নির্বাচন


ভারতে নির্বাচন হয়ে গেল, লোকসভা নির্বাচন নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি আবার ক্ষমতায় এই বিজয় নিয়ে খুব কম মানুষেরই সন্দেহ ছিল, তবে বিজয়ের আকার অবাক করেছে অনেককেই সামাজিক মাধ্যমে এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে বিচরণকারী বাংলাদেশের অধিকাংশ পোস্ট নেগেটিভ যদিও কিছু ব্যতিক্রমও আছে ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজেও এই বিজয়ে খুশি হতে পারিনি আমার নিজস্ব রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে তবে এটাই বর্তমানের বাস্তবতা, শুধু ভারতের নয় বিশ্ব বাস্তবতা
দল হিসেবে বিজেপি আমার মনে হয় বাংলাদেশের বিএনপির মতই – বিশেষ করে বর্তমানের বিএনপি
কারণ বিজেপি যেমন উগ্র ধর্মীয় আরএসএস এর পাবলিক মুখপাত্র, বর্তমান বিএনপিও উগ্র ধর্মীয় জামাতের পাবলিক মুখপাত্র তবে বর্তমানে আওয়ামী লীগও ধর্মীয় দল দ্বারা প্রভাবিত বলেই মনে হয়, অথবা ক্ষমতার জন্য তাদের সাথে আঁতাত করে চলে যেমনটা করে পশ্চিম বঙ্গের তৃণমূল
কিন্তু কথাটা হচ্ছে কেন দেশে দেশে এ সমস্ত দল বা রাজনীতি জয়লাভ করছে? এক সময় পুঁজির সাথে বিজ্ঞানের কোয়ালিশনে বিশ্বে শিল্প বিপ্লব হয়েছিল, পৃথিবী সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদের পথে পা রেখেছিল
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর দিকে দিকে মুক্তির পতাকা উড়তে শুরু করলেও ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পরে শুরু হয় সাম্রাজ্যবাদের নতুন কৌশল, অর্থনৈতিক এবং প্রয়োজনে সামরিক বল প্রয়োগের মাধ্যমে দেশে দেশে নিজেদের পছন্দের সরকার ক্ষমতায় বসানোর রাজনীতি এতে সুবিধা এই যে সাম্রাজ্যবাদ কী অর্থনৈতিক, কী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের প্রভাব ঠিকই বজায় রাখে, একই সঙ্গে কলোনিয়াল আমলের মত কোন দায়দায়িত্ব নিতে হয় না কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া মানুষ সেটা মানে না, তারা বিদ্রোহ করে ফলে এই গ্লোবাল পৃথিবীতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে জাতীয়তাবাদ পশ্চিমা বিশ্ব ধর্মীয় অনুশাসন থেকে যতই দূরে সরে যাচ্ছে এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে তৃতীয় বিশ্বে শক্তি অর্জন করছে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি এর সাথে যুক্ত হচ্ছে মিডিয়া, ইন্টারনেট রাজনীতি, ধর্ম, ভোগবাদী দর্শন, নিয়ন্ত্রিত ও অনিয়ন্ত্রিত সংবাদ মাধ্যম, হাই টেকনোলোজির ব্যবহারে ননকন্টাক্ট যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষমতা – এদের সম্মিলিত শক্তির কাছে গণতন্ত্র, মানবতা নেপথ্যে চলে গেছে, যদিও সবই করা হচ্ছে গণতন্ত্র ও মানবতার দোহাই দিয়ে অনেক আগে, যখন একের পর এক নতুন ভূমি আবিষ্কৃত হতে থাকে সাধারণ মানুষ ভাগ্যের সন্ধানে সেসব দেশে যায়, অনেকে যায় দাস হিসেবে নতুন দেশ গড়ে তোলে সমাজতন্ত্রের জোয়ারের সময় দেশে দেশে বিপ্লবীরা আদর্শের জন্য লড়াই শুরু করে এখন সে সব অতীত কাহিনী আল কায়েদা, আই এস ধর্মীয় উন্মাদনায় যুদ্ধ করলেও তাদের সুতিকাগার পেন্টাগন নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় অ্যামেরিকা এসব সন্ত্রাসবাদী সংগঠন তৈরি করলেও পরে সেগুলো তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় ইসলামী সন্ত্রাসবাদের ভয় দেখিয়ে ভারতে শক্তিশালী হয় হিন্দু উগ্রবাদ এভাবেই বিভিন্ন দেশে পপুলিস্টিক রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় আসে আসলে এক সময় বাম রাজনীতি সমাজের একটা অংশের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের মাঝে বাম রাজনীতির আবেদন ছিল তারা সমাজে অনেকটা ফিলটারের দায়িত্ব পালন করত বর্তমানে রাজনীতিতে বামদের প্রভাব কমছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি এর মূল কারণ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পক্ষে কথা বলার মত শক্তিশালী রাজনৈতিক দলের অভাব আগে এটা বামেরা করত কিন্তু বর্তমানে তারা এক দিকে যেমন আগের সেই রাজনীতি করতে পারছে না, অন্য দিকে বর্তমানের বিশ্ব বাস্তবতায় যে নতুন  রাজনৈতিক রণকৌশল দরকার সেটা হয় বুঝতে পারছে না, বা বুঝতে পারলেও বিভিন্ন দুর্বলতার কারণে সেটা করতে পারছে না প্রায় সব কিছুর মতই রাজনীতিও আজ পণ্যে পরিণত হয়েছে যেটা কেনাবেচার জন্য মার্ক্সের ক্যাপিটালই যথেষ্ট নয়, দরকার সত্যিকারের ক্যাপিটাল আর এজন্যে দরকার ট্র্যান্স বা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সহযোগিতা সঙ্গত কারণেই বামেরা সেটা পাচ্ছেনা
অনেকেই বিজেপিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনায় ভারতীয় জনগণের উপর এক হাত নিয়েছে
কিন্তু সব জিনিসের মত ভোটের বেচাকেনাও নির্ভর করে সঠিক মার্কেটিঙের উপর আজ বিশ্ব চলছে দ্রুত গতিতে, যেখানে প্রতিদিনই নতুন নতুন ডিভাইস মার্কেটে আসছে, যেখানে প্রায় প্রতিদিনই মানুষ নিজের আশেপাশে পরিবর্তনের ছোঁয়া পাচ্ছে সেখানে তারা আর বছরের পর বছর আদর্শের বুলি শুনতে রাজি নয়, জনতা চায় নগদ ফসল এটা যুগের দাবি তাই জনতা যে পপুলিস্ট রাজনীতিবিদদের ভোট দেবে তাতে অবাক হবার কিছু নেই এটা জনগণের ব্যর্থতা নয়, এটা সমাজের সচেতন, প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবতাবাদী মানুষদের ব্যর্থতা তারা মানুষের কাছে সঠিক বার্তা পৌঁছে দিতে পারেনি, তারা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন কোন রাজনৈতিক ফর্মুলা বের করতে পারেনি
মানব সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখবো সেটা পুরোপুরিই নিরাপত্তার ইতিহাস আদিম যুগে মানুষ গুহায় বাস করেছে নিরাপত্তার খোঁজে, বিভিন্ন হিংস্র প্রানীর সাথে তার লড়াই – সেটাও নিরাপত্তা এই যে আমরা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা আর চিকিৎসার কথা বলি, যা কিনা মানুষের মৌলিক অধিকার, সেটাও নিরাপত্তা রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকদের এই নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেওয়া সেটা কাজের গ্যারান্টি, সেটা শিক্ষার গ্যারান্টি, সেটা চিকিৎসার গ্যারান্টি আর এসব পেলে মানুষ বাকিটা নিজেরাই করতে পারে আপনার প্রতিবেশী যদি নিজের বাসায় বিশাল এক কুকুর কিনে আনে, আপনার বলার কিছুই থাকবে না, তবে আপনি নিশ্চয়ই চলাফেরায় একটু সাবধান হবেন, বাড়িতে ছোট বাচ্ছা থাকলে ইচ্ছা অনিচ্ছায় একটু টেনশন করবেন এটা স্বাভাবিক ব্যাপার যদি সে কুকুর শেকল ছাড়া হয়, আপনার টেনশন বাড়বে, আর যদি একটার পরিবর্তে দশটা কুকুর প্রতিবেশির দুয়ারে সকাল বিকাল ঘুরে আর আপনাদের দেখলেই ঘেউ ঘেউ করে ওঠে, তাহলে আপনার টেনশন ভয়ে পরিণত হবে, আপনার চেষ্টা থাকবে সামর্থ্য অনুযায়ী কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করার রাষ্ট্রও ওই রকম যদি আপনার আশে পাশের রাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদীদের অভয়ারণ্য হয়, যদি সেখানকার সন্ত্রাসবাদীরা আপনার নিরাপত্তার প্রতি হুমকি স্বরূপ হয়, আপনি, আপনার স্বদেশী নাগরিকরা সরকারের কাছে এর প্রতিকার খোঁজেন আপনারা ভোট দিয়ে সেই সরকারকে ক্ষমতায় আনেন যারা অন্তত তাদের কথায় বার্তায় সেই সন্ত্রাসবাদীদের দমনের কথা বলে সেটা পৃথিবীর সব দেশে সব যুগেই হয় এভাবেই হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হয়েছে, মুসোলিনি ইটালিতে ক্ষমতায় এসেছে সব দেশের শাসকরাই বিদেশি শত্রুকে ব্যবহার করে তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় মানুষ সেটা খায়, বিশেষ করে যদি সেটার পেছনে বাস্তব কারণ থাকে তাই আমার দেশের মৌলবাদের প্রতি সহানুভুতিশীল হব আর পাশের দেশে মৌলবাদ ক্ষমতায় এলে গণতন্ত্র গেল গণতন্ত্র গেল বলে চিৎকার করব সেটা তো হয় না মৌলবাদের সমস্যা আজ বিশ্বব্যাপী এই সমস্যার সমাধান করতে হলে সকলে মিলেই করতে হবে সব দেশ থেকেই মৌলবাদ বিকাশের উপকরণগুলো দূর করতে হবে আর সেটা সম্ভব ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে নিজের দেশের সব নাগরিকদের নাগরিক অধিকার রক্ষা করার মাধ্যমে, প্রতিবেশির সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করার মাধ্যমে সেটা করতে পারলে মৌলবাদ পায়ের নীচের মাটি হারাতে বাধ্য আমাদের মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের সম্পর্ক নতুন নয়, বরং রাষ্ট্র ও ধর্ম যে আলাদা সত্ত্বা সেটা নতুন সময়ের আবিষ্কার ধর্মে বলা হয়ে থাকে ঈশ্বর নিজের মত করে মানুষ সৃষ্টি করেছেন আর রাজা হলেন পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতিনিধি এভাবেই রাষ্ট্রকে দৈব রূপ দেওয়া হয়েছে ঈশ্বর যেমন জন্ম ও মৃত্যুর মালিক, ঠিক সেভাবেই রাষ্ট্র আইনের মধ্যে থেকেই মানুষ মারতে পারে তাই চাইলেই যে ধর্মের সাথে রাষ্ট্রের ওতপ্রোত যোগাযোগ অস্বীকার করা যাবে তার উপায় নেই এমন কি যারা রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে আলাদা করতে চান তাদেরও একদা ধর্ম কর্তৃক প্রদত্ত রাষ্ট্রের এই অধিকারগুলো মেনে নিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয় সেদিক থেকে দেখতে গেলে মানবিকতার উপর ভিত্তি করে যে রাজনীতির আমরা প্রবক্তা সেটা নতুন, সেটাও যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রথার বিপরীতে তাই যত ভালই হোক, সেটা প্রতিষ্ঠা করা একদিনে সম্ভব নয় কিন্তু সমস্যা হল এসব যুক্তিই আমরা ব্যবহার করি নিজেদের সাময়িক স্বার্থের কথা মাথায় রেখে রাজনৈতিক লাভ লোকসান মানবতাকে ছাপিয়ে যায় এ জন্যেই ধর্ম ও রাষ্ট্রের একান্নবর্তী পরিবার গঠন না করাই ভালো তাহলে কে কি খেল আর কে কার উপাসনা করল এ সবই থাকবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আর রাষ্ট্র বাধ্য থাকবে তার নাগরিকরা যাতে তাদের এসব অধিকার চর্চা করতে পারে তার গ্যারান্টি দিতে       

ফিজিক্স ফ্যাকাল্টিতে বেশ জনপ্রিয় একটা জোক চালু ছিল
ইলেকট্রিক কেটলির ব্যবহার পদ্ধতি শেখান হচ্ছে দুই ছাত্রকে এদের একজন গণিতবিদ অন্যজন পদার্থবিদ ইনস্ট্রাক্টর বললেন, “প্রথমে কেটলিতে জল ভরবে, তারপর সুইচ অন করবে“ এরপর ইনস্ট্রাক্টর দুজনের হাতে দুটো জল ভর্তি কেটলি দিলেন হাতেনাতে তাদের থিওরী ক্লাসের টেস্ট নিতে গণিতবিদ কেটলি থেকে জল ঢেলে ফেলে দিল ইনিশিয়াল কন্ডিশনে ফিরে যাওয়ার জন্য, তারপর কেটলিতে জল ভরে সেটা সুইচ অন করল পদার্থবিদ ভরা কেটলিটা সোজা সুইচ অন করল আমি পদার্থবিদ চাই বা না চাই বিজেপি ক্ষমতায়, নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর শপথ অনুষ্ঠান দেখব কী দেখব না সেটার উপর তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্ব নির্ভর করবে না তাঁকে এড়িয়ে চললে আমরা শুধু নিজেদেরকেই এই বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখব দুঃখজনক হলেও সত্য এভাবেই আমাদের দেশেও অনেক রাজনৈতিক দল নিজেদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখে       

আমাদের দেশে যারা বিজেপির বিজয়ে অখুশি তারা শুধু মুদ্রার এক পিঠ দেখছেন
তাদের অন্য দিকটা দেখার অনুরোধ করছি সব কিছুর পরেও বিজেপি একটা সফল নির্বাচন করতে পেরেছে কারচুপি হয়তো হয়েছে, কিন্তু নির্বাচনও হয়েছে সব দল তাতে অংশ নিয়েছে সে জন্যে সরকারি দল ও বিরোধী দল দু’ পক্ষেরই সচেতন প্রচেষ্টা ছিল মানুষ ভোট দিয়ে আমার পছন্দের দলটিকে ক্ষমতায় আনেনি ঠিকই, কিন্তু (অধিকাংশ) মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ভোট দিতে পেরেছে – সেটাই বা কম কী? আসলে আজকাল কেউ আর হার মানতে চায় না ট্রাম্পের ক্ষমতার দু বছর পরেও খোদ অ্যামেরিকায়ই সেই ফলাফল অনেকেই এখনও মানতে পারছে না এটাও বর্তমান রাজনীতির এক নতুন দিক পরাজয় স্বীকার না করা তবে এটা কতটুকু গণতান্ত্রিক সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ যদি আমরা মানুষের গণতান্ত্রিক রায় মানতে ব্যর্থ হই তাতে গণতন্ত্রের ভবিষ্যতই শুধু অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে      
     
দুবনা, ২৬ মে ২০১৯                       
     
  




     

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি