আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনে ঠিক কখন
প্রবেশ করেছেন সেটা বলতে পারব না, ঠিক যেমন বলতে পারব না আমি কখন আকাশ বা বাতাসের
সাথে পরিচিত হয়েছি। যতদিন নিজেকে মনে পড়ে ততদিনই তিনি
আমার সঙ্গে
ছিলেন সঙ্গী হয়ে। আমাদের গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে
যাওয়া কালীগঙ্গাকে কোনমতেই ছোট নদী বলা যাবে না, বিশেষ করে আমার ছোটবেলায় তো নয়ই। কে জানে আমি ছোট ছিলাম বলে নদীকে বড় মনে হত, নাকি সে
সত্যি সত্যি তখন
মস্ত বড় ছিল! তারপরেও শিশুকালে যখনই তাঁর
আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে
কবিতাটি যখন সুর করে পড়তাম আমাদের সেই বিশাল নদীটা কেমন করে যেন ছোট হয়ে যেত। গরু আর গাড়ি অনায়াসে পার হয়ে যেত সেই নদী আর কল্পনায় তার দুই ধারের কাশবন ফুলে ফুলে হয়ে যেত সাদা।
এটা ছিল কল্পনার জগৎ। আর যেটা ছিল নিত্যদিনের দেখা সেটা আমার জ্যাঠামশাই। তখনকার দিনে আজকের মত স্মার্টফোন নামে অল ইন ওয়ান ছিল না। আলাদা ঘড়ি, আলাদা ক্যালেন্ডার, আলাদা অ্যালার্ম। আগে পরিবার ছিল একান্নবর্তী কিন্তু ডিভাইস ছিল আলাদা আলাদা। এখন ঠিক উল্টো। পরিবার আলাদা কিন্তু ডিভাইসগুলো একান্নপরিবারভুক্ত। যাহোক, বছর শেষ না হতেই কলকাতা থেকে আসতো আসছে বছরের রঙ বেরঙের ক্যালেন্ডার। তাতে থাকতো ঠাকুর-দেবতার ছবি। আর স্বর্গের ঠাকুরদের সাথে থাকতেন আমাদের মর্ত্যের ঠাকুর – রবি ঠাকুর। নজরুলের ছবিও থাকতো। রবীন্দ্র নজরুল দুজনেই টিনের ঘরের দেওয়াল থেকে আমাদের গতিবিধির দিকে নজর রাখতেন। তখন এতো কিছু বুঝতাম না। সে সময় রবি ঠাকুর যতটা না তাঁর সাহিত্য দিয়ে তার চেয়ে বেশি তার দাড়ি দিয়ে আমাদের সম্মোহিত করতেন। আর যেহেতু আমার জ্যাঠামশাইএর ছিল সেই রাবিন্দ্রীক দাড়ি, তাই কবি ছিলেন আমার জ্যাঠার মত বা ঠিক তার উল্টোটা।
মায়ের উদ্যোগে বাড়িতে গানের চর্চা ছিল। দিদি, রতন গান গাইত, আমিও শুরু করেছিলাম
ওগো নদী, আপন বেগে পাগল-পারা
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে
কবিতাটি যখন সুর করে পড়তাম আমাদের সেই বিশাল নদীটা কেমন করে যেন ছোট হয়ে যেত। গরু আর গাড়ি অনায়াসে পার হয়ে যেত সেই নদী আর কল্পনায় তার দুই ধারের কাশবন ফুলে ফুলে হয়ে যেত সাদা।
এটা ছিল কল্পনার জগৎ। আর যেটা ছিল নিত্যদিনের দেখা সেটা আমার জ্যাঠামশাই। তখনকার দিনে আজকের মত স্মার্টফোন নামে অল ইন ওয়ান ছিল না। আলাদা ঘড়ি, আলাদা ক্যালেন্ডার, আলাদা অ্যালার্ম। আগে পরিবার ছিল একান্নবর্তী কিন্তু ডিভাইস ছিল আলাদা আলাদা। এখন ঠিক উল্টো। পরিবার আলাদা কিন্তু ডিভাইসগুলো একান্নপরিবারভুক্ত। যাহোক, বছর শেষ না হতেই কলকাতা থেকে আসতো আসছে বছরের রঙ বেরঙের ক্যালেন্ডার। তাতে থাকতো ঠাকুর-দেবতার ছবি। আর স্বর্গের ঠাকুরদের সাথে থাকতেন আমাদের মর্ত্যের ঠাকুর – রবি ঠাকুর। নজরুলের ছবিও থাকতো। রবীন্দ্র নজরুল দুজনেই টিনের ঘরের দেওয়াল থেকে আমাদের গতিবিধির দিকে নজর রাখতেন। তখন এতো কিছু বুঝতাম না। সে সময় রবি ঠাকুর যতটা না তাঁর সাহিত্য দিয়ে তার চেয়ে বেশি তার দাড়ি দিয়ে আমাদের সম্মোহিত করতেন। আর যেহেতু আমার জ্যাঠামশাইএর ছিল সেই রাবিন্দ্রীক দাড়ি, তাই কবি ছিলেন আমার জ্যাঠার মত বা ঠিক তার উল্টোটা।
মায়ের উদ্যোগে বাড়িতে গানের চর্চা ছিল। দিদি, রতন গান গাইত, আমিও শুরু করেছিলাম
ওগো নদী, আপন বেগে পাগল-পারা
গানটি দিয়ে,
যদিও পরে গানের চর্চাটা বাদ হয়ে যায়। তখন পাড়ার বন্ধুদের
ঠাট্টায়। এখন বুঝি আমার শ্রবণ শক্তির অভাবে। আমার বউ আর ছেলেমেয়েরা যাদের প্রায় ১০০% শ্রুতিশক্তি,
বলে আমার কানে নাকি ভালুক দাঁড়িয়েছিল (রাশিয়ার একটি জনপ্রিয় প্রবাদ – কারো শ্রবণ
শক্তি খারাপ হলে মানে মিউজিক শুনে সেটা ঠিকমত
গলায় তুলতে না পারলে এটা বলা হয়)। তখন আমি তবলা শিখতে শুরু করি।
রতন গান গাইত। ও বুলবুল ললিতকলা অ্যাকাডেমিতে রবীন্দ্র সঙ্গীত শিখত। তাই প্রতিদিন
সকাল বিকাল ওর সাথে তবলা বাজাতাম। এভাবে রবি ঠাকুর হন আমাদের নিত্য দিনের সাথী।
তবে তখন বা এর পরে অনেক বছর পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাইরে বাইরে, ওই দেওয়ালে ঝুলানো “কেবলই ছবি শুধু পটে আঁকা”। অনেক পরে, যখন জীবনটাকে একটু একটু করে বুঝতে শুরু করলাম তখন কোন এক সময়ে তিনি আমার ঘরে এলেন “বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে” এর উল্টো পথে। অথবা এমনও হতে পারে আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলেন দেখতে তাঁকে পাইনি।
আমি রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ নই, এমন কি একজন শিক্ষিত বাঙ্গালী হওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথকে যতটুকু পড়া দরকার সেই পড়াশুনা আমার নেই। তার চেয়েও বড় কথা আমার ঠিক আদর্শ ব্যক্তি বলে কেউ নেই। এটা মনে হয় আমাদের পদার্থবিদদের বৈশিষ্ট্য। আমাদের প্রচলিত বিশ্বাসকে অস্বীকার করেই সামনে এগোতে হয়। অনেক বিশাল মানুষদের কাঁধে ভর করে দূর দিগন্ত তাকিয়ে দেখলেও তাঁদের অস্বীকার করে বা তাঁদের কাজকে পরিবর্তন বা পরিশোধন করেই নিজের স্থান দখল করে নিতে হয় সূর্যের নীচে। তাই আমাদের পক্ষে কাউকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যথেষ্ট কষ্টসাপেক্ষ, তা তিনি নিউটন হন আর আইনস্টাইনই হন। এসবের পরও রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনে আর দশজন থেকে আলাদা। আমার আলো, আমার আঁধার, আমার সুখ, আমার দুঃখ, আমার জীবন – সব।
পড়াটা আমার অন্যতম প্রধান শখ বলে বাংলা, রুশ, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান সাহিত্য, বিশেষ করে ক্ল্যাসিকাল সাহিত্য পড়া আছে বেশ খানিকটা। রুশ দেশ অনেক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গেছে। কিন্তু পুশকিন সেখানে সব সময়ই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁকে বাদ দিয়ে রুশ ভাষা, রুশ সাহিত্য ভাবা যায় না, যদিও তলস্তয়, দস্তয়েভস্কিসহ বহু শক্তিশালী কবি, লেখক জন্ম নিয়েছেন এই দেশে। শেক্সপীয়ারও তাই ইংরেজি সাহিত্যে। বাংলায় তেমনি রবীন্দ্রনাথ। এদের বাদ দিয়ে এসব ভাষা ভাবা যায় না। এরা যেন নতুন প্রাণ জুগিয়েছেন এসব ভাষায়, সংস্কৃতিতে। এ কারণেই হয়তো পাকিস্তানী শাসকেরা চেয়েছিল আমাদের রবীন্দ্রনাথ থেকে মুক্তি দিতে, তাদের দেশীয় দোসররা এখন সেটা করছে। চাইছে আমাদের বাঙ্গালীপনাকে ধর্মের লেবাসে ঢেকে দিতে। তাই আমরা যদি জাতি হিসেবে টিকে থাকতে চাই রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। তাঁকে শুধু জাতিগত নয়, ব্যক্তিগত পর্যায়ে গ্রহণ করা ছাড়া গতি নেই। উনি বাঙ্গালীর আলোবাতাস, বাঙ্গালীর সবুজ মাঠ, লাল সূর্য, বাংলার নীলাকাশ, রবীন্দ্রনাথ – সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলার আরেক নাম।
আজকাল আমরা প্রায়ই বাংলা সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করি। আমার মনে হয় আমরা যারা এটা করি তারা যদি নিজেদের কাছের মানুষদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভালোবাসা জাগাতে পারি, তাহলে শত বাধা শত বিঘ্নতার মধ্য দিয়েও আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকব, পশ্চিমের হাঙ্গর সংস্কৃতি বা আরবের অন্তহীন মরুভূমি এই সুজলা সুফলা বাংলাকে গ্রাস করতে পারবে না।
তবে তখন বা এর পরে অনেক বছর পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বাইরে বাইরে, ওই দেওয়ালে ঝুলানো “কেবলই ছবি শুধু পটে আঁকা”। অনেক পরে, যখন জীবনটাকে একটু একটু করে বুঝতে শুরু করলাম তখন কোন এক সময়ে তিনি আমার ঘরে এলেন “বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে” এর উল্টো পথে। অথবা এমনও হতে পারে আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলেন দেখতে তাঁকে পাইনি।
আমি রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ নই, এমন কি একজন শিক্ষিত বাঙ্গালী হওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথকে যতটুকু পড়া দরকার সেই পড়াশুনা আমার নেই। তার চেয়েও বড় কথা আমার ঠিক আদর্শ ব্যক্তি বলে কেউ নেই। এটা মনে হয় আমাদের পদার্থবিদদের বৈশিষ্ট্য। আমাদের প্রচলিত বিশ্বাসকে অস্বীকার করেই সামনে এগোতে হয়। অনেক বিশাল মানুষদের কাঁধে ভর করে দূর দিগন্ত তাকিয়ে দেখলেও তাঁদের অস্বীকার করে বা তাঁদের কাজকে পরিবর্তন বা পরিশোধন করেই নিজের স্থান দখল করে নিতে হয় সূর্যের নীচে। তাই আমাদের পক্ষে কাউকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা যথেষ্ট কষ্টসাপেক্ষ, তা তিনি নিউটন হন আর আইনস্টাইনই হন। এসবের পরও রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনে আর দশজন থেকে আলাদা। আমার আলো, আমার আঁধার, আমার সুখ, আমার দুঃখ, আমার জীবন – সব।
পড়াটা আমার অন্যতম প্রধান শখ বলে বাংলা, রুশ, ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, জার্মান সাহিত্য, বিশেষ করে ক্ল্যাসিকাল সাহিত্য পড়া আছে বেশ খানিকটা। রুশ দেশ অনেক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গেছে। কিন্তু পুশকিন সেখানে সব সময়ই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁকে বাদ দিয়ে রুশ ভাষা, রুশ সাহিত্য ভাবা যায় না, যদিও তলস্তয়, দস্তয়েভস্কিসহ বহু শক্তিশালী কবি, লেখক জন্ম নিয়েছেন এই দেশে। শেক্সপীয়ারও তাই ইংরেজি সাহিত্যে। বাংলায় তেমনি রবীন্দ্রনাথ। এদের বাদ দিয়ে এসব ভাষা ভাবা যায় না। এরা যেন নতুন প্রাণ জুগিয়েছেন এসব ভাষায়, সংস্কৃতিতে। এ কারণেই হয়তো পাকিস্তানী শাসকেরা চেয়েছিল আমাদের রবীন্দ্রনাথ থেকে মুক্তি দিতে, তাদের দেশীয় দোসররা এখন সেটা করছে। চাইছে আমাদের বাঙ্গালীপনাকে ধর্মের লেবাসে ঢেকে দিতে। তাই আমরা যদি জাতি হিসেবে টিকে থাকতে চাই রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। তাঁকে শুধু জাতিগত নয়, ব্যক্তিগত পর্যায়ে গ্রহণ করা ছাড়া গতি নেই। উনি বাঙ্গালীর আলোবাতাস, বাঙ্গালীর সবুজ মাঠ, লাল সূর্য, বাংলার নীলাকাশ, রবীন্দ্রনাথ – সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলার আরেক নাম।
আজকাল আমরা প্রায়ই বাংলা সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করি। আমার মনে হয় আমরা যারা এটা করি তারা যদি নিজেদের কাছের মানুষদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভালোবাসা জাগাতে পারি, তাহলে শত বাধা শত বিঘ্নতার মধ্য দিয়েও আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকব, পশ্চিমের হাঙ্গর সংস্কৃতি বা আরবের অন্তহীন মরুভূমি এই সুজলা সুফলা বাংলাকে গ্রাস করতে পারবে না।
দুবনা,
০৮ মে ২০১৯
Comments
Post a Comment