একজন মানুষের জন্ম
ঘুমের মধ্যে অভি শুনতে পেল টেলিফোনের শব্দ। অনেকক্ষণ ধরে
বাজছিল মনে হয়। তখনও সেল ফোনের যুগ শুরু হয়নি। আলসেমি লাগছিল করিডোরে গিয়ে ফোনটা
রিসিভ করতে। ঘুমের ঘোর কাটলে মনে পড়ল কার হতে পারে ফোনটা। দৌড়ে গিয়ে ধরল ফোনটা।
আমরা দুজনেই ভালো আছি।
আমরা মানে?
ওদিক থেকে হাসির শব্দ।
ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার হতে শুরু করল।
বরাবরের মতই অভি দুবনা থেকে ফিরেছে শুক্রবার রাতে। শনিবার বাসার টুকিটাকি কাজকর্ম শেষ করে বন্ধুদের ওদিকে যাবে বলে রেডি হচ্ছিল। গুলিয়ার যাওয়ার কথা ছিল। ইচ্ছে ছিল সাত্তারের ওখানে বেড়াতে যাবে। এরপর আবার কবে কোথায় যাওয়া হয় কে জানে। সব ঠিক করে বেরুবে এমন সময় গুলিয়া বলল
মনে হয় শুরু হল?
কি?
কী আবার? অ্যাম্বুলেন্স ডাকতে হবে। তুমি ০৩ ফোন করে ওদের ডাক, আমি রেডি হয়ে
নিচ্ছি।
অভি যথারীতি ফোন করল। ওদিক থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন। অভি উত্তর দিচ্ছে যথাসম্ভব। রুশ
ভাষার কিছু কিছু শব্দ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। অভি তখনও অনেক কিছুই জানতো না। ওদিক
থেকে জানতে চাইল
কাকোই রদ?
এর অর্থ হতে পারে কয় নম্বর সন্তান আবার কোন লিঙ্গ। অভির শুধু পরের অর্থটাই জানা ছিল।
ও একটু অবাকই হল, কেন না পুরুষেরা সন্তান প্রসব করে এটা ওর জানা ছিল না। তাই বলল
স্ত্রীলিঙ্গ।
ওদিক থেকে হাসির শব্দ শোনা গেল। এদিকে অভির উত্তর শুনে
গুলিয়াও হেসে উঠল। বলল
বল দ্বিতীয়।
কিছুক্ষনের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স চলে এল। জিনিসপত্র নিয়ে ওরা চলল ২৫ নম্বর মাতৃসদনে।
তখন ওরা থাকত লেনিনস্কি প্রস্পেক্তে। যেখানে নিয়ে যাবে, সেটা ওদের বাসা থেকে দশ থেকে পনের মিনিটের হাঁটা রাস্তা। অনেক বার সেখানে গেছে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে, রেগুলার চেক আপ করতে। ডাক্তার পরিচিত। গুলিয়ার নিজের জন্ম ওঁর হাতেই। তাই ভয়ের কিছু ছিল না। অভি ওকে রেখে একা একা বাসার দিকে হাঁটতে লাগলো। মনে কত প্রশ্ন। অভি যদিও এর আগে দশ বছর মস্কোয় থেকেছে, আজই প্রথম একা হোস্টেলে নিজের ঘর ছাড়া অন্য কোথাও থাকবে। কি এক অস্বস্তিকর অবস্থা মনের মধ্যে। চাইলে তখনও সাত্তারের ওখানে যাওয়া যেত, কিন্ত কিছুই করতে মন চাইছিল না। কি এক অজানা উত্তেজনা ঘিরে রেখেছিল ওর সারা মন। আকাশকুসুম কিসব ভাবতে ভাবতেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল অভি।
মুহূর্তে অভির মনে সিনেমার মত ভেসে উঠল সব চিত্র। ও এতক্ষণে বুঝল গুলিয়া আমরা বলতে ওর আর মনিকার কথা বলছে।
হঠাৎ হুঁশ ফিরে পাওয়ার মত ও জিজ্ঞেস করল
কিছু আনতে হবে তোমাদের জন্য?
আপেল আর অন্য কিছু ফল নিয়ে এসো। নীচে সিস্টারদের হাতে দিতে হবে। তারপর যেদিকে লেনিনস্কি
প্রস্পেক্ত সেখানে এসো। আমি চার তলায়। জানালা দিয়ে কথা বলা যাবে।
মনিকা কি করছে?
ও এখন ঘুমে। একটু পরে আমি ওকে খাওয়াতে যাব। দেখতে একেবারে তোমার কার্বন কপি।
যত দ্রুত সম্ভব রেডি হয়ে গুলিয়ায় জন্য আপেল আর টুকিটাকি
কিছু ফল কিনে অভি গেল ২৫ নম্বর মাতৃসদনে। হাঁটতে হাঁটতে। অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে।
জিনিসগুলো সিস্টারের হাতে দিয়ে কথামত এসে দাঁড়াল নীচে। ওখানে আরও কিছু লোকজন
অপেক্ষা করছিল তাদের সন্তানদের জন্য। জানালায় দেখা গেল গুলিয়ার ক্লান্ত কিন্তু
হাসিমুখ। কাপড়ে জড়ানো ছোট্ট একটা কিছু দেখানোর চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুই বোঝা গেল
না। এক অতৃপ্তি নিয়ে অভি ফিরল বাসায়। সেখানে অনেক কাজ। ঘর পরিষ্কার করতে হবে। ডেটল
দিয়ে সব মুছতে হবে। এ সব কাজই ছিল অভির অজানা, তবে উদ্যোগের ঘাটতি ছিল না। এর
মধ্যে সাত্তারকে ফোন করে জানাল সুখবর। দীপুকেও জানাল। বিকেলের দিকে আবার গেল মনিকা দর্শনে। এবার গুলিয়া
ওপর থেকে একটা ইনভেলাপ ফেলল ওর উদ্দেশ্যে। খুব যত্নে সেটা খুলে পেল একটা ছবি।
প্রায় ব্যাঙ্গের মত দেখতে একজন মানুষের ছবি। তাতে লেখা মায়ের নাম আর জন্মের সময়
২:২০। এটা ছিল রবিবার, ১৯৯৪ সালের ৭ আগস্ট।
এর দিন তিনেক পরে ওরা বাসায় ফেরে। দীপুকে (দীপঙ্কর নাগ) নিয়ে অভি যায় ওদের আনতে।
এর আগে নিজের ভাইপো, ভাইঝি, পাড়া প্রতিবেশীদের আর বন্ধুদের ছেলেমেয়েদের অনায়াসে কোলে
নিয়েছে অভি। সিস্টার মনিকাকে এনে অভির কলে তুলে দিল। খুব ভয়ে ভয়ে অভি ওকে কোলে
নিল, ভয় পাছে ফেলে দেয়। কিছুক্ষণ পর মনিকা বাসায় ফিরল। এর আগের ২৯ বছর কোথায় যেন
হাওয়া হয়ে গেল। অভির মনে হল মনিকা যেন আজীবন ওর সাথেই ছিল।
আজ আবারও ৭ আগস্ট। বড় হলেও ও এখনও সেই আগের মত ছোটই রয়ে গেছে অভির কল্পনায়।
দুবনা, ০৭ আগস্ট ২০২০
Comments
Post a Comment