নতুন করে শুরু


গতকাল সেভা চলে গেল, মস্কো। অনেক দিন পরে দুবনা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। ২০০৯ সালে ওরা সবাই যখন মস্কো চলে যায়, অনেকটা সে রকম। তখন প্রথম দিকে খারাপ লাগলেও আমি প্রায় প্রতি উইকএন্ডে মস্কো যেতাম। অভ্যেস হয়ে গেছিল এই কাছে না থাকাটা। ছোট বেলা থেকেই ও আমার ন্যাওটা। সব সময় সাথে সাথে থাকবে। আমি ওকে নিয়ে ঘুরতে যেতাম ভল্গার তীরে বা পাশের বনে। ছবি তুলতাম। ছবি তুলছি, হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ঘাড়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল আর কিছু বলার আগেই খুশিতে গদগদ হয়ে পালিয়ে গেল দূরে। এই আমার সেভা। আমার মত ও সবার ছোট, তাই হয়তো এত ভালবাসা ওর প্রতি। ও কখনই কথা শুনত না, বাড়িতে কেউই শোনে না। আমি নিজেও ছিলাম দুষ্টের শিরোমণি। তাই ওদের কথা না শোনা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। নিজের ফেলে আসা অতীতকেই ওদের মাঝে দেখতে পাই।
২০০৯ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত একটানা মস্কো থাকার পর গত গ্রীষ্মে সেভা দুবনা আসে আমার এখানে। এতদিন আমার ঘরে ফেরার ঠিক ছিল না। অফিস যেতাম যখন খুশি, কখনও ১০ টায়, কখনও ১২ টায় আবার কখনও বা বেলা ২ টায়। ফিরতামও সেভাবেই, রাত ৮ টা, ১০ টা বা ১২ টায়। যখন খিদে পেত। তাও আবার সব সময় রান্না করা হত না আলসেমি করে। সেভা আসার পর থেকে বাসায় ফেরাটা নিয়মিত হয়, নিজে খাই না খাই ওকে খাওয়াতে হয়। আমি খাবার বেড়ে না দিলে অপেক্ষায় থাকবে। কখনও একটু দেরি হলে ফোন করত। ঘরটা আবার ঘর হয়ে উঠেছিল। গত ডিসেম্বর থেকে ও অবশ্য অন্য বাসায় থাকতে শুরু করে, নতুন বাসায়। কথা ছিল ও থাকবে ওর মা আর মাসীর সাথে। আমি আপাতত আমার পুরানো বাসায়। সেটা হয়নি। বউ এসে আস্তানা গাড়ল আমার এখানে। আমার শুরু হল দুই বাসায় দৌড়াদৌড়ি। যদিও পাশাপাশি বাড়ি, তবুও অসুবিধার শেষ নেই। রান্না করি ওর ওখানে, ওকে খাওয়াই। একটু ঝাল পোড়া খেতে ইচ্ছে করলে নিজের বাসায়। ফলে কাজ আর হয় না, এবাসা ওবাসা করতে করতেই দিন যায়।
সেভা এবার ক্লাস নাইন শেষ করল। ঠিক করেছে স্কুলে আর না পড়ে কলেজে ভর্তি হবে, থাকবে মস্কো, ভাইবোনদের সাথে। এর আগে ছেলেমেয়েদের সাথে আমি বা গুলিয়া কেউ না কেউ থাকতো, ফলে খাবারদাবার জামাকাপড় ধোয়া এসব নিয়ে ওদের তেমন না ভাবলেও চলত। এই প্রথম ওরা নিজেরা থাকছে, মানে সেভা ১৮ বছর না হতেই। এর মধ্যে অবশ্য কয়েকদিন মস্কো ছিল, পরশু রাতে আমার সাথে ফিরল স্কুল সার্টিফিকেট নিতে। আগেই বলেছিল মস্কো ফিরে যাবে। ভাবলাম বলে কয়ে এক আধদিন রেখে দেব। ওর ফোন এল।
-       পাপা, তুমি কখন ফিরবে?
-       কেন। একটু দেরি হবে।
-       তাহলে আমি চলে যাই ১৭.৩০ এর ট্রেনে।
-       এত তাড়া কিসের? যদি যেতেই চাস ২০.৩০ এর এক্সপ্রেসে যা। আমি মনিকা বা আন্তনকে বলে দিই তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্টেশন থেকে।
-       দরকার নেই। আমি নিজেই যেতে পারব। অনেক জিনিসপত্র। জামাকাপড়। আইকা (ওর কুকুর)।
-       ঠিক আছে। আমি আসব কিছুক্ষন পর। অপেক্ষা করিস।
টুকিটাকি কিছু কাজ ছিল, শেষ করে বেরুবো ভাবছি, আবার সেভার ফোন।
-       আমি ট্রেনে। বাসায় ফিরে ফোন করব।
হঠাৎ যেন মনে হল দুবনায় কি একটা নেই। বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করল না। অফিসেই বসে রইলাম অনেকক্ষণ। বাসায় ফিরতে ফিরতে আটটা পেরিয়ে গেল। ওর ওখানে গেলাম, কিন্তু খেতে ইচ্ছে করল না। দুপুরে রান্না করা মাংস নিয়ে ফিরলাম বাসায়, সাথে সালাদ। বাসায় খাব বলে। এক অস্বস্তির মধ্যে কাটল সন্ধ্যে। এর মধ্যে ওর বাসায় ফেরার কথা। ফোন করলাম, ধরল না। একটু পরে লিখল
-       আমি বাসায়। সব ঠিক আছে। ভেব না।
-       খেয়েছিস?
-       খুব খিদে পেয়েছে। তাড়াহুড়ো করে দুবনায় খাওয়া হয়নি।
-       মনিকা, ক্রিস্তিনাকে বল কিছু করতে। আমি গত পরশু অনেক কিছু কিনে রেখে এসেছি। সেদ্ধ করে বা ভেজে খেতে পারবি।
-       বলি ওদের। দেখি কি করে।
আধা ঘণ্টা পরে আবার জিজ্ঞেস করলাম
-       কি, কিছু করল ওরা?
-       না। ওরা কে করবে সেটা ঠিক করতে পারছে না।
-       ওদের জন্য বসে না থেকে নিজেই কিছু করে খেয়ে নে।
-       ঠিক আছে।
পরে আর জিজ্ঞেস করিনি। গুলিয়ার খুব একটা মত নেই সেভা এখন মস্কো চলে যাক।
-       তুমি অযথা সেভাকে মস্কো যেতে দিলে।
-       আমি কি বলব। ওর নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন ছুটি। থাকুক দুমাস। যদি দেখে নিজে নিজে সব করতে পারবে, করুক, না পারলে চলে আসবে।  
ছেলেমেয়েরা সাথে সাথে সমস্যাগুলোও বড় হয়। এটাই নিয়ম।   

দুবনা, ২১ জুন ২০১৮ 



Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি