেয়েছে কলোনীয়াল শাসন থেকে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো ভেঙ্গে
জন্ম নিয়েছে অনেক নতুন দেশ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর বাংলাদেশ ছিল তলাবিহীন ঝুড়ি। আজ বিশ্বের অনেক দেশের সাথে
তুলনা করলে দেখব বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য উন্নতি যে জন্যে
বাংলাদেশের মানুষ নিঃসন্দেহে গর্ব করতে পারে। বাংলাদেশ
যে শুধু অর্থনৈতিক ভাবেই এগিয়ে গেছে তা নয়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার স্বাধীন
পররাষ্ট্রনীতি আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশংসিত হয়েছে। জনস্বাস্থ্য থেকে শুরু করে
বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই অগ্রগতি অমর্ত্য সেনের মত নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদদেরও দৃষ্টি
আকর্ষণ করেছে। কিন্তু সেই
সঙ্গে অনেক ঘটনা ঘটেছে বা ঘটছে যা আমাদেরকে সামনে চলতে বাঁধার সৃষ্টি করছে। একটা কথা আছে “স্বাধীনতা অর্জন
করার চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন।“ কথাটা যেকোন ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। “অধিকার আদায় করা খুব কঠিন, কিন্তু সেই অধিকার সবার
জন্য নিশ্চিত করা অনেক অনেক বেশি কঠিন।‘ প্রতিটি সমাজ, প্রতিটি রাষ্ট্র নিজের চলার জন্য এক ধরণের এলিট শ্রেনী
তৈরি করে। সেটা যেমন
দিল্লীর সুলতানরা করেছে, তেমনি করেছে ব্রিটিশরা। দিল্লীর সুলতানরা ফার্সি ভাষায় রাজকার্য
চালাতো, ব্রিটিশরা ইংরেজি ভাষায়। তাদের তৈরি স্থানীয় এলিট সে ভাষাতেই কথা বলত, ভাবতো। আর মানুষ যে ভাষায় ভাবে সেই
ভাষা, সেই সংস্কৃতিকেই নিজের মনে করে, তার উন্নতির জন্যই কাজ করে। আর এ জন্যেই পাকিস্তানিরাও
চেয়েছিল বাঙালিকে উর্দু শেখাতে, উর্দু ভাষাভাষী বাঙালি দিয়ে এদেশের সাধারণ মানুষকে
শাসন ও শোষণ করতে। কিন্তু বাঙালি
সেদিন রুখে দাঁড়িয়েছে, শুধু ভাষা নয়, দেশকে স্বাধীন করেছে। কিন্তু যে ভাষা, যে মানুষের জন্য
এই লড়াই, সেই ভাষা, সেই মানুষ কতটা পেয়েছে? ভাষা আজও উপেক্ষিত। যার ফলে বাংলা ভাষার মহান
লেখকদের লেখা আজ পড়ানো হয় না স্কুলে, ভাষা নয়, ধর্মের দ্বারা নির্ধারিত হয় হয় কি
পড়বে বাংলার সন্তান। আমরা যখন নিজের
অধিকারের কথা বলব, আমাদের মনে রাখতে হবে পাশের লোকটির কথা, যার ঠিক সেই একই অধিকার
আছে। তাঁর অধিকারকে
সম্মান করতে না পারলে, না করলে আমার অধিকার আদায়ের লড়াই আর ন্যায়ের লড়াই থাকবে না। আমরা যেমন মাতৃভাষার জন্য লড়াই
করেছি, আমাদের উচিৎ ঠিক সে ভাবেই আমাদের দেশে বিভিন্ন ভাষাভাষী যে সমস্ত জাতি
উপজাতি বাস করছে তাদের ভাষার প্রতিও সমান সম্মান দেখানো, তাদের ভাষা চর্চায় পথ
খুলে দেওয়া। তাদের ভাষা যেন
মরে না যায়, তাদের ভাষা যাতে সময়ের সাথে উন্নত হতে পারে সে ব্যবস্থা করা। এর মধ্য দিয়ে আমরা শুধু একটা ভাষাকেই
বাঁচাবো না, বিশ্ব ঐতিহ্য রক্ষায় আমাদের অবদান রাখতে পারবো। আমাদের
মনে রাখতে হবে যে, ছোট বড় সব জাতি উপজাতি মিলেই পৃথিবীর ইতিহাস রচনা করে। বর্তমান
যুগের মানুষ কী না করে হারিয়ে যাওয়া সুমের, ব্যবিলন বা মহেঞ্জোদারোর মানুষের রেখে
যাওয়া বার্তা পড়ার জন্য। অথচ আমাদের পাশাপাশি বাস করা কোন সাওতাল, কোন গারো বা কোন
খাসিয়ার ভাষা বোঝার জন্য, তার জীবন যাপনের রীতিনীতি জানার জন্য আমরা কোনই আগ্রহ
দেখাই না। আমাদের এই অবহেলা আজকে আমাদের কিছু সস্তা ভোট এনে হয়তো দেবে, কিন্তু
হাজার বছর পরে এই মাটিতে যারা বাস করবে, এ দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাস যারা
জানতে চাইবে তাঁদের প্রতি এটা হবে অমার্জনীয় অপরাধ।
ছোটবড় সমস্ত জাতি উপজাতির ভাষা ও
সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখা যে কত গুরুত্বপূর্ণ সেটা সোভিয়েত ইউনিয়ন, রাশিয়া বার বার আমাদের দেখিয়েছে। সোভিয়েত
ইউনিয়নে শুধু বড় বড় জাতি নয়, অনেক ছোট উপজাতির ভাষা যাতে লোপ না পায় সে জন্যে
সরকারীভাবে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আর এসব কারণেই রাসুল গামজাতভ,
চেঙ্গিস আইতমাতভের মত বিশ্বখ্যাত লেখকের জন্ম হয়েছে। আধুনিক রাশিয়াও রুশ ভাষার
পাশাপাশি বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার উন্নতির জন্য যথেষ্ট যত্নবান। সরকারীভাবে দেশের সমস্ত ভাষা চর্চা ও উন্নয়নের
সুযোগ বিচ্ছিন্নতাবাদ তৈরি তো করেই না, বরং বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক
হিসেবে কাজ করে। তাই শুধু মাত্র
দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষকে তাদের মাতৃভাষা চর্চার সুযোগ করে দিলেই একুশকে
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস করার আমাদের প্রয়াস সফল হবে, আর সেটা করতে না পারলে
আমাদের দেশেই একুশ তার অর্থ হারাবে।
সারাবিশ্বে আজ নতুন করে
মাতৃভাষাকে অসম্মান করা হচ্ছে। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর থেকে বিভিন্ন দেশে রুশ
ভাষাভাষীরা এই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এসব ব্যাপার নিয়ে কথা বলার দায়িত্ব ও অধিকার দুটোই আছে আমাদের দেশের। কিন্তু কী নিজের দেশে, কী বিদেশে
– সেটা আমরা করবো কিনা তা নির্ভর করছে আমরা একুশের প্রতি কতটা অঙ্গীকারবদ্ধ,
আমাদের একুশের চেতনা কতটা অকপট।
একটা সময় ছিল যখন জনসংখ্যা ছিল
দেশের জন্য বোঝা। আজকের নতুন
বিশ্ববাস্তবতায় সে আর বোঝা নয়, সে সম্পদ – জনসম্পদ। সোনালী আঁশ পাট নয়, এই জনগন আজ
দেশের বিদেশী মুদ্রা উপার্জনের অন্যতম
প্রধান খাত। এ কথা চিন্তা
করে, একুশের কথা চিন্তা করে সরকার কি পারে না দেশে দেশে যে সব দূতাবাস আছে, বিশেষ
করে যে সব দেশে উল্লেখযোগ্য পরিমান বাংলাদেশি নাগরিক আছে, সেখানে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি
চর্চার কোন ব্যবস্থা করতে? তাই আসুন আমরা
ধর্ম নয় ভাষা ভিত্তিক জাতি করে
তুলি।
সব দেশেই যাতে মাতৃভাষার সম্মান
দেয়া হয়, মানুষ যাতে মাতৃভাষায় কথা বলতে পারে সেজন্য সোচ্চার হই।
বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাদেশিরা
যাতে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা করতে পারে সেজন্য কাজ করি।
মহান একুশ অমর হোক!
দুবনা, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০১৮
Comments
Post a Comment