স্বাধীনতার ৫০ বছর
আজ ২৬ মার্চ ২০২১। বাংলাদেশ পালন করছে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উৎসব। এখনই সময় ফিরে তাকানোর, সাফল্য ব্যর্থতার জমা খরচ মেলানোর। একজন ব্যক্তির জীবনে যেমন সাফল্য ব্যর্থতা আসে, তেমনি সাফল্য ব্যর্থতা আসে জাতির জীবনে, দেশের জীবনে। তবে সাফল্য যত বড়ই হোক, ব্যর্থতা যদি একটা সীমার নীচে নেমে যায় সাফল্য উবে যায় কর্পূরের মত। ধরুন একজন লোকের টাকা পয়সা, শিক্ষা দীক্ষা এসবের কোন অভাব নেই, কিন্তু তার স্বাস্থ্য যদি ভালো না থাকে এত টাকা পয়সা, শিক্ষা দীক্ষা তাকে সুখী করতে পারবে না। এ রকম প্রতিটি ক্ষেত্রেই। এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে এক প্রতিবেশীর কথা। ও আমার এক বছরের সিনিয়র। একবার এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আমার সাথে পরীক্ষায় বসে। আমরা একই বাসায় লজিং থাকতাম পরীক্ষার সময়ে। ও সব পড়াশুনা বাদ দিয়ে সারাদিন শুধু বুক কিপিং পড়ত।
কী ব্যাপার, তুমি সারা দিন বুক কিপিং পড়, তা অন্য পরীক্ষা নাই?
আছে, তবে এ বিষয়ে লেটার পেতে হবে।
দেখ, বুক কিপিংয়ে লেটার পেলেও কোন সাব্জেক্টে যদি ফেল কর এই লেটার কোন কাজে লাগবে না।
ও এ বিষয়ে লেটার পেল বটে, কিন্তু ইংরেজিতে ফেল করল। ও আর কখনও পরীক্ষায় বসেনি।
আমাদের দেশ বিভিন্ন সেক্টরে অস্বাভাবিক উন্নতি করেছে। কৃষকের হাত ধরে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। শ্রমিক আর গার্মেন্টসের নারীরা আনছে অঢেল বৈদেশিক মুদ্রা। দেশের বিজ্ঞানীরা পাট থেকে পলিথিন আবিষ্কার করেছে, ফিরিয়ে এনেছে হারিয়ে যাওয়া মসলিন, করোনায় দেখিয়েছে সন্তোষজনক সাফল্য। পদ্মা সেতু, রাস্তাঘাট আরও কত কিছু। মহান একুশ আজ শুধু আমাদের নয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আর এ সবই আসছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে, আসছে বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে। আজ আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে যা কিছু করছি, তার মূলে রয়েছে বাংলা ভাষা, এদেশের সংস্কৃতি, এদেশের নদী, এদেশের জল, এদেশের বায়ুর স্পর্শ, যা আমাদের সহজাত। যখনই বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপর নির্ভর করেছি আমরা সাফল্য পেয়েছি। এমনকি রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এদের হাত ধরে যে রেনেসাঁ এসেছিল - সেও বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতিকে ঘিরে। কিন্তু যখনই আমরা আমাদের সহজাত জাতীয়তাবাদকে ভুলে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুকেছি, আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। অন্যেরা আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খেয়েছে। বাঙালি মুসলমানের সক্রিয় সহযোগিতায় পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে। ফল পেয়েছে কারা? উত্তর প্রদেশের উর্দুভাষী বনেদি মুসলমান আর পাঞ্জাবীরা। এমনকি দেশভাগের সময় অসংখ্য প্রাণ হারালেও কী পাকিস্তানে, কী ভারতে - পাঞ্জাবীরা যথেষ্ট সমাদরে পুনর্বাসিত হয়েছে। কিন্তু দেশত্যাগী পূর্ব বঙ্গের হিন্দুরা পশ্চিম বঙ্গে সহজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি, স্থানান্তরিত হয়েছে দ্বন্দ্বকারণ্যে বা আন্দামানে। বৃহত্তর বাংলার পরিবর্তে আমরা পেয়েছি খণ্ডিত বাংলা। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বাঙালি জাতিসত্ত্বা। এমনকি আজও দেখি এই উন্নতির মধ্যেও আমাদের সব ব্যর্থতা আসছে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের হাত ধরে। শিক্ষা ক্ষেত্রে মৌলবাদের চাপে পড়ে আমরা যে কারিকুলাম চালু করেছি সেটা একুশে ফেব্রুয়ারীর স্পিরিটের পরিপন্থী। অথচ একুশ আমাদের সব। আমাদের সমস্ত আন্দোলনের, স্বাধীন চেতনার মূলে রয়েছে একুশ। মানুষের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখব সে সবই করেছে, সবই করে নিজের আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু রামু, নাসিরনগর, শাল্লা কি আমাদের কোন নিরাপত্তা দেয়? বলতে পারেন এতে তো সংখ্যালঘুরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কী? আমার বিশ্বাস এ সবের পেছনে আছে অর্থনৈতিক কারণ, আছে ভূমি দখলের রাজনীতি। আজ সংখ্যালঘুরা সমাজের সবচেয়ে দুর্বল লিংক তাই আক্রমণের প্রথম শিকার। তারা যখন থাকবে না আপনি হবেন দুর্বল লিংক, কেননা অর্থের লোভ, সম্পদের লোভ কখনোই কমবে না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে আমাদের সমস্ত ব্যর্থতার মূলে আছে মৌলবাদ, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ। কিন্তু ভোটের অংকের হিসেব করে সব দলই এই মৌলবাদের সাথেই আপোষ করে যাচ্ছে। তারা আপোষ করছে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে, আপোষ করছে একুশকে, আপোষ করছে স্বাধীনতাকে। আমরা কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের কথা বলি, কিন্তু তিনি কি মৌলবাদের সাথে আপোষ করা বাঙালি জাতি চেয়েছেন? তিনি কি এমন বাংলাদেশ চেয়েছেন যেখানে সোনার বাংলা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে? যতদিন না আমরা বাংলাদেশে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব বাঙালির সমান অধিকার নিশ্চিত করতে পারব ততদিন পর্যন্ত উন্নয়ন সম্পূর্ণ হবে না। দেশের কোন বর্ণ নেই, দেশের কোন ধর্ম নেই। ধর্ম যার যার, দেশ সবার এটাই হোক আমাদের ২০২১ এর স্বাধীনতা দিবসের স্লোগান।
দুবনা, ২৬ মার্চ ২০২১
Comments
Post a Comment