সাদাকালো


দেশে মাদকতা বিরোধী অভিযান চলছে। এ যে কোন চলা বোঝা কষ্ট। এই সরল পথে চলে তো এই অলিগলির ভেতর দিয়ে চলে।   আইন আর আইনহীনতা – এই দু’এর এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ ঘটায় উত্তর আর প্রশ্ন আজ পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। মাদকতা আমাদের দেশের কখনই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দ্বারা সমর্থিত হয়নি, তাই এ আন্দোলনের পেছনে জন সমর্থন থাকবে সেটাই স্বাভাবিক।  তবে এর পদ্ধতি, বিশেষ করে কিছু বিচার বহির্ভূত মৃত্যু নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ফলে সামাজিক মাধ্যমে তো বটেই, এমন কি রাস্তায় প্রতিবাদ হয়েছে, হচ্ছে। আর প্রতিবাদ করছে মূলত বাম ঘেঁষা রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠনগুলো। সরকার অবশ্য বসে নেই, এই সুযোগে প্রগতিশীলদের উপর এক হাত নিয়েছে। এখন চলছে প্রতিবাদ না করতে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। তাই অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, যেখানে বাম বা প্রগতিশীলদের দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হয় সেখানে তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ না করাই কি বুদ্ধিমানের কাজ ছিল না? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে এক গল্প মনে পড়ে গেল। ফেসবুকেই পড়া – তার সারমর্ম এ রকমঃ        
“বিশাল এক সাদা ক্যানভাসের মাঝে একটা বিন্দু কালির ছোপ দেওয়া একটি ছবি দেখিয়ে শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের বললেন ছবিটি সম্পর্কে একটা রচনা লিখতে দেখা গেলো সবাই ঐ কালো বিন্দু সম্পর্কেই লিখেছে শিক্ষক বললেন, "দেখ, সাদা স্বচ্ছতার প্রতীক, অথচ সবাই ঐ একফোঁটা কালি নিয়েই লিখলে এটা আমাদের মানসিকতার কথা বলে। আমরা ভালো জিনিস দেখতে পাই না, শুধু খারাপ খুঁজে বেড়াই।"


আসলে শিক্ষকের এই সিদ্ধান্ত ছিল একপেশে কেননা যদি এর উল্টোটা হতো, মানে ক্যানভাসটা কাল আর বিন্দুটা সাদা হতো তখন ছাত্ররা ঐ সাদা বিন্দু নিয়েই রচনা লিখত ব্যাপারটা কনট্রাস্টে একচ্ছত্র সাদার মধ্যে কালো যেমন চোখে পড়ে, একচ্ছত্র কালোর মধ্যেও সাদা তেমনই চোখে পড়ে এ অনেকটা বিশাল প্রশান্ত পুকুরে একটা ঢিল পড়া বা কোরাসে বেসুরো গলা। অথচ সাদা আর  কালোর পরিমাণ যদি প্রায় সমান সমান হতো, তাহলে এটা কারও চোখেই পড়তো না। সবাই কোন একটা বিন্দুর প্রতি এতো বেশী মনোযোগ না দিয়ে পুরো ছবি নিয়ে কথা বলত।  


বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনও এখন সেই একরঙা ক্যানভাসের মত মনে মনে যে দলের বা যে চেতনার সমর্থকই হোক না কেন, রাজনৈতিক ফায়দা নিতে প্রায় সবাই আজ সরকারি দল করে বা সে দলকে সমর্থন করে এই বিশাল একরঙা ক্যানভাসে বামদের ছোটোখাটো প্রতিবাদ বা প্রতিবাদের প্রচেষ্টা সেই ভিনদেশী, ভিনরঙা বিন্দুর মত, তাই খুব চোখে পড়ে এ যেন দুধে টইটম্বুর বঙ্গোপসাগরে এক বিন্দু গরুর চুনা (মুত্র) আর সে জন্যেই হয়তো এদের প্রতি আক্রোশ এতো বেশি  আমার এক ইয়ার মেটের কথা মনে পড়ে গেল এ প্রসঙ্গে। বেশ কয়েক বছর আগে আমাদের প্রধানমন্ত্রী এলেন রাশিয়ায়। অনেকেই গেছে দেখা করতে। আমিও গিয়েছিলাম। লাউঞ্জে বসে গল্প করতে করতে ও বলল, “সত্যি বলতে কি আওয়ামী লীগ আর বি এন পি’র মধ্যে আজ খুব বেশী পার্থক্য নেই। দু’ দলের অর্থনৈতিক এজেন্ডা প্রায় এক। শুধু ওরা একাত্তরের চেতনা বিরোধী, আমরা একাত্তরের পক্ষের শক্তি।“ ও আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী। রাশিয়ায় আসার আগেও এই রাজনীতি করতো, এখনও করে। ওর কাছ থেকে এ রকম স্বীকারোক্তি শুনে অবাক লাগলো, বিশেষ করে ওর লেখালেখি যখন এর বিপরীত বলে।

বি এন পি বরাবরই বাম দলগুলোর বিশেষ করে সি পি বি’র বিরোধী ছিল। এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু বর্তমানে আওয়ামী লীগের সি পি বি বিরোধিতা চোখে পড়ার মত।  প্রধানমন্ত্রীর মস্কো সফরের পর আরও কয়েক বছর কেটে গিয়েছে, একাত্তর থেকে আমরা আরও কয়েক বছর দূরে সরে গিয়েছি। এখন শুধু আওয়ামী লীগ আর বি এন পি’র মধ্যে অর্থনৈতিক নয়, আদর্শগত বিরোধও কমে এসেছে। একাত্তরের চেতনার লড়াই আজ মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষক না বঙ্গবন্ধুর বানীর পাঠক, ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস বা জন্মদিন এসব ব্যক্তিগত পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন সব বড় দলই ইসলামী শাসন, ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলে। ধর্ম নিরপেক্ষতা আজ গলায় ফুটে যাওয়া ছোট্ট এক কাঁটা, গেলাও যায় না ফেলাও যায় না। এ অবস্থায় শুধু মাত্র সি পি বি, ছাত্র ইউনিয়নসহ কিছু খুদে দল অনবরত একাত্তরের চেতনার কথা বলে, ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা বলে বর্তমানের রাজনৈতিক পরিবেশ দূষণ করে। আর পরিবেশ দূষণের শাস্তি স্বরূপ এই সব বাম ও পরিবেশ কর্মীদের মাঝে মধ্যে আইনের আওতায় আনা হয়। কে বললও আইন নাই দেশে? আইন আছে, তবে আইন আজ কুলীন বামুন, সবার কাছে যায় না।

বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে এক পাখার পাখী। যতদিন আওয়ামী লীগ কেন্দ্রিক দল ছিল, এক ধরণের ভারসাম্য ছিল দুই ডানায়। বর্তমানে আওয়ামী লীগ খুব বেশী ডান ঘেঁষা। বি এন পি তো বরাবরই তাই। ফলে নষ্ট হয়েছে রাজনৈতিক ভারসাম্য। আজ দেশের গ্রামে গঞ্জে আওয়ামী লীগের নব্য কর্মীদের হাল চাল দেখলে এরা আসলে কোন দলের সেটাই বোঝা কঠিন। এই ভারসাম্যহীনতার জন্য বামরাও কম দায়ী নয়। তারা আওয়ামী লীগ, বি এন পি’র সাথে জোট বাঁধবে, কিন্তু নিজেরা একজোট হয়ে যে রাজনীতির এই বিমানটাকে পতনের হাত থেকে বাঁচাবে – তা করবে না।  ফলে শাহবাগসহ অনেক আন্দোলনই অকালে মাঠে  মারা যাবে।

যাকগে, শুরু করেছিলাম মাদকতা বিরোধী অভিযান দিয়ে। আমরা যারা সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিলাম, দেখেছি  গর্বাচভের সেই অভিযান – সুখোই জাকন বা শুষ্ক আইন। এখন অনেকের ধারণা সেটা সফল হয় নি, বরং চোরাচালানী থেকে শুরু করে অনেক নতুন সমস্যার জন্ম দিয়েছে এই সেক্টরে। পৃথিবীর বহু দেশেই এ অভিযান অসংখ্য মৃত্যুর কারণ হয়েছে। তার মানে এই নয় যে মাদকতা বিরোধী অভিযান চলবে না। চলবে, তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় এনে সেটা করলে ভালো হয়। এটা নতুন সমস্যা নয়, সব যুগে সব দেশেই ছিল। কিছু সমস্যা আছে যেটা পুরোপুরি উৎখাত করা যায় না, নিয়ন্ত্রনের মধ্যে রাখতে হয়। এ সমস্যার সমাধান শুধু বল প্রয়োগের মাধ্যমে হবে না, এর জন্য দরকার প্রচার প্রোপ্যাগান্ডা, দরকার যুব সমাজের সময় কাটানোর জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা। গ্রামে গঞ্জে ক্রীড়াচক্র, লাইব্রেরি ইত্যাদি গড়ে তোলা। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশে মসজিদ তৈরির। একই সাথে সাথে ক্লাব, লাইব্রেরি এসব গঠনে সরকার যদি উদ্যোগ নেয় আর জনগণকে এই উদ্যোগে সম্পৃক্ত করতে পারে তাহলে মাদকতাসহ অনেক সমস্যাই বিদায় না নিলেও আজকের মত মাথা তুলে দাঁড়াবে না।   


দুবনা, ০৭ জুন ২০১৮                      





Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি