আশা নিরাশা

 


আমরা যারা সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনা করতাম তাদের একটা বিরাট অংশ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করত, সেদেশের নিয়ম কানুন মেনে চলত। কথাটা এ জন্যেই বলছি যে যে কাজগুলো আমাদের দেশে অপরাধ বলে গণ্য হয়না, যেমন বেচাকেনা, তেমন অনেক কিছুই সোভিয়েত ইউনিয়নে অপরাধের পর্যায়ে পড়ত। সোভিয়েত ইউনিয়নে শৌখিন জিনিসের অভাবের সুযোগ নিয়ে তখন অনেকেই এক্সট্রা ইনকাম করলেও আমাদের অনেকেই সে পথে পা বাড়াত না। আমাদের অনেকেই ভাবত দেশে গিয়ে সরাসরি রাজনীতি না করলেও বিভিন্ন গণ সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে ভূমিকা রাখবে, সোভিয়েত ইউনিয়নে পাওয়া শিক্ষা বিভিন্ন ভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। উল্লেখ করা যেতে পারে দেশে ফিরে যাওয়া অনেকেই, বিশেষ করে ডাক্তাররা সাফল্যের সাথে তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালন করে চলছেন। যারা সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার আগে পর্যন্ত দেশে ফিরেছেন তাদের অনেকেই বিভিন্ন ভাবে বাম ঘরানার রাজনৈতিক স্রোতের সাথে নিজেদের জড়িত করেছিলেন। সমস্যা ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর। সে সময় পার্টিও দ্বিধাবিভক্ত হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে যারা পড়াশুনা করেছে তারা শুধু বই পড়েই বা পার্টি নেতা বা কর্মীদের মত সংক্ষিপ্ত সফরে এসে এ দেশের সাফল্য সম্পর্কে জানেনি, দীর্ঘ দিন এদেশে বাস করে, এখানকার মানুষের সাথে মিশে এই দেশ, সমাজ ও সমাজ ব্যবস্থার ভাল মন্দ সবই চাক্ষুষ দেখেছে। তাই সমাজতন্ত্রের প্রতি মোহ না কাটলেও সেখানে যে পরিবর্তন আনা দরকার সেটা সবাই কমবেশি অনুভব করত। যারা মস্কোয় ছিল তাদের অনেকেই বাম ঘরানার নেতাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আসার সুযোগ পেয়েছে, তাদের মধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ও সেক্ষেত্রে মনোভাব বুঝেছে। সোভিয়েত দেশে পেরেস্ত্রইকার খোলা হাওয়া বাংলাদেশের বাম আন্দোলনেও যে লাগা দরকার সেটা এরা অনুভব করত। এমনকি আশির দশকে তার কিছু লক্ষণও দেখা যায়। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন দেশের পার্টিতেও ভাঙ্গন আনে। যারা মূল ধারায় থেকে যান বা বলা চলে পুরনো সাইন বোর্ডের নীচে বসে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যান তারা দল থেকে বেরিয়ে যাওয়া কমরেডদের সংশোধনবাদী বলে আখ্যায়িত করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কট্টর পন্থা অবলম্বন করেন। আশির দশকে পার্টি যে গণ চরিত্র লাভ করেছিল, কিছুটা হলেও গণতন্ত্রের যে হাওয়া এতে লেগেছিল সেটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়, পার্টির গণ চরিত্র কর্পোরেট চরিত্র লাভ করে। সেটা হয়তো যুগের দাবী। এ কারণেই হোক আর অন্য যে কারণেই হোক খুব কম সংখ্যক সোভিয়েত ফেরত বিশেষজ্ঞ পার্টির কাজের সাথে নিজেদের যুক্ত করে। এ নিয়ে দু পক্ষের মধ্যেই ক্ষোভ আছে। পার্টি বলছে সোভিয়েত ফেরত বিশেষজ্ঞরা, বিশেষ করে যারা পার্টির স্কলারশিপ নিয়ে সেদেশে গিয়েছে তারা পার্টির বদান্যতায় শিক্ষা দীক্ষা পেলেও তা শুধু নিজেদের কাজেই ব্যবহার করছে, এমনকি কৃতজ্ঞতা বোধ থেকেও পার্টির জন্য কিছুই করছে না, পার্টির মানুষের ভাগ্য বদলানোর সংগ্রামে কোন ভাবেই নিজেদের সম্পৃক্ত করছে না। অন্য দল বলছে পার্টির ব্যুরোক্রাটিক পরিবেশের কারণে তারা সেখানে যেতে পারছে না, নিজেদেরকে তাদের সাথে মানিয়ে নিতে পারছে না। তবে এটা ঠিক সক্রিয় রাজনীতি করুক আর নাই করুক পার্টির প্রতি তাদের একটা সফট কর্নার ছিল, নিজেদের বিভিন্ন আড্ডায় তারা পার্টি নিয়ে কথা বলে, পার্টির সাফল্যে খুশি হয়, ব্যর্থতায় কষ্ট পায়। পরোক্ষভাবে হলেও পার্টির গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তবে সমস্যা হল, অনেক ক্ষেত্রেই পার্টির কর্মকাণ্ড দেশের স্বার্থে যায় বলে তারা মনে করে না। বিশেষ করে তাদের অনেক কর্মসূচী পরোক্ষ ভাবে হলেও মৌলবাদের হাতকে শক্তিশালী করে বলেই অনেকের বিশ্বাস। তবে অনেক ভুল সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত পার্টিই যে সমাজতন্ত্রের সংগ্রামে অগ্র সৈনিক এটা তারা বিশ্বাস করত। আওয়ামী লীগের হেফাজত ঘেঁষা নীতির ফলে তারা এটাও বিশ্বাস করত যে পার্টিই এখনও পর্যন্ত একাত্তরের চেতনার পক্ষে, বাহাত্তরের সংবিধানের পক্ষে একমাত্র সংগঠিত শক্তি। কিন্তু পশ্চিম বঙ্গের নির্বাচনে মৌলবাদীদের সাথে বামদের জোট গঠন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে মোদীর আগমনকে কেন্দ্র করে পার্টির কর্মকাণ্ড অনেককেই হতাশ করেছে। এসব কর্মকাণ্ড তাদের বাধ্য করবে উপমাহাদেশের বাম আন্দোলনকে নতুন ভাবে পর্যালোচনা করে দেখতে। যারা এখনও পর্যন্ত বাম ঘরানার বিভিন্ন সংগঠনের প্রতি আবেগ পোষণ করত তাদের অনেকেই হয়তো ধীরে ধীরে নিজেদের সরিয়ে নেবে। কয়েক বছর পর পর কোন এক কংগ্রেসে নিজেদের ভুল স্বীকার করে রেজুলেশন নিয়ে ঈশ্বরের কাছ থেকে পাপমুক্ত হওয়া যায়, রাজনীতি সচেতন মানুষ এখন আর সেই অজুহাত গ্রহণ করে না।

দুবনা, ২৮ মার্চ ২০২১ 
 

 

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা