চৌকিদারের ভাইপোঁ
২০০৬ সালে আমরা কয়েকজন মিলে ফটো ক্লাব ফোকাস তৈরি করি। শুরু থেকে যারা ছিলাম, আজ তাদের দুজন মাত্র এর সাথে জড়িত আছি - ভাসিলি আর আমি। এটা আমাদের অ্যামেচার ফটোগ্রাফারদের ক্লাব। অ্যামেচার - মানে খারাপ ফটোগ্রাফার নয়, আমরা ছবি তুলি মনের সুখে, এ থেকে জীবিকা অর্জন করি না। অনেক ছেলেমেয়ে আমাদের এখানে ছবি তোলা শিখেছে, বর্তমানে সেটাকে পেশা হিসেবে নিয়ে ভাল আছে। তবে কথাটা সেখানে নয়।
একবার এক মেয়ে এলো আমাদের ক্লাবে। আমরা সাধারণত বসে গল্প গুজব করি, চা খাই, কেউ ছবি দেখাতে চাইলে সেটা দেখি, নিজেদের মতামত জানাই। খারাপ হলে খারাপ, ভাল হলে ভাল বলি। এক কথায় প্রত্যেকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলি কীভাবে ছবিটা আরও ভাল করা যেত। ভাল ছবির প্রশংসা করি, তেমন ভাল না হলে চেষ্টা করি বলার কীভাবে আরও ভাল করা যেত। কোন জোর জবরদস্তি নেই, শুধু মতামত জানান। ফটোগ্রাফার নিজেই ঠিক করে সে সে সমস্ত রিকমেন্ডেশন গ্রহণ করবে কি না। যাহোক, সেই মেয়ে এসে ছবি দেখালো। সেই প্রথম মনে হয় আমাদের কারোই কোন ছবি পছন্দ হল না। কিন্তু সে সেগুলো না শুনে তার বিভিন্ন সার্টিফিকেট দেখাতে শুরু করল, সে কোথায় কোথায় ছবি তোলা শিখেছে সেসব জানালো। যাহোক, আমাদের সাথে ও বেশিদিন চলতে পারেনি যদিও এখনও ক্লাবে এলে আমরা ধৈর্য সহকারে ওর ছবি দেখি।
অনেক সময় কাউকে কোন কাজের সমালোচনা করলে সে কাজটাকে সঠিক (সঠিক ব্যাপারটাও আপেক্ষিক, কিন্তু আমি যদি ক্লায়েন্ট হই তাহলে তাকে আমার মতামতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে) করার চেষ্টা না করে তার শিক্ষাগত যোগ্যতা, ইউনিভার্সিটি এসব দেখায়। এটা আসলে তার সবলতার চেয়ে দুর্বলতাই বেশি করে প্রকাশ করে। কারণ শিক্ষাগত যোগ্যতা, সার্টিফিকেট এসব দরকার চাকরি পাওয়ার আগে, একবার চাকরিতে ঢুকলে প্রয়োজন ঠিক মত কাজ করা, কাজ দিয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করা। অন্যের সার্টিফিকেট আমাকে ভাত দেবে না।
কিছু কিছু লোক নিজের নাম বলার আগে জানায় যে তার চাচা চৌকিদার অথবা মামা মিনিস্টার। আবার অনেকে নিজের যোগ্যতার কথা জানায় তার বর্তমান অবস্থান দিয়ে, ভাবখানা এই যে পশ্চিমা বিশ্বে বাস করলেই সে মুক্তমনা, গণতান্ত্রিক ইত্যাদি ইত্যাদি গুণের অধিকারী হয়ে যায়। আর যখনই কেউ এভাবে ভাবে তখনই আমার মনে হয় সামথিং ইস রঙ উইথ দিস গাই। কারণ একমাত্র অন্ধবিশ্বাসই মানুষকে এভাবে ভাবতে বা বলতে শেখায়।
অনেক আগে, যখন অটম্যাটিক্যালি অনেক ইছু করা যেত না, তখন পোস্ট স্ক্রিপ্ট ফাইলের ভেতরে ঢুকে হাতে অনেক কিছু এডিট করতাম, তারও আগে হাতে লিখে রিপোর্ট রেডি করতাম, ম্যানুয়ালি একাধিক ছবি জোড়া দিয়ে প্যানারমা তৈরি করতাম। অন্য ধরণের ক্রিয়েটিভিটি ছিল। এখন সব এমনিতেই করা যায়। অন্য মানুষের ক্রিয়েটিভিটির কাছে নিজের সব কিছু চাপা পড়ে যায়, আমরা অলস হয়ে উঠি, এমনকি নিজেকে প্রশ্ন করার শক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলি। শুধু প্রাণপণে নিজের বর্তমান অবস্থাটা জায়েজ করার চেষ্টা করি।
ছোটবেলায় বাড়িতে পূজা হত, ঠাকুর উদ্দেশ্যে যে খাবার দেওয়া হত সেটাকে বলা হত ভোগ। ঠাকুর এত অলস ছিল যে মুখে তুলে দিলেও খাবারটা পর্যন্ত খেত না। বর্তমানের ভোগবাদী সমাজও আমাদের অলস করছে। আর মস্তিষ্ক যখন অলস সেখানে যে শয়তান বাসা বাঁধবে তাতে অবাক হবার কী আছে?
Comments
Post a Comment