পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র

হঠাৎ করেই ফোনটা বেজে উঠলো। আমি অনেক রাতে ঘুমুতে যাই, তাই উঠি পরে। দেখি ভারতীয় নম্বর, অপরিচিত। ভাবলাম স্বপন দার নতুন নম্বর কিনা। তাই কলটা রিসিভ করলাম।
- আমি কোলকাতা থেকে বলছি। মিঃ বিজন সাহার সাথে একটু কথা বলতে চাইছি।
- বলুন।
- খবর আসছে যে ইউক্রেনে এক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আক্রমণ হয়েছে। ওটা কি চেরনোবিলের মত কিছু হতে পারে? আপনি কিছু বলবেন?
- দেখুন আমি এখনও ঘুম থেকে উঠিনি। আমাকে খোঁজ খবর নিতে হবে, তারপর কথা বলতে পারব। ঘণ্টা তিন চার পরে ফ্রি হয়ে জানাব।
- অনেক ধন্যবাদ। আমি আপনাকে আপাতত কিছু লিংক পাঠাচ্ছি।

লিংকগুলো দেখে বুঝলাম তাতে খবরের চেয়ে প্রোপ্যাগান্ডা বেশি। কি করা? রিয়া নভোস্তির সাইটে জাপারোঝিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিঙে আগুন লাগার কথা লিখেছে, তবে ইতিমধ্যে আগুন নিবিয়ে ফেলেছে। এ থেকে খুব বেশি কিছু জানা যাচ্ছে না। কী করা? এ ক্ষেত্রে কাজ করে বইপত্তর। খুঁজতে লাগলাম সোভিয়েত ইউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে সেফটি ব্যাপারটা কতখানি ছিল। এসব সেন্টার হাই রিস্কি, তাই সেই সময়ের সবচেয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা যে অবলম্বন করা হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। বিশেষ করে তখন আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে শত্রুতা ছিল, তাতে বাইরে থেকে বোমা মেরে বা মিসাইল দিয়ে এসব কেন্দ্র যাতে সহজে ধ্বংস করতে না পারে সে ব্যবস্থা ছিল। তবে এটাও ঠিক, এই নিরাপত্তার প্রথম স্টেপ ছিল বিমান বা ক্ষেপানাস্ত্র আগেই ধ্বংস করা। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার ইউক্রেনের জন্য এটা আগের মত নেই। যাহোক, আমরা জানি যে ইউরেনিয়ামে নিয়ন্ত্রিত চেইন রিয়াকশন ঘটিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। আর তা যাতে কন্ট্রলের বাইরে চলে না যায় সে জন্য কয়েক স্টেপ সিকিউরিটির ব্যবস্থা আছে। এমনকি কোন কারণে বিদ্যুৎ সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেলে তুলনামূলক দীর্ঘ সময়ের জন্য রিয়াক্টর নিরাপদ অবস্থানে চলে যায় আর ধীরে ধীরে চেইন রিয়াকশন বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ এখানে এক্সটারনাল কন্ট্রোলের সাথে সাথে অনেক অটোম্যাটিক কন্ট্রোল কাজ করে। চেরনবিলের ইতিহাস থেকে জানা যায় এই অটোম্যাটিক সিস্টেম বিভিন্ন স্টেজে আসন্ন বিস্ফোরণের ইঙ্গিত দেয়, তবে একটার পর একটা সিকিউরিটি সিস্টেম বন্ধ করার ফলে (আসলে এখানে তখন কিছু এক্সপেরিমেন্ট চালানো হচ্ছিল - কতটুকু চাপ রিয়াক্টর নিতে পারে সেটা জানার জন্য) এক সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। যার ফলাফল আমরা জানি। আসলে এসব জায়গায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা এত বেশি যে সেটা নষ্ট করতে অনেক ঘাম ঝরাতে হয়। আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ছাড়াও আছে এক্সটারনাল নিরাপত্তা। যেমন সোভিয়েত আমলের এসব রিয়াক্টর যে স্থাপনায় অবস্থিত তা (১) ৩০ কিলো পাস্কেল শক্তির শক ওয়েভের চাপ বহন করতে পারে। এই চাপে বিমান দুমড়ে মুচড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যায়; (২) ২০ টন ওজনের প্লেন ৭২০ কিমি/ঘন্টা বেগে এর উপর পড়লে ঠিক দাঁড়িয়ে থাকবে; (৩) ৫৬ মি/সেকেন্ড বেগের ঝড় সইতে পারে; (৪) বন্যায় টিকে থাকতে পারে; (৫) রিখটার স্কেলের ৮ নম্বর ভুমিকম্পে দাঁড়িয়ে থাকে। অর্থাৎ নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টেশনের ক্ষতি করা বেশ শ্রম সাধ্য।

যখন যুদ্ধ শুরু হয় আমার প্রথম প্রশ্ন ছিল ইউক্রেনের ১৫ টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কাদের রক্ষণাবেক্ষণে? কারণ কিছু না করতে পারলেও এসব দখল করে বিশ্বকে জিম্মি রাখা যায়। প্রথমেই এরা দখল নেয় চেরনোবিলের। এখন রুশ সৈন্যরা স্থানীয় সিকিউরিটির সাথে যৌথভাবে এটা পাহারা দিচ্ছে। মাঝে কিয়েভ চেরনোবিলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিলে কিছুটা দুশ্চিন্তার কারণ ঘটে। পরবর্তীতে সেটা কাটিয়ে ওঠা যায়।

পাঁচ দিন আগে রুশ সেনাবাহিনীর হাতে চলে এসেছে জাপারঝিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দায়িত্ব। স্থানীয় সিকিউরিটি পালিয়ে যায়। রুশ ন্যাশনাল গার্ড এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। গত রাতে ওরা এই গার্ডদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ করলে গোলাগুলি শুরু হয়। সে সময় আক্রমণকারীরা আডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিঙে শেল্টার নেয় আর পালিয়ে যাওয়ার আগে সেখানে অগ্নি সংযোগ করে। তবে দ্রুত সেই আগুন নিভিয়ে ফেলা হয়েছে। বর্তমানে সেখানে রেডিওআক্টিভ ব্যাকগ্রাউন্ড নর্মাল। আসলে যেকোনো স্থপনা যেখানে রিয়াক্টর আছে তার রেডিওআক্টিভ ব্যাকগ্রাউন্ড ২৪ ঘন্টা মনিটরিং করা হয়। আমি যেখানে কাজ করি সেখানে সব সময় এটা হয়। প্রবেশ পথে সময়, তাপমাত্রা, দিন, তারিখ, বায়ুমন্ডলের চাপের সাথে সাথে রেডিওআক্টিভ ব্যাকগ্রাউন্ড কত সেটাও দেখানো হয়। ইউক্রেনের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে সমস্যা নতুন নয়, এর আগেও হয়েছে আর তার কারণ মিসম্যানেজমেন্ট। এখানে বরাবরই রাশিয়া থেকে পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহার করা হত, মাঝে সেখানে আমেরিকা থেকে জ্বালানি আমদানির কথা ভাবা হয়। যেহেতু বিভিন্ন দেশের রিয়াক্টর নিজ নিজ স্পেসিফিক জ্বালানি ব্যবহার করে সেটা বরং আরও বড় ধরণের বিপদ ডেকে আনতে পারত। এখন শুধু এটাই বলা যায়, যারা পারমাণবিক চুল্লী রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চায় তাদের থেকে সাবধান। কয়েক বছর আগেও সরকারের সাথে দরাদরির এক পর্যায়ে ন্যাশনালিশটরা পারমাণবিক স্টেশন দখল করার হুমকি দিয়েছিল। যদিও যথেষ্ট নিরাপদ তার পরেও ১০০% গ্যারান্টি কেউই দিতে পারে না। আর সেটা হলে চেরনোবিল মনে হবে একেবারেই নিরপরাধ শিশু। তাই পশ্চিমা দেশগুলোর উচিৎ হবে ন্যাশনালিস্টদের আস্কারা দেবার আগে দশ বার ভেবে দেখা। তালেবান, আল কায়েদা, ইসলামিক স্টেট বার বার তাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে, এরা যে করবে না তার কোন গ্যারান্টি আছে কি? পারমাণবিক আর যাই হোক পরম মানবিক নয়।

দুবনা, ০৪ মার্চ ২০২২ 
 
 

 

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

প্রায়োরিটি

ছোট্ট সমস্যা