ঢেঁকি
শনিবার সকালে বসে কাজ করছি, হঠাৎ কলিং
বেল বাজল। একটু অবাক হলাম। ভাবলাম আন্তন আগেই
চলে এসেছে। ও গত রাতেই দুবনা এসেছে। রাতে লাদাকে
(কুকুর) আমার এখানে রেখে বন্ধুর ওখানে ছিল। গুলিয়া দরজা খুলে
দিল। দেখি সেভা।
- এতো তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ হল?
- আজ মাত্র তিনটে ক্লাস ছিল।
- কিন্তু তোদের তো কলেজে যাওয়ার কথা।
- আমি যাবো না। মস্কো যাবো।
- ক্রিস্টিনা বললো, ওদের টাকাপয়সা নেই। কি করবি গিয়ে?
- আমার কথা হয়েছে। অসুবিধা হবে না।
- পকেটে মানিব্যাগ আছে। দে আমাকে।
কিছু টাকা সেভার হাতে দিয়ে বললাম,
- এটা রাখ। রাতে তিনজন মিলে কোথাও ঘুরতে যাস। ক্যাফেতে
ঢুঁকে ফোন করিস কার্ডে টাকা পাঠিয়ে দেব।
- স্পাসিবা (থ্যাঙ্কু)।
এই সময় মনিকার ফোন এলো।
- প্রিভিয়েত মিউ।
- প্রিভিয়েত পিম পিম। সেভা আসছে। কিছু টেস্টি
খাবার পাঠাতে পারবে?
- কি দরকার?
- এই ধর, মাংস।
- আগে বললে রান্না করে পাঠাতাম। সেভা তো এই
মাত্র বললও যে মস্কো যাচ্ছে। হ্যাম বা এই জাতীয় কিছু হলে চলবে?
- পাঠাও।
- ঠিক আছে। আমি সোমবার আসবো। তোদের জন্য
রান্না করে নিয়ে আসবো।
- স্পাসিবা।
সেভা চলে গেল। একটু পর আন্তন
এলে গুলিয়া ওর সাথে চলে গেল কাজে। আমি গেলাম সেভার ওখানে – কফি খেতে
আর দেখতে ও সময় মত বেরুল কিনা। সেভা থাকে মায়ের ওখানে ওর অ্যান্টির
সাথে। আমার আর গুলিয়ার বার্টার। লাঞ্চ আর ডিনারের বদলে বেড অ্যান্ড
ব্রেকফাস্ট। সমস্যা হল ওর ওখানে লাঞ্চ আর ডিনার প্রায়ই আমাকেই তৈরি করতে
হয়।
বাসায় ঢুকতে গিয়ে দেখি সেভা বেরুচ্ছে।
- খেয়েছিস?
- না।
- কেন?
- সময় নেই।
- না খেয়ে যেতে পারবি না। আমি তাড়াতাড়ি
কিছু একটা করে দিচ্ছি।
- দরকার নেই। আমি সকালে স্যান্ডউইচ করেছিলাম, খেতে
ভুলে গেছি। ওগুলো খেয়ে নিচ্ছি।
ফ্রীজ খুলে দেখি স্মোকড মাংস। ওখান থেকে
অর্ধেকটা কেটে বললাম
- এটা নিয়ে যা মনিকা, ক্রিস্টিনার জন্য। রাস্তায় রুটি
কিনে নিস।
সেভা চলে গেলে আমি গেলাম দোকানে। মাংস কিনলাম, আগামীকাল রান্না করবো বলে। দুপুরে খেয়ে
বাসায় ফিরেই মাংস কেটে পেঁয়াজ, মশলা আর লেবু দিয়ে ভিজিয়ে রাখলাম। রবিবার দুপুরে
আন্তন চলে গেল। আমি গুলিয়ার ওখানে মাছ রান্না করে খেয়ে বাসায় গেলাম মাংস
রাঁধতে।
একটু যত্ন করে রাঁধা দরকার, ভাবলাম
মনে মনে। তেল গরম করে মাংস ছেঁড়ে নাড়লাম খানিক ক্ষন। এবার আঁচটা
একটু কমাতে হবে। হতে থাক। আমিও একটু নেটে গিয়ে বসি। যা ভাবা তাই
কাজ। তারাদের নিয়ে লিখছিলাম। হঠাৎ দেখি ঘর ধোঁয়ায় ভরে গেছে।
- কারাউল (আক্ষরিক অর্থ গার্ড, তবে অনেক সময় জাস্ট চিৎকার ধর
ধর)।।
কিন্তু ততক্ষনে মাংসের নিচের দিকটা
প্রায় ব্ল্যাক হোলে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে। আগুনের দিকে
তাকিয়ে বুঝলাম “আঁচ কমানোর” কম্যান্ডটা ঠিক মত কাজ করেনি। যাই হোক,
কোন রকমে মাংস ঠিক করে চলে গেলাম গুলিয়ার ওখানে রাতের খাবার খেতে আর মনে মনে ভাবলাম,
“আমি কি ঢেঁকি হয়ে যাচ্ছি?”
সেভা এর মধ্যে ফিরে এসেছে। মুড তেমন
ভালো নেই। কিছুই বললাম না। আমারও পরের দিন ভোর
সকালে মস্কো যেতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে কেটে পড়লাম। গুলিয়া এলো
কিছুক্ষন পরে।
কথা ছিল, আমি প্রথমে যাব মেয়েদের সাথে
দেখা করতে। ওখান থেকে ইউনিভার্সিটিতে। পরে সেটা
বদলে সোজা গেলাম ভার্সিটি। গিয়ে দেখি একটা ছাত্রও নেই। কি ব্যাপার?
খোঁজ নিয়ে দেখি, ওদের প্র্যাক্টিক্যাল চলছে, ক্লাস শুরু হবে ২৬ তারিখ থেকে। মনিকাকে ফোন
করে জানলাম ও দেড়টা পর্যন্ত বাসায় থাকবে। তাই ডিপার্টমেন্টে
বসে একটু গল্পগুজব করে গেলাম ওদের ওখানে। যেতে যেতে বাজলো
একটা।
- এই নে, মাংস নিয়ে এসেছি।
- এখন খাবো না। এসে খাবো।
- ক্রিস্টিনা কি খাবে?
- আমি আইসক্রিম খাবো। আর যদি কিছু
রান্না করো।
- পাপ, মামা অনেক মাংস কিনে রেখে গেছে। একটু রেঁধে
দাও আমাদের।
- ঠিক আছে। দেখছি।
মনিকা চলে গেল। ক্রিস্টিনা
স্নানে। ভাবলাম, বসেই আছি, দেখি কিছু রাঁধা যায় কি না। ফ্রীজে দেখি
কাটা মাংস। ফ্রাইপ্যানে একটু জল আর লবন দিয়ে তাতে মাংস ছেঁড়ে দিলাম
(এটা যাতে মাংস না পুড়ে)। আঁচটা কমিয়ে ঘরে বসে আছি, হঠাৎ সব অন্ধকার হয়ে এলো। দেখি মাংস
আবার বিট্রে করেছে। তাড়াতাড়ি নামিয়ে মাংসটা প্লেটে সরিয়ে ফ্রাইপ্যান ধুয়ে আবার
শুরু করলাম প্রথম থেকে। আর মনে মনে ভাবলাম, “আমিই ঢেঁকি হয়ে যাচ্ছি, নাকি স্বর্গটা
কাছে চলে আসছে?”
ক্রিস্টিনা বাথরুম থেকে বেরিয়ে সব
দেখে বলে
- এতো ধোঁয়া কিসের? পাপ, তুমি দেখি আগুন লাগিয়ে ছাড়বে।
- কি খাবি মাংসের সাথে, নুডলস?
- করো।
রান্না শেষ। আমি বুদ্ধি
করে সাথে করে আনা মাংসটা ওখানে মিশিয়ে দিলাম। ওদের তেল
আর লবন বাদে কিছুই ছিল না, না হলুদ, না মরীচ, না অন্য কিছু।
- ক্রিস্টিনা, খাবার রেডি।
- ঠিক আছে, আমি একটু পর নিয়ে নিচ্ছি।
- ওকে, তুই খেতে থাক, আমি আইসক্রিম আনতে যাচ্ছি। আর কিছু লাগবে?
- কিছু বিগ লাঞ্চ আর কৌটার মাংস নিয়ে এস।
বাসায় ফিরে দেখি ক্রিস্টিনা তখনও শুয়ে।
- আইসক্রিম চলে এসেছে। চায়ের জল
বসা।
চা রেডি হতে হতে আমি আইসক্রিম শেষ
করলাম, ক্রিস্টিনা নুডলস আর মাংস খেল। কিছু বললও না। কে জানে,
মাংস পুড়ে গেছে সেটা খেয়াল করে নি অথবা আমাকে অপ্রস্তুত করতে চায়নি।
- কি খবর তোমার?
- ভালো। তবে কাজকর্ম একটু ঢিলে তালে চলছে। তোর খবর কি?
ক্রিস্টিনার সাথে আমার খুব একটা দেখা
হয় না। তাই এরকম কোন সময় পেলে খুঁটিনাটি সব জিজ্ঞেস করে।
- কি করছ এখন।
- একটা বই লেখার চেষ্টা করছি?
- কোন বিষয়ে?
- কসমোলজির উপর।
- রাশিয়ানে?
- না, বাংলায়।
- আমি সামারে ইন্ডিয়া ঘুরতে গেলে তুমি যাবে আমার সাথে?
- নারে, সময় হবে না। আমি গেলে তো কাজ
নিয়ে যাবো। তুই বরং একা যাস অনেক ঘুরতে পারবি। তোর না ইসরাইল
যাওয়ার কথা, কবে যাবি? আমি মামাকে বলেছি, তোর টিকেটের টাকাটা আমরা দেব।
- না, আমি যাবো না এখন। পরে দেখা
যাবে।
আমার কথা ছিল আরও কিছু কাজ করার। কিন্তু ক্রিস্টিনা
৫ টা পর্যন্ত বাসায় থাকবে। ওর সাথে সময় একেবারেই কাটানো হয় না। কাজটা বরং
পরের বার করবো। বসে বসে দুনিয়ার গল্প করলাম। কিভাবে ওদের
সময় কাটে, মনিকা আর ও রান্না করে কি না, এইসব আর কি।
- আমি তোমাকে চা করে দেব?
- না রে, একটু পর বেরুবো। দরকার নেই
আর।
- কোথায় যাবে?
- দুবনা। কেন?
- আমি ভাবলাম তুমি আজ থেকে যাবে।
- নারে। কাজ আছে।
মনে হয় এই প্রথম ক্রিস্টিনা আমাকে
চা করে দিতে চাইল। সাধারণত আমাকে বলে ওর চা করে দিতে। বড় হয়ে যাচ্ছে
সবাই। দেখতে দেখতে পাঁচটা বাজল। আমার গাড়ি ৬ টায়। ওখানে যেতে
মিনিট পঞ্চাশ লাগবে। দুজনে বেরুলাম। ও গেল সেন্ত্রাল
রেলে, আমি মেট্রোতে।
- তোমার টুপিটা উদ্ভট রকম করে পড়া।
- হতে পারে। ঠিক করে দে।
ক্রিস্টিনা চেষ্টা করল রাস্তায় দাঁড়িয়ে
আমাকে টুপি পড়িয়ে দিতে।
- এরপর কবে আসবে?
- শনিবার একটা মিটিং আছে। ওখানে আসবো
কয়েক ঘণ্টার জন্য।
- বাসায় আসবে না?
- জানি না। আবার সোমবার আসতে হবে। তাই চেষ্টা
করবো রাতেই দুবনা ফিরে যেতে। সোমবার তোরা বাসায় থাকলে ঢুঁ মারব।
- পাকা (বাই) পাপ!
- পাকা ক্রিস্তুশা!
দুবনা, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০১৮
Comments
Post a Comment