গণতন্ত্র: ঘরে বাইরে

আজকাল শুধুমাত্র অলসরাই গণতন্ত্রের কথা বলে না। আর হয়তো ইসলামিক স্টেট। গণতন্ত্রের অনেক অপূর্ণতা থাকার পরও  এটাই হয়তো এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে ভালো সামাজিক ব্যবস্থা। কিন্তু সমস্যাটা হলো তত্বের দিক থেকে গণতন্ত্র  সমতা, সমান অধিকারের কথা বললেও প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঘটে একেবারেই উল্টো। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় - আমেরিকার নাগরিকদের সে দেশের সরকার যেমনভাবে গণতাত্রিক অধিকার দেয় - অন্য প্রায় সব দেশের নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার মার্কিন প্রশাসন একই রকম ভাবে ক্ষুন্ন করে। আর তা তারা করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ছদ্মবেশে। আবার তার উল্টো দিকে অনেক মৌলবাদী সংগঠন গণতন্ত্রের সুবিধা নিয়ে ক্ষমতায় এসে সেই গণতন্ত্রের শ্বাসরোধ করে সবার আগে।

কয়েকদিন আগে রাশিয়ার আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী ঠিক করার জন্য ইউনাইটেড রাশিয়া প্রিলিমিনারী  নির্বাচন করলো আমেরিকান স্টাইলে। ওতে শুধুমাত্র পার্টিরই  নয়, পার্টির বাইরের লোকেরাও অংশ নিয়েছে - ভোট দিতে আর ভোট পেতে। ফলে পার্টির সদস্য নয় এমন অনেকেই ইউনাইটেড রাশিয়ার পক্ষ থেকে নির্বাচনে যাচ্ছে। এটাকে এমনকি প্রেসিডেন্ট পুতিনের সমালোচকরাও এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ বলে আখ্যায়িত করেছে। কথাটা বলা এই জন্যেই, রাশিয়া দীর্ঘ দিন ট্রাডিশনাল গণতন্ত্রের  বাইরে থাকলেও, পুতিনকে অনেকে একনায়ক আখ্যা দিলেও তারা চাইছে প্রশাসনে বা নির্বাচন পদ্ধতিতে ম্যাক্সিমাম মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে। এটা নিঃসন্দেহে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে চেষ্টার পরেও জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক তেমন পার্টি গড়ে ওঠেনি - অনেকটাই হয়েছে প্রশাসনিক শক্তি ব্যবহার করে। এই প্রথম তারা চাইছে প্রশাসন নয়, মানুষের ভোটেই নির্বাচিত হতে।

এবার আসি বাংলাদেশের কথায়। বাংলাদেশ সাংবিধানিক ভাবে গণতান্ত্রিক দেশ। ১৯৯১ এ  শেষ স্বৈরশাসকের পতনের পর থেকে মোটামুটি ভোটের মধ্য দিয়েই সরকার নির্বাচিত হচ্ছে। তবে দলগুলো নিজেরা কতটুকু গণতান্ত্রিক বা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সে নিয়ে প্রশ্ন আছে। সবসময়ই সরকারি দল (যে নামই  তার হোকনা কেন) নিজেদের গণতন্ত্রের দিশারী বলে গলা ফাটায়, আর বিরোধী দল দেশে গণতন্ত্র নেই বলে বোমা ফাটায়। জনগণের রায় তাদের কাছে মোক্ষ নয়, রায়টা তার পক্ষে গেলো কিনা - সেটাই বিবেচ্য। তবে এই দলগুলো যে শুধু ক্ষমতার প্রশ্নেই গণতন্ত্রী/অগণতন্ত্রী তা কিন্তু নয়। দলের ভেতরেও এরা গণতন্ত্রহীনতায় ভোগে - আর এটা শুধু দলের নেতৃত্ব গণতন্ত্র দেয়না বলে নয়, একদিকে কর্মীরা দলের ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে নেতৃত্বের হাতে সমস্ত ক্ষমতা নিঃশর্তে সপে দেয় আর অন্যদিকে স্থানীয় নীতি-কৌশল ও নেতৃত্বের প্রশ্নে নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হয়ে দল তো বটেই, দেশের আর জনগণের বারোটা বাজিয়ে দেয়। তাই আমার অন্ততঃ  ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় বাংলাদেশের সমস্যার একটা বিরাট বীজ নিহিত এর মূল দলগুলোর গণতন্ত্রহীনতার মধ্যে। যতক্ষণ না দেশের রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে মূল দলগুলো নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু না করছে, ততদিন বাংলাদেশ অন্তহীন ক্রান্তিলগ্নের মাঝ দিয়েই চলবে। কেননা না, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অরাজকতা সমাজে অরাজকতার জন্ম দেয় আর মৌলবাদীরা এটাকে পুঁজি করে দল ভারী করে। আবার দলীয় গণতন্ত্র যে তাদেরকে অন্যের গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তুলবে, দেশকে সংকট মুক্ত করবে, তারও  গ্যারান্টি নেই। আমেরিকার উগ্র গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালারা অন্তত সেই ভয়টাও মনে জাগায়। তার পরেও শুরু করতে হবে নিজেদের থেকেই - দেশকে গণতান্ত্রিক করতে হলে আগে নিজেকে, দলকে গণতান্ত্রিক হতে হবে।

পুনশ্চঃ জাতীয় কাউন্সিল বার বার পেছানো যায়, তাতে আর যাই হোক, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়  এটা সহায়ক হয় না। তবুও আশা করবো আওয়ামী লীগের ২০ তম জাতীয় কাউন্সিল দলের ভেতরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় এক মাইল ফলক হিসেবে কাজ করবে।



দুবনা, ১২ জুলাই ২০১৬ 

Comments

Popular posts from this blog

২৪ জুনের দিনলিপি

ছোট্ট সমস্যা

প্রায়োরিটি